Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ১.৮

    আট

    ১৭৫৭ থেকে ১৯৩০। পুরো দুটো শতাব্দীও নয়। ইতিহাসের অনন্ত প্রবাহে একটি ছোট্ট বিলীয়মান বুদ্বুদ। কিন্তু কী প্রচণ্ড তার আলোড়ন! কী সুদূরপ্রসারী গভীর আবর্ত সে রচনা করে গেল এই সুপ্রাচীন জাতির বহুমুখী জীবনধারায়!

    এই হতভাগ্য দেশের বুকের উপর বিদেশী বিজেতার পদাঘাত তো এই নতুন নয়। ঠিক এরই আগে সাতশ বছর ধরে আস্ফালন করে গেছে পাঠান, মোগল, তুর্কী—কত সুলতান মামুদ, চেঙ্গিস খাঁ, আলাউদ্দিন খিলজি, ঔরংজেবের দল। রস্তস্রোতে ভেসে গেছে নদী, গিরি, জনপদ। কলুষিত হয়েছে দেবমন্দির; লাঞ্ছিত হয়েছে নারী। কিন্তু ভারতের অন্তরাত্মা ধরা দেয়নি। সেই সাতশ বছরের ইতিহাস যেন একটা কালরাত্রির দুঃস্বপ্ন; যেন জলস্রোতের উপর চলন্ত মেঘের ছায়া!

    কিন্তু ইংরেজ শুধু দিগ্বিজয়ী নয়। রাজ্য জয় আর ধন লুণ্ঠন করেই সে ক্ষান্ত হল না। সে কেড়ে নিতে চাইল মনুষ্যত্ব। তার বিষবৃক্ষের বিষাক্ত শিকড় ধীরে ধীরে প্রবেশ করল এই উর্বর দেশের অস্থি-মজ্জায়। বিষক্রিয়ায় মুহ্যমান হয়ে গেল একটা সুবিশাল জাতির সমস্ত চেতনা। মোহগত মূঢ়ের মত সে তার সমস্ত ধ্যান-ধারণা, তার কর্মৈষণা, তার প্রতিভা নিয়োজিত করল বিদেশী সাম্রাজ্যের পরিচর্যায়।

    এমনি করে কাটল বছরের পর বছর। তারপর একদিন শতাব্দীর মোহনিদ্রা থেকে জেগে উঠল একদল মুষ্টিমেয় লোক। সভয়ে দেখল তারা, বিরাটকায় শ্বেতাঙ্গ অক্টোপাস লোহার বাঁধনে জড়িয়ে ধরেছে সমস্ত জাতির কণ্ঠ। প্রাণ যায় যায়। মুক্তি-কামনায় প্রথমে- শুরু হল আবেদন-নিবেদন। তারপর তর্জন-গর্জন। কিন্তু বন্ধন শিথিল হল না। যন্ত্রণার তাড়নায় এখানে-সেখানে দু’চারটা অর্বাচীনের দল ছটফট করে উঠল। দেখা দিল ১৮৫৭, তারপর ১৯০৫। কিন্তু সাম্রাজ্যের স্টীমরোলার শুঁড়িয়ে দিয়ে গেল যেখানে যত ছিল উদ্ধত শির।

    কিছুদিন গেল। ১৯২১ সালের বসন্ত কাল। সহসা একদিন ভারতের পশ্চিম প্রান্ত থেকে বেরিয়ে এল এক অর্ধনগ্ন ফকির,—ক্ষীণ দেহ, পরনে কটিবাস, মুখে রহস্যময় হাসি। ব্রিটিশ-সিংহকে আহ্বান করে বলল, হে পশুরাজ, আমরা নিরস্ত্র। কিন্তু তোমার দংষ্ট্রাঘাতকে ভয় করি না। তোমার ঐ বিজয়রথের চাকায় এতদিন আমরাই তেল যুগিয়ে এসেছি। আজ থেকে আর যোগাবো না। আমার দেশের বুকের পাঁজর গুঁড়িয়ে দিয়ে আমরাই তো তাকে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছি। সে দড়িও ছেড়ে দিলাম। তোমার সঙ্গে আমার বিরোধ নেই; তোমার সঙ্গে আমার অসহযোগ।

    বৈরাগীর ক্ষীণ কণ্ঠে এত শক্তি ছিল কে জানত? আসমুদ্রহিমাচল কেঁপে উঠল। দেড়শ বছরের শাসন-প্রতিভা দিয়ে গড়ে তোলা যে কীর্তিস্তম্ভ, তার মূলে দেখা দিল ফাটলের রেখা। কিন্তু সে শুধু ক্ষণিকের তরে। ঝড় থেমে গেল, পড়ে রইল শুধু তার অবসাদ। রাজশক্তির জয়রথ চলল আবার ঘর্ঘর শব্দে চারদিক মুখরিত করে। যারা দড়ি ছেড়েছিল, আবার এসে এসে ধরল। দু-চার জন শুধু ছিটকে পড়ে রইল এখানে ওখানে, তলিয়ে গেল বিস্মৃতির অতলে।

    দশটি বছর না যেতেই আবার কোথা থেকে ফিরে এলো সেই শীর্ণকায় ফকির। দেহ ক্ষীণতর, কিন্তু ললাটে বজ্রের দৃঢ়তা। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হল, হে যন্ত্ররাজ বিভূতি, আমাদের জীবনের স্বচ্ছন্দ ধারা রুদ্ধ করে গড়ে তুলেছ যে পর্বতপ্রমাণ যন্ত্র তার বাধানিষেধের জঞ্জাল আমরা মানবো না।

    সেই কণ্ঠ দিকে দিকে প্রতিধ্বনিত হল—আমরা মানবো না। বেরিয়ে এল হাজার হাজার নিপীড়িতের দল, জীবনের নানা ক্ষেত্র, সমাজের নানা স্তর থেকে। সবারই কণ্ঠে এক সুর—আমরা মানবো না।

    ব্রিটিশ-সিংহের দণ্ডদীপ্ত ললাটে জেগে উঠল চিন্তা-রেখা। এ কী করে সম্ভব হল? যারা ছিল চিরকালের most obedient servant তাদের মুখে disobedience-এর ধ্বনি! কিন্তু ভাবনার সময় নেই। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল সাম্রাজ্য-শক্তি। আমরা ইংরেজ। আমাদের রাজ্যে সূর্যাস্ত নেই। চালাও রিপ্রেশন। যন্ত্ররাজ বিভূতি চালিয়ে দিল তার পেষণ-যন্ত্র। যারা পিষে মরল, তারা তো গেলই। যাঁরা বেঁচে রইল, বাঁধা পড়ল দেশব্যাপী লোহার খাঁচায়।

    তারই একটা ক্ষুদ্র খাঁচা আগলে বসে আছি আমরা ক’টি যন্ত্ররাজের অনুচর, এই দুর্ভেদ্য পাহাড়-ঘেরা হিমালয়ের জঙ্গলে। কিন্তু পাথরের বর্ম ভেদ করে বহির্জগতের তুমুল কোলাহল এখনো এখানে এসে পৌঁছায়নি। ইংরেজের স্নেহপুষ্ট, কৃপাভাজন এই পাহাড়ী জাত। চা, সিগারেট আর মদ—এই তিনদফা মহানেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে আছে। দু-একটা যদি বা মাথা তুলেছিল চাকরি বা খেতাবের মর্ফিয়া খেয়ে, আবার অচেতন হয়ে গেছে।

    সুতরাং বেশ আছি আমরা। আমাদের এই খাঁচায় তাদেরই বাসা, যারা খায় দায়, শেখানো কায়দায় হাত-পা নাড়ে এবং নিরুপদ্রবে নিদ্রা যায়। অনাবশ্যক ডানার ঝাপটায় মনিবের শান্তিভঙ্গ করে না। ভগবানকে ডাকছি, হে ঠাকুর, আমাদের এই মহাশাস্তি অটুট থাক। চোর, ডাকাত আর গাঁটকাটা নিয়ে মহাসুখে কেটে যাক দিনগুলো। কিন্তু আমার এই প্রার্থনায় মোবারক আলির যোগ নেই। হাতটা তার নিসপিস করছে। দু-চারটা বেয়াড়া স্বদেশী সায়েস্তা করবার সুযোগ যদি না জুটল, তবে বৃথাই তার এ জেলর-জন্ম।

    শেষ পর্যন্ত মোবারক আলির মনোবাঞ্ছাই পূর্ণ হল। কলকাতার কোন জেল থেকে হঠাৎ একদিন পাঠিয়ে দিল গুটিকয়েক নামজাদা “স্বদেশী” আর “স্বদেশিনী”। সেখানকার বাতাস নাকি এমন গরম করে তুলেছিলেন এঁরা, যে এই শীতল নির্বাসনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের গত্যন্তর ছিল না।

    স্বদেশিনী যাঁরা এলেন তাঁর মধ্যে একজন ছিলেন শ্রীমতী তাপসী দাস। আমদানী কেতাবে তাঁর নামধাম যেখানে লেখা হল, জেলর সাহেব ‘দাস’ কেটে ‘দাসী’ বসিয়ে দিলেন। জেলে যারা নবাগত, হাসপাতালের রুগীদের মত তারাও একখানা করে টিকেট পায়, যার উপরের দিকটায় থাকে নাম আর অন্যান্য বিবরণ এবং সেগুলো সংগ্রহ করা হয় আমদানী কেতাব থেকে। শ্রীমতী দাসের হাতে যথাসময়ে এই ‘দাসী’ মার্কা টিকেট গিয়ে পৌঁছল। সঙ্গে সঙ্গে জেনানা ফাটকে আগ্নেয়গিরির আবির্ভাব। পরদিন স-পরিষদ সুপারের দর্শন মাত্রেই শুরু হল উদ্‌গিরণ। যে বস্তু উৎক্ষিপ্ত হল, তার মধ্যে যত না আগুন, তার অনেক বেশী কদম। আমরা নিঃশব্দে মাথা পেতে নিলাম। এক ফাঁকে মিস্টার রয় মোবারক আলির দিকে চেয়ে জানতে চাইলেন, ব্যাপারটা কি?

    জেলর সাহেব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ব্যাপার কিছুই নয়, স্যার। একখানা ওয়ারেন্টে কিছু গ্রামারের ভুল ছিল। কারে করে দিয়েছি।

    —গ্রামারের ভুল কি রকম?

    জেলর সাহেব আমার দিকে একটা বজ্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, বি. এ., এম. এ., পাশ না করলেও ছেলেবেলায় বাঙলা ব্যাকরণটা তো ভাল করেই পড়েছিলাম। যতদূর জানি, ‘দাস’ শব্দটা পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গে হয় দাসী”। “স্বদেশী” করতে গেলে লিঙ্গ-প্রকরণ বাতিল হয়ে যায়, একথা তো জানা ছিল না।

    সুপার-সাহেব অন্যদিকে মুখ ফেরালেন। বন্দিনীদের মধ্যে দু-একজন যাঁরা একটু বয়স্কা, নিঃশব্দে চলে গেলেন। মিস্ দাস দিলেন হাঙ্গার-স্ট্রাইকের নোটিশ।

    শেষ পর্যন্ত সরকার পক্ষেরই পরাজয় হল। অত বড় একজন অভিজ্ঞ জেলরের ব্যাকরণ-নিষ্ঠার মর্যাদা রক্ষা হল না। শ্রীমতী আবার ‘দাসী’ থেকে ‘দাস’-এ রূপান্তর লাভ করলেন।

    রেলযাত্রীর মত জেলযাত্রীদেরও তিনটি শ্রেণী—প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়। কিন্তু রেলের কামরা যেমন যাত্রী নিজেই বেছে নেয়, জেলের কামরা স্থির করে দেন দণ্ডদাতা বিচারক। “স্বদেশী” মহিলাদের ছিল প্রথম শ্রেণীর টিকেট। কারণ—কতকটা সামাজিক, কতকটা রাজনৈতিক এবং বেশীর ভাগ বোধ হয় রোমান্টিক। কেননা, টিকেটদাতা হাকিম পুরুষজাতীয়। এদের শ্রেণীটাই শুধু প্রথম নয়, দণ্ডটাও ছিল অশ্রম। অতএব ভোজ্য এবং ভোগ্যবস্তুর অকৃপণ সমাবেশ। কিন্তু উপকরণই তো ভোগের একমাত্র উপাদান নয়। তাকে উপভোগ্য করে তুলতে হলে চাই মানুষের হাত। সে মানুষের অভাব নেই জেলখানায়। মুষ্টিমেয় প্রথম শ্রেণীর জন্যে গতর খাটাবে অপরিমেয় তৃতীয় শ্রেণী—এই ধারাই তো চলে আসছে সমাজে, রাষ্ট্রে, সেই অ্যারিস্টটলের “সিটি স্টেট” থেকে আরম্ভ করে অতি আধুনিক “পিউপিল্স ডেমোক্রেসি” পর্যন্ত। জেলতন্ত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? তাই প্রথম শ্রেণীর কয়েদীর পরিচর্যা করে ধন্য হয় তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী। ‘সার্ভেন্ট’ বললে পাছে এরা বা এদের শুভানুধ্যায়ীরা কুপিত হন, তাই কেতাবে এদের নাম অ্যাটেন্‌ড্যানট। জেল পরিভাষায় বলে ‘ফালতু’।

    একটি অল্পবয়সী পাহাড়ী মেয়ে “স্বদেশিনীদের” ফালতুর কাজ করত। হঠাৎ একদিন শ্রীমতী ব্যানার্জি এবং শ্রীমতী লাহা জিদ ধরলেন, ও মেয়ে চলবে না।

    বললাম, কেন?

    —কারণ দেখানোটা আমরা প্রয়োজন মনে করি না।

    আমি সবিনয়ে বললাম, সে তো অবশ্যই। আপনারা বলছেন, সেই যথেষ্ট। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম, ও কি কাজকর্ম ঠিকমত করছে না?

    মিস্ লাহা একটা দৃপ্তভঙ্গী করে বললেন, আমরা যা বলেছি, তার বেশী আর কিছু বলতে চাইনে।

    এর পরে আর কথা নেই। পরিচারিকার পরিবর্তন হল।

    পরদিন বিকালবেলা স্বদেশী ওয়ার্ডের চিঠিগুলো ডাকস্থ হবার আগে পড়ে দেখছিলাম, জেলের ভাষায় যাকে বলে সেন্সর। তখন চাকরি কাঁচা, মনটাও পাকেনি। এই পরের চিঠি-পড়া ব্যাপারটাকে কেমন যেন অশোভন এবং অশিষ্ট বলে মনে হত। “স্বদেশী” মহিলাদের যেদিন থেকে আবির্ভাব হল এবং তাদের বাঁকা ছাঁদের দীর্ঘ পত্র হাতে আসতে লাগল, তখন বুঝলাম, সঙ্কোচটা আমার তরফে যতই হোক, ও তরফে তার একান্ত অভাব। সুতরাং আড়ষ্ট ভাব কাটিয়ে উঠতে বেশীদিন লাগেনি।

    মিসেস চ্যাটার্জির লেখা মোটা চিঠিখানা খুললাম। তাঁর কোনো বান্ধবীকে লেখা ঠাসবুনানী পাঁচ পাতা। কৌতূহল হল প্রথমেই ঐ পাহাড়ী মেয়েটার উল্লেখ দেখে মুখবন্ধের পর মিসেস চ্যাটার্জি লিখছেন, কাল আমরা একটা মস্ত বড় কাজ করে ফেলেছি। একটি নেপালী মেয়ে-কয়েদী আমাদের কাজ-টাজগুলো করে দিত। মেয়েটি ভারী লক্ষ্মী, শান্ত এবং বিশ্বাসী। কাজেকর্মেও চটপটে। হঠাৎ আমাদের কানে এল, ও জেল খাটছে কোনো সুস্পষ্ট কারণে স্বামীকে বিষ খাইয়ে মেরেছিল বলে। এ হেন স্ত্রীলোকের ঘৃণ্য সান্নিধ্য আমাদের মত সুসভ্যা এবং সুনীতিপরায়ণা মহিলাদের অবশ্য বর্জনীয়। অতএব আমরা জিদ ধরলাম, ওকে তাড়াতে হবে। কর্তৃপক্ষ প্রথমে রাজী না হলেও পরে বাধ্য হলেন। তাকে যখন চলে যেতে বলা হল তার নিজের ওয়ার্ডে, মেয়েটার চোখদুটো ছলছল করছিল। কিন্তু সে-সব তুচ্ছ সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দিলে আমাদের মর্যাদা থাকে না। এবার যে এসেছে, সে করেছিল কাপড় চুরি। অতএব আমরা নিরাপদ।

    সমস্ত রাত ধরে আমি ঐ মেয়েটার কথা ভেবেছি। স্বামীকে ও বিষ খাইয়ে মেরেছে। আর, আমি কি করেছি? আমার অন্তর, আমার কণ্ঠ, আমার প্রতিদিনের আচরণ থেকে যে বিষ ঝরে পড়েছে, সে কী আমার স্বামী এবং তার পরিজনদের জর্জর করে তোলেনি? একদিনে মেরে ফেলাটাই মারা, আর তিলে তিলে পলে পলে মারাটা কি মারা নয়? মেয়েটা কি আমার চেয়েও বেশী অপরাধী?

    আমি একা নই। আমার মত আধুনিকার দল, যারা আজ ঘর ছেড়েছে, কিংবা ঘরে থেকেও ঘরের বাঁধন স্বীকার করছে না, সবারই ঐ এক ইতিহাস। আমরা সব বিষকন্যার দল। স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা, মর্যাদা আর নারী-প্রগতির ফণা তুলে আমরা আমাদের ঘর- সংসার, স্বামী-পুত্র-কন্যা, শাশুড়ী-ননদ, দেবর-ভাসুর সবারই দেহে নির্বিচারে বিষ ঢেলে বেড়াচ্ছি। তাই, সংসারও আমাদের কাছে বিষময়। ঘর আমাদের ধরে রাখতে পারলো না।

    আমার মাকে মনে পড়ছে। বাবা ছিলেন সামান্য কেরানী; মানুষ হিসেবেও অতি সামান্য। অফিস থেকে যখন ফিরতেন, তার আগে থেকেই মা আমাদের সাবধান করে দিতেন, যেন গোলমাল চেঁচামেচি না করি। বারান্দায় এসে দাঁড়ালে মা নিজে হাতে তাঁর জুতোর ফিতে খুলে দিতেন। জামাটা চাদরটা হাত থেকে নিয়ে বাড়ির কাপড় এনে দিতেন। তারপরে সযত্নে ঠাঁই করে নিকানো মেঝে আবার নিজে হাতে নিকিয়ে কত পরিপাটি করে দুখানা রুটি আর একটু তরকারি তাঁর সামনে ধরে দিয়ে পাখা নিয়ে বসতেন। আমাদের সেখানে আসবার হুকুম ছিল না। তবু যদি বাবা আমাদের জন্যে পাতে কিছু রেখে দিতে চাইতেন, মা ভয়ানক রাগ করতেন। বলতেন, ওর থেকে আবার ফেলে রাখছ? না, সে আমি কিছুতেই শুনবো না। এত খাটুনির পর এইটুকু না খেলে শরীর ঢেঁকে?

    বড় হয়ে যখন নারী-প্রগতির আস্বাদ পেলাম, মার এই দাসীবৃত্তি দেখে মনে মনে লজ্জিত হয়েছি। কিন্তু আমার চেয়ে কে বেশী জানে, মা দাসী ছিলেন না? মর্যাদা আর অধিকার নিয়ে বাবার সঙ্গে কোনোদিন লড়াই করেননি। তবু ছোট্ট সংসারের তিনিই ছিলেন সর্বময়ী কর্ত্রী।

    অভাবের সংসার। তার উপর বাবা ছিলেন রুক্ষ মেজাজের লোক। মাঝে মাঝে তাঁর মুখ থেকে অনেক রূঢ় কথা শুনতে হত মার্কে। কিন্তু একটারও জবাব দেননি কোনোদিন। হেসে বলতেন, পুরুষ মানুষকে কতো সইতে হয়; আমরা একটা শক্ত কথাও সইতে পারবো না? কখনো বলতেন, রাগ হলে দুটো কথা আমাকে শোনাবেন, না ঐ পাড়ার লোককে শোনাতে যাবেন?

    সেই মায়ের মেয়ে আমি। আমার এবং আমার মত আর দুজন আধুনিকার স্বামী যখন কর্মক্লান্ত দেহে অফিস থেকে ফেরেন, আমরা থাকি ড্রইংরুমে, শয়নকক্ষে কিংবা বাইরে কোথাও। হঠাৎ সেলাই কিংবা বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সামনে এসে দাঁড়ালে পাছে খাটো হতে হয়, তাই আসি না। দেখাতে চাই, আমাদেরও আছে একটা স্বতন্ত্র জগৎ। তোমাদের চেয়ে আমরা কিছুমাত্র ছোট নই। কিন্তু পুরুষ চিরকালই পুরুষ। আধুনিকার স্বামী হলেও সে সেই সনাতন স্বামী। স্ত্রীর কাছে সে চায় সেবা, যত্ন, আর তার চেয়েও বেশী, আনুগত্য। যখন বঞ্চিত হয়, তার সমস্ত অন্তর বিষিয়ে যায়। সভ্যতার মোলায়েম আবরণ ভেদ করে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে তার ঝাঁজ। কিন্তু আমরা সই না কিছুই, মেনে নিই না কাউকে। রুখে দাঁড়াই মর্যাদার সঙ্গীন উদ্যত করে। তখন চলতে থাকে আঘাত আর প্রত্যাঘাত, বক্রোক্তি ব্যঙ্গোক্তি, আর কটূক্তির কবির লড়াই। সভ্য নরনারী যে ছুরি চালায়, তার অবস্থান হাতে নয়, জিহ্বাগ্রে। কিন্তু তীক্ষ্ণতায় যে-কোন কসাই-এর ছুরিকেও সে হার মানায়।

    আর এক ধরনের দম্পতি আছে, আমাদের এই অতি-আধুনিক ঈঙ্গ-বঙ্গ সমাজে, যারা ছুরি চালায় না। কিন্তু হানাহানি নেই বলেই যে তাদের প্রাণে ‘প্রেম করে কানাকানি’, সে ভুল করে বোসো না। সেখানে স্বামী ব্যক্তিটির একমাত্র আশ্রয়—অভিনয়। তার মুখে বিলিতি মুখোশ, রসনায় সস্তাদরের বিলিতি মধুর প্রলেপ। “দাঁতের আগে মিষ্টি হাসি টানি” ভদ্রতার বাণী দিয়ে তিনি ঢেকে রাখেন তাঁর পুরুষ-হৃদয়ের ক্রোধানল। যে স্ত্রীর কাছে তাঁর দৈনিক বরাদ্দ অবহেলা, অনাদর আর ঔদাসীন্য, যার কঠিন মুখের দিকে চাইলে মাথায় খুন চেপে যায়, তাকে তিনি কাঁধে হাত দিয়ে আদর করেন, উপহার দেন নিত্যি নতুন জুয়েলারি। তার রূপের জৌলুস, কিংবা প্রসাধনের পালিস সম্বন্ধে দুটো গিল্টি-করা স্তুতিবাদ উচ্চারণ করে ক্লাবে গিয়ে হাঁফ ছাড়েন। আমাদের ভ্যানিটি-বোধ হয়তো তৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু অন্তর? অন্তর থেকে যায় উপবাসী।

    তোমাদের চোখে আজ আমি মস্ত বড় দেশনেত্রী। আমার বক্তৃতায় আগুন ছোটে। করতালির দাপটে কেঁপে ওঠে দিমণ্ডল। কিন্তু, সভার শেষে ঘরে ফিরে আমার ভক্তের দল যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, সেটা কি জানো? সেটা হচ্ছে আমার রূপ, আমার দাঁড়াবার, চলবার, কিংবা বক্তৃতার ভঙ্গী। আমার পারিবারিক ইতিহাস যাদের জানা আছে, তারা যে ভাষা প্রয়োগ করে তোমাকে বলবো না। কেননা তুমি আমার বাল্যবন্ধু হলেও গৃহস্থবধূ।

    এই আমার মর্যাদা! —যার লোভে ঘরের বাঁধন ছিঁড়ে দেশের কাজে নেমেছিলাম।

    আজ এই গভীর রাত্রে এই নগাধিরাজ হিমালয়ের পদপ্রান্তে বসে তোমার সেদিনকার কথাটাই অকপটে স্বীকার করছি। নারীর যদি কোনো গৌরব থাকে, সে তার প্রেম। সে অমৃতলোক থেকে বরণ করেছি স্বেচ্ছানির্বাসন। যে-তরুশাখায় নীড় বেঁধেছিলাম, নিজ- হাতে তারই মূলে করেছি নির্মম আঘাত।…

    এমনিধারা আরো অনেকখানি আবেগ উচ্ছ্বাস পার হয়ে শেষটায় এসে পৌঁছানো গেল দীর্ঘ চিঠির উপসংহারে। মিসেস চ্যাটার্জি বলছেন :

    স্বামীগতপ্রাণা বলে একদিন তোমাকে কত না অবজ্ঞার চোখে দেখেছি। আমার সে ধৃষ্টতা আজ তুমি ক্ষমা করো, মিনতি। তোমার একটি মাত্র মেয়ে। আশীর্বাদ করি, সে যেন তোমার মত হয়। তার এই দেশবন্দিতা মাসীমার মত তাকে যেন দেশের কাজের নেশায় না পায়। বড় হলে নিজেরা দেখেশুনে ভাল ঘর বর দেখে মেয়েকে পাত্রস্থ করো। নিজের ঘরে গিয়ে নিজেকে যেন সে নির্বিচারে বিলিয়ে দিতে পারে তারই হাতে, যার সঙ্গে তার জীবন একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেল।

    একজন অতি-আধুনিকা, অত্যুচ্চ রাজনৈতিক খ্যাতিসম্পন্না বিদুষী মহিলার মুখে এহেন সেকেলে তত্ত্ব তোমার কানে আজ অদ্ভুত শোনাবে জানি। তবু বলবো, নারী-জীবনে সুখ যদি কোথাও থাকে, এই তার একমাত্র রাজপথ। এ পথ থেকে যে সরে দাঁড়াল, আশ্ৰয় করল উদ্ধত শির আর উদ্যত তর্জনী, সে আর যাই পেয়ে থাক, পাবে না সুখ—পাবে না সম্মান।…

    চিঠিটা শেষ করে মনে হল স্বপ্ন দেখছিলাম। এ কোন্ মিসেস্ চ্যাটার্জি? ইনিই কি সেই নীহারিকা চ্যাটার্জি, যাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতার প্রচণ্ড ঝটিকায় ভেঙে গেছে কত সাজানো সংসার? পুঁথির বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে তরুণীর দল, ঘরকন্নার জোয়াল ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে এসেছে বহু-সন্তানবতী প্রৌঢ়া, খদ্দরের বোঝা কাঁধে নিয়ে ফেরি করেছে রাস্তায় রাস্তায়, পিকেটিং করেছে মদগাঁজার দোকানে, তারপর ভিড় করেছে জেলের দরজায়? আজ তার কণ্ঠে এ কী সুর? কে জানে কোন্‌টা তাঁর আসল রূপ?

    তারপর বাইশ বছর চলে গেছে। নারী-প্রগতির আলোক আজ পৌঁছে গেছে সাধারণ বাঙালীর ঘরে ঘরে। নারীকণ্ঠের সোরগোলে আকাশ বাতাস মুখরিত। কিন্তু তারা যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে কি? পেয়েছে সুখ? পেয়েছে সম্মান? না, আজও তারা নীহারিকা চ্যাটার্জির মত বিনিদ্র রাত্রির নিভৃত অন্ধকারে দুঃখের কাহিনী লিখে যাচ্ছে, পাতার পর পাতা কোনো পতিগতপ্রাণা সেকেলে বান্ধবীর উদ্দেশে?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }