ইতি নির্ভয়পুর – ১
১
নির্ভয়রপুর তার নিজের সুনাম বজায় রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি কোনওদিন। নামে নির্ভয়পুর হলেও এখানে ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। সন্ধে হলেই সামনের জঙ্গল থেকে হাতি বেরোয়। সেই হাতির দল এই ছোটো ছোটো কাঠের ঘরগুলোকে খেলনা ঘরের মতো নিমেষে সমতলভূমি বানিয়ে দিয়ে আবারও ফিরে যায় নির্ভয়পুরের উত্তর দিকের ঘন জঙ্গলে। নিজের সুনাম বা বদনাম কোনওটা বজায় রাখতেই আগ্রহী নয় নির্ভয়পুর। সে যেন সন্ধের পরেও বাড়ির নিষেধ-না-মেনে মাঠে খেলা করে বেড়ানো অবাধ্য ছেলেটা। বাড়ি গেলে বকুনি জুটবে জেনেও নিরুত্তাপ। কে তাকে ভালো বলল, না বলল সেটা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। নিজের খেয়ালেই সে থাকতে পছন্দ করে। এসব ছেলেরা সঙ্গী হিসেবে পেয়েও যায় নিজেদের মতোই কয়েকজনকে। ঠিক যেমন নির্ভয়পুর পেয়েছে দূর বিস্তৃত পাহাড়কে, নাম না-জানা কিছু পাহাড়ি নদীকে। পাশের গ্রাম রংবুল ছোটো হলেও নিজেকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচয় করাতে উদ্যত। কিন্তু নির্ভয়পুরের নাম ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে কেউ তেমন জানে না। জানানোর কোনও আগ্রহও যেন নেই এ অঞ্চলের কারও। বরং বাইরের লোকের প্রবেশ ঠিক মেনে নিতে পারে না এই আদিবাসী মানুষগুলো। ভূমিপুত্ররা এক চুল জায়গা ছাড়তে নারাজ সভ্য জনগোষ্ঠীকে। তবু অনাত্মীয় প্রবেশকারীরা ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠিকই জায়গা করে নেয় নির্ভয়পুরের মাটিতে। আবার পাশাপাশি এই মানুষগুলোই বিশ্বাস করে ডাক্তারবাবুকে। ডাক্তারবাবু তাদের যা ওষুধ দেয়, সেটাই তারা অম্লানবদনে বিশ্বাসের সঙ্গে খেয়ে নেয়। রোগের জ্বালা অবশ্য কমে তাতে। নির্ভয়পুরের একমাত্র সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের ডাক্তার শৌনক বসু। বয়েস বত্রিশ। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট। শ্যামলা গায়ের রঙে পেটানো চেহারা। শরীরের কোথাও এতটুকু মেদের আধিক্য নেই। ওষুধের ব্যাগ কাঁধে চড়াই-উতরাই পেরোতে হয় রাত-বিরেতে শৌনককে। সঙ্গী থাকে প্রলয়। নির্ভয়পুরের ছেলে। সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। বছর চারেকের চেষ্টায় তাকেই গড়েপিটে নিয়েছে শৌনক। ডাক্তারি ছাড়াও আর একটা নেশা তাকে কাবু করে ফেলেছে। প্রকৃতির ছবি তোলা। শৌনক জানে, নির্ভয়পুরকে ক্যামেরাবন্দি করে ফেলা অত সহজ নয়। এ বড়ো বেয়াড়া জায়গা। এখানের মানুষের ভালোবাসাও ভীষণ রকমের তীক্ষ্ণ। এরা কাউকে ভালোবাসলে উজাড় করে দিতে পিছ-পা হয় না, কিন্তু একবার যদি অবিশ্বাস করে, তাকে ছুড়ে ফেলে দেয় জঙ্গলে। ভালোবাসায় এরা বেইমানি পছন্দ করে না। শৌনক যখন প্রথম এসেছিল এই নির্ভয়পুরে ফ্রি ট্রিটমেন্ট ক্যাম্পে, তখন ও সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছে। বর্ধমান হসপিটালে পোস্টেড ছিল।
শৌনকের স্যার শ্রী ধ্রুবাশীষ মাহাতো বলেছিলেন, “শৌনক, যাবে নাকি ফ্রি ট্রিটমেন্ট ক্যাম্পে। পাহাড়ি জনপদ নির্ভয়পুরে? ঝাঁ-চকচকে কিছুই নেই সেখানে, শুধু খরস্রোতা নদীর জলটাই একমাত্র স্ফটিকের মতো ঝকমক করে। অবশ্য ব্যবসাদারদের অত্যাচার যা বাড়ছে তাতে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত না হোক, জীবনযাত্রা উন্নত হবে কিছু মানুষের খুব শীঘ্রই।”
শৌনক এক কথায় রাজি হয়েছিল। প্রত্যন্ত জায়গায় মেডিকেল ক্যাম্পে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ ছাড়তে চায়নি।
স্যারকে হ্যাঁ বলে দিয়েছিল। বাড়ি ফিরে বাবাকে বলতেই, অদ্ভুতভাবে বাবা রাজি হয়নি। সেই প্রথম শৌনকের কোনও কথায় বাবা রাজি হয়নি। ছোটো থেকে বাবাকে যা বলেছে শৌনক, সেটাই প্রশ্নহীনভাবে শুনেছিল শোভন বসু। হঠাৎ এমন বেঁকে বসার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই, ওর নিরীহ নির্বিবাদী মা-ও রাশভারী গলায় বলেছিল, “বাবা যখন বারণ করছে, তখন জেদ ধরার তো কিছু নেই। এসব মেডিকেল ক্যাম্প তো প্রায়ই লেগে থাকে। আমিও অল্পবয়সে তোর বাবার সঙ্গে বহু ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। তখনও আমি ডাক্তারি পাশ করিনি। তোর বাবাও সদ্য প্র্যাকটিস শুরু করেছে। আমি তখন থার্ড ইয়ারে। বেশ কয়েকটা মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। তাই বলছি, এ সুযোগ বহুবার আসবে। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।”
শৌনক শুধু বলেছিল, “কিন্তু এখানে যাব না কেন?”
নিবেদিতা বসু নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল, “আমরা বারণ করেছি তাই। তোর কোনও কাজে তো কখনও নিষেধ করিনি, এবারে বারণ করছি, তাই যাবি না।”
.
“কী ব্যাপার ডাক্তার তুমি, এখানে এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ? চায়ের ব্যবসা করবে নাকি?”
নিরঞ্জন সমাদ্দার গাড়ি হাঁকিয়ে এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। শৌনক এতক্ষণে খেয়াল করল, ও নিরঞ্জন সমাদ্দারের চা বাগানেই দাঁড়িয়ে আছে। বিঘের পর বিঘে চা বাগান নিয়ে টি-এস্টেট গড়ে তুলেছে সমাদ্দার। বয়েস প্রায় ষাটের কোঠায়। কিন্তু এখানের জল-হাওয়ায় সে বয়েসকে পঞ্চাশের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে দেয়নি। এ পাহাড়ি অঞ্চলে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে নিরঞ্জন। খোশ-মেজাজি, মিশুকে মানুষ। নির্ভয়পুরেই বিশাল বাংলো বাড়ি করে রেখেছে। বছরের অর্ধেক সময় এখানে অর্ধেক সময় কলকাতায় কাটায় ভদ্রলোক। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে অনুপমা টি-এস্টেট। অনুপমা নিরঞ্জনের স্ত্রীর নাম। একমাত্র কন্যার নামেই চায়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন নিরঞ্জনের শ্বশুরমশাই। তখন অবশ্য এ ব্যবসার এতটাও রমরমা ছিল না। এমনিই শখের বশে বেশ কয়েক বিঘা চা-জমি কিনেছিলেন নিরঞ্জনের শ্বশুর জলের দরে। জমি কিনেছিলেন নিজের মেয়ে অনুপমার নামে। তার পরের ইতিহাসে বেশ বড়ো। সমাদ্দারের সঙ্গে মিনিট দশেক গল্প করলেই সে ইতিহাস লোকে জেনে যাবেই। কারণ নিরঞ্জন সর্বদা আত্মপ্রচার করতে ব্যস্ত। এ অঞ্চলের লোকজন নিরঞ্জনকে আড়ালে টাকার কুমির বলে ডাকে। অবশ্য শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতেই ওর যত কষ্ট। নির্ভয়পুরে ওর অনুপমা টি-এস্টেটকে কেন্দ্র করে বারবার বিক্ষোভ হয়েছে সুজয় হাঁসদার নেতৃত্বে একবার প্রায় মাসখানেক কোম্পানির কা রেখেছিল শ্রমিকরা। কিন্তু গরিব মানুষ, খিদে নিয়ে আর ক’দিন লড়াই করা শেষে বাধ্য হয়েই একে একে কাজে যোগ দিয়েছিল।
সুজয় বলে, “আসলে কলেজে যখন পড়তাম, তখন থেকেই দেখতাম বন্ধুরা বলত, তোদের আর চিন্তা কী রে? কোটায় চাকরি পাবি। ওরা বুঝত না, নির্ভয়পুরের ঘরে ঘরে আজও মানুষ নিজেদের মানুষই ভাবে না।”
সুজয় নিরঞ্জনের কোম্পানিতেই অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। ও জানে কীভাবে এখানের শ্রমিকদের কতটা ঠকায় নিরঞ্জন সমাদ্দার। এসব প্রথম প্রথম কিছুই জানত না শৌনক। থাকতে থাকতে জেনেছে নির্ভয়পুরের অলিগলিতে লুকিয়ে রাখা গল্পগুলো।
শৌনক হেসে বলল, “আরে না না, আমি একটু মল্লিকবাবুর বাড়িতে যাচ্ছিলাম। ভোর ভোর খবর এসেছে, ভদ্রলোক বেশ অসুস্থ।”
নিরঞ্জন মুচকি হেসে বলল, “সে তো হবেই। বুড়ো হাড়ে দ্বিতীয়পক্ষের অত্যাচার সইবে কেন?”
কথাটা বলেই একটু চোখের ইশারা করল নিরঞ্জন।
“সাহেব তো বাবাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না। ওইজন্যই তো নির্ভয়পুরের বাংলো ছেড়ে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে আছে। বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেই না। এদিকে অরুণাংশু মল্লিক তো আবার রসিক লোক, তার তো ছেলের থেকে বেশি দ্বিতীয়পক্ষের প্রতি টান।”
সাহেব অরুণাংশু মল্লিকের একমাত্র ছেলে।
শৌনক জানে, এই ছোটো জনপদে প্রত্যেকে প্রত্যেকের খবর রাখে। কার হাঁড়িতে কী রান্না হল সেটাও বোধহয় জানে এখানের বাঙালি পরিবারগুলো। হাতে গোনা গোটা দশেক বাঙালি পরিবার আছে এই নির্ভয়পুরে। তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে সারাবছর। কারণ এই পরিবারগুলো সবই ব্যবসাদার। নির্ভয়পুরের প্রাকৃতিক সম্পদকে কবজা করেই বংশপরম্পরায় চলছে এদের ব্যবসা।
নিরঞ্জন বলল, “দেখো ডাক্তার, রাতবিরেতে তুমিই আমাদের একমাত্র ভরসা। না হলে পাশ করা ডাক্তার তো এখানে কোনওদিনই এক মাসের বেশি টিকল না। সবই হাতুড়ে দিয়ে কাজ সারতে হত। এই তুমি এখানে এসে জ্বর-জ্বালায় মানুষের মৃত্যুর হার কমেছে। ও মল্লিক বুড়োর কিছু হবে না আধঘণ্টা দেরি করে গেলে। তুমি ডাক্তার আমার সঙ্গে একটু অরেঞ্জ-টি পান করে তবে যাবে। সকাল সকাল চা না খাইয়ে তোমায় ছাড়লে অস্মিতা আমার ওপরে খুব রাগ করবে।”
অস্মিতার নাম শুনলেই একটু গুটিয়ে যায় শৌনক। অস্মিতা নিরঞ্জন সমাদ্দারের একমাত্র আদুরে সুন্দরী মেয়ে। বিদেশ থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে ফিরে এসে আপাতত বাবার এস্টেট নিয়ে নতুন কিছু ভাবনাচিন্তা করছে। কলকাতাতেই থাকে বেশি। মাঝে মাঝে এসে এখানেও থেকে যায় মাসখানেক। বার চারেক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল অস্মিতার সঙ্গে। শৌনকের প্রতি যে অস্মিতার দুর্বলতা তৈরি হয়েছে, সেটা একটু হলেও টের পেয়েছে ও। তবে অস্মিতার ব্যবহার অন্তত মার্জিত। হাবেভাবে কোনও প্রকাশ নেই তার। কিন্তু নিরঞ্জন বোধহয় তার মেয়ের ঘরজামাই হিসেবে শৌনককেই পছন্দ করে রেখেছে। তাই দেখা হলেই অস্মিতার কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে। শৌনক একটু অস্বস্তি নিয়েই বলল, “না না নিরঞ্জনবাবু, আমি মল্লিকবাবুকে আজ দেখে আসি। পরে না হয় জমিয়ে চায়ের আসরে বসা যাবে।”
নিরঞ্জনের গাড়িকে বাঁ-পাশে রেখেই হনহন করে পা চালাল শৌনক। শর্টকাট পাহাড়ি রাস্তা ধরেছিল ও, গাড়ি করে গেলে ঘুরপথে দেরি বেশি হত।
নির্ভয়পুরে আসার পর একটা জিনিস ওর সবসময়ের সঙ্গী হয়েছে, ওষুধের ব্যাগের সঙ্গে একটা নাকলম্বা ছাতা। বার চারেক আচমকাই রোদেলা আকাশকে মুখ গোমড়া অভিমানী হয়ে অযথা অশ্রু বিসর্জন করতে দেখেছে। সেই আচমকা বৃষ্টিতে ভিজেও গিয়েছিল শৌনক। তারপর টোংলু বাজার থেকে এই বিকট সাইজের ছাতাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রলয় বলেছিল, “স্যার, এটা ছাড়া পথে বেরোলে বিনা নোটিশে ভিজে যাবেন।” সেই থেকেই ছাতটা শৌনকের সর্বসময়ের সঙ্গী।
অরুণাংশু মল্লিকের স্ত্রী-ভাগ্য যে মোটে সুবিধার নয়, সেটা শুধু উনি নন, এ অঞ্চলের সকলেরই জানা বিষয়। প্রথম স্ত্রী নিরুপমাদেবীও খুবই দাপুটে মহিলা ছিলেন। তাঁর চিৎকারে মল্লিক বাড়ির সকলেই ভীত হয়ে থাকত। কিন্তু নিরুপমাদেবীর পরমায়ু কম থাকায়, সন্তান যখন মাত্র বছর দশেকের তখন গত হলেন। অরুণাংশু মল্লিকের হোটেলের ব্যবসা। নির্ভয়পুর থেকে মাইল তিনেক দূরে গোটা তিনেক গেস্ট-হাউস আর গোটা দশেক কটেজ রয়েছে। পর্যটনপ্রিয় বাঙালির দৌলতে সারাবছর গেস্ট হাউসের সব রুম আর কটেজগুলো ভর্তিই থাকে। মা লক্ষ্মীর কৃপায় কলকাতাতেও ব্যবসার রমরমা। কিন্তু যতদিন নিরুপমা সংসারে ছিলেন, ততদিন মল্লিকবাবু একটু নিশ্চিন্তে ছাদে ঘুরতেও পারেননি। দোষের লিস্ট হাতে নিরুপমা পিছন পিছন ঘুরে ঘুরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এত বড়ো অকর্মার ঢেঁকি বিশ্বে আর দুটি নেই। কথায় কথা বাড়বে বলেই মল্লিকবাবু চুপ করে থেকেছেন। আর তাতেই নিরুপমাদেবী প্রশ্রয়ে আটখানা হয়ে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। নিরুপমাদেবী যখন আচমকাই কিডনির রোগে আক্রান্ত হলেন, তখন নাকি মল্লিকবাবু নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে স্ত্রীর সেবা করেছিলেন। কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। নিরুপমাদেবী চলে যাওয়ার পরে ছেলে সাহেবকে নিয়েই কাটছিল সময়। ব্যবসায় বেশি করে মনোযোগ দেন। চল্লিশের মল্লিকবাবুর বিয়ে দেবার জন্য অনেকেই উঠে-পড়ে লেগেছিল। তারপরেই হঠাৎই মল্লিকবাবু প্রায় সমবয়েসি এক মহিলাকে বিয়ে করে বসেন। মহিলার ঠিক কী পরিচয় কেউই জানে না। অতসী মল্লিক দেখতে ভারি সুন্দরী। তবে দ্বিতীয়পক্ষটিও বড়োই কড়া স্বভাবের। কথায় কথায় মল্লিকবাবুকে বিঁধিয়ে তবে ছাড়েন। বেচারা অরুণাংশু মল্লিক! সারাজীবন শুধু নিগৃহীতই হয়ে গেলেন। মানুষটা আবার খুবই আড্ডাবাজ, মিশুকে স্বভাবের। বাড়িতে অতিথি গেলে তাকে না খাইয়ে ছাড়েন না। সাহেব বরাবরই কলকাতার নামী স্কুলের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। সৎ মায়ের সঙ্গে সাহেবের সম্পর্কটা ভালো হলেও হতে পারত, কিন্তু দু’পক্ষেরই অনাগ্রহে সে সম্পর্ক শীতলই রয়ে গেছে। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সাহেব বাড়িতে এলে অতসীদেবী পাল্টে যান। সৎ ছেলের যত্নের কোনও ত্রুটি করেন না। গলার আওয়াজও তখন খাদে বয়ে যায়। বাড়ির চারটে পরিচারিকাকে বলেন, “ছেলেটা ওখানে কী ছাইপাঁশ খায় কে জানে? যে ক’দিন আছে, সে ক’দিন যেন এ বাড়ির হেঁশেলে সাহেবের পছন্দের রান্নাই হয়।” মুখোমুখি কথা হলে সাহেব অতসীকে আন্টি বলে ডাকে। অতসীও কোনওদিন মা ডাকতে বলেনি সাহেবকে। অরুণাংশু আর অতসীর মেয়ের বয়েস এখন বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ। সে মেডিকেল পড়ছে উত্তরবঙ্গ কলেজে। ইন্টার্নশিপ করছে। সাহেবের সঙ্গে নূপুরের খুব ভাব। নূপুর দাদা বলতে অজ্ঞান। ওদের দেখে কখনওই মনে হয় না, ওরা সৎ ভাই-বোন। সাহেব কলকাতার ব্যবসা দেখে। অরুণাংশুবাবুর ওপরে একটু যেন বিরক্ত। সেই বিরক্তির কারণ অতসী না অন্য কিছু সেটা আজও মল্লিকবাবুর কাছে পরিষ্কার নয়। কারণ অতসীর যাবতীয় রাগ মল্লিকবাবুর ওপরে। সাহেবকে আর নুপুরকে কোনওদিন আলাদা চোখে দেখেননি অতসী।
দরজায় বেল বাজতেই সাহেবই দরজার খুলল। শৌনককে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “আমি গাড়ি পাঠাতেই যাচ্ছিলাম তারপর বুনি বলল, আপনি নাকি পেশেন্টের পাঠানো গাড়ি ইউজ করেন না।”
শৌনক মৃদু হেসে বলল, “বাবা এখন কেমন আছেন? বুকে ব্যথাটা কখন থেকে হচ্ছে?”
সাহেব বলল, “গতকাল রাতে প্রথম বলল বুকে ব্যথা। আন্টি তখনই আপনাকে খবর দিতে চাইছিল। তখন আবার বাবা বলল, এখন বেটার লাগছে। আর রাতে ডাক্তারকে বিরক্ত করতে হবে না। সকালে খবর দিলেই চলবে। কিন্তু ভোর পাঁচটায় আবার বলছে ব্যথা করছে। তখনই ফোনটা করলাম।”
শৌনক সোজা মল্লিকবাবুর ঘরে গিয়ে বুকে টেথোস্কোপটা লাগিয়ে বার দুয়েক পরীক্ষা করেই বলল, “সাহেব, গাড়ি কে ড্রাইভ করবে? তুমি?”
সাহেব একটু ঘাবড়ানো গলায় বলল, “কেন ডক্টর? এনি এমার্জেন্সি?”
শৌনক বলল, “অ্যাডমিট করে বেশ কয়েকটা টেস্ট করাতে চাইছি।” মল্লিকবাবু কিছু একটা বলতে গেলেন। ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে অতসীদেবী বেশ নির্দেশের সুরেই বললেন, “সাহেব গাড়ি বের কর। এ মানুষ চিরটাকাল মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। পারে না বলেই যত সমস্যা।”
শৌনক বলল, “সোজা এমার্জেন্সিতে নিয়ে যাও সাহেব। আমি লিখে দিচ্ছি।”
অতসী বললেন, “ডাক্তারবাবু ওর কিন্তু এমনিতেই গ্যাসের ধাত। তাই সাধারণত বাড়ির খাবারেও আমি তেল কম দিয়ে রাঁধতে বলি। সেই কারণে অবশ্য আমি চক্ষুশূল।”
সাহেব আর অতসী মল্লিকবাবুকে নিয়ে গাড়িতে উঠল।
শৌনকের অভিজ্ঞতা বলছে, এটা গ্যাসের ব্যথা নয়। চোখ আর জিভ দেখে মনে হচ্ছিল, মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছিল ঘুমের মধ্যেই। তাই কোনওরকম রিস্ক নিতে চায় না শৌনক।