কাছের সঙ্গী – ১
।। ১।।
আজ্ঞে কর্তাবাবু, বলছি, নায়েবখানার দিকের দক্ষিণের দেওয়ালে একটা বড় বটগাছ মাথাচাড়া দিচ্ছে। শিকড় বাকড় নিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। মন বলছে, সে দক্ষিণের দেওয়ালকে ভেঙে দেবে।
গৌরীশঙ্কর রায়চৌধুরী সস্তার সিগারেটে টান দিয়ে বললো, ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর বলছো? তা দিক না। কে বটের সাহসের সাথে লড়াই করতে যাচ্ছে? আর বিষ্ণুকাকা, তুমি কেন বোঝো না বলতো, আমার ধমনীতে জমিদারী রক্ত বইছে বলেই আমি জমিদার নই। তোমার বয়েস তো কম হলো না, প্রায় বিরাশি না চুরাশি, সে যাইহোক মোট কথা আশির ঘর ছেড়ে দ্রুত দৌড়াচ্ছে। তারপরেও তুমি কি সেই আমায় কর্তাবাবু বলেই ডাকবে বিষ্ণুকাকা?
বিষ্ণুচরণ এ বাড়ির পুরোনো কর্মচারী। বংশানুক্রমে ওদের গোটা পরিবার এই রায়চৌধুরী বাড়িতে কাজ করে গেছে। এমন কি বিষ্ণুচরণের ছেলেও এই বাড়ির গাড়ির ড্রাইভার। তাই মহেশডাঙার এই জমিদারবাড়ির প্রতি বিষ্ণুচরণের টান আজন্মকাল ধরে।
বাবার সাথে নতুন জামা পরে প্রথম এই রায়চৌধুরী বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে পা দিয়েছিল। তখন এ জমিদার বাড়ির চাকচিক্য ছিল আলাদা। শ খানেক ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছে। চণ্ডীমণ্ডপকে ঘিরে বিশাল ম্যারাপ বাঁধা। সেখানেই পংক্তিভোজনের ব্যবস্থা। গোটা গ্রামের লোক এসে জড়ো হয়েছিল। অষ্টমীর পুজো দেখে, ভোগ খেয়ে তবে সব বাড়ি ফিরবে।
খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের লুচি, ছোলার ডাল, ছানার ডালনা, চার রকমের মিষ্টি। সেসব স্বাদ তো ভোলার নয়। গৌরীশঙ্কর তখনও জন্মায়নি। গৌরীশঙ্করের দাদুর জমিদারীর আমল। যদিও ইংরেজরা এসে জমিদারদের ক্ষমতা তখন প্রায় খর্ব করে দিতে শুরু করেছিল তবুও চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরীর দাপট তখনও অবশিষ্ট রয়েছে মহেশডাঙায়।
জমিদারী ক্ষমতা চলে গেলেও তার জমির পরিমাণ কিছু কম ছিল না। খাজনা আদায় প্রথা উঠে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার আয় বা সঞ্চিত অর্থ তখনও তাকে প্রভাবশালী মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করার মতো ছিল।
আর মহেশডাঙার মানুষজন তখনও তাকে দেখলেই পেন্নাম ঠুকে বলতো, আজ্ঞে জমিদারবাবু আমার বড় ছেলের বড্ড অসুখ, আপনি একটু না দেখলে মারা যাবে যে। জমিদার চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরীও গোমস্তা বা নায়েবকে ডেকে হুকুম দিতেন, ওরে কে আছিস এর হাতে কিছু টাকা দিয়ে দে। আর দেখিস যেন ছেলের চিকিৎসাটা ভালো করে হয়। যদি দেখিস নেশা করে ওড়ালো তাহলে চাবকে পিঠের চামড়া তুলে নিস।
বিষ্ণুচরণ এসব যখন দেখেছে তখন ওরও কম বয়েস। বেশির ভাগই ওর বাপ ঠাকুরদার কাছ থেকে শোনা কথা। যেহেতু তারা এই বংশের সাথে আজীবন যুক্ত ছিল তাই বিষ্ণুর ঘর বলতেও এই রায়চৌধুরী বাড়ির ঘর। সংসার বলতেও এবাড়ির মানুষগুলো। বাপ, ঠাকুরদার কাছে এবাড়ির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সব জমিদারদের কথা শুনে শুনে বিষ্ণুচরণের সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।
এবাড়ি যেমন একদিকে ঐতিহ্যের প্রতীক, দান-ধ্যানের প্রতীক তেমনি দাপট আর অহংকারের ইতিহাসও লেখা আছে এর দেওয়ালের গোপন কক্ষে। খাজনা আদায়ের জন্য অনেক গরিব কৃষকের রক্তে রাঙা হয়েছে বৈঠকখানার দেওয়ালে টাঙানো শঙ্কর মাছের চাবুকটা। বিষ্ণুচরণের চোখ তার সাক্ষী নয় ঠিকই কিন্তু বিষ্ণুচরণের ঠাকুর্দার নিজের চোখের দেখা ঘটনা থেকেই ও জানতে পেরেছে রায়চৌধুরী বাড়ির রক্তে ছিল দম্ভ। এমন কি চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরীর দম্ভও কিছু কম ছিল না। পুজোর সময় দত্ত বাড়ির পুজোর সাথে কম্পিটিশন করে ঢাকির দল ডাকতেন তিনি। কিছুতেই যেন দত্তরা মানে উঠতি বড়লোকরা ছাপিয়ে না যায় রায়চৌধুরীদের বংশমর্যাদাকে। মুখে বলতেন, তেল বেচা চারটি টাকা পেয়ে দত্তরা দুর্গাপুজো চালু করলো, জানে না তো দুর্গাপুজোর খরচ। দেখা যাক ওই নতুন পালক গজানো দত্তরা কতদিন এ পুজো টানতে পারে!
দুর্গাপুজোর খরচ জোগাতে কান্তপুরের জমিদারকে তার জমিদারী অবধি নিলাম রাখতে হয়ছিল, সেখানে ওই কাঁচা পয়সার মালিক দত্তরা তো নেহাতই শিশু।
বিষ্ণুকাকা, দুর্গাপুজোর খরচ যা দাঁড়াচ্ছে তাতে আমার এই কেরানির চাকরির টাকায় তা কুলানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মহেশডাঙায় এখন অনেকগুলো পুজো হয়। এখানের মানুষ আর সেই আগের মত জমিদারবাড়ির পুজোর অপেক্ষায় বসে নেই।
বিষ্ণুচরণের মুখে কেউ যেন এক পোচ কালো কালির তুলি টেনে দিলো মূহূর্তে। মুখের সবটুকু আলো নিভিয়ে বিষ্ণুচরণ বললো, তাই বলে মায়ের পুজো বন্ধ করে দেবে কর্তাবাবু? এমনিতেই তো তোমার বিয়েটা এখনও এই মহেশডাঙার লোকজন মেনে নিতে পারেনি। তারপর যদি বড় কর্তাবাবু মারা যাবার একবছরের মধ্যেই পুজো বন্ধ করে দাও, তাহলে তো লোকে ছি ছি করবে!
গৌরীশঙ্কর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বাবার মৃত্যুটা আকস্মিক ছিল না বিষ্ণুকাকা। বাবার লিভারটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অত্যাধিক মদ্যপান তার কারণ বলেছিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু আমার মনে হয় কারণটা বোধহয় আমি। বাবা তো অল্প বয়সে এমন বেহিসেবি জীবনযাপন করেননি, বরং বেশ গোছানো জীবন ছিল।
জমিদারী রক্তের অহংকার, রূপের দম্ভ, সম্মানের আকাঙ্খা নিয়ে বেশ ভালোই ছিলেন। বাবার দুই মেয়েরই ভালো বিয়ে হয়েছিল। সত্যি বলতে কি একমাত্র পুত্র সন্তানটি কুলাঙ্গার হবার পর থেকেই মনোকষ্টে বাবা বেহিসেবি জীবন যাপন করতে শুরু করেন। তাই আমি জানি, বাবার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।
বিষ্ণুচরণ মুখ নিচু করে বলল, ছোট মুখে বড় কথা কর্তা, তবুও বলছি, নিজের জমি ভেস্ট করে দেওয়ার মত এমন অলুক্ষণে কথা কেউ শোনেনি। সেটাও তুমি করলে। তাছাড়া তোমার বিয়েটাও বড় কর্তাবাবু কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি। কর্তামাও মনে মনে তোমাকেই দোষারোপ করেন বৈকি।
ত্রিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে গৌরীশঙ্করের গোঁফের ফাঁকে হালকা হাসির ছোঁয়া দেখা দিল। ফিসফিস করে বললো, ওই জন্যই তো বলি বিষ্ণুকাকা, আমি তোমাদের জমিদারবাবু নই। আমাকে ছোটকর্তা বলে ডেকো না। ছোটবেলায় যেমন দাদাবাবু বলতে অমনি বলো। জমিদারী রক্তের ভার আর বইতে পারছি না। দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করার চেষ্টা না করেই বললো ও। রায়চৌধুরী বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।
বিষ্ণুচরণ একটু থমকে দাঁড়িয়ে থেকে বললো, তাহলে কর্তামাকে গিয়ে কি বলবো? তুমি কি অন্দরে গিয়ে নিজেই বলবে?
গৌরীশঙ্কর হাতের সিগারেটটা কারুকার্য করা স্ফটিকের ছাইদানিতে ফেলে দিয়ে বললো, বেশ আমিই বলবো যা বলার। তবে এই পুজো চালানো আর আমার দ্বারা সম্ভব নয় গো। চারটে হাতি পোষার খরচ। আমার একবছরের মাইনে দিলেও এমন রাজকীয় পুজো করা সম্ভব নয়।
লম্বা টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে দেখলো, মাধবীলতা একা দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনদীঘির সবজে জলের দিকে তাকিয়ে। এক সময় ওই পুকুরে গোলাপী পদ্ম ফুটতো। গৌরীশঙ্কর আর মাধবীলতা দুজনে একসাথে সাঁতরে বড় বড় পদ্ম তোলার খেলায় মেতে উঠতো।
।। ২।।
মাধবীলতাকে ও চেনে সেই বছর ছয়েক বয়েস থেকে।
মহেশডাঙার রায়চৌধুরী বাড়িতে একটা ছোট্ট মত পুতুলকে সাজিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। পরণে লাল বেনারসী, নাকে নথ, কপালে সিঁথিময়ূর, ছোট্ট কপালে বেশ বড় একটা লাল টিপ। গৌরীশঙ্করের চেয়ে মেয়েটা বছর তিনেকের ছোট। ও তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। অবাক চোখে দেখছিল অমন ছোট্ট মেয়ের বউ বউ সাজ। মায়ের কাছে গিয়ে বলেছিল, ওটা কে মা? ওকে অমন কেন সাজানো হয়েছে? ওর মাথায় মুকুট কেন?
মা হেসে বলেছিল, এবার থেকে এই বাড়ির পুজোয় কুমারীপুজো চালু হলো। তোর দাদু গতবছর পুজোর সময় বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন, ওখানে দেখেই এ বছর থেকে এ বাড়িতেও কুমারী পুজো শুরু করলেন।
কিছুই মাথায় প্রবেশ করছিল না ওর। হঠাৎ ঠাকুরের পাশে ওই পুচকি মেয়েটা কেন গিয়ে বসলো, কেনই বা সবাই ওকে ঠাকুরের মত পুজো করবে…অনেক প্রশ্নের ভিড়ে একটা কথাই মনে হয়েছিল, ওদের বাড়ির পুজোয় ওর পুজো করা হয় না, আর একটা বাইরের মেয়ের পুজো কেন হবে!
ওর দাদুর বয়েস তখন প্রায় পঁচানব্বই। তবুও বেশ শক্তপোক্ত ছিলেন। তিনিই দাঁড়িয়ে পুজোর তদারকি করছিলেন। বাবাও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। গৌরীশঙ্কর রায়চৌধুরী বাড়ির একমাত্র বংশপ্রদীপ বলে ওর একটু বেশিই আদর ছিল। আর বাবার যথেষ্ট বেশি বয়েসের সন্তান ও। বাকি সব দিদি আর বোন। এমনকি ওর মেজ কাকারও দুই মেয়ে, ছোট কাকারও এক মেয়ে। বংশে ছেলে বলতে শুধু ও। তাই চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরী প্রায় বলতেন, দাদাভাই ভাগ্যিস জন্মালো তাই মহেশডাঙার রায়চৌধুরী পদবীটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল না। বাকি সব তো পরগোত্রে চলে যাবে। মেয়ে মানেই তো অপরের সম্পত্তি, নিজের বলতে শুধুই গৌরী।
সেই দাদুই কিনা একটা পুচকি মেয়ের পুজো করছে ওকে বাদ দিয়ে।
হন্তদন্ত হয়ে ও পৌঁছেছিল দাদুর সামনে। দাদুকে মহেশডাঙার সবাই ভয় করে বলেই হয়তো দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বেশ ভয়ই করতো ওর। তবুও এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না ভেবেই ভয়ে ভয়ে বলেছিল, আমি যদি তোমার সংসারের একমাত্র প্রদীপ হই তাহলে আমায় বাদ দিয়ে ওই বাইরের মেয়েটাকে পুজো কেন করছো?
দাদু একটু থমকে দাঁড়িয়ে তারপর দরাজ গলায় হেসে বলেছিলেন, এটা যে কুমারী পুজো, তাই রমেশ ঘোষালের একমাত্র কন্যা, সুলক্ষণা মেয়েটিকেই বেছে নিতে হয়েছে এই পুজোর জন্য। একটু ভুল হলেই মা কুপিত হবেন যে দাদুভাই।
রাগে ধপ ধপ পা ফেলে ও এসে দাঁড়িয়েছিল চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। ততক্ষণে ওই মেয়ে বসে পড়েছে ব্রাহ্মণের সামনে। বিরক্ত হয়েই গৌরীশঙ্কর ওকে জিভ ভেঙিয়েছিলো। সে মেয়েও চুপ করে থাকেনি, পাল্টা জিভ দেখিয়েছিল ওকে। পুজোর শেষে বেনারসী গুটিয়ে কোমরে হাত দিয়ে ওর সামনে এসে বলেছিল, ঠাকুর দেবতাকে কেউ জিভ দেখায়? তোমার জিভ খসে যাবে।
গৌরীশঙ্কর মুখ ভেঙিয়ে বলেছিল, যে ঠাকুর নিজেই জিভ দেখায় সে আবার ঠাকুর কি?
ওই পাকা মেয়ে তখন আরেকধাপ গলা চড়িয়ে বলেছিল, মা কালীও তো সবাইকে জিভ দেখায়, তাই বলে কি তাকে আমরা জিভ দেখাবো? তুমি যে আমায় জিভ দেখালে তোমার জিভ এবারে মাটিতে খসে পড়বে।
গৌরীশঙ্কর বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল মেয়েটার নিখুঁত যুক্তি শুনে।
ভয়ে ভয়ে বলেছিল, তাহলে আমায় এখন কি করতে হবে?
মেয়েটা আর কিছু না বলে কোমরে শাড়িটা গুটিয়ে পালিয়েছিল।
ও মেজকাকিমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ঠাকুরকে জিভ দেখালে কি হয় গো?
মেজকাকিমা কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেছিল, জিভ আড়ষ্ট হয়ে যায়, বোবা হয়ে যায়!
গৌরীশঙ্কর বলেছিল, আর ওই যার কুমারী পুজো হলো তাকে জিভ দেখালে?
মেজকাকিমা বলেছিল, ওমা, মাধবীলতাও যে এখন ঠাকুর রে। দেখলি না ব্রাহ্মণ ওকেও মন্ত্র বলে মাতৃজ্ঞানে পুজো করলো?
ভয়ে ওর বুকটা ঢিপ ঢিপ করছিল।
মেজকাকিমা বলেছিল, কান মুলে ক্ষমা চেয়ে নিস ঠাকুরের কাছ থেকে। তুই ছোট ছেলে, তোর ওপরে কি উনি রাগ করে থাকতে পারেন?
গৌরীশঙ্করের তখন উভয়সঙ্কট অবস্থা। একে তো ওই মাধবীলতা নামক অত্যন্ত পাকা মেয়েটাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে। তাছাড়া ওইটুকু মেয়ের সামনে নিজের জিভ বাঁচাতে কান মুলে ক্ষমা চাওয়াটাও সম্মানহানির বড় কারণ। তবুও ক্ষমা ওকে চাইতেই হবে রাত পেরোনোর আগেই। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতেই দেখলো নথ পরা মেয়েটা একটা পিঙ্ক কালারের ফ্রক পরে কাঞ্চনদীঘির ধারে বসে পা দোলাচ্ছে।
গৌরীশঙ্কর একটু সাহস করেই মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটা ওকে দেখেই জিভ ভেঙচে বলল, পচা ছেলে, আমি খুব রেগে আছি। এমন পাপ দেব যে বিকেলে তুমি তোমার ব্যাটটাই খুঁজে পাবে না।
এমন সংকটে ওকে আগে পড়তে হয়নি।
নরম গলায় গৌরীশঙ্কর বলেছিল, আমি তো তোমাকে ঠাকুর ভেবেই তোমায় একটা গিফট দিতে এলাম। আর তুমি বলছো তুমি আমায় পাপ দেবে?
মেয়েটা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলেছিল, কি গিফট? কই দেখি?
আজ সকালেই মেজপিসি এসেছে কলকাতা থেকে। একটা খুব সুন্দর পেন্সিলবক্স এনেছিল ওর জন্য।
পাপের ভয়ে এখন এই মেয়েটাকে থুড়ি ছোট্ট মেয়ে ঠাকুরটাকেই এটা দিতে হচ্ছে। আরেকবার প্রিয় পেন্সিলবক্সটাতে হাত বুলিয়ে ও মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও।
মেয়েটা পেন্সিলবক্সটা উল্টে পাল্টে দেখে বললো, বা দারুণ তো। আবার গাড়ির ছবিও আঁকা আছে। তারপরেই মুচকি হেসে বলল, এটা তুমিই নাও। আমি তোমায় পাপ দেব না। কিন্তু ঠাকুররা কখনো ঘুষ নেয় না। ঠাকুররা এমনিই সবার ভালো চায়। আমারও তো বামুনদাদু পুজো করেছে। আর বাবা বলেছে, আমিও যেন সবার ভালো চাই। তাই তোমার পছন্দের পেন্সিলবক্সটা আমি নেব না। তুমি মনে দুঃখ পেলে আমিও কষ্ট পাবো।
গৌরীশঙ্করের চোখদুটো প্রায় কপালে উঠে যাচ্ছিল। বাপরে মেয়েটা কি মারাত্মক কথা বলে। কত কথা জানে। ও সে তুলনায় বয়েসে বড় হয়েও বোকাই রয়ে গেল।
নিজের এই বেশি কথা না বলতে শেখার জন্য এই মুহূর্তে বাবার ওপরেই রাগ হলো বেশি। বাবা সব সময় বলেন, ছোটদের মুখে বড় বড় কথা নাকি বড্ড বেমানান।
গৌরিশঙ্কর পেন্সিলবক্স হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির রাস্তা ধরেছিল। ঠিক তখনই মেয়েটা বলে উঠলো, আমার নাম মাধবীলতা, তোমার নাম কি?
গৌরীশঙ্কর দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরে বলেছিল, গৌরীশঙ্কর রায়চৌধুরী।
মাধবীলতা ফিক করে হেসেছিল। হাসলে মেয়েটার গালটা ফুটো হয়ে যায়। মা যেন এটাকে কি একটা বলে। যাকগে ওই ফুটো গালের মেয়েটার দিকে একটু গম্ভীর ভাবেই তাকিয়ে গৌরীশঙ্কর বলেছিল, কি ব্যাপার হাসছো কেন?
মেয়েটা আরেকবার হেসে বলেছিল, তোমার এত বড় নাম? শুধু গৌরী বা শুধু শঙ্কর হলেই তো চলতো। আমি তোমায় শঙ্করদা বলে ডাকবো। এই যে তোমায় আমি পাপ দিলাম না, তাই তোমার জিভটাও মুখের মধ্যেই রয়ে গেছে, পড়ে যায়নি এইজন্য তোমায় একটা কাজ করতে হবে। আমায় ক্রিকেট খেলা আর ডাংগুলি খেলা শিখিয়ে দিতে হবে।
গৌরীশঙ্কর খুব খুশি হয়েছিল। সাধারণত মাঠে খেলতে গেলেই বড় ছেলেরা হাত থেকে ব্যাট বলটা নিয়ে মাঠের শেষে বল কুড়ানোর জন্য দাঁড় করিয়ে দেয়। আর সমবয়সীদের সাথে খেলতে গেলে দু বলে আউট করে দিয়ে বলে, যা বাড়ি যা। জমিদার বাড়ির ননীর পুতুল হয়ে থাকিস। এর সবগুলোই বেশ অপমানজনক।
বরং এই মাধবীলতাকে যদি শিখিয়ে নেওয়া যায় তাহলে মন্দ হয় না। গৌরীশঙ্কর এক কথায় লাফিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলো।
বেশ নরম গলায় বলল, তুমি কখনো খেলেছো? খেলতে জানো ক্রিকেট?
মাধবীলতা বেশ দৃঢ়তার সাথে বললো, জানি। আমি খেলতেও পারি। আমি যখন মামার বাড়ি যাই তখন দাদাদের সাথে খেলেছি। কিন্তু এই পাড়ায় মেয়ে বলে কেউ খেলা নেয় না। বলে যা পুতুল খেল। কিন্তু আমার পুতুল খেলতে ভালো লাগে না।
গৌরীশঙ্কর মাধবীলতার হাতটা চেপে ধরে বলেছিল, আমরা বন্ধু হলাম। সব সময় পাশে থাকব। মাধবীলতা মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, খুব মজা হবে। বন্ধু শব্দের প্রকৃত অর্থ না জেনেই শুরু হয়েছিল ওদের বন্ধুত্ব।
গৌরীশঙ্কর নিজের সবটুকু ক্ষমতা দিয়েই মাধবীলতাকে ব্যাট বলের লড়াই শেখানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মাধবী প্রতিদিনই রেগে গিয়ে বলতো, তুমি কিছুই জানো না। মেয়েদের আউট করতে নেই তাও জানো না।
অগত্যা সর্ব বিষয়ে পারদর্শী মাধবীর কাছে শঙ্করকে হার মানতে হয়েছিল। ওর কথা না শুনলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করতো মাধবী, তাই বাধ্য হয়ে কান্না থামাতে ওভারের পর ওভার বল করে যেত শঙ্কর। আর উইকেট আগলে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো মাধবী। বারংবার আউট হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং দুর্গার অংশ এবং মেয়ে হওয়ার দৌলতে শঙ্কর কোনদিনও ব্যাটসম্যান হতে পারতো না।
কুমারীপূজার পর থেকেই মহেশডাঙার লোকজন মাধবীলতাকে পথে ঘাটে দেখলেই হাত জোড় করে প্রণাম করতো। ওর মুখ দেখলে নাকি তাদের দিন ভালো যায় এমন এমন একটা কথার প্রচলন হয়েছিল গ্রামে। পথচলতি লোকজন তাদের ছোট্ট দুর্গার হাতে চকলেট, কেক, বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিতো। মাধবী অবশ্য বন্ধুত্বের শর্ত মেনে সে সব জিনিস একা খেত না। শঙ্করের জন্য বিকেল পর্যন্ত রেখেও দিতো।
এমনিতে শঙ্করের মাধবীকে খারাপ লাগতো না। কিন্তু ব্যাট নিয়ে নিলেই বলতো, এমন অভিশাপ দেবে যে শঙ্করের জিভ খসে যাবে। এমন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের বিরুদ্ধে গিয়েই শঙ্কর পর পর দুদিন মাধবীর সাথে না খেলতে এসে পাড়ার অন্য বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়েছিল। দূর থেকে মাধবীকে দেখেও পাত্তা দেয় নি। এমনকি মাধবী হাতের ইশারায় লালচে রঙের কেকের প্যাকেটটা দেখালেও সাড়া দেয়নি শঙ্কর। প্রায় মাস দুয়েক পরে হাতে ব্যাট পেয়ে ও তখন খেলতে ব্যস্ত ছিল।
মাধবী মিনিট কুড়ি মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে নানা রকম ভাবে শঙ্করকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিল।
শঙ্কর দেখেও দেখেনি এমন ভাব করে বন্ধুদের সাথে খেলছিল।
দিন পাঁচেক মাধবীলতার আর দেখা পায়নি শঙ্কর। নিজের মনেই স্কুল গেছে। স্কুল থেকে ফিরে পড়াশোনা খেলাধুলো নিয়েই মেতে ছিল।
সপ্তম দিনে মাঠে বেরোতেই একটা দৃশ্য দেখে থমকে গিয়েছিল শঙ্কর। মাধবীলতা ওরই বয়েসী একটা ছেলের সাথে ক্রিকেট খেলছে। ব্যাট বল দুটোই নতুন।
ছেলেটা বল করছে মাধবীর নির্দেশ মত, আর মাধবী ব্যাট চালাচ্ছে।
দেখেই কোনো কারণ ছাড়াই অযৌক্তিক রাগে গাটা জ্বলে উঠেছিলো ওর। কটকট করে মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে গৌরীশঙ্কর বলেছিলো, তা ইনি বুঝি মা দুর্গার বাহন?
মাধবী মুখটা বেঁকিয়ে বলেছিল, চল পীযুষ তুই বল কর। যে বন্ধু হবে কথা দিয়েও কথা রাখে না, তার সাথে আমার আড়ি।
গৌরীশঙ্কর অসহায় গলায় বলেছিল, ঠাকুরকে জিভ দেখালে জিভ খসে পড়ে, আর ঠাকুর মুখ বেঁকালে কিছুই বুঝি হয়না?
মাধবীলতা যথারীতি ওই পীযুষ নামক ছেলেটির বলে আউট হয়েও নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, হয় তো। সেও জীবনে অনেক কষ্ট পায়। তারও কোনো বন্ধু হয়না। কথাটা বলেই কাঁদো কাঁদো গলায় ব্যাট বল পীযুষের হাতে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল।
ওর ওই কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে আর অভিমানে ছুটে চলে যাওয়ার পথের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভেবেছিল, ইস, ছোট মাদুর্গাকে কাঁদিয়ে ফেললাম! বড় অন্যায় হলো। মুখ ভার করে বাড়ি ফিরেছিল গৌরীশঙ্কর। বেশ কয়েকদিন রাস্তায়, স্কুল যাওয়ার পথে আর মাধবীলতার দেখাই পায়নি ও।
কিছুদিনের মধ্যেই ভয়ঙ্কর মনখারাপ করা একটা খবর এসেছিল গৌরীশঙ্করের কানে। ওকে নাকি পড়াশোনার জন্য কলকাতায় মামার বাড়িতে পাঠানো হবে।
জমিদারী চলে গেছে কবেই, তবুও রায়চৌধুরী পরিবারের ঠাটবাটের ভাটা পড়েনি কিছুতেই। বাড়ির অন্য ছেলে মেয়েদের মতোই গৌরীশঙ্করও নিজেকে জমিদার, রায়বাহাদুর ভাবতে শুরু করার আগেই ওকে এই পরিবেশ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। গৌরীশঙ্করের বড়মামা ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যার সামনে ওর দাদু চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরীও মাথা নিচু করে কথা বলতেন। মামা নিজের দুই ছেলেকে ডাক্তার বানানোর কাজে মন দিয়েছিলেন। সে কাজ সফল হবার মুখেই একমাত্র ভাগনার প্রতি তার নজর পড়ে। ব্যস, গৌরীশঙ্করের মা নন্দিনীদেবীকে নির্দেশের সুরে বলেন, নদী, ছেলেটাকে মানুষ করতে দে। তোদের ওই জমিদারী হালচাল আর বেশিদিন টিকবে না এ রাজ্যে। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে রে। অশিক্ষিত জমিদারদের দিন শেষ। তাই গৌরীকে আমার কাছে কলকাতায় পাঠিয়ে দে। নন্দিনীদেবী মহেশডাঙায় যতই জমিদারগিন্নীর ভাবসাব করুক না কেন, বড়দার চোখের দিকে তাকিয়ে তার নির্দেশ অগ্রাহ্য করবে এমনটা কল্পনাতেও আনতে পারবে না।
পুজোর ছুটিতে বা গরমের ছুটিতে মামার বাড়ি গেলেই মামা অঙ্ক কষাতে বসত, যেটা গৌরীশঙ্করের একেবারেই নাপসন্দ ছিল, সেই বাঘের গুহায় মা ওকে নির্দ্বিধায় ঢুকিয়ে দিয়ে আসবে আজীবনের মত এটা ভাবতেই দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু বড়মামার কথা যে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে তার আভাস বাবা, মায়ের কথাতেই পেয়েছিলো ও। উমাশঙ্কর রায়চৌধুরীও সেদিন ঘরে বসেই বলছিলেন, বুঝলে নন্দিনী, তোমার দাদা কিন্তু প্রস্তাবটা খারাপ দেননি। উনি বিচক্ষণ মানুষ। ঠিকই বুঝেছেন, জমিদারী উঠে গেছে, সরকারের জমি অধিগ্রহণ কর্মসূচি চলছে চারদিকে। তাই গৌরীশঙ্কর যদি এই জমিদারীর ভরসায় জীবন কাটায় তবে বড়ই দুর্দিন আসছে। তার থেকে ছেলেটা তোমার দাদার মত মানুষ হোক। সুশিক্ষিত মানুষের সম্মান গোটা দেশময়। গৌরী না হয় মহেশডাঙার বাইরে পা দিয়েই বুঝুক জীবনটা কেমন। আমরা তো এই গ্রামের চৌহদ্দির মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। নন্দিনীদেবীর ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে উমাশঙ্কর বাবু বলেছিলেন, দূরে বিদেশে তো কোথাও যাচ্ছে না, যাচ্ছে তো তোমার বাপের বাড়িতে। তোমার বৌদি মানুষটিও বড় ভালো। গৌরীর অনাদর কোনোমতেই হবে না। তোমার কদিন কষ্ট হবে নন্দিনী, কিন্তু ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এটুকু কষ্ট তোমায় মানতে হবে বৈকি!
।। ৩।।
মায়ের ঘর থেকেই আওয়াজটা শুনতে পেল গৌরীশঙ্কর।
না না বিষ্ণু তুমি আর ওর হয়ে সালিশি করতে এস না বাপু। রায়চৌধুরী বাড়িতে একটা কুলাঙ্গার জন্মেছিল। এর থেকে এ বংশ নির্বংশ হলেই বোধহয় ভালো হতো। এ বংশের মান তো কবেই ডুবিয়েছে কাঞ্চনদীঘির জলে। এখন ঐতিহ্যটুকুও শেষ করে দিতে বদ্ধপরিকর। মায়ের গলার তীক্ষ্ন ব্যঙ্গাত্মক কথাগুলো শুনেই গৌরীশঙ্করের দিকে কয়েক পা এগিয়ে এলো মাধবীলতা। কিন্তু ঠোঁটটা অল্প ফাঁক করেই আবার বন্ধ করে নিলো। বোধহয় এই আলোচনা করার অধিকার ওর নেই বলেই এমন মৌনব্রত! গৌরীশঙ্করের ঠোঁটে করুণ হাসি। ওর চেনা সেই মাধবীলতার কি মারাত্মক পরিবর্তন। সেই কথায় কথায় কোমরে হাত দিয়ে রুখে দাঁড়ানো মেয়েটার যেন বিবর্তন ঘটে গেছে। পুনর্জন্ম নিয়েছে একটা মুখচোরা, নির্বিবাদী, ভাবনার জগতে বাস করা মেয়ে। এই মাধবীলতাকে গৌরীশঙ্কর চিনতো না কোনো কালে!
কিছু বলবে মাধবী? নিঃসংকোচে বলো, আমার কাছে দ্বিধা কিসের?
মাধবীলতা ধীর গলায় বলল, তোমার জন্য তোমার মা অপেক্ষা করছেন দক্ষিণের ঘরে। আমি এই কথাটা বলতেই এসেছিলাম। তারপর কাঞ্চনের সবজে জলে স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম।
গৌরীশঙ্কর বললো, তো কাঞ্চনের গভীর সবজে জলে আমারও একটা মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেছে। পারলে একটু খুঁজে দেখো। খুঁজে দিতে পারলেই পুরস্কার আছে।
মাধবী বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, কি জিনিস?
গৌরীশঙ্কর ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আমার পরিচিত মাধবীলতা।
ও পাশ থেকে জেঠিমা বলে উঠলো, দিনের বেলায় বেহায়াপনা এ বাড়ির কোনো পুরুষ করেছে বলে শুনিনি গৌরী! এ মেয়ে কি সব রকম ছলাকলা শিখেই এসেছে! আমি আর তোমার মা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি তোমার সাথে কথা বলবো বলে, যদি সময় পাও তো একবার পায়ের ধুলো দিও ওঘরে।
মাধবীলতা মাথায় ঘোমটা দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল।
ওর চলে যাওয়ার সময়ের সংকোচটুকু বলে গেলো, দোহাই, আর অপমান করো না আমায় তোমরা! সেদিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল গৌরীশঙ্কর রায়চৌধুরী। এ বংশের শেষ বংশধর।
মাধবীলতা হালকা পায়ে অন্দরে ঢুকে গেলো। যদিও মূল অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার ওর নেই। বৈঠকখানার পাশ দিয়ে নায়েবখানাকে উত্তরে রেখে যে মস্ত ঘরটাতে এখন মাধবীলতা প্রবেশ করলো সেটাকে এবাড়ির লোকজন ভদ্রভাষায় অতিথিশালা বলতো। গৌরীশঙ্কর ছোটবেলায় দেখেছে, এ বাড়ির বিশেষ অতিথি এলে এই ঘরেই রাজকীয় ব্যবস্থা করতেন দাদু। তারপর ধীরে ধীরে এ ঘর তার ঐতিহ্য হারিয়েছে গোটা রায়চৌধুরী বাড়ির মতই। এখন ভীষণ ভাবে আটপৌরে এর সাজসজ্জা। নেহাত পুরোনো আমলের মেহগনি কাঠের পালংক আর দেরাজ খানা আছে তাই ঘরটা জমিদারীর গন্ধ বহন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাধবীলতার স্থান হয়নি নন্দিনীদেবীর খাস অন্দরমহলে। তার ঠাঁই হয়েছে এই অতিথিশালা নাম বহনকারী ঘরটাতেই। মাধবীর অবশ্য তাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি তার কিছুতেই নেই। শুধু তার কারণে কেউ গৌরীশঙ্করকে অপমান করলে বড্ড অসহায় বোধ করে ও। তখন নিজেকে অকারণে দোষারোপ করে ক্ষতবিক্ষত করে ওর নিষ্পাপ মনটাকে।
গৌরীশঙ্করের হাজার নিষেধ সত্ত্বেও বারবার নিজেকে দোষারোপ করে যন্ত্রণা ভোগ করে মাধবীলতা। যন্ত্রণা, কষ্ট এগুলো পাওয়া যেন তার জন্মগত অধিকার।
গৌরীশঙ্কর অন্যমনস্ক ভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতেই এগোলো মায়ের ঘরের দিকে।
নন্দিনীদেবীর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার সব সময় দেখতে পায় গৌরীশঙ্কর। বন্ধুদের মুখে যে মায়ের বর্ণনা শুনেছে, তার সাথে ওর মায়ের যেন বড্ড পার্থক্য। ছোটবেলায় যদিবা স্নেহের স্পর্শ পেত, একটু বড় হতেই জমিদার গিন্নীর অহংকার বড় বেশি সুস্পষ্ট হতে লাগলো ওর চোখে। তখন থেকেই মায়ের গায়ে আর সেই নির্মল মা মা গন্ধটা পেত না গৌরীশঙ্কর। বরং দেখতো এক গা গয়না আর দামি শাড়ি পরে নির্দেশরত এক অপরিচিত মহিলা। যার কাছে রায়চৌধুরী বাড়ির ঐতিহ্য অনেক দামি একমাত্র সন্তানের জ্বরো কপালের চেয়ে। ছেলের মাথায় জলপট্টি দেওয়ার চেয়ে বর্গাদারদের সাথে হিসেব বুঝে নেওয়ায় ছিল বেশি উৎসাহ। মাতৃস্নেহ সেভাবে না পেয়েও মাকে সম্মান করে গেছে গৌরীশঙ্কর। কারণ স্বল্পপরিচিত দূরের ওই মহিলাকেই একমাত্র ও মা বলে ডাকতে পারতো। তাই নন্দিনীদেবীর অনেক অন্যায্য কথাও নির্বিবাদে মেনে নিয়ে এসেছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত। কিন্তু মায়ের সব আব্দার মানতে মানতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে গৌরীশঙ্করের। নিজের ইচ্ছেগুলোর জলাঞ্জলি দিয়েই ও মেনে নিচ্ছিল রায়চৌধুরী বাড়ির অযৌক্তিক নিয়ম কানুন।
বড় ঘরের কোণে একটা বিশাল আবলুস কাঠের পালংকে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন নন্দিনীদেবী। সামনে রুপোর ডাবর। তার থেকে পান সেজে দিচ্ছে বিন্দু পিসি। বিন্দু পিসিই গৌরীকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। মায়ের থেকে বয়েসে বছর দুয়েকের ছোটই হবে। কিন্তু বেঁটে বেঁটে গোলগাল চেহারার বিন্দুপিসির মুখে চোখে এখনো গ্রাম্য সরলতা। বিন্দু পিসিও একজনকে ভালোবাসতো। গৌরী জানতো তার কথা। কিন্তু নন্দিনীদেবীর কাছের বিশ্বস্ত চাকরানীর কোনোদিন বিয়ে হতেই পারে না, এমন সিদ্ধান্তে স্থির থেকেই বাড়ির ড্রাইভার গোবিন্দকাকাকে বিনাদোষে কাজ থেকে বিতাড়িত করেছিল মা। গোবিন্দকাকার অনেক কাকুতি মিনতিতেও গলেনি নন্দিনীদেবীর মন। বিন্দুপিসিকে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছিল ও। সেই থেকেই বিন্দুপিসি ওর মায়ের কথাবলা বাধ্য তোতাপাখি হয়েই রয়ে গেছে এবাড়ির অন্দরমহলে।
মায়ের পাশে জেঠিমাও বসে রয়েছেন দেখে ধীর নরম গলায় গৌরিশঙ্কর বললো, মা আমায় ডেকেছিলে?
নন্দিনীদেবী বিন্দুপিসির হাত থেকে পানটা নিয়ে মুখের মধ্যে ভরে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত মুখে বললো, অনেকক্ষণ ধরেই ডাকছিলাম শঙ্কর, কিন্তু আপাতত তোমার ফুরসৎ বড়ই কম মিলছে বলে শুনেছি। তা কলকাতার বাসাতেও কি আঁচলের নীচে থাকতেই ভালোবাসো? এবাড়ির কোনো পুরুষমানুষ নারীদের দ্বারা বশীভূত হয়নি বলেই জানতাম, তুমি দেখছি সব নিয়মের মত এই নিয়মটিও ভাঙতে উদ্যত হয়ে পড়েছো।
নেহাত কচি খোকাটা তো নয়। তোমার বাবার তোমার বয়েসে দুটো মেয়ের জন্ম হয়ে গিয়েছিল। তাই বিয়ের পরের মাদকতায় ভাসছ শুনতেও বড্ড শ্রুতিকটু আর কি। সে যাকগে, এবারের দুর্গাপুজোর বিষয়ে কথা বলতেই তোমায় ডাকলাম।
কুমারী পুজোয় এবাড়ির যা সর্বনাশ হয়ে গেছে তাতে আমি বাধ্য হলাম তোমার দাদুর প্রবর্তন করা পুজো বন্ধ করে দিতে। কুমারী পুজো ছাড়াই এবাড়ির দুর্গা পুজো হবে এবার। তোমার বাবার অকালে মৃত্যুর কারণও হয়তো তুমি আন্দাজ করতে পারছ! মানুষটা মনকষ্টেই শেষ হয়ে গেলেন। জমিদারী হারিয়ে তোমার দাদু এত কষ্ট পাননি, এবাড়ির ঐতিহ্য হারিয়ে তোমার বাবা যা পেলেন। আর সেটার কারণ যে তুমি সে বিষয়ে নিশ্চয়ই তোমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই! গতবছর কালাশৌচ ছিল বলেই নম নম করে পুজো সারতে হয়েছে। এবছর কিন্তু বেশ ঘটা করে করবো ভেবেছি। ব্যবস্থা করো শঙ্কর।
গৌরীশঙ্কর আমতা আমতা করে বললো, কিন্তু পুজোর তো অনেক খরচ! নন্দিনীদেবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে বললেন, কি বলতে চাইছো তুমি?
।। ৪।।
কি বললে তুমি? তুমি মামার বাড়ি চলে যাবে? এমন কথা তুমি বন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারলে? মাধবীলতা বেশ ছলছল চোখে তাকিয়ে বলেছিল গৌরীশঙ্করকে।
মহেশডাঙা ছেড়ে কলকাতা যেতে হবে ভেবেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়েছিল, তারপর মাধবীলতার চোখে জলের বিন্দুর আনাগোনা দেখে নিজেই কেঁদে ফেলেছিলো পুরুষত্বের অহংকারকে বর্জন করে।
নিজেকে সামলে নিয়ে গৌরীশঙ্কর বলেছিল, কেন তোমার তো নতুন বন্ধু হয়েছে দেখলাম। যাকে নিয়ে তুমি ক্রিকেট খেলছিলে। কদিন তো আমার ধারে কাছেও আসো নি।
মাধবীলতা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, ওকে মেরে ভাগিয়ে দিয়েছি। তুমি আমায় খেলা না নিলেও তুমিই আমার বন্ধু। করুণ স্বরে গৌরীশঙ্কর বলেছিল, আর খেলা! কদিনের মধ্যেই তো চলে যেতে হবে।
মাধবীলতা বয়েসের তুলনায় একটু বেশিই পাকা ছিল। গম্ভীর ভাবে বলেছিল, যখন বাড়ি ফিরবে তখন যেন দেখা করতে ভুল না। মনে রেখো এই মহেশডাঙায় একজন বন্ধু তোমার জন্য বসে আছে। কাঞ্চনদীঘির দিকে তাকিয়ে মাধবী বলেছিল, আমি সাঁতার শিখবো, পরেরবার তুমি যখন আসবে তখন তোমায় ওই পদ্মটা তুলে দেব। পুজোর সময় আমার হাতে পদ্ম ছিল বলে তোমার রাগ হচ্ছিল, তাই না? আমি তোমায় গোলাপী পদ্ম তুলে দেব।
গৌরীশঙ্কর মাধবীলতার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল, আমায় ভুলে যাবে না তো?
মাধবী নিজের কান্না ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলেছিল, ঠাকুররা কি কাউকে ভুলে যায়? আমিও তো কুমারী ঠাকুর, আমি কাউকে ভুলবো না।
গৌরীশঙ্করের মন ভালো করার জন্যই মাধবী বলেছিল, বেশ, আমি আজ বল করবো সারাক্ষণ আর তুমি ব্যাট।
খেলায় মেতে উঠেছিলো দুজনে। তারমধ্যেই ঘুরে ফিরে আসছিল গৌরীর মহেশডাঙা ছেড়ে যাবার দুঃখ।
মাধবীলতার সাথে খেলে বেড়ানোর দিন যে হাতেগোনা সেটা বুঝেই মান অভিমান ভুলে রোজ বিকেলে নিয়ম করে ওরা এসে বসছিলো কাঞ্চনদীঘির পাড়ে।
কচুপাতার ওপরে জলের ফোঁটা নিয়ে শুরু হতো দুজনের প্রতিযোগিতা। কতক্ষণ কার পাতায় জলের অস্তিত্ব বজায় থাকে তারই পরীক্ষা চলতো।
বেশিরভাগ দিনই জিতে যেত গৌরীশঙ্কর। কারণ মাধবীলতা স্বভাবে বড়ই চঞ্চল। এক সেকেন্ডও সে চুপ করে বসতে পারে না। জল ভর্তি কচুপাতা নিয়েই সে হুটোপাটি করতো। ফলস্বরূপ তারা পাতার জল খুব দ্রুত মাটি স্পর্শ করতো। ধীর, স্থির গৌরীশঙ্করের জয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে নিজের জেতার থেকেও হেরে গিয়ে মাধবীলতার মুখের বোকা বোকা হাসিটা দেখতে ওর ভারী মিষ্টি লাগতো। মনে মনে ভাবত, এমন দুষ্টু ঠাকুর হলে ভক্তদের যে কি হাল হবে। একদণ্ড স্থির নয় এমন চঞ্চল ঠাকুরকে হারিয়েও বেশ মজা হতো ওর। রাগ করে নিজের কচু পাতাটা মাটিতে ফেলে দিয়ে মাধবী বলতো, তুমি খুব পচা। আমায় একটা বাজে পাতা দিয়ে নিজে ভালো পাতাটা নাও, তাই আমার পাতায় কিছুতেই জল দাঁড়ায় না।
পরক্ষণেই মেতে উঠতো খেলনা বাটি খেলতে। জেনে নিতো গৌরীশঙ্করের পছন্দের পদগুলো। তারপরেই ওর তৈরি মাটির উনোনে নারকেলের মালাইয়ে রান্না হত কাতলা মাঝের কালিয়া। কবে যে নিজের পছন্দ ভুলে গৌরীর পছন্দ মতই রান্নার মেনু ঠিক করতে শুরু করেছিল মাধবীলতা সেটা বোধহয় ও নিজেও জানে না। তবে এটুকু জানতো, গৌরীশঙ্কর কাতলা মাছের কালিয়া, সোনামুগের ডাল, মুড়িঘন্ট, বড়ি দিয়ে সুক্ত ভীষণ ভালোবাসে। যদিও কি করে সেসব পদ রাঁধতে হয় তা জানত না মাধবী, তবুও ওর ধুলো বালির সরঞ্জামেই রান্না হতো গৌরীশঙ্করের সব পছন্দের পদগুলো। গৌরীও মাধবীলতার মুখে হাসি দেখবে বলেই মিথ্যে অভিনয় করতো। পাতার ঝোলে হাত ডুবিয়ে মুখে আওয়াজ করে বলতো, উফ দারুণ হয়েছে মাছের ঝালটা। আমাদের বাড়ির বামুনও এমন রাঁধতে পারে না। ঝলমলে হয়ে উঠত মাধবীলতার চোখ দুটো। ঠোঁটের কোণে হালকা লজ্জা মিশিয়ে বলতো, তোমার ভালো লেগেছে আমার রান্না? আমার বাবা বলে আমার মেয়ের মতন রাঁধতে এ দুনিয়ায় কেউ পারে না। আমি তো বাবাকেই এতদিন রেঁধে খাওয়াতাম। বাবা বলে, আমি মায়ের চেয়ে ঢের ভালো রাঁধি।
রমেশ ঘোষাল ওদের বাড়ির কুলপুরোহিত। রমাকাকাকে ছোট থেকেই দেখেছে ওদের গোপালের মন্দিরে পুজো করতে ঢুকতে। নেহাতই নিরীহ মানুষ। সাত চড়ে রা করেন না। বরং গোপালের নাড়ু, ভোগ গৌরীর হাতে দিয়ে বলেন, খাও বাবা। এ বংশ যে তোমায় রক্ষা করতে হবে। তোমার অনেক দায়িত্ব।
সেই রমেশকাকার মেয়ে কিনা এমন ডাকাত!
এতদিন বাবাকে ধুলো বালির মাছ, তরকারি খাইয়ে সাধ মেটে নি, এখন আবার গৌরীশঙ্করকে পাকড়াও করেছে।
একমুহূর্ত স্থির নয় এই মেয়ে। চোখের পলকে গাছের ডাল থেকে পা ঝুলিয়ে বলেছে, পেয়ারা খাবে?
হি হি করে হেসে বলেছে, এতক্ষণ তো মিছিমিছি খাবার খেলে। পেট তো ভরেনি! এই নাও ভালো পেয়ারা খাও।
ওকে গাছের ডালে বসে থাকতে দেখে শঙ্কিত হয়ে ও বলেছে, নেমে এস বলছি। পড়ে যাবে যে, হাত, পা ভাঙবে!
মেয়েটা আরো জোরে হেসে উত্তর দিয়েছে, আহা, ভীতুরাম জমিদার। গাছেও উঠতে পারেনা। সাঁতারও কাটতে পারেনা। মুখ ভেঙিয়ে উঠে গেছে আরও উঁচুতে। নীচে দাঁড়িয়ে গৌরী ভগবানের নাম জপেছে। মনে মনে বলেছে, মেয়েটার যেন কিছু না হয়। মাধবী ফ্রকের মধ্যে করে পেয়ারা এনে ওর হাতে দিয়ে বলেছে, নাও খাও। কিছুই তো পারো না, পুরো সংসারই আমায় সামলাতে হবে। উফ, আর পারি না বাবা। পাক্কা গিন্নীর সামনে গৌরী চিরকালই অসহায়ের মত হেসে বলেছে, গাছে উঠলে দাদু বকবে। সেই ছোটবেলা থেকেই গৌরীশঙ্করের ধারণা হয়েছিল, ওর থেকে বয়েসে ছোট মেয়েটা বোধহয় অনেক ক্ষমতার অধিকারিণী, তাই ওকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করা হলো। মাধবীলতা সঙ্গে থাকলে কোনো বিপদ স্পর্শ করতে পারবে না গৌরীশঙ্করকে।
মাধবীর সাথে বন্ধুত্ব হবার পরে পাড়ার ছেলেরা ভেংচি কেটে বলেছে, জমিদারবাড়ির ছেলের বন্ধু কিনা শেষ পর্যন্ত একটা পুচকে মেয়ে! ওর রাগ হয়নি, বরং ভালো লেগেছিল, কারণ মাধবীলতাকে ও বিশ্বাস করত।
কিন্তু ওর মহেশডাঙা ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন অনেক চেষ্টা করেও মাধবীর সাথে দেখা করতে পারে নি ও। ওদের সব খেলার জায়গা, লুকোচুরির লুকোনোর সমস্ত সম্ভাব্য জায়গা খুঁজেও মাধবীর দর্শন পায়নি। আগেরদিন মাধবী কত কথা বলেছিল, কিন্তু যাওয়ার দিন ওকে না খুঁজে পেয়ে খুব মনখারাপ হয়েছিল গৌরীর। বড় মামার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল গেটের বাইরে, মা, বাবা এমনকি দাদুও মুখ কালো করে দাঁড়িয়েছিল। তাই মাধবীর সাথে দেখা না করেই গাড়িতে চাপতে হয়েছিল ওকে।
মাও সঙ্গে এলো না। মামাই বোধহয় বলেছে, ওকে বড় হতে দে, ইমোশন কন্ট্রোলের জিনিস, সেটাই কর নদী।
কষ্ট হচ্ছিল খুব, ভীষণ রকম কান্না পাচ্ছিলো গৌরীশঙ্করের। কিন্তু মাধবীলতা বলেছিল, ভীতু, বাচ্চা ছেলেরা কাঁদে, তুমি কি তাই?
ওই কথাটা শোনার পর থেকে নিজেকে বড় প্রমাণ করার তাগিদেই কান্নাকে কন্ট্রোল করে ও। তবুও আজ বড় বড় দুটো ফোঁটা জল ওর গাল বেয়ে টুপ করে পড়েছিলো হাতের চেটোতে।