নীলকণ্ঠের পুজো
মন্দিরের গর্ভগৃহ পরিচ্ছন্ন করে বাগানের ফুল তোলায় ব্যস্ত ছিল মধুবালা। পুরোহিতমশাই উপস্থিত হবার সময় আসন্ন। রক্তকরবীর সাজিটা ধীরে ধীরে ভরে উঠছে রক্তিম পুষ্পে। মন্দিরের গর্ভগৃহে যে নীলকণ্ঠের মূর্তি আছে তার পুজো নীল অপরাজিতা দিয়ে হয় না। তার পুজোয় লাগে রক্তকরবী। বিষপুরের এই নীলকণ্ঠ মন্দির বিশেষ জাগ্রত। মন্দিরের ওপরের ঘরে শুধু একটা পিতলের ঝকঝকে ত্রিশূল বসানো আছে। তাতে আকন্দের মালা জড়ানো থাকে। পুজো হয় গোটা দশেক সিঁড়ি অতিক্রম করে এসে এই অন্ধকার গর্ভগৃহে। দিনের প্রখর সূর্যের আলোরও তিলমাত্র প্রবেশের অধিকার নেই এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গর্ভগৃহে। দেওয়ালে ঘিয়ের মশালে দিনের বেলাতেও ছায়া ছায়া রহস্যময় হয়ে ওঠে গর্ভগৃহ। তার মধ্যেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিত চিত্তহরণ চাটুজ্জে রক্তকরবীর গায়ে রক্ত চন্দন লেপন করে নীলকণ্ঠের চরণে অর্পণ করেন।
চিত্তহরণ পণ্ডিতের একমাত্র কন্যা মধুবালা। রূপে গুণে অনিন্দিতা। তার গানের গলাটিও অতি মধুর।
কিন্তু তার একটা বিশেষত্বের কথা সম্ভবত বিষপুরের কেউ জানে না। বোধহয় মাতৃহীনা কন্যা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান নেই স্বয়ং পণ্ডিত চিত্তহরণ চাটুজ্জেরও। একমাত্র গর্ভগৃহের নীলকণ্ঠ আর মধুবালা জানে যে নীলকণ্ঠের সামনে একান্তে গিয়ে দাঁড়ালে তার পায়ে তাল ওঠে। নীলকণ্ঠকে গান শোনাতে শোনাতে অতর্কিতে মধুবালার গোটা শরীর বাঙময় হয়ে ওঠে। বেখেয়ালে সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যও পরিবেশন করে ও।
নীলকণ্ঠ যেদিন প্রসন্ন হন সেদিন একটি রক্তকরবী তার চরণ থেকে গড়িয়ে পড়ে মধুবালার সম্মুখে। আশীর্বাদী ফুলটা সযত্নে রেখে দেয় ও। এত বছরে এমন আশীর্বাদী ফুলের সংখ্যা মাত্র চারটে। মধুবালা মনে মনে ভালোবাসে নীলকণ্ঠকে। সেই শিশুবেলা থেকে ও উঠতে বসতে বাবার কাছে শুনেছে নীলকণ্ঠের স্তুতি। তাই নিজের অজান্তেই যৌবনে উত্তীর্ণ হয়ে মনপ্রাণ সমর্পণ করেছে নীলকণ্ঠকে। মধুবালার কোনো সঙ্গীসাথী নেই। গৃহস্থ সংসারের কাজের অতিরিক্ত সময় ও অতিবাহিত করে ফুল তুলে, মালা গেঁথে, চন্দন বেঁটে, নীলকণ্ঠকে পরিপূর্ণভাবে সাজিয়ে।
রক্তকরবীর মালাটা গাঁথা শেষ হতেই গর্ভগৃহের ভারী কাঠের দরজায় একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজ হলো। সচকিত হলো মধুবালা। একমাত্র চৈত্রমাসের সংক্রান্তি ছাড়া এ গর্ভগৃহে প্রবেশের অধিকার সাধারণ মানুষের নেই। চৈত্রমাসের সংক্রান্তি তিথিতে নীলকণ্ঠ তার দুয়ার খুলে দেন জনসাধারণের জন্য। ওইদিন মধুবালা একটা বিশেষ কাজে নিযুক্ত থাকে। শ শ ফুলের মালা পড়ে নীলকণ্ঠের উদ্দেশ্যে। প্রত্যেকেরই আকাঙ্ক্ষা জাগে তার নিয়ে আসা মালাটা পরানো হোক বিগ্রহের কণ্ঠে। মধুবালা সেটাই করে। বাবার নির্দেশে প্রত্যেক দর্শনার্থীর মালা একবার করে অন্তত পরিয়ে দেওয়া হয় ত্রিভুবনেশ্বরের কণ্ঠে। সেদিন বিষপুরের নীলকণ্ঠ মন্দিরের সামনে বিশাল মেলা বসে। পাড়ার মেয়েরা গিয়ে কাঁচের চুড়ি কেনে। মধুবালারও ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে কাঁচের চুড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রংমিলান্তি খেলায় মাততে। কিন্তু সেই কোন ছোটবেলা থেকেই ও শুনে আসছে ও নাকি নীলকণ্ঠের বিশেষ কাছের। নীলকণ্ঠ নাকি তার সেবায় নিয়োজিত করবে বলেই জন্ম দিয়েছেন মধুবালার। তাই আর পাঁচজন সাধারণের মত আচরণ ওর কাছ থেকে আশা করেন না স্বয়ং পণ্ডিত চিত্তহরণ চাটুজ্জে। এভাবে অন্তরের সব ইচ্ছেকে দমন করেই যৌবনে পা রেখেছে মধুবালা। তাই কাঁচের চুড়ির হাতছানিকে উপেক্ষা করে ও মেতে ওঠে ধূপ-ধুনোর গন্ধে।
এই মুহূর্তে পিছনের দিকে না তাকিয়েও ও বলে দিতে পারে বাবা এসেছেন। পুজোর উপাচার প্রস্তুত হলে পুজোয় বসবেন বলেই উপস্থিত হয়েছেন চিত্তহরণ। এ তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। পূজারী ব্রাহ্মণ হিসাবেই দেবোত্তর এই বিশাল বাগানবাড়ি সহ মন্দিরের অধিকার ভোগ করছে চাটুজ্জে পরিবার।
বংশপরম্পরায় বিষপুরের নীলকণ্ঠ মন্দিরের পূজারী ওরা। চিত্তহরণও শিশু বয়েস থেকে ওর বাবার সঙ্গে মন্দিরে আসতেন পুজো শিখতে। মধুবালাও পুজোর মন্ত্র সবই জানে, কিন্তু মেয়ে বলে পুজোর অধিকার থেকে বঞ্চিত। মধুবালার রজস্বলার দিনগুলোতে বড় বিপদে পড়েন চিত্তহরণ। সবটুকু তখন স্বহস্তে করতে হয় ওনাকে।
গর্ভগৃহের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন চিত্তহরণ, মা মধুবালা পুজো শুরুর সময় উপস্থিত, তোমার কি বিলম্ব হবে? মধুবালা সচকিত হয়ে বললো, আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে। তুমি আসন গ্রহণ করো।
নিবিষ্ট মনে নীলকণ্ঠের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন চিত্তহরণ। তখন শুধু তার ঠোঁট দুটো নড়ে।
গর্ভগৃহে বসেই সৈন্যদের পদচারণা শুনতে পেলেন চিত্তহরণ। একটু বিচলিত হলেন যেন। মধুবালা ভীত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, কোনো গোলযোগ?
চিত্তহরণ নীলকণ্ঠের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললেন, বাগানের চৌহদ্দির বাইরে পা রাখবে না এখন। যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বিষপুরের জঙ্গল দিয়েই সৈন্যদের আনাগোনার পথ ঠিক করেছেন স্বয়ং বাদশাহ মুসাফির। তাই মন্দিরের পাশ দিয়েই ওরা সড়কে ওঠার রাস্তা বানাচ্ছে। তুমি এ সময় বাইরে যেও না একেবারেই। সদ্য আঠেরোর উদ্ভিন্ন যৌবনা মধুবালা ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, নয়না নদীর ধারেও যাবো না? চিত্তহরণ বিরসবদনে বললেন, না।
বাইরে সৈন্যদের পদচারণাকে উপেক্ষা করেই পূজার্চনায় বসলেন চিত্তহরণ। উচ্চারণ করলেন…’নাগেদ্র হারায়া ত্রিলোচনায়া, ভাশমাঙ্গে রাগায়া মহেশ্বরায়া, নিত্যায়া শুদ্ধায়া দিগমবারায়, তাসমৈ না কারায়া নমহ শিবায়’।
.
মধুবালা হাতজোড় করে বসলো বাবার পাশে।