অনুভবে তুমি – ১
।।১।।
আকাশটা লালচে ঘোলাটে, ঘড়ির ডিজিটাল অক্ষরগুলো জানান দিচ্ছে সূর্য উঠতে এখনও বেশ খানিক দেরি আছে। যদিও নৈঋতের সকাল হয় বেলা নটার সময়। তাই এমন ঘোলাটে প্রভাতের দর্শন ও শেষ কবে করেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। স্টেশনের এককোণে বসে আছে নৈঋত, একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে। গাছটা যে ঠিক কি গাছ চেনার চেষ্টা করলো একটু। অপারগ হয়ে আরেকবার তাকালো ঘড়ির দিকে। মুশকিল হচ্ছে মোবাইলটা অন করতে পারলে হয়তো অনেককিছুই আবিষ্কার করতে পারতো, বিশেষ করে এই স্টেশন থেকে বেরোনোর উপায়টাও, কিন্তু আপাতত ওকে মোবাইলটা সুইচড অফ রাখতে হয়েছে। এখনও ভাবলে গাটা কেমন শিরশির করছে, জীবনে এই প্রথমবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল ও। এখনও মেয়েটার চন্দন পরা মুখটা ভাসছে চোখের সামনে। বাংলায় কি যেন একটা কথা— আছে লগ্নভ্রষ্টা, ও কি ঐভাবেই ছেড়ে এলো মেয়েটাকে! জমকালো বিয়ে বাড়ি, মেয়ের পরণে লালচে বেনারসি, ফুল দিয়ে সাজানো বিবাহবাসর, মেয়ের মা এসে প্রায় হাতজোড় করে বলেছিল, নৈঋত বড় কষ্ট করে মানুষ করেছি মেয়েটাকে, একটু আগলে রেখো। সব তো ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল, তারপর কেন যে কাউকে কিছু না বলে এতবড় সিদ্ধান্তটা একা নিয়ে ফেললো নৈঋত সেটা ও এখনও জানে না। বুকের ভিতরটা এখনও ধুকপুক করছে ওর। জীবনে প্রথম বার এলো এই রাইগঞ্জ নামক মফঃস্বলে। এসেছিল তো বরের গাড়ি করে! এখান থেকে ট্রেনে করে কি ভাবে কলকাতা ফিরবে সেটাই চিন্তার বিষয়। তাছাড়া ওর পরনে আছে ধুতি আর পাঞ্জাবি। ধুতি জীবনে এই প্রথম পরলো নৈঋত, তাই অলরেডি বার তিনেক হোঁচট খেয়েছে ও। যে লোকটা স্কুটি করে ওকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েই হাওয়া হয়ে গেল তাকে জিজ্ঞেস করলে হতো, ফার্স্ট ট্রেন কটায় আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ও ওদের যাদবপুরের বাড়িতে যাবেই বা কি করে! আজ তো ওদের বাড়িতে ভর্তি লোকজন। নৈঋত বউ নিয়ে ফিরবে আর মা বরণ করবে এটাই প্ল্যান করা ছিল।
নৈঋত বসু, পেশায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের লেকচারার। স্বভাবে একটু উদাসীন। তবে মিশুকে বলেও নাম আছে ক্লোজ সার্কেলে। বিশেষ করে বসু পরিবারের আইডল হিসাবে নৈঋত বসুর নাম বরাবরই একবাক্যে উচ্চারিত হয় পিসি, মাসি, কাকু, জেঠু মহলে। নৈঋতের বাবা রেলের বড় অফিসার, মাও রেল কর্মী। একমাত্র সন্তানের বিয়েতে সব স্বাদ পূরণ করবার এক অদমনীয় নেশায় পেয়ে বসেছিলো কাবেরী বসু অর্থাৎ নৈঋতের মাকে। তাই বিয়ের তিনদিন আগে থেকেই ওদের যাদবপুরের বাড়ির গেটের ওপরে নহবৎখানা থেকে ভেসে আসছিল সুরেলা সানাইয়ের সুর। নীলাদ্রি বসু বরাবরই কথা কম কাজ বেশি মন্ত্রে বিশ্বাসী। একটু গভীরে ভাবতে ভালোবাসেন। তিনিও একমাত্র সন্তানের বিয়ে উপলক্ষ্যে কোনো ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেননি।
শেষ অগ্রহায়ণের নরম শীতেও কুলকুল করে ঘেমে উঠছিলো নৈঋতের পাঞ্জাবিটা। বিয়ের আসর থেকে ড্রেস চেঞ্জ করার নাম করে ও পালিয়ে এসেছে, এখবর নিশ্চয়ই এতক্ষণে বসুবাড়িতে নাগাসাকির বোমার মতই উৎক্ষেপিত হয়েছে। পায়ে পায়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে এগোলো নৈঋত। হাওড়া ফেরার ব্যবস্থা তো করতে হবে। উঠে দুপা এগিয়েছে আর ঘোলা অন্ধকারে একটা মানুষের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা। এমনিতেই বর্তমান পরিস্থিতির আতঙ্কে ওর মাথা কাজ করছিল না, তাতে এমন জোরে ধাক্কাতে ও আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, একটু তো সাবধানে চলুন। এভাবে মানুষকে মেরে জনসংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা যদিও নিয়ে থাকেন তবুও বয়েস দেখে ধাক্কা মারুন। আমি সদ্য ঊনত্রিশ। নিজের হাঁটুর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তেই কথাগুলো বললো নৈঋত। এতক্ষণে খেয়াল করলো, ধাক্কা দেওয়া পাবলিকটি পুরুষ নয়, মহিলা। জিন্স, পুলোভার পরে আছে বলে প্রথম চটকে এতটা খেয়াল করেনি নৈঋত। মেয়েটি বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল, আপনাদের মত কেয়ারলেস পাবলিকের জন্যই আজকাল রাস্তাঘাটে অ্যাক্সিডেন্টের পরিমান বেড়ে গেছে বুঝলেন! মেয়েটাও প্লাটফর্ম থেকে নিজের হাতের ব্যাগটা তুলে ধুলো ঝেড়ে নিলো।
একটা অন্তত সোয়েটার পেলে এতটা কষ্ট হতো না নৈঋতের, ফিনফিনে গরদের পাঞ্জাবিতে কেমন যেন কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে ওর। নিজের পরিচিত গন্ডির বাইরে নৈঋত বরাবরই একটু অস্বস্তিতে ভোগে, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। কমফোর্টজোন থেকে বেরোতেই মনে হলো, পৃথিবীটা যেন কেমন থমকে আছে। সত্যি বলতে কি ও যে কত বছর ট্রেনে চাপেনি সেটাও মনে করতে পারলো না। নিজস্ব গাড়িতে সর্বত্র যাওয়ার অভ্যেসটা যে ঠিক কতটা খারাপ, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে ও।
মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো টিকিট কাউন্টারের দিকে। এতক্ষনে ওরও মনে হলো, টিকিট তো কাটতেই হবে। পায়ে পায়ে ঐদিকেই এগিয়ে গেল নৈঋত, যদিও এই মুহূর্তে ওর গন্তব্য ঠিক কোথায়, ও নিজেও জানে না!
।।২।।
ফোন করে বারবার অনুরোধ করেছিল সুচেতা, অনিরুদ্ধরও যে একেবারেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না এমন নয়। বরং একটু বেশিই ইচ্ছে ছিল, লাল বেনারসিতে মেয়েটাকে কেমন লাগবে সেই শুভ মুহূর্তে সেটা দেখার লোভ তো অবশ্যই ছিল। দাদাবাবু হিম পড়ছে তো, আপনি এখন উঠোনে কি করছেন! এখনও তো আপনার মর্নিং ওয়াকের সময় হয়নি! নাকি মাঝরাতেই হাঁটতে বেরোবেন? বছর পঞ্চাশের বেঁটেখাটো লোকটার যেন জন্মই হয়েছে অনিরুদ্ধর খেয়াল রাখবে বলে। বিজু, তুমি বিয়েটা কেন করলে না বলতো? যদি তোমার একখানা গোছানো সংসার থাকতো তাহলে তো আর চব্বিশঘণ্টা আমার প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করতে না! অনিরুদ্ধর মুখে এসব কথা বিজু মানে বিজয়চাঁদ এতবার শুনেছে যে, এখন আর তার মধ্যে বিশেষ হেলদোল হয় না। কিন্তু বিজু জানে, সে ছাড়া মানুষটার আর কেউ নেই। সংসার, সন্তান সব থাকতেও মানুষটা বড্ড একা, তাই বিজুকে এখান থেকে চলে যেতে বললেও ও নিরুপায়। ও বাজারে গেলেও দাদাবাবু অস্থির হয়ে ওকেই ডাকে বারবার।
বিজু নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো, সে আমি বিয়ে করলেই আপনার নিস্তার মিলতো এমন কেন ভাবছেন! অনিরুদ্ধর থেকে বছর নয়-দশের ছোট হবে বিজু, কিন্তু ওর গাট্টাগোট্টা গড়নের জন্যই বয়েসটা বোঝা যায় না। আর সর্বদা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলেই কোনোরকম জটিলতা ওকে স্পর্শ করতে পারেনা।
অনিরুদ্ধ আবার বললো, তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়টা বড্ড কাকতলীয় ছিল তাই না বিজু। দেখতে দেখতে হয়েও গেল প্রায় বছর ছয়েক তুমি আমার কাছে আছো, তাই না?
বিজু মাথা নেড়ে এক মুখ হেসে বললো, আপনি বাঁচিয়েছিলেন বলেই তো বেঁচে আছি। নাহলে তো পাবলিকের মারে তখনই দেহ রাখতাম। অনিরুদ্ধ হেসে বললো, পকেটটা সেদিন সত্যিই তুমি মারোনি বলছো!
এই একটা কথা বললেই বিজয়চাঁদের কানের লতি গরম হয়ে যায়, অভিমানী মুখ করে বলে, আমি খেটে খাওয়া মানুষ, আমি কেন পকেট মারতে যাবো? ওসব ছোটকাজ আমি করিনি দাদাবাবু। অনিরুদ্ধ জানে বিজু পকেট মারেনি সেদিন। নিজে চোখে অন্য একজনকে পকেট কাটতে দেখেছিলো অনিরুদ্ধ। যে পকেট কেটেছিল সে গলে পালিয়েছিল নিজস্ব কায়দায়। ভদ্রলোকের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বিজু, তাই লোকজন ওকেই সন্দেহ করে মারতে শুরু করেছিল। অনিরুদ্ধই সেদিন বিজুকে বাঁচিয়েছিল। শুধু মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল এমন নয়, ওকে এনে তুলেছিল ওর বাগানবাড়িতে। সূর্যপুরের এই বাগানবাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বও দিয়েছিল বিজুকে। তখনই শুনেছিল, সংসারে ওর কেউ নেই। একা থাকে একা খায়।
কি হলো, বললে না তো, বিয়েটা কেন করলে না?
বিজু করুণ হেসে বললো, আমার বাপ দিলো না যে। মেয়েটা দেখতে সুন্দর ছিল, লেখাপড়া জানতো, গান গাইতো, ঘরের কাজ পারতো, কিন্তু মেয়ের বাপটা ছিল গরিব। বিয়ের রাতে পণের টাকার জন্য আমার বাপ আমায় বিয়ের আসর থেকে টেনে নিয়ে চলে এসেছিল। সেই থেকে এতগুলো বছর ওই মেয়েটার ভেজা চোখ দুটো আমায় তাড়িয়ে বেরিয়েছে। পালাতে পালাতে এসে পৌঁছেছিলাম কলকাতায়। বাপ আমার আবার বিয়ে দেবে মনস্থ করেছিল, সেদিনই ঘর ছেড়েছিলাম। পাপ করেছিলাম গো দাদাবাবু। তখন অল্প বয়েস, বাপের মুখের ওপর কিছু বলতে পারিনি, কিন্তু ওই লক্ষ্মীপ্রতিমার মত মেয়েটাকে লগ্নভ্রষ্টা করে পাপ করেছিলাম।
অনিরুদ্ধ বললো, সেকি! তবে থেকে তুমি নিজের থেকেই নিজে পালিয়ে বেড়াচ্ছ! সবটা খুলে বলো তো একদিন, একটা বেশ বড় করে স্টোরি করাবো তোমার জীবনকাহিনী নিয়ে। বিজু হেসে বললো, পালিয়ে বেড়াচ্ছে যে তার আবার জীবনকাহিনী বেরোবে কাগজে? তাহলে আর পালিয়ে পালিয়ে কি লাভ হলো?
।।৩।।
পালিয়েছে মানে, কে পালিয়েছে নীলাদ্রি? আরে চুপ করে কেন আছো? কিছু তো বলো? ফোনের অন্য প্রান্তে উদ্বেগে ছটফট করে উঠলো কাবেরীর গলাটা। কি বলছো, ক্লিয়ার করো। নৈঋত পালিয়েছে মানে? না মানে বিয়ের আসর থেকে টুটাই পালালো আর তোমরা চুপচাপ দেখলে? আর হঠাৎ টুটাই পালাবেই বা কেন? টুটাই তো এ বিয়েতে অমত করেনি, অহনাকে তো ওর অপছন্দও হয়নি। তাহলে হঠাৎ পালাবে কেন? নীলাদ্রি, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ? নীলাদ্রির গলাটা বেশ গম্ভীর। একটু থেমে থেমে বললো, কাবেরী জীবনে কখনো এত অপমানিত হইনি বিশ্বাস করো। এদের বাড়ির সকলে আমার দিকে আঙুল তুলছে। আমি নাকি টুটাইকে সঠিকভাবে মানুষ করতেই পারিনি। কাবেরীর কাছে এখনও সবটাই বেশ ধোঁয়াশায় ঢাকা। নীলাদ্রি আক্ষেপের সুরে যেগুলো বলছে তার থেকে বেশি প্রয়োজন বিয়ের আসরে ঠিক কি হয়েছিল জানাটা। নীলাদ্রি কতটুকুই বা সময় দিয়েছে টুটাইকে, নিজের সমস্ত কাজ সামলে ওকে একটু একটু করে বড় তো করেছে কাবেরী। তাই সব দিক থেকে বাধ্য একটা ছেলে হঠাৎ বিয়ের আসর থেকে কেন পালালো সেটা জানার জন্যই মনটা উতলা হয়ে উঠলো ওর। টুটাইয়ের কোনো দোষ আছে এটাই যেন ভাবতে পারছে না কাবেরী। প্রতিটা মা-ই বোধহয় নিজের সন্তানের দোষ খুঁজে পায় না, সেই তথ্যে অবশ্য কোনোদিনই বিশ্বাসী ছিলনা ও। ছোটবেলায় টুটাই কখনো কারোর সঙ্গে মারপিট করলেও কাবেরী খুঁজে বের করতো দোষটা আসলে কার। ছেলে মিথ্যে বলছে কিনা জানাটা ছিল ওর কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবারই কাবেরী দেখেছে টুটাই দোষ করলে নিজে বাড়িতে এসে সত্যিটা বলেছে। সেই নার্সারী থেকে কাবেরীর একটা অদ্ভুত ধারণা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল, টুটাই দুষ্টুমি করতে পারে, অবাধ্য হতেও পারে কিন্তু মিথ্যে বলবে না। কাবেরী এই সম্বন্ধ ঠিক করার সময়েই ওকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, ও কোথাও এনগেজড কিনা, যদি কাউকে পছন্দ থাকে তাহলে কাবেরীর কোনো প্রবলেম নেই তাকে বৌমা হিসাবে মেনে নিতে। তখন টুটাই হাসতে হাসতে বলেছিল, অন্য ধর্মের হলেও অসুবিধা নেই মা?
কাবেরী একটু থমকে ছিল বৈকি, তারপর ঘাড় নেড়ে বলেছিল, না নেই। তোর পছন্দই শেষ কথা তোর জীবনে।
কাবেরীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল নৈঋত, ফিসফিস করে বলেছিল, আমি মজা করছিলাম মা, সত্যিই আমি এনগেজড নই, তবে বিয়েটা আর কয়েকদিন পরে করলে কি একান্তই চলছিল না?
কাবেরী হাসি মুখে বলেছিল, ধুর বোকা ছেলে, বিয়ে বললেই কি বিয়ে! মেয়ে খুঁজতে খুঁজতেই বছর দুয়েক লেগে যায় কারোর কারোর। আমি শুধু তোর মতামতটুকু জানলাম, এবারে কলিগ, পরিচিত এদের বলবো, আর ম্যাট্রিমনি সাইটে একটা অ্যাকাউন্ট খুলবো তোর ছবি দিয়ে। নৈঋত হেসে বলেছিল, বুঝতে পারছি রিটায়ারমেন্টের বছর পাঁচেক আগে সিনিয়রদের কাজ কমিয়ে দেয় রেল, তাই আমার মা নতুন একটা কাজ খুঁজছে। কাবেরী চোখ পাকিয়ে বলেছিল, চুপ কর পাকা ছেলে, বাবা-মায়ের কত দায়িত্ব তুই এখন কি বুঝবি! অবশ্য তোর বাবাও তো আমার কাঁধে দায়িত্ব ফেলে দিয়ে গোটা জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিলো। এবারে আমার টুটাইয়ের যোগ্য মেয়ে খুঁজতে হবে।
কাবেরী তো সেদিন টুটাইয়ের কথায় কোনো অমত দেখেনি! তবে কি অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসতো ও, সেটাই মায়ের সামনে বলতে পারেনি? কিন্তু এতদিনে মাকে এই চিনলো টুটাই? কাবেরী কাছে একটা ভালো মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, টুটাইয়ের পছন্দ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ধর্ম তো নয়!
সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ওর। অহনাকে অবশ্য কাবেরীই পছন্দ করেছিল। কিন্তু টুটাইয়েরও যথেষ্ট পছন্দ ছিল বললেই জানিয়েছিল ও। সেইজন্যই সম্বন্ধটা এগিয়েছিলো কাবেরী। আরেকটু পরেই বাকি আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করবে। কাবেরীর বেশ কিছু কলিগও আসবে আজকে। বৌভাতের দিনেও তাদের নিমন্ত্রণ করেছিল ও। শুধু ফুলশয্যা নয়, বিয়ের তিনটে দিন দুর্দান্ত করে সাজিয়েছিলো কাবেরী। ওর আর নীলাদ্রির যখন বিয়ে হয়েছিল তখন ওরা দুজনেই কম মাইনে পেত, তারপর ছিল সংসার গড়ার খরচ। নিজেদের সব শখ পূরণ করতে পারেনি বিয়েতে। তাই ভেবেছিল, একমাত্র সন্তানের বিয়েতে সে শখ মেটাবে। কতদিন ধরে অফিসের পরে ঘুরে ঘুরে অহনার জন্য শাড়ি পছন্দ করেছে কাবেরী, মনের মত গহনার জন্য ঘুরেছে দোকানের পর দোকান। এত পরিশ্রম, এত স্বপ্ন সব কিছু এভাবে ধূলিস্যাৎ করে দেবে টুটাই, এ যেন অবিশ্বাস্য লাগছে ওর। টুটাই পর্যন্ত বকতো কাবেরীকে, মা প্লিজ আমার বিয়ে নিয়ে তুমি এমন পাগলামি করো না, এবার অতি পরিশ্রমে তোমার শরীরটা ভেঙে যাবে। অহনার মিষ্টি মুখটা ভাসছে চোখের সামনে, কি উত্তর দেবে মেয়েটাকে? নিজের ছেলেটাকে কি তবে মানুষই করতে পারেনি কাবেরী! এভাবে ব্যর্থ হলো ওর সব প্রচেষ্টা। বাড়ি ভর্তি লোকজনের সামনে কিভাবে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াবে? এলোমেলো ভাবনার মাঝেই ফিসফিস করে বলে উঠলো, নীলাদ্রি, ছেলেটা কখন পালালো? ও তো রাইগঞ্জে প্রথমবার গেলো গো, ওখানের তো কিছুই চেনে না! কেন যে আমি অহনার মায়ের কথায় রাজি হতে গেলাম! কলকাতা থেকে বিয়েটা হলে এমন বিপদ বোধহয় হতো না! অহনার মা যে কেন বললো, ওদের দেশের বাড়ি থেকে বিয়েটা দিতে চায়, আমিও রাজি হলাম। ফোনটা কানে চেপে নিজের মনেই এলোমেলো বলে যাচ্ছিল কাবেরী। নীলাদ্রির দীর্ঘশ্বাস ছাড়াও আরও কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছিল, সেগুলো বোধহয় বিয়ে ভেঙে যাবার পরে মেয়ের আত্মীয়স্বজনদের কথাবার্তা। ভালো করে শোনার চেষ্টা করলো কাবেরী, একটাই কথা কানে এলো, বরের গাড়ি তো বাইরে দাঁড়িয়ে, তাহলে বর গেল কোথায়! বুকের ভিতরটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো কাবেরীর। টুটাই ঠিক আছে তো! ওর কোনো বিপদ হয়নি তো? আজকাল সব সম্ভব, কেউ কিছু খাইয়ে টুটাইকে কোথাও নিয়ে গিয়ে ফেললো না তো!
আশঙ্কাটা মনের মধ্যে উঁকি দিতেই কাবেরী প্রায় আর্ত চিৎকার করে উঠে বললো, নীলাদ্রি টুটাইয়ের কোনো বিপদ হয়নি তো? তোমরা ওর খোঁজ করেছো? কল করেছ ওকে?
নীলাদ্রি হালছাড়া গলায় বলল, টুটাই ফোন সুইচঅফ করে রেখেছে, আর তোমার ছেলে কোনো কচি বাচ্চা নয়, যে তাকে কেউ কিডন্যাপ করবে বাড়ি ভর্তি লোকের মধ্যে থেকে! প্লিজ কাবেরী, এই মুহূর্তে টুটাইয়ের ভাবনা বাদ দিয়ে একটু বলবে, এখান থেকে সম্মানটুকু বাঁচিয়ে নিয়ে কিভাবে বেরোবো? কাবেরী থমথমে গলায় বলল, অহনার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে এসো, এছাড়া আর করারই বা কি আছে! ফোনটা কেটে দিলো নীলাদ্রি।
আকাশ পাতাল ভাবছে কাবেরী, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বরযাত্রীর দল বাড়ির সবাইকে ফোন করে জানিয়েও দিয়েছে যে নৈঋত বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে!
ভাবনা শেষ হবার আগেই কাবেরীর দরজায় কেউ একজন ঠকঠক আওয়াজ করে আস্তে আস্তে বললো, মামীমা, দাদাভাই নাকি বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে, তুমি একবার বাইরে আসবে?
পা দুটোতে একটুও জোর পাচ্ছে না কাবেরী। এই দুটো পা দিয়েই গত তিনমাস গড়িয়াহাট চষে বেরিয়েছিল কাবেরী, ছেলের বিয়ের শপিং করার জন্য। সেই পা দুটোই অসার লাগছে এখন। দরজায় আবার দুটো ঠকঠক আওয়াজ হলো।
।।৪।।
নৈঋতের বাবা হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে চলে গেছেন, লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে আছে ফুলে ফুলে সাজানো বিবাহবাসর। একটু আগেই ওখানে লাল বেনারসি পরে বসেছিলো অহনা। সেই ছোট থেকে সুচেতা ওকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছিল, ভেবেছিল ওর মত কপাল যেন মেয়েটা না পায়, কিন্তু ভগবান বোধহয় মুচকি হেসেছিল সেদিন। লগ্নভ্রষ্টা কথাটা বোধহয় এই সমাজে আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিশেষ করে অহনার মত স্বাধীনচেতা মেয়েদের জন্য তো নয়ই। সুচেতার খুব ইচ্ছে ছিল অহনা ওর মতই স্কুল টিচার হোক, কিন্তু অহনার দশটা-পাঁচটার একঘেয়ে জীবনটাতে বড্ড আপত্তি। তাই কোন কিছু না ভেবেই, সুচেতার কথাতে গুরুত্ব না দিয়েই সাংবাদিকতার জীবনটাকে বেছে নিলো। সুচেতার অবশ্য বেশ মনে হয় এর জন্য কিছুটা হলেও অনিরুদ্ধ দায়ী। অহনার ওপরে অনিরুদ্ধর যে একটা মারাত্মক প্রভাব আছে সেটা ও বেশ বুঝতে পারে। বাবাই বলতে মেয়ে অজ্ঞান। অনিরুদ্ধর প্রশ্রয়েই মেয়ে এমন একটা প্রফেশন বেছে নিলো যেখানে প্রতিদিন চ্যালেঞ্জ। সিনিয়র নিউজ রিপোর্টার অনিরুদ্ধ পালকে যেদিন সুচেতা প্রথম দেখেছিলো সেদিন অবশ্য বুঝতেও পারেনি মানুষটা এতটা সাহসী। অনিরুদ্ধকে এককথায় সুপুরুষ বলা চলে, রিপোর্টার বলেই হয়তো স্মার্টনেসটাও চোখে পড়ার মত। কিন্তু অনিরুদ্ধর একটা স্বভাব কোনোদিন মেনে নিতে পারলো না – ওর একগুঁয়ে জেদ। অমন একজন শিক্ষিত, শান্ত ভদ্র মানুষের মধ্যে যে এতটা গোঁয়ার মানুষ থাকতে পারে, সেটা সামনে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না। সুচেতা এতগুলো বছর ঘর করেছে বলেই টের পেয়েছে মানুষটা বড্ড অবুঝ। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে সুচেতার। কেন যে মনে হচ্ছে অনিরুদ্ধ উপস্থিত থাকলে বোধহয় এমন অলুক্ষণে ব্যাপার ঘটতো না। সুচেতা মেয়েকে সম্প্রদান করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলেই বোধহয় অহনার বিয়েটা ভেঙে গেল।
সুচেতা তো বারবার বলেওছিল অনিরুদ্ধকে বিয়েতে উপস্থিত থাকতে, কিন্তু সে তো আড়াল থেকেই ক্যাটারার, ডেকরেটর সব ব্যবস্থা করে দিয়ে বিয়ের দিন থাকলো না। থাকলো না, নাকি সুচেতার অমন কথায় চূড়ান্ত আঘাত পেয়েই সরে গেল ওর জীবন থেকে! অহনা তিনদিন ধরেই জিজ্ঞেস করছে, মা বাবাই কি আমার বিয়েতে থাকবে না? বাবাইকে কল করলেই বলছে ওইদিন নাকি বিশেষ কি কাজ আছে! তুমি কি কিছু জানো? নাকি ওই এক ইস্যু নিয়ে তুমি ক্রমাগত বাবাইকে দোষারোপ করে যাচ্ছ! সুচেতা ইচ্ছে করেই কাজের বাহানায় এড়িয়ে গেছে অহনার কথাগুলো। এড়িয়ে না গিয়ে উপায়ই বা কি ছিল। কারণ সুচেতা জানে অহনা দিনরাত একটা প্রশ্নের পিছনে ছুটে যাচ্ছে, যার উত্তর সুচেতার কাছে থাকলেও ও কোনোদিন দিতে পারবে না অহনাকে। সেই না পাওয়া উত্তরের আশায় মেয়েটা ইদানিং পাগলামি শুরু করেছে যেন। দিন নেই রাত নেই এদিক ওদিক উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে বেড়াচ্ছে। মুখে অহনা যতই বলুক, সুচেতা তো মা, তাই ওর মুখ দেখে বুঝতে পারবে না এমন নয়। বেশ বুঝতে পারছে মেয়েটার মনের মধ্যে একটা এলোমেলো বাতাস সর্বদা তার সব শক্তি দিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। ভেঙে তছনছ করে দিতে চাইছে অহনার মনের নরম প্রকোষ্ঠগুলোকে। নেহাত শক্ত ধাতের মেয়ে বলেই অহনা সমানে লড়াই করে যাচ্ছে তার সঙ্গে। সেইজন্যই সুচেতা চেয়েছিল মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে একটু থিতু করতে, পারলো কই! ডেস্টিনিকে অস্বীকার করবে বললেই কি হয়? নাহলে অমন সুপাত্র, অমন সুন্দর পরিবার যেচে এসেছিল অহনাকে পছন্দ করে, তারপরেও শেষরক্ষা হলো কি!
মনে মনে আবারও দোষারোপ করলো অনিরুদ্ধকে। এর জন্য অনিরুদ্ধই দায়ী। ও চেষ্টা করলেই অহনার মাথা থেকে ওই প্রশ্নটার বীজকে নির্মূল করতে পারতো তা না করে বীজের গোড়ায় সার সঞ্চার করে চারা গাছটাকে জন্মাতে সাহায্য করেছে। নৈঋত বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যাবার পরে সেই যে অহনা ঘরে লক করে দিয়েছে এখনও খোলেনি। সুচেতার বুকটা কেঁপে উঠলো। মেয়েটা ভুল-ঠিক কিছু করে বসবে না তো! যত শক্ত মনের মেয়েই হোক, বিয়ের আসর থেকে বর চলে যাবার মত অপমানজনক ঘটনা মেনে নিতে পারবে কি! এই একটা দিনকে ঘিরে মেয়েদের অনেক স্বপ্ন থাকে, সঙ্গে কিছুটা সংশয়মিশ্রিত ভয়। নতুন পরিবারে যাওয়ার আগে এমনিতেই স্নায়ু একটু হলেও দুর্বল থাকে, তার মধ্যে এ ভাবে নৈঋত পালিয়ে যাওয়ায় মেয়েটা বোধহয় সত্যিই ভেঙে পড়েছে। সুচেতার মাথার ঠিক ছিল না এতক্ষণ, এখন মনে হচ্ছে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত ওর। মা ছাড়া কার কাঁধে মাথাটা রাখবে মেয়েটা!
বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজনের চোখে একটাই প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, কেন পালালো বর? তবে কি জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো? সবাই এই মুহূর্তে জল্পনা কল্পনা ছেড়ে বেশ জোরেই আলোচনা শুরু করেছে, একটা বিয়ের খরচ তো কম নয়, ছেলের বাড়ি থেকে আদায় করা উচিত ছিল। দুশ্চরিত্র ছেলেকে নিয়ে বিয়ে দিতে এসেছে সেই বাড়ির এটুকু তো রেস্পনসেবেলিটি থাকবেই। ছেলের বাবা তো দেখলাম, ক্ষমা চেয়ে দায় সারলেন। অসহ্য লাগছে সুচেতার এসব আলোচনা। তাই একটু দৃঢ় স্বরেই বলল, কেন আমরা কি ভিখারি, যে পাত্রপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করবো? কেউ এমন কথা বলো না প্লিজ। নিজেকে বড় ছোট মনে হয়।
সুচেতা জানে ও দুপা এগিয়ে গেলেই তথাকথিত আত্মীয়স্বজনরা শুরু করবে সমালোচনার ফিসফিসানি, উঠে আসবে ওর অতীতও। তাই ইদানিং আর ভালো হয়ে থাকার নাটক থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই পছন্দ করে সুচেতা। শুভাকাঙ্খীদের ইতিমধ্যেই চিনে ফেলেছে সুচেতা, যারা সারাটা বছর সত্যিই ওর পাশে থাকে। আর কিছু মানুষ তো কাছের মানুষ হবার মুখোশ পরে অভিনয়টা বেশ নিখুঁতভাবেই চালিয়ে যায়। অনিরুদ্ধ অবশ্য বলে, সুচেতার নাকি সন্দেহ করাটাই স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। হয়তো তাই, এত উত্থান পতন দেখেছে নিজের জীবনে যে অভিজ্ঞতা নেহাত কম নেই ওর। আর সেই সুখ-দুঃখের সময়ে কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ সেটা বেশ ভালোই বুঝে নিয়েছে ও। তাই এই বিয়েবাড়ির কৌতূহলী মুখগুলোর দিকে তাকালে এক্সরে মেশিন ছাড়াই সুচেতা নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারবে কজন সত্যিকারের কষ্ট পাচ্ছে আর কজন মজা দেখবে বলে অপেক্ষা করছে! মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ও এখন নৈঋতের বাড়ি থেকে বিয়ের খরচের ক্ষতিপূরণ দাবি করবে, এটা ভাবলো কি করে ওরা, সেটা ভেবেই চমকে উঠলো ও! সুচেতা নিজে একজন শিক্ষিকা, তাছাড়া অহনা যথেষ্ট ভালো রোজগার করে। যদিও অহনার বিয়ের একটা টাকাও সুচেতাকে খরচ করতে দেয়নি অনিরুদ্ধ। তার নাকি বহুদিনের শখ ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবে। সুচেতা নিতে চায়নি অনিরুদ্ধর টাকা, কিন্তু অহনা বেঁকে বসেছিলো, বেশ জেদ ধরে বলেছিল, বাবাইকে বাবাইয়ের ইচ্ছেপূরণ করতে দাও মা, প্লিজ ডোন্ট সিনক্রিয়েট। অহনা বড় হবার পর থেকে মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনোদিনই তেমন যায়নি সুচেতা, তাই অনিরুদ্ধই সমস্ত খরচ করেছিল। অহনার দরজার সামনে দেখলো, ওর দুজন বন্ধু রুমি আর চন্দ্রিমা মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছে। সুচেতা ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলো, ওকে ডেকেছিস রুমি? রুমি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, লক করার সময় বলে ঢুকলো, আমরা যেন বিরক্ত না করি। ও আপাতত একা থাকতে চায়! সুচেতার মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েটার বোধহয় নৈঋতকে ভালোই পছন্দ হয়েছিল, সে যে এভাবে আঘাত দেবে বুঝতে পারেনি বোধহয়। চন্দ্রিমা বললো, আন্টি প্রায় ঘণ্টা খানেক হয়ে গেল, এবারে একবার ডাকা উচিত কিন্তু, আমার কেমন ভয় করছে। ওকে তো সেই স্কুল থেকে চিনি। ওর ভাবনাচিন্তা কোনোদিনই সোজা পথে এগোয় না। আমরা যেখানে গিয়ে ভাবনা শেষ করি ও সেখান থেকে শুরু করে। আর যা জেদ ওর, সুইসাইড করার মেয়ে ও নয়, কিন্তু তবুও কেমন যেন ভয় করছে।
সুইসাইড করার কথাটা শুনেই বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠলো। তবে সুচেতা জানে অহনা হেরে যাবার মেয়ে নয়। হয়তো মায়ের কাছ থেকেই সে এই গুন পেয়েছে। লোকে বলে সুচেতাও নাকি ভীষণ শক্ত মনের মহিলা।
রুমির দিকে ইশারা করতেই রুমি দরজায় টোকা দিলো। চন্দ্রিমা ডাকলো অহনা, দরজাটা খোল প্লিজ। আন্টি এসেছে, একটু কথা আছে রে।
রুমি দরজায় জোরে একটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজাটা। গোটা মেঝে ময় ছড়ানো আছে অহনার পরনের লাল বেনারসিটা। সাদা পাথরের মেজের ওপরে রক্তের স্রোতের মতই এঁকে বেঁকে ছড়িয়ে আছে শাড়িটা। মাঝের সোনালী ফুলগুলো যেন বিদ্রুপ করে বলছে, আমরা প্রাণহীন, সুগন্ধ বেলাতে পারবো না। পাশে পড়ে রয়েছে লালগোলাপের মালাটা।
বিছানার ওপরে সুচেতার দেওয়া সব সোনার গয়নাগুলো। সবই রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, শুধু নেই অহনা। সুচেতা ধপ করে খাটে বসে পড়লো। স্খলিত গলায় বলল, রুমি, অহনা কোথায় রে?
রুমি হকচকিয়ে তাকালো চন্দ্রিমার দিকে। চন্দ্রিমা ভয়ে ভয়ে বললো, আন্টি আমরা তো ঘরের বাইরে বসেছিলাম সেই তখন থেকেই, ও তো ঘর থেকে বেরোয়নি, তাহলে গেল কোথায়?
রুমি চট করে অ্যাটাচ বাথটা ঘুরে দেখে নিলো। বেসিনে এখনো মেকআপ রিমুভ করার তুলোটা পড়ে রয়েছে।
সুচেতা হালছাড়া গলায় বলল, পিছনের বারান্দার তালাটা খোলা নাকি একবার দেখ তো চন্দ্রিমা?
চন্দ্রিমা বারান্দা থেকে ঘুরে এসে বললো, আন্টি বারান্দার গ্রিল হাট করে খোলা আছে।
সুচেতা আলমারির মাথায় তাকিয়ে দেখল, অহনার ট্যুরে নিয়ে যাওয়ার ট্রলি ব্যাগটাও নেই যথাস্থানে। আলমারি খুলতেই চোখে পড়লো একটা তাক একটু ফাঁকা লাগছে। তারমানে কিছু পোশাক নেওয়া হয়েছে ওখান থেকে।
যেমন মা তার তেমনি মেয়ে, কথাটা তীরের মত এসে বিঁধলো কানে।
আরেকজন তার পাশ থেকেই বললো, বাবাটাকে বিয়েতে থাকতে অবধি দিলো না সুচেতা। ছি ছি অমন ভালোমানুষটা মেয়ের বিয়ের সব খরচ দিয়েও উপস্থিত থাকতে পারলো না।
ওই জন্যই তো মেয়ে চিঠি লিখে পালিয়েছে। এখন কার সঙ্গে পালিয়েছে সেটা অবশ্য কেউ জানে না। চিঠিটা দেখেও তো তেমন কিছু বোঝার উপায় নেই। শুধু লিখেছে, যতক্ষণ না সত্যি জানতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত বিয়ের মত ছেলেমানুষি করতে পারবো না।
বোঝো কান্ডঃ আজকাল ছেলেমেয়েদের তো বিয়ে দেওয়াই মুশকিল। প্রথমে পাত্র পালালো, এখন পাত্রী।
সুচেতা উদ্ভ্রান্তের মত বাইরে বেরিয়ে দেখলো, সম্পর্কে সুচেতার পিসিই কথাগুলো বলছিলেন। হাতে একটা টুকরো কাগজও রয়েছে। সুচেতা প্রায় কেড়ে নিল কাগজটা। তারপরেই বললো, এটা কোথায় পেলে রাঙা পিসি?
রাঙা পিসি তার মোটা ঠোঁট উল্টে বললেন, ওই যে তোমাদের পাশের বাড়ির বাচ্চু এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দে ছুট। তা মেয়ের যখন অন্য জায়গায় প্রেম ছিলই তখন জোর করে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিতেই বা কেন গিয়েছিলে বাপু?
সুচেতার সামনে ভেসে উঠলো অহনার হাতের লেখা।
‘মা, প্লিজ রাগ করো না। খবরটা হঠাৎই পেলাম। চললাম আসল সত্য খুঁজতে। যতক্ষণ না খুঁজে পাই ততক্ষণ পর্যন্ত বিয়ের মত সম্পর্কে জড়াতে পারবো না।’
সুচেতার মুখটা নীল হয়ে গেল অপমানে। নিজের সন্তান যে এভাবে সকলের সামনে মুখটা পুড়িয়ে দিতে পারে কল্পনাই করতে পারেনি ও। সুচেতা জানে অহনা এখুনি বিয়েটা করতে চায়নি, আরেকটু সময় চেয়েছিল। হয়তো ভালো পাত্র, ঘর পেয়ে সুচেতাই একটু তাড়াহুড়ো করেছিল, তাই বলে অহনার অমত ছিল এটা মেনে নিতে পারবে না ও। অবশ্যই নৈঋতকে পছন্দ ছিল অহনার। সুচেতা মা হয়ে মেয়ের এটুকু মনের কথা টের পেয়েছিলো বৈকি অহনার আচরণে। আচমকা অনিরুদ্ধর ওপরে রাগটা চেপে বসলো। যত নষ্টের গোড়া ওই অনিরুদ্ধই। ফোনটা হাতে নিয়ে অনিরুদ্ধর নম্বরটা ডায়াল করলো।