Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বীর শ্রেষ্ঠ – জাহানারা ইমাম

    জাহানারা ইমাম এক পাতা গল্প61 Mins Read0

    তিনজনের মৃত্যুর চেয়ে একজনের মৃত্যু ভালো

    ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ বীরশ্রেষ্ঠ

    ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। যশোর জেলার একটি গ্রাম, নাম—গোয়ালহাটি।

    এই গ্রামের একপ্রান্তে বড়বড় গাছপালা-ঘেরা একটা জায়গায় সেদিন ঘটেছিল প্রাণস্পর্শী এক ঘটনা, পরবর্তী কালে যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে।

    সেদিন, ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, গোয়ালহাটির সেই বড়বড় গাছপালা-ঘেরা জায়গাটিতে উপস্থিত ছিলেন তিনজন সৈনিক। দুজন গুরুতর আহত, মাটিতে পড়ে রয়েছেন। একজনের গায়ে গুলি লেগেছে, আঘাত তত গুরুতর নয়। অন্যজনের হাঁটু ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, ডান কাঁধ দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। তিনি একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছেন, হাতে লাইটমেশিনগান। তৃতীয় সৈনিকটি অক্ষত, দাঁড়িয়েই আছেন বটে, তবে তাঁর মুখে ক্লেশ ও উদ্বেগের ছাপ। চারপাশ দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি। লক্ষ্য এঁরা তিনজন। হাঁটুভাঙা সৈনিকটি একবার বাঁ দিকে নল ঘুরিয়ে ঠাঠা ঠাঠা করে এলএমজির গুলি ছুড়লেন খানিকক্ষণ, তারপর দাঁড়ানো সৈনিকটির দিকে তাকিয়ে কড়াস্বরে বললেন, ‘এখনো হা করে দাঁড়িয়ে আছ মোস্তফা? শিগগির নানুমিয়াকে কাঁধে তুলে নাও। তাড়াতাড়ি যাও প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতে। আমি ততক্ষণ কাভার দিই।

    মোস্তফা কাঁদ-কাঁদ গলায় বললেন, ‘আপনাকে ফেলে কিছুতেই যাব না স্যার—’

    আহত সৈনিকটি ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আবার অবাধ্য হচ্ছ? জান না, আদেশ অমান্য করার শাস্তি কী?’ বলে এবার ডানদিকে ঠাঠা ঠাঠা করে আবার কিছুক্ষণ গুলি ছুড়লেন, তারপর নির্মম আদেশের স্বরে কেটে-কেটে বললেন, ‘নানুমিয়াকে কাঁধে তুলে নাও। এই নাও এলএমজি। তোমার এসেলারটা আমাকে দাও। এটা তোমার উপরঅলার হুকুম। তুমি সিপাহী, তোমার ল্যান্সনায়েকের হুকুম না মানলে তোমার কোর্টমার্শাল—’

    সিপাহী মোস্তফা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে হাঁটুভাঙা আহত ল্যান্সনায়কের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে কাঁধে তুলে নিতে গেলেন, বলতে লাগলেন, ‘হোক কোর্ট মার্শাল, আপনাকে নিয়ে যাবই—’

    ল্যান্সনায়েক হাত বাড়িয়ে পাশের গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরে বলে উঠলেন, ‘আরে এ কী! থামো থামো। উহ্ লাগছে, লাগছে।’ কড়া এক ধমক দিলেন, ‘সরো মোস্তফা।

    সিপাহী মোস্তফা থতমত খেয়ে ল্যান্সনায়েকের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। ল্যান্সনায়েক তখন তার হাত দুটি ধরে নরম গলায়, কিন্তু দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘আল্লার দোহাই মোস্তফা, হুঁশ করে শোনো। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখ, যেভাবে জখম হয়েছি তাতে আমি আর বাঁচব না। যেভাবে রক্তপাত হচ্ছে, তাতে এখনই আমার সারা শরীর ঝিমঝিম করছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আমাকে-সুদ্ধ নিতে গেলে তোমরা দুজনও মারা পড়বে। তিনজন মরার চেয়ে দুজন বাঁচা ভালো নয় কি? নানুমিয়ার জখম গুরুতর নয়, ও বেঁচে যাবে। কিন্তু আমি-যে বাঁচব না, সে তো তুমিও বুঝছ। আমার কথা শোনো। আর দেরি কোরো না, জান না, যুদ্ধক্ষেত্রে একটা মিনিট নষ্ট করা মানে কী? দেখছ না, কিভাবে শত্রুর গোলাগুলি ছুটে আসছে? ওরা অ্যাডভান্স করছে— যাও, তাড়াতাড়ি যাও। দেরি করে সকলের সর্বনাশ কোরো না মোস্তফা। এক্ষুনি রওনা দাও।’

    সিপাহী মোস্তফা, তার উপরঅলা ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ-এর এই নিষ্ঠুর আদেশ শিরোধার্য করে আর কথাটি না বলে আহত নানুমিয়াকে কাঁধে তুলে, লাইট মেশিনগানটা হাতে নিয়ে পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করলেন। আর ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ সিপাহী মোস্তফার সেল্ফলোডেড রাইফেলটি দিয়ে অ্যাডভাসরত শত্রুর উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়তে লাগলেন, যাতে সিপাহী মোস্তফা ও নানুমিয়া নিরাপদে পিছু হটে নিজ প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতে ফিরে যেতে পারে।

    .

    কে এই ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ? যিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও বাঁচবার আকুতিকে সবলে দমন করে তাঁরই অধীনস্থ দুজন সিপাহীর জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করছেন? ডান হাঁটু মর্টারের গোলার আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, সেই ভাঙা পা আর ডান কাঁধ দিয়ে প্রবল বেগে রক্তপাত হচ্ছে, অসহ্য যন্ত্রণা আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। চোখ ঝাপসা, মাথা ঝিমঝিম— তার মধ্যেও বিচার-বুদ্ধি স্থির রেখে তিনি নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে বসিয়ে রেখে, সঙ্গী সিপাহি দুজনকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিচ্ছেন—কোন্ ধাতুতে গড়া এই ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ?

    তাঁর সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বেশ অনেকগুলি বছর আগে— তাঁর জন্মসময়ে।

    যশোর জেলার নড়াইল থানার মহেশখালি গ্রামের এক সম্পন্ন কৃষক ছিলেন মোহাম্মদ আমানত শেখ। জমিজমা যা ছিল, তাতে নিজের হাতে চাষ করে বেশ ভালোই উৎপাদন হত। সচ্ছলভাবে চলে যেত সারা বছর। কেবল একটি জিনিসেরই অভাব ছিল সংসারে, তা হল সন্তানের। ক্রমে সে অভাবও পূর্ণ হল একদিন। আমানত শেখ ও জেন্নাতুন্নেসা খানমের ঘর আলো করে এল এক শিশু—পুলকিত পিতামাতা তার নাম রাখলেন নূর মোহাম্মদ শেখ। সেটা ছিল ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি।

    নূর মোহাম্মদের আর কোনো ভাই-বোন হয়নি। বলাই বাহুল্য, একমাত্র সন্তান হিসাবে তার প্রতি পিতামাতার আদ- আহ্লাদের পরিমাণ একটু বেশিই ছিল। ফল যা হবার, তাই হয়েছিল। বুদ্ধি এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও স্কুলের পড়াশোনা বেশি দূর এগোতে পারেনি। অন্যদিকে গান-বাজনা, যাত্রা-থিয়েটার—এইসব সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে মন চলে গেল। খেলাধুলাতেও বেশ আসক্তি ছিল। দুরন্ত এবং সাহসী বলেও নাম-ডাক কম হয়নি গ্রামে। বাবা-মা তার কোনো কিছুতেই বাধা দিতেন না, তাঁদের অগাধ ভালোবাসা আর অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে আনন্দে বড় হয়ে উঠছিলেন নূর মোহাম্মদ।

    .

    হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাত হল। শৈশবের হিরন্ময় দিনগুলি পার হতে-না-হতেই হারালেন বাবা-মা দুজনকেই। আমানত শেখের নিজের হাতে বানানো টিনের চালওয়ালা বড় ঘরটি আর তাঁর জমিজমার মালিক হয়ে নবীন কিশোর নূর মোহাম্মদ কী যে করবেন, প্রথমত ভেবেই পেলেন না। আশেপাশে আর কোনো দরদী অভিভাবক ও ছিলেন না যে প্রিয়জন হারানোর শোকে মূহ্যমান এই নিঃসহায় কিশোরকে সান্ত্বনা ও সুপরামর্শ দেবেন। সমবয়সী বন্ধুরাই ক্রমে হয়ে উঠল সর্বক্ষণের সঙ্গী, ব্যথার ব্যথী, আনন্দের অংশীদার। তাদের নিয়ে তিনি গান-বাজনায় মেতে উঠলেন, নিজেও গান গাইতে পারতেন ভালোই। যাত্রার দল, জারিগানের দল তৈরি করতে উদ্যোগী হলেন। এসব কাজে টাকা-পয়সা লাগে, খেতে-পরতেও টাকা লাগে, বন্ধু-বান্ধব আপ্যায়ন করতে লাগে আরো বেশি। নূর মোহাম্মদকে যে-বয়সে তাঁর বাবার হাল-চাষ শেখানো শুরু করার কথা, তার আগেই তিনি মারা গেলেন। অতএব নূর মোহাম্মদের আর শেখা হয়নি কী করে জমিতে হাল-চাষ দিয়ে ফসল উৎপাদন করতে হয়, কী করে তা থেকে সারা বছরের খাওয়া-পরা, ওষুধ-বিষুধ, লৌক-লৌকিকতা সবকিছুর খরচ সামাল দিতে হয়। তাই যখন টাকার প্রয়োজন হল, হতবুদ্ধি কিশোর সবচেয়ে সহজ পন্থাটাই ধরলেন—জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করা। একটু-একটু করে জমি বিক্রি করেন আর দিন কাটান।

    এমনি করে-করে বেশ ক’টা বছর কেটে গেল, নূর মোহাম্মদ যুবক হয়ে উঠেছেন বন্ধু-বৎসল, দরাজ-দিল তরুণ, যাত্রা-থিয়েটার, গান-বাজনার জগতে সবাই তাঁকে একডাকে চেনে। খুব শৌখিনও। বাড়িতে একটা গ্রামোফোন পর্যন্ত কিনেছেন। সে-যুগে গ্রামে কারো বাড়িতে ‘কলের গান’ থাকা খুব একটা বড় ব্যাপার ছিল। তাছাড়া কলসির ঢালা পানির মতো জমি বিক্রির টাকা সবসময় হাতে মজুদ।

    .

    বিয়ের বয়স হয়েছিল।

    ঐ গ্রামেরই আরেক সম্পন্ন কৃষকের মেয়ে তোতাল বিবির সঙ্গে একদিন বিয়ে ও হয়ে গেল বেশ ধুমধাম করে।

    বসে খেলে রাজার ধনও শেষ হয়ে যায়। কলসির পানি গড়িয়ে খেতে-খেতে একদিন কলসি শূন্য হল অর্থাৎ বিক্রি করার মতো আর জমি নেই।

    শুধু ভিটেবাড়িটাই রয়েছে।

    বিয়ের পর থেকে অবশ্য নূর মোহাম্মদ শ্বশুরবাড়িতেই বাস করছিলেন। কিছুদিন যেতে-না-যেতেই তিনি উপলব্ধি করলেন; এখন আর তিনি একা নন। তাঁর ঘাড়ে পড়েছে সংসারের দায়িত্ব। এখন তাঁর উপার্জন করা দরকার। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি যোগ দিলেন স্থানীয় আনসারবাহিনীতে। কিন্তু তাতেও যেন সংসার চলতে চায় না। ছেলেমেয়ে হয়েছে। আরো বেশি উপার্জন করা দরকার।

    .

    একদিন হঠাৎ করেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন চাকরির খোঁজে। স্কুলের বিদ্যা তাঁর বেশি ছিল না বটে কিন্তু সম্বল ছিল সাহস ও উদ্যম-ভরা টগবগে মন, সুঠাম দেহ আর আনসারবাহিনীর প্রশিক্ষণ। এই সম্বল নিয়েই ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ নূর মোহাম্মদ তেইশ বছর বয়সে ভর্তি হলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস অর্থাৎ ইপিআর বাহিনীতে। বর্তমানে যার নাম বিডিআর। বাড়ি ছাড়ার দেড় বছর পরে তিনি এই চাকরি পান। চাকরি পেয়ে তিনি স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের জন্য কিছু কাপড়-চোপড় কিনে একটি চিঠিতে সব জানিয়ে পাঠিয়ে দেন তোতাল বিবির কাছে।

    প্রাথমিক সামরিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তাঁর পোস্টিং হয় দিনাজপুর সেক্টরে ১৯৫৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। এখানেই তিনি ১৯৭০ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পরে বদলি হন যশোর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে।

    .

    একাত্তরের প্রথম থেকেই সারা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে। সে আন্দোলনের দোলা নূর মোহাম্মদের মনকেও নাড়া দিয়ে যায়। স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এগুলোর অর্থ তাঁর ভালোভাবেই জানা ছিল আশৈশব সংগীত ও নাট্যচর্চার মাধ্যমে। উদ্বেলিত সেই দিনগুলোতে নূর মোহাম্মদও স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। তাই মার্চে ছুটি ভোগ করতে নিজ গ্রামে এসে যখন দেখলেন ২৫ মার্চের ভয়াল রাত্রে হিংস্র পাকবাহিনী এদেশের নিরীহ জনসাধারণকে কুকুর-বিড়ালের মতো নির্বিচারে হত্যা করার উৎসবে মেতে উঠেছে, তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না।

    .

    আপন বিবেকের নির্ভুল নির্দেশে তিনি যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

    স্বাধীনতাযুদ্ধে ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ যশোরে ৮নং সেক্টরে যুদ্ধরত ছিলেন। তার কোম্পানিটি মূলত গঠিত হয়েছিল সাবেক ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে। দীর্ঘদিনের সামরিক অভিজ্ঞতা থাকার দরুন নূর মোহাম্মদকেই অধিনায়ক করে গোয়ালহাটি গ্রামের সামনে স্থায়ী টহল বসানো হয়। সুতিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষার নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন ছিল এটির।

    .

    দিনটি ছিল ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।

    তাঁর সঙ্গে ছিল দুইজন সৈনিক। স্থায়ী টহলে তাঁর দায়িত্ব ছিল ঘুটিপুর ঘাঁটির পাকিস্তানী বাহিনীর উপর নজর রাখা। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, শত্রুর উপর নজর রাখতে গিয়ে তাঁরাও শত্রুর নজরে পড়ে যান। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানীরা তৈরি হয় আক্রমণ করার জন্য। সকাল সাড়ে ন’টার দিকে পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা-ঘাঁটির তিনদিকে অবস্থান নেয়। শত্রুরা এটা করে ঘুরপথে, যাতে নূর মোহাম্মদের বাহিনী বুঝতে না পারে। তিনদিক থেকে এগিয়ে এসে বিপদজনক অবস্থায় টহলকে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করে শত্রুরা। আক্রমণ করার জন্য গোলাগুলি ছোড়া শুরু করতেই নূর মোহাম্মদ বুঝতে পারেন যে, ফাঁদে পড়ে গেছেন। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা- ব্যূহও জেনেছে যে, টহল আক্রান্ত। প্রতিরক্ষা-ঘাঁটি থেকে প্রতি-আক্রমণ করে নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন টহলটিকে রক্ষা করার জন্য তারা চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না পেট্রোলটিকে উদ্ধার করা। ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদও চেষ্টা করছিলেন তাঁর পেট্রোলটিকে পিছু হটিয়ে নিয়ে প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতে ফিরে যেতে।

    টহল দলের প্রধান অস্ত্র — হালকা মেশিনগানটি ছিল সিপাহী নানুমিয়ার হাতে। শত্রুর আক্রমণের ধারায় এবং তাৎক্ষণিক সেই পরিস্থিতিতে এ অস্ত্রটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। টহল দলকে পিছু হটিয়ে প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতে যোগ দেবার চেষ্টা করার এ সময়টিতে ঘটল অঘটন। নানুমিয়া গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। মারাত্মক আহত অবস্থায় নানুমিয়া এলএমজি চালাতে পারছেন না। সময় নেই। নূর মোহাম্মদ নিজের হাতে তুলে নিলেন লাইটমেশিনগান।

    সংসার জীবনের দায়িত্বের মতো সৈনিক জীবনের দায়িত্বকে তুলে নিলেন কাঁধে। তিনি অধিনায়ক। সঙ্গীদের রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁর। আহত সিপাহী নানুমিয়াকে ফেলে গেলেন না তিনি। হাতে এলএমজির সঙ্গে তাকেও কাঁধে তুলে নিলেন। একই সঙ্গে কৌশলও পালটে ফেললেন যুদ্ধের অথবা আত্মরক্ষার।

    এ-সময় নূর মোহাম্মদের লক্ষ্য ছিল সঙ্গী যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে নিরাপদে প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতে পৌঁছে যাওয়া। নানু মিয়াকে কাঁধে রেখেই ঘনঘন অবস্থান পালটিয়ে গুলি করছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য শত্রুকে গোলকধাঁধায় ফেলা। শত্রু যেন তাঁদের সঠিক অবস্থান বুঝতে না পারে। কোন্ পথ দিয়ে পশ্চাদপসরণ, তাও যেন ধরতে না পারে।

    এভাবে ডাইনে-বাঁয়ে গুলি চালাতে চালাতে পিছু হটছেন, এমন সময়ে ২ ইঞ্চি মর্টারের এক গোলা এসে পড়ল ঠিক ডানপাশে।

    গোলার আঘাতে তাঁর ডান হাঁটু ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, আঘাত পেলেন ডান কাঁধেও। বুঝতে পারলেন শেষ পরিণতি কী। কিন্তু তখনও অধিনায়কের দায়িত্বের কথা মনে রয়েছে— টহলবাহিনীর বাকিদেরকে প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতেঁ পৌঁছে দেয়ার শেষ চেষ্টাটুকু করতেই হবে।

    সহযোগী সিপাহী মোস্তফার দিকে এলএমজিটা বাড়িয়ে ধরে আদেশ করলেন ওটার কাভারে পশ্চাদপসরণ করতে। সঙ্গে নিতে বললেন আহত নানুমিয়াকে। আর মোস্তফার সেলফলোডেড রাইফেলটি তাঁকে দিতে বললেন। ঐ এসএলআর দিয়ে তিনি শত্রুকে ঠেকিয়ে রেখে সঙ্গীদের নিরাপদে ঘাঁটিতে পৌঁছার পথ প্রশস্ত করবেন। এলএমজি-টি সঙ্গে রাখবেন না। ওটা শত্রুর হাতে পড়বে।

    নেতার হুকুমে সিপাহী মোস্তফা নানুমিয়াকে কাঁধে তুলে, এলএমজি হাতে নিয়ে ফায়ার করতে করতে পিছু হটলেন।

    ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করলেন জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। সিপাহী মোস্তফা পিছু হটতে শুরু করলে তিনি এসএলআর দিয়ে শত্রুর উপর গুলি করতে শুরু করেন একটি-একটি করে। এদিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবু তিনি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে গুলি করেই চলছেন—যাতে শত্রুরা তাঁর গুলিতে ব্যতিব্যস্ত থেকে মোস্তফা ও নানুর দিকে মনোযোগ দিতে না পারে।

    .

    নূর মোহাম্মদের এই অসাধারণ আত্মত্যাগ সার্থক হয়েছিল। মোস্তফা নান্নুমিয়াকে বহন করে নিয়ে শেষপর্যন্ত নিজস্ব প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতে পৌঁছতে পেরেছিলেন। ঘণ্টাখানেক পরে আরো মুক্তিসেনা এনে প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিকে আরো শক্তিশালী করে পাকসেনাদের আক্রমণ-ব্যূহর উপর পালটা আক্রমণ চালানো হয়। বেগতিক দেখে শত্রুসেনা পিছু হটে নিজেদের ডেরায় সরে যায়।

    সিপাহী মোস্তফা কামাল ও আরো অনেকে ছুটে যায় ল্যান্সনায়েকের খোঁজে সেই গাছপালা-ঘেরা জায়গাটিতে।

    অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে নূর মোহাম্মদের প্রাণহীন দেহটি আবিষ্কার করে পাশের এক ঝোপে। সেখান থেকে শহীদের লাশটি তুলে এনে মাটিতে শোয়ানোর পর স্তম্ভিত বাকহারা মুক্তিসেনারা দেখতে পায় বর্বর পাকিস্তানীরা যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে আহত এ মুক্তিযোদ্ধার চোখ দুটি উপড়ে ফেলেছে। মৃতদেহে বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন দেখে বোঝা যায় বর্বররা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে।

    .

    মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে তুলে নেয় বীর শহীদ নূর মোহাম্মদের লাশ।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম
    Next Article বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    Related Articles

    জাহানারা ইমাম

    একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম

    August 13, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নিঃসঙ্গ পাইন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বুকের ভিতর আগুন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }