Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প137 Mins Read0
    ⤷

    ০১. রইসউদ্দিনকে দেখলে মনে হবে

    বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ০১.

    রইসউদ্দিনকে দেখলে মনে হবে তিনি বুঝি একজন খুব সাধারণ মানুষ। তাঁর চেহারা সাধারণ (মাথার সামনে একটু টাক, আধপাকা চুল, নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ), বেশভূষা সাধারণ (হাফহাতা শার্ট, ঢলঢলে প্যান্ট, পায়ে ভুসভুসে টেনিস শু), কথা বলার ভঙ্গিও সাধারণ (যখন বলার কথা ‘দেখলুম’ ‘খেলুম’ তখন বলে ফেলেন ‘দেইখা ফালাইছি’ ‘খায়া ফালাইছি’)। রইসউদ্দিনের কাজকর্মও খুব সাধারণ, একটা বিজ্ঞাপনের ফার্মে তার নয়টা-পাঁচটা কাজ, সারাদিন বসে বসে নানান ধরনের কোম্পানি-ফার্মের দরকারি ছবি, কাগজপত্র, প্লেট ফাঁইলবন্দি করে রাখেন।

    দেখতে-শুনতে বা কথা বলতে সাদাসিধে মনে হলেও রইসউদ্দিন মানুষটা কিন্তু খুব সাহসী। দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ হয় তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ষোলো। সেই বয়সে তিনি একেবারে ফাটাফাটি যুদ্ধ করেছিলেন। নান্দাইল রোডে এক অপারেশনে একেবারে খালিহাতে একবার তিনজন পাকিস্তানিকে ধরে এনেছিলেন। এখন তার বয়স বিয়াল্লিশ কিন্তু এতদিনেও তার সাহসের এতটুকু ঘাটতি হয়নি। অফিসের বড় সাহেব একবার তার সাথে কী-একটা বেয়াদবি করেছিলেন, রইসউদ্দিন তার কলার ধরে দেয়ালে ঠেসে ধরে বলেছিলেন, “আর একবার এই কথা বলছেন কি জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেব। বলবেন আর?”

    বড় সাহেব মিনমিন করে বললেন, “না।” রইসউদ্দিন তখন তাকে ছেড়ে দিলেন। বড় সাহেব এরপর জীবনে আর কোনোদিন রইসউদ্দিনকে ঘটায়নি।

    রইসউদ্দিন যে সাহসী তার আরও অনেক প্রমাণ আছে। যেমন ধরা যাক তাঁর পোষা সাপের কথা। সাধারণ মানুষ সাপ পোষা দূরে থাকুক, যেখানে সাপ রয়েছে তার ধারেকাছে যাবে না। কিন্তু রইসউদ্দিন একবার দুটো কেউটে সাপ পুষেছিলেন। কথায় বলে ‘দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষা’–কিন্তু সাপ পুষে রইসউদ্দিন আবিষ্কার করলেন সাপ দুধ-কলা মুখে নেয় না, তাদের প্রিয় খাবার হচ্ছে ইঁদুর আর ব্যাঙ। যা-ই হোক, সাপ দুটি একদিন বেড়াতে বেড়াতে পাশের বাসায় হাজির হল, ভয়ংকর হৈচৈ শোনা গেল তারপর দুই মিনিটের মাঝে লাঠির আঘাতে এই সাপের জীবন শেষ। রইসউদ্দিন মনের দুঃখে সাপ পোষাই ছেড়ে দিলেন।

    রইসউদ্দিন শুধু যে সাপকে ভয় পান না তাই না, বাঘ-সিংহকেও ভয় পান না। চিড়িয়াখানায় গেলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খামার কাছে দাঁড়িয়ে বাঘের কান চুলকে দেন, সিংহের কেশরে বিলি কেটে দেন। শুধু বাঘ-সিংহ নয়, চোর ডাকাতকেও তার কোনো ভয় নেই।

    একবার গভীর রাতে চোখ খুলে দেখেন ষণ্ডাগোছের একজন মানুষ তাঁর ড্রয়ার ঘাটাঘাটি করছে। রইসউদ্দিন ”কে রে?” বলে হুংকার দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই মানুষটা পিছলে বের হয়ে গেল। রইসউদ্দিন তখন আবিষ্কার করলেন চোরেরা গায়ে তেল এবং পাকা কলা মেখে চুরি করতে আসে।

    রাস্তাঘাটেও তিনি চোর-ডাকাত আর বদমাইশদের ভয় পান না। একদিন বিজয় সরণি দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন কয়জন মাস্তান পিস্তল উঁচিয়ে একটা রিকশাকে ঘিরে রেখেছে। রিকশায় বসে থাকা মেয়েটি ভয়ে ভয়ে তার গলার হার, হাতের চুড়ি খুলে দিচ্ছে। আশেপাশে অনেক মানুষ–সবাই দূর থেকে দেখছে কিন্তু কেউ কাছে যাবার সাহস পাচ্ছে না।

    রইসউদ্দিন এগিয়ে গিয়ে একজন মাস্তানের শার্টের কলার ধরে তাকে এমন রদ্দা দিলেন যে, সাথে সাথে তার একটা কলার-বোন ভেঙে গেল। অন্য দুজন তখন তাদের নাকমুখ খিঁচিয়ে চোখ উলটে বিকট চিৎকার করে রইসউদ্দিনের উপর লাফিয়ে পড়ল, রইসউদ্দিন একটুও না ঘাবড়ে পালটা তাদের মুখে ঘুসি হাঁকালেন। মাস্তানগুলো নেশা-ভাং করে একেবারে দুবলা হয়েছিল, গায়ে কোনো জোর ছিল না তাই রইসউদ্দিনের ঘুসি খেয়ে একেবারে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল। তারা আসলে গায়ের জোর দেখিয়ে মাস্তানি করে না, সত্যিকারের জোর তাদের অস্ত্র। হাতে রিভলবারের মতো অস্ত্র থাকার পরেও সেটা কেন ব্যবহার করল না ব্যাপারটা অবিশ্যি একটা রহস্য। মনে হয় সস্তা রিভলবার, ট্রিগার ধরে টানাটানি করলে মাঝেমধ্যে এক-দুইটা গুলি বের হয়–সেই গুলিও যখন উত্তরদিকে যাবার কথা তখন যায়–পুবদিকে! রিলভবারের আসল কাজ হচ্ছে ভয় দেখানো, রইসউদ্দিনের মতো মানুষ, যাদের বুকে ভয়ডর নেই তাদের সামনে তাই মাস্তানরা খুব বেকায়দায় পড়ে যায়।

    এই যে রইসউদ্দিন–এত বড় একজন সাহসী মানুষ, তিনিও কিন্তু একটা জিনিসকে খুব ভয় পান। সেই জিনিসটি মাকড়শা নয়, জোঁক বা বিছে নয়, পুলিশ কিংবা মিলিটারি নয়, ঝড় বা ভূমিকম্পও নয়, তিনি বাচ্চাকাচ্চাকে একেবারে যমের মতো ভয় করেন। বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাবে সেই ভয়ে তিনি বিয়ে পর্যন্ত করেননি! বাচ্চাকাচ্চাকে ভয় পাওয়ার পেছনে তাঁর অবিশ্যি কারণ আছে। ছেলেবেলায় তিনি ছোটখাটো ভীতু এবং দুর্বল ধরনের ছিলেন। পাড়ার কাছে যে স্কুলে তিনি পড়তেন সেখানে দুর্দান্ত ধরনের কিছু বাচ্চা পড়াশোনা করত। রইসউদ্দিনকে দুর্বল পেয়ে বাচ্চাগুলো তাঁকে পেটাত। পিটুনি খেয়ে খেয়ে সেই যে তাঁর ছোট বাচ্চার একটা ভয় ঢুকে গেল, সেটা আর কখনো দূর হয়নি।

    যখন তিনি কলেজে পড়েন তখন পাড়ার বাচ্চাকাচ্চারা মিলে ঠিক করল তারা একটা নাচগানের অনুষ্ঠান করবে। রইসউদ্দিনের উপর ভার পড়ল স্টেজে আলোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার। ইলেকট্রিক তার টেনে রইসউদ্দিন যখন সকেট লাগাচ্ছেন তখন এক দুষ্টু ছেলে এসে সেই তার প্লগের মাঝে ঢুকিয়ে দিল, ইলেকট্রিক শক খেয়ে রইসউদ্দিন একেবারে আঁ আঁ আঁ চিৎকার করে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়লেন। তাই দেখে পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের সে কী আনন্দ-মুখে হাত দিয়ে তাদের সে কী খিকখিক হাসি!

    বছরখানেক আগে তাঁর এক বন্ধু বউ-বাচ্চাকে নিয়ে রইসউদ্দিনের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। বাচ্চাটার বয়স পাঁচ বছর, ফুটফুটে চেহারা, মুখে নিষ্পাপ একটা ফেরেশতা ফেরেশতা ভাব, কিন্তু তার কাজকর্ম ছিল একেবারে ইবলিশের কাছাকাছি। ঘরে ঢুকেই শেলফ থেকে তাঁর প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটা টেনে ফেলে দিল, কবিগুরুর কপাল এবং নাক গেল একদিকে, দাড়ি এবং গোঁফ অন্যদিকে। দুপুরবেলা রইসউদ্দিন দামি ফাউন্টেন পেনটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তার বাম চোখটা গেলে দেওয়ার চেষ্টা করল, চোখে চশমা ছিল বলে চোখটা বেঁচে গেলেও গালের কাছাকাছি খানিকটা চামড়া উঠে গেল। তাঁর নিজের বড় ক্ষতি না হলেও দামি ফাউন্টেন পেনটার একেবারে বারোটা বেজে গেল। খাবার সময় হলে ছেলেটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে ষাড়ের মতো চিৎকার করতে শুরু করল। এইটুকু মানুষ কীভাবে এত জোরে চিৎকার করে ভেবে রইসউদ্দিন একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কোনোভাবে তাকে শান্ত করতে না পেরে তার হাতে একটা লাল মার্কার দেওয়া হল। সেই মার্কার দিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই সে সবকয়টি ঘরের দেয়ালের যেটুকু নাগাল পেল সেটুকুতে ছবি এঁকে ফেলল। বাচ্চাটি আর তার বাবা-মা রইসউদ্দিনের বাসায় ছিল তিন দিন, সেই তিন-দিনকে রইসউদ্দিনের মনে হল তিন বছর এবং এই সময়ে তার বাচ্চাভীতি বেড়ে গেল আরও তিনগুণ!

    শুধু যে এই বাচ্চাটিই তার মাঝে ভয় ঢুকিয়ে গেছে তাই নয়, অবস্থা দেখে মনে হয় পৃথিবীর সব বাচ্চাই যেন ষড়যন্ত্র করে তার পেছনে লেগে গেছে। রেস্টুরেন্টে চা খেতে গেলে বাচ্চা বয়-বেয়ারারা সবসময় তার কোলে খানিকটা গরম চা ফেলে দেয়। দোকানে কেনাকাটা করতে গেলে ছোট ছোট বাচ্চা মনে হয় ইচ্ছে করেই তার পায়ের তলায় চাপা পড়ার চেষ্টা করে। তাদের বাঁচাতে গিয়ে রইসউদ্দিন নিজে আছাড় খেয়ে পড়েন কিন্তু সেই বাচ্চাদের কখনো কিছু হয় না এবং তাকে আছাড় খেতে দেখে বাচ্চারা উলটো আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। রাস্তার পাশে যেসব ছোট ছোট বাচ্চা ইট ভাঙে রইসউদ্দিন যখন তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যান তখন অবধারিতভাবে সেইসব ছোট বাচ্চা হাতুড়ি দিয়ে তাঁর পায়ের নখকে অল্পবিস্তর থেঁতলে দেয়।

    একদিন অন্যমনস্কভাবে রিকশায় উঠেছেন, খানিক দূর যাবার পর হঠাৎ ভালো করে তাকিয়ে দেখেন রিকশা চালাচ্ছে একেবারে বাচ্চা একটা ছেলে। রইসউদ্দিন আঁতকে উঠে বললেন, “থামাও–রিকশা থামাও!” তার আগেই সেই রিকশা নিয়ে ছেলেটি রইসউদ্দিনকে রাস্তার পাশে নর্দমায় ফেলে দিল। দেখতে দেখতে তখন তাঁকে ঘিরে ভিড় জমে উঠল এবং এরকম বুড়ো ধামড়া একজন মানুষ যে এত ছোট একটা বাচ্চাকে দিয়ে রিকশা চালিয়ে নিচ্ছে সেইজন্যে সবাই মিলে তাঁকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালিগালাজ শুরু করল।

    সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি ঘটেছে মাত্র মাসখানেক আগে। একটা মনোহরী দোকান থেকে রইসউদ্দিন চায়ের প্যাকেট কিনেছেন, হঠাৎ দেখলেন ছোট একটা বাচ্চাও তার বাবা-মায়ের সাথে দোকানে এসেছে। ফুটফুটে বাচ্চা হাঁটিহাঁটি পায়ে দোকানে ঘুরছে, রইসউদ্দিনের দিকে তাকাতেই তিনি দ্রতা করে মুখে একটা হাসিহাসি ভাব করলেন। সাথে সাথে বাচ্চার সেকি চিৎকার! তার বাবা-মা ভয় পেয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বাবা?”

    ফুটফুটে বাচ্চাটি রইসউদ্দিনকে দেখিয়ে বলল, “ছেলেধরা!”

    সাথে সাথে তাঁকে নিয়ে কী সাংঘাতিক অবস্থা! শুধুমাত্র মানুষটা ভয়ংকর সাহসী বলে কেউ তাঁর গায়ে হাত দিতে পারেনি, কিন্তু পুরো একদিন তাঁর থানা হাজতে থাকতে হল। কাজেই রইসউদ্দিন যদি ছোট বাচ্চাদের ভয় করেন, তা হলে তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।

    এই রইসউদ্দিন কাছে একদিন একটা চিঠি এল। চিঠিটা এরকম :

    প্রিয় রাইচউদ্দিন,

    সালাম পর সমাচার এই যে, আপনাকে বিশেষ প্রয়োজনে পত্র লিখিতেছি। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আপনার ভাই জনাব জমিরউদ্দিন নৌকাডুবিতে সপরিবারে ইনতিকাল করিয়াছেন। তাহার নয় বৎসরের কন্যা শিউলি ঘটনাক্রমে বাঁচিয়া গিয়াছে। এই এতিম বালিকাটি গত ছয়মাস যাবৎ আমার সহিত বসবাস করিতেছে। আমি কিছু বলিতে চাহি না আবার না বলিয়াও পারিতেছি না যে, এই বালিকাটি অত্যন্ত দুষ্ট প্রকৃতির। সে আমার পরিবারে বিশেষ অশান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। তাহার সহিত মিশিয়া আমার পুত্র ও কন্যাও বখিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে। পত্রপাঠ মারফত তাহাকে লইয়া যাইবার জন্য আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করিতেছি।

    আরজ গুজার
    মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি.

    .

    মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি.-র চিঠি পড়ে রইসউদ্দিন খুব সাবধানে বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের করে দিলেন। তার নাম রাইচউদ্দিন না (তার ধারণা কারও নাম রাইচউদ্দিন হওয়া সম্ভবও নয়), তার জমিরউদ্দিন নামে কোনো ভাই নেই এবং নয় বছরের কোনো ভাইঝিও নেই। কাজেই এত অল্প বয়সে বাবা মা মারা যাওয়া এই বাচ্চা মেয়েটার জন্যে তার একটু দুঃখ লাগলেও তার কিছু করার নেই। সত্যি কথা বলতে কি, এই দুষ্টু মেয়েটা এসে তার ঘাড়ে চেপে বসবে চিন্তার করেই রইসউদ্দিনের মনটা খুশি হয়ে ওঠে। চিঠিটা ভুল করে তার কাছে চলে এসেছে। পরদিন দুপুরবেলা তিনি পিয়নকে চিঠিটা ফেরত দিয়ে সত্যিকারের রাইচউদ্দিনের কাছে পৌঁছে দিতে বললেন।

    এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, রইসউদ্দিন মোল্লা কফিলউদ্দিনের চিঠির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। তখন আবার তার কাছ থেকে একটা চিঠি এসে হাজির হল। চিঠিতে মোটামুটি একই জিনিস লেখা তবে এবারে শিউলি নামের মেয়েটার কাজকর্মের কিছু বৃত্তান্ত দেওয়া আছে (টুপির মাঝে বিষপিপড়া ছেড়ে দেওয়া, মক্তবের মৌলবি সাহেবকে ভূত সেজে ভয় দেখানো, গ্রামের চেয়ারম্যানের নামে কুকুর পোষা, পাড়ার ছেলেপিলে নিয়ে মাঝরাতে গাবগাছে উঠে বসে থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি।) পুরো চিঠিটা পড়ে রইসউদ্দিনের শরীর শিউরে উঠল। চিঠির শেষদিকে এবারে মোল্লা কফিলউদ্দিন বি, এ, বি, টি. কিছু-কিছু কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন, শুধু তাই নয়, যদি শিউলি নামের মেয়েটাকে এখনই নিয়ে যান তা হলে কোর্টে কেস করে দেবেন বলে ভয় দেখিয়েছেন।

    চিঠি পেয়ে রইসউদ্দিন খুব ঘাবড়ে গেলেন। পরদিন অফিস কামাই করে পিয়নের সাথে কথা বললেন। পিয়ন বলল, চিঠিতে যে-রাইচউদ্দিনের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেখানে কেউ থাকে না বলে তাঁকে চিঠিটা দেওয়া হচ্ছে। রইসউদ্দিন তখন নিজেই খোঁজ-খবর করে প্রকৃত রাইচউদ্দিনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো লাভ হল না। রইসউদ্দিনের ভয় হতে লাগল যে মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি. হয়তো ‘শিউলি’ নামের ভয়ংকর মেয়েটাকে নিয়ে নিজেই হাজির হয়ে যাবেন। রাতে তাঁর ভালো ঘুম হল না, স্বপ্নে দেখলেন শিউলি নামের মেয়েটা মুখে রং মেখে এসে তার গলা চেপে ধরে খিলখিল করে হাসছে আর হাসির শব্দের সাথে সাথে মুখ দিয়ে আগুন আর নাক দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে আসছে। রইসউদ্দিনের খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেল। কী করবেন বুঝতে না পেরে তিনি ছটফট করতে লাগলেন।

    এক সপ্তাহ পরে আবার যখন মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি-র কাছ থেকে একটা চিঠি এসে হাজির হল তখন রইসউদ্দিনের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। খুব ভয়ে ভয়ে চিঠিটা খুলে পড়লেন, কিন্তু এবারে চিঠির ভাষা সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেখানে লেখা :

    ভাই রাইচউদ্দিন,

    আমার সালাম নিবেন। পর সমাচার এই যে, আপনাকে এর আগে অনেকগুলি পত্র লিখিয়া বিরক্ত করিয়াছি সেইজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। শিউলি একটু দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে তবে একটি বিশেষ কারণে তাহাকে আমার নিকট রাখিব বলিয়া মনস্থির করিয়াছি।

    আপনি হয়তো এর কারণ জানিবার জন্য কৌতূহলী হইয়াছেন। অন্য দশজনকে বলিতে দ্বিধা করিতাম, কিন্তু আপনি নিজের মানুষ, আপনাকে বলিতে দ্বিধা নাই। আমাদের গ্রামের একজন মানুষ (তিনি বিশিষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি, নাম ফোরকান আলী) সম্প্রতি আমাকে একটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন কোনো কোনো মানুষের শরীরে নাকি কিডনি নামক একধরনের বস্তু থাকে, কাহারো একটি কাহারো দুইটি। ইহা শরীরের বিশেষ কোনো কাজে লাগে না কিন্তু বাহিরে অনেক উচ্চমূল্যে বিক্রয় করা সম্ভব। জনাব ফোরকান আলী শিউলিকে নিয়া শহরে গিয়াছিলেন। শহরের ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছেন তাহার দুইটি কিডনি রহিয়াছে (আলহামুদুলিল্লাহ্) এবং একজন খদ্দের তাহার কিডনি দুইটি ক্রয় করতে রাজি আছেন। বাজারে আজকাল এই কিডনি দুই হাজার টাকায় বিক্রয় হয় কিন্তু তিনি আমাকে আড়াই হাজার টাকা মূল্য দিতে রাজি হইয়াছেন।

    মানুষটি আমাকে জানাইয়াছেন যে, এই কিডনি দুইটি দুইমাসের মাঝে আবার টিকটিকির লেজের মতো গজাইয়া যাইবে এবং ছয় মাসের মাঝে আবার কাটিয়া বিক্রয় করা সম্ভব হইবে। শিউলিকে এতদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়াছি কিন্তু এখন আবিষ্কার করিলাম যে গাভিন গরু বা ফলবতী বৃক্ষ হইতে কোনো অংশে কম অর্থকরী নহে (সোবহান আল্লাহ্)। প্রথমবার বলিয়া কিডনির মূল্য লইয়া দরদাম করিতে পারি নাই। পরের বার বাজার যাচাই করিয়া ঠিক মূল্য না পাওয়া পর্যন্ত শিউলির কিডনি বিক্রয় করিব না ইনশাআল্লাহ।

    আরজ গুজার
    মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি.

    পুনশ্চ : আগামী মাসের ছয় তারিখ কিউনি বিক্রয় করিবার উদ্দেশ্যে শিউলিকে

    .

    লইয়া শহরে যাত্রা করিব। দোয়া রাখিবেন। চিঠি পড়ে রইসউদ্দিন হার্টফেল করার মতো অবস্থা হল। সব মানুষেরই দুটি কিডনি থাকে এবং অন্তত একটা কিডনি ছাড়া কোনো মানুষই বাঁচতে পারে না। অসুখবিসুখ বা রোগে-শোকে যখন মানুষের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায় তখন শরীরের টিস্যু ইত্যাদি মিলিয়ে অন্য কোনো মানুষের শরীরের একটা কিডনি অপারেশন করে নিজের শরীরে লাগানো যায়, কিন্তু কেটে-ফেলা কিডনি কখনোই টিকটিকির লেজের মতো গজায় না। যারা নিজের কিডনি অন্যকে দিয়ে দেয় তাদের বাকি জীবন একটা কিডনি নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। সাধারণত খুব আপনজনেরা–যেরকম ভাইবোন বা ছেলেমেয়ে কিডনি দান করে। যদি কিডনি দেওয়ার মতো আপনজন না থাকে তা হলে কখনো কখনো অন্য কারও থেকে কিডনি নেওয়া হয়। অনেক সময় গরিব মানুষেরা টাকার জন্যে নিজের কিডনি বিক্রয় করারও চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যাপারটি মোল্লা কফিলউদ্দিন যেভাবে বলেছেন মোটেও সেরকম নয়। কিডনি মোটেও টিকটিকির লেজ বা গাছের পেঁপে নয় যে, একবার কেটে নিলেও আবার গজিয়ে যাবে! মোল্লা কফিলউদ্দিন হয় নিজেই বড় প্রতারক, নাহয় আরও বড় প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। তবে সেটা যা-ই হয়ে থাকুক না কেন তার ফল হিসেবে শিউলি নামের এই দুষ্টু মেয়েটার সব দুষ্টুমি সামনের মাসের ছয় তারিখের মাঝে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

    রইসউদ্দিনের খুব মন-খারাপ হল। তিনি ছোট বাচ্চাদের খুব ভয় পান। তারা যদি দুষ্টু হয় তা হলে শুধু যে ভয় পান তাই নয়, তাদের থেকে একশো হাত দূরে থাকেন। কিন্তু এরকম একটা ব্যাপারে তো কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। কী করবেন সেটা নিয়ে রইসউদ্দিন খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।

    রইসউদ্দিন যখন কোনোকিছু নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তখন তিনি ব্যাপারটি নিয়ে মাঝে মাঝে মতলুব মিয়ার সাথে কথা বলেন–আজকেও তাই তার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।

    মতলুব মিয়া রইসউদ্দিনের কাজকর্মে সাহায্য করার মানুষ, তার সাথে গত পঁচিশ বছর থেকে আছে। সাধারণত যারা খুব বিশ্বাসী এবং কাজের মানুষ তারা একজন আরেকজনের সাথে বিশ-পঁচিশ বৎসর থাকে, কিন্তু মতলুব মিয়ার বেলায় সেটা একবারে সত্যি নয়। সে অলস এবং নির্ধমা। তার মাথায় কখনো ভালো জিনিস আসে না কিন্তু সারাক্ষণ নানা ধরনের ফিচলে বুদ্ধি কাজ করে। রইসউদ্দিন যখন মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন তখন মতলুব মিয়ার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। যুদ্ধের নয়টা মাস সে গুলির বাক্স টানাটানি করেছে এবং সারাক্ষণ কোনো-না-কোনো বিষয়ে নিয়ে কারও-না-কারও কাছে ঘ্যানঘ্যান করেছে। প্রায় রাতেই সে মাথা নেড়ে নেড়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলত, “ধুত্তেরি ছাই! মুক্তিবাহিনীতে না এসে রাজাকারবাহিনীতে যোগ দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে শালার এক প্যাক-কাদার মাঝে গুলির বাক্স টানাটানি করতে হত না।”

    দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা সবাই যখন অস্ত্র জমা দিচ্ছে তখন মতলুব মিয়া একটা অস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাকে নাকি কে খবর দিয়েছে যুদ্ধ শেষ হবার পর ডাকাত বাহিনী তৈরি হবে–তাদের কাছে মোটা দামে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে। রইসউদ্দিন ধমক দিয়ে তাকে থামিয়েছিলেন। তখন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মতলুব মিয়া রইসউদ্দিনের সাথে ঢাকা চলে এল। রইউদ্দিন ভেবেছিলেন দেশের যোগাযোগ-ব্যবস্থা ঠিক হওয়ার পর সে বাড়ি যাবে, কিন্তু তার কোনো নিশানা দেখা গেল না। এই ‘যাচ্ছি’ ‘যাব’ করে করে সে পঁচিশ বছর কাটিয়ে দিল। রইসউদ্দিন তাকে বাসার কাজকর্ম, বাজারপাতি, রান্নাবান্না, এ ধরনের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না। মতলুব মিয়া আশ্চর্যরকম আলসে এবং নির্ধমা। পৃথিবীর কোনো বিষয়ে তার কোনোরকম কৌতূহল নেই, কোনো আগ্রহ নেই। কোনো ব্যাপারে তাই তার কোনো ধারণাও নেই। দেশে কোন পার্টি ক্ষমতায় আছে বা কে প্রধানমন্ত্রী সেটাও সে ভালো করে জানে বলে মনে হয় না। মানুষ যে বানর থেকে এসেছে মতলুব মিয়াকে দেখলে ডারউইন সাহেব সেই থিওরিটা আরও দশ বছর আগে দিতে পারতেন।

    গভীর কোনো সমস্যা হলে রইসউদ্দিন মতলুব মিয়ার সাথে সেটি নিয়ে আলোচনা করেন। সে তখন এমন অকাট মূখের মতো কথা বলে যে, সেগুলো শুনে মাঝেমাঝেই রইসউদ্দিনের মাথায় বিচিত্র সমাধান বের হয়ে আসে। আজকেও রইসউদ্দিন তাকে ডেকে বললেন, “মতলুব মিয়া–”

    “জে?”

    “তোমাকে শিউলি নামে একটা দুষ্টু মেয়ের কথা বলেছিলাম মনে আছে? ঐ যে তার চাচার কাছে লেখা চিঠিগুলো আমার কাছে চলে আসছিল?”

    মতলুব মিয়া মেঝেতে থুতু ফেলে বলল, “জে, মনে আছে। পোস্টঅফিস ডিপার্টমেন্টটাই তুলে দেওয়া উচিত। খালি সময় নষ্ট।”

    রইসউদ্দিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে চিঠিপত্র যাবে কেমন করে?”

    মতলুব মিয়া উদাস-মুখে বলল, “দরকার কী চিঠিপত্র লেখার? লিখতে সময় নষ্ট, পড়তে সময় নষ্ট। কিছু জানতে হলে টেলিগ্রাম করলেই হয়।”

    রইসউদ্দিন কষ্ট করে ধৈর্য ধরে রেখে বললেন, “যা-ই হোক সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে না। আমি বলছিলাম কি–”

    “বলেন।”

    “শিউলি মেয়েটা যে-লোকের সাথে আছে সেই লোক শিউলির কিডনি বিক্রি করার চেষ্টা করছে।”

    মতলুব মিয়া মাথা নেড়ে মুখ গম্ভীর করে বলল, “কত করে হালি?”

    “কিডনি হালি হিসেবে বিক্রি হয় না। মানুষের কিডনি থাকেই দুটি।”

    “তা হলে কত করে জোড়া?” রইসউদ্দিন মুখ শক্ত করে বললেন, “আমি কিডনির দরদাম নিয়ে কথা বলছি। এই যে মেয়েটার কিডনি কেটে ফেলছে, মেয়েটা তো বাঁচবে না।” মতলুব মিয়া নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।”

    রইসউদ্দিন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কী মনে হয়? ব্যাপারটা কি পুলিশকে জানানো উচিত?”

    “সব্বোনাশ!” মতলুব মিয়া আঁতকে উঠে বলল, “পুলিশের ধারেকাছে যাওয়া ঠিক না। পুলিশ ছুঁলে আগেই ছিল আঠারো ঘা, এখন একশো ছত্রিশ ঘা।”

    রইসউদ্দিন তখন মনে মনে-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তার মানে এখন তাঁর পুলিশের কাছেই যাওয়া উচিত। মতলুব মিয়া যেটা বলবে তার উলটোটাই হচ্ছে ঠিক।

    রইসউদ্দিন কিন্তু পুলিশের কাছে গিয়ে বিপদে পড়ে গেলেন। যে-লোকটি ফাঁইলপত্র নিয়ে বসেছিল সে রইসউদ্দিনের কথা শুনতে শুনতে খুব মনোযোগ দিয়ে নাকের লোম ছিঁড়তে লাগল। যখন রইসউদ্দিনের মনে হল তিনি পুরো ব্যাপারটা বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তখন পুলিশের লোকটা হাই তুলে বলল, “তা, কী হয়েছে সমস্যা?”

    রইসউদ্দিন একটু থতমত খেয়ে পুরো ব্যাপারটা আবার গোড়া থেকে বুঝিয়ে বললেন। এবার মানুষটা একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কান চুলকাতে লাগল। রইসউদ্দিন মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন মানুষটা এবারেও কোনো কথা শোনেনি, তাঁকে আবার পুরোটা বলতে হবে। কিন্তু দেখা গেল এবারে সে শুনেছে। মাথা নেড়ে বিকট হাই তুলে বলল, “আমি কী করব?”

    রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “মেয়েটাকে বাঁচাবেন।”

    “মেয়েটার কি কিছু হয়েছে?”

    “এখনও হয় নাই কিন্তু হবে।”

    “যখন হবে তখন আসবেন।”

    “তখন–তখন—” রইসউদ্দিন তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “তখন কি দেরি হয়ে যাবে না?”

    মানুষটি হঠাৎ কান চুলকানো বন্ধ করে খুব গম্ভীর মুখ করে বলল, “আমি কি আপনাকে গ্রেপ্তার করেছি?”

    রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “আমাকে? আমাকে কেন গ্রেপ্তার করবেন?”

    ”যদি আপনি কোনো ক্রাইম করেন সেজন্যে?”

    রইসউদ্দিন মুখ হাঁ করে বসে রইলেন আর পুলিশের লোকটি মুখের মাঝে খুব একটা সবজান্তার ভাব করে বলল, “আপনাকে গ্রেপ্তার করি নাই। আপনি ভবিষ্যতে ক্রাইম করবেন সেজন্যে এখন গ্রেপ্তার করা যায় না। ক্রাইমটা আগে করতে হয়। এখানেও সেই এক ব্যাপার। এক লোক ভবিষ্যতে ক্রাইম করবে সেজন্যে তাকে অ্যাডভান্স গ্রেপ্তার করা যায় না। আগে করুক তখন গিয়ে কাঁক করে ধরব। শালার ব্যাটার টাকা-পয়সা কেমন আছে?”

    রইসউদ্দিন হতবুদ্ধি হয়ে ফিরে এলেন। মনে হল এই প্রথমবার মতলুব মিয়াই পুলিশের ব্যাপারটা ঠিক বলেছিল। রইসউদ্দিন পরের কয়েকদিন ভালো করে খেতে পারলেন না, ঘুমাতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত একদিন বিকেলে ঠিক করলেন তিনি নিজেই যাবেন মোল্লা কফিলউদ্দিনের সাথে দেখা করার জন্যে। মানুষটাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলে নিশ্চয়ই বুঝবে ব্যাপারটা।

    বিকালবেলা রওনা দিলেন ট্রেনে। সারারাত ট্রেনে করে গিয়ে ভোরবেলা উঠলেন বাসে–বাস থেকে নেমে নৌকা এবং সবশেষে পাকা দুই মাইল হেঁটে যখন ঠিক জায়গায় পৌঁছালেন তখন বিকেল হয়ে গেছে। মোল্লা কফিলউদ্দিন বি.এ.বি.টি গ্রামের মাতবরগোছের মানুষ, তার বাড়ি খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হল না। রইসউদ্দিন বাড়ির ভিতরে খবর পাঠিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাড়িটি গ্রামের আর দশটা বাড়ির মতো, পুরানো নকশাকাটা চেয়ার, মাটির ভিটে, সামনে টিউবওয়েল, পাশে খড়ের গাদা।

    কিছুক্ষণের মাঝেই মোল্লা কফিলউদ্দিন বের হয়ে এলেন। রইসউদ্দিন ঠিক যেরকম একটা চেহারা কল্পনা করেছিলেন তার চেহারা ঠিক সেরকম। লম্বা শেয়ালের মতো মুখ, সেখানে ছাগলের মতো দাড়ি, শুকনো দড়ির মতো শরীর, কোটরাগত চোখ, মাথায় ময়লা তেল-চিটচিটে টুপি, পরনে রং-ওঠা নীল পাঞ্জাবি আর খাটো লুঙ্গি। রইসউদ্দিন দিকে তাকিয়ে খুব সন্দেহের চোখে বললেন, “আপনার কী দরকার?”

    রইসউদ্দিন পকেট থেকে তাঁর লেখা চিঠিগুলো বের করে বললেন, “আপনি এই চিঠিগুলো লিখেছিলেন?”

    মোল্লা কফিলউদ্দিন হঠাৎ কেমন জানি শক্ত হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ ভুরু

    কুঁচকে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং এ-সময়টাতে তাঁকে কেমন জানি ছুঁচোর মতো দেখাতে থাকে। রইসউদ্দিন বললেন, “আপনি লিখেছেন শিউলির কিডনি বিক্রি করবেন। কিন্তু—”

    “আপনি কি শিউলির চাচা?”

    “আমি কে সেটা ইম্পরট্যান্ট না।”

    “তা হলে কোনটা ইম্পরট্যান্ট?”

    “মানুষের কিডনি আলু-পটল না যে বাজারে বিক্রি করবেন–সেইটা ইম্পরট্যান্ট। আপনি লিখেছেন কিডনি কাটলে সেটা আবার টিকটিকির লেজের মতন গজায়–সেটা ঠিক না। আপনাকে যে এটা বুঝিয়েছে সে-ব্যাটা মহা বদমাইশ। সত্যি সত্যি যদি দুটো কিডনিই কেটে ফেলা হয় মেয়েটা মারা পড়বে। শুধু তাই না, আপনারাও ফাঁসি হয়ে যাবে।”

    মোল্লা কফিলউদ্দিন পিটপিট করে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। রইসউদ্দিন বললেন, “কী হল, আপনি কিছু বলছেন না কেন?”

    “আপনি লেকচার দিতে এসেছেন লেকচার দিয়ে চলে যান, আমি কি বলব?”

    মোল্লা কফিলউদ্দিনের কথা শুনে হঠাৎ রইসউদ্দিনের রাগ উঠে গেল। মেঘের মতো গর্জন করে বললেন, ‘আমি লেকচার দিতে আসি নাই। আমি একটা মেয়ের জান বাঁচাতে এসেছি।”

    মোল্লা কফিলউদ্দিন পিচিক করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলে বললেন, “সেই মেয়ের জন্যে দরদ এতদিন পরে উথলে উঠল কেন? এতদিন থেকে যে আমার কাছে থাকে খায় তখন কেউ খোঁজ নেয় নাই কেন?”

    “কেউ খোঁজ পায় নাই তাই খোঁজ নেয় নাই।”

    “এখন কিসের খোঁজ পেয়ে আপনি এসেছেন সেইটা আমি বুঝি নাই মনে করছেন? আমার বয়স তো কম হয় নাই, আমি মানুষ চিনি।”

    মোল্লা কফিলউদ্দিন পাঞ্জাবির হাতায় ফাঁৎ করে নাক ঝেড়ে বললেন, “তবে আপনি দেরি করে ফেলেছেন।”

    “দেরি?”

    “হ্যাঁ। আবাগীর বেটি শিউলি পালিয়ে গেছে।”

    “পালিয়ে গেছে?”

    “হ্যাঁ।”

    রইসউদ্দিন হতবাক হয়ে মোল্লা কফিলউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটা যে মিথ্যে কথা বলছে সেটা বুঝতে তাঁর একটুও দেরি হল না। মাথা নেড়ে বললেন, “এতটুকুন মেয়ে পালিয়ে কোথায় যাবে?”

    “সেটা আমি কী জানি? আর ঐ মেয়ে এইটুকুন হলে কী হবে, বেটি বজ্জাতের ঝাড়!”

    রইসউদ্দিন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। মোল্লা কফিলউদ্দিনের দাড়ি ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলার ইচ্ছে করল, ব্যাটা ছুঁচো কোথাকার, মিথ্যে বলবি তো মাথা ভেঙে ফেলব। কিন্তু সেটা তো আর সত্যি সত্যি বলা যায় না, তাই গলার স্বর শান্ত রেখে বললেন, “আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই কোথাও আছে, খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন।”

    “কী আমি মিথ্যে কথা বলছি?” মোল্লা কফিলউদ্দিন হুংকার দিয়ে বললেন, “আপনার কত বড় সাহস, আমার বাড়িতে এসে আমাকে মিথ্যেবাদী বলেন?”

    “আমি মিথ্যেবাদী বলি নাই। আমি বলছি–”

    “আপনি কী বলেছেন আমার শোনার দরকার নাই।” কফিলউদ্দিন মাটিতে থুতু ফেলে বললেন, “বাপ-খাগি মা-খাগি আবাগীর বেটি ছয় মাস আমার বাড়িতে আছে, কারও খোঁজ নাই, এখন আসছেন দরদ দেখাতে? ঐ ছেমড়ি গেছে জাহান্নামে, তারে খুঁজতে হলে আপনি জাহান্নামে যান।”

    রইসউদ্দিন দাঁত-কিড়মিড় করে বললেন, “দেখেন মোল্লা কফিলউদ্দিন সাহেব, আমি কোথায় যাব সেটা আমিই ঠিক করব। তবে এই মেয়ের যদি কিছু হয় তা হলে আপনি শুনে রাখুন–”

    “কী শুনে রাখব?”

    “আপনার গলায় ফাঁসির দড়ি লাগানোর সব প্রমাণ আমার কাছে আছে।“

    কফিলউদ্দিন কুতকুতে চোখে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর রইসউদ্দিন রেগেমেগে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন। গ্রামের পথে আবার দুই মাইল হেঁটে নৌকায় উঠলেন, নৌকা করে ঘণ্টাদুয়েক গিয়ে বাস, বাসে ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর ট্রেন। সারাদিনে দুটো ট্রেন। সকালেরটা চলে গেছে, পরের ট্রেন রাত নয়টায়, এখনও ঘণ্টাদুয়েক বাকি।

    রইসউদ্দিন স্টেশনের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে ভাত খেয়ে রেলস্টেশনের বেঞ্চে বসে রইলেন। শিউলি নামের এই বাচ্চা মেয়েটাকে কীভাবে পিশাচ মোল্লা কফিলউদ্দিনের হাত থেকে বাঁচানো যায় সেটা ভাবছিলেন। দেশ তো এখনও মগের মুলুক হয়ে যায়নি, নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো উপায় আছে। এমনিতে থানা-পুলিশ যদি উৎসাহ না দেখায়, নারী সংগঠন, শিশু সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন–এসব বড় বড় জায়গায় যাওয়া যাবে। তার কাছে কফিলউদ্দিনের নিজের হাতে লেখা তিন-তিনটে চিঠি আছে। কাউকে বিশ্বাস করানো কোনো ব্যাপারই না।

    কী করা যায় ভেবে ভেবে রইসউদ্দিনের যখন প্রায় মাথা-গরম হয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ মনে হল কেউ-একজন যেন তাঁর শার্টের কোনা ধরে টানছে। রইসউদ্দিন মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলেন আট-নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। রইসউদ্দিন বাচ্চাকাচ্চাকে খুব ভয় পান তাই একেবারে চমকে উঠলেন। কাঁপা গলায় বললেন, “কে?”

    মেয়েটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমি শিউলি।”

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবুবুনের বাবা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বকুলাপ্পু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }