Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সেরা কিশোর গল্প – হুমায়ূন আহমেদ (অসম্পূর্ণ)

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প63 Mins Read0
    ⤷

    নিউটনের ভুল সূত্র

    নিউটনের ভুল সূত্র

    রূপেশ্বর নিউ মডেল হাইস্কুলের সায়েন্স টিচার হচ্ছেন অমর বাবু।

    অমর নাথ পাল, বি.এসসি. (অনার্স, গোল্ড মেডাল)।

    খুব সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। স্কুলের স্যারদের আসল নামের বাইরে একটা নকল নাম থাকে। ছাত্র মহলে সেই নামেই তাঁরা পরিচিত হন। অমর বাবু স্কুলে ঘড়ি স্যার নামে পরিচিত। তাঁর বুক পকেটে একটা গোল ঘড়ি আছে। ক্লাসে ঢোকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ামাত্র আবার ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। তখন যদি তাঁর ভুরু কুচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়েনি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।

    তার ক্লাসে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। হাসা যাবে না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোঁচা দেয়া চলবে না, খাতায় কাটাকুটি খেলা চলবে না। মনের ভুলেও যদি কেউ হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব চোখে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলবেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেইৗয়েন্স পড়াবার সময় তুমি হেসেছ, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। মহা অন্যায় করেছ। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার প্রবাড়ি যাবে না। পাটীগণিতের সাত প্রশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?

    অপরাধী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লাঞ্ছনা দেখে অন্য কেউ হয়তো ফিক করে হেসে ফেলল। অমর স্যার থমথমে গলায় বলবেন, ও-কি! তুমি হাসছ কেন? হাস্যকর কিছু কি বলেছি? তুমি উঠে দাঁড়াও। অকারণে হাসার জন্যে শাস্তি হিসেবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে।

    অমর বাবু পকেট থেকে ঘড়ি বের করবেন। পাঁচ মিনিট তিনি একদৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইবেন। ছাত্ররা মূর্তির মতো বসে থাকবে।

    .

    অমর বাবুর বয়স পঞ্চাশ। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে–এই নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি ছেলেই বড় হয়েছে–রূপেশ্বর বাজারে একজনের কাপড়ের ব্যবসা, অন্যজনের ফার্মেসি আছে। ভালো টাকা রোজগার করে। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য মেয়েটির বিয়ের কথা হচ্ছে। এদের কারোর সঙ্গেই তাঁর বনে না। স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। অনেক দিন হলো বাড়িতেও থাকেন না। স্কুলের দোতলায় একটা খালি ঘরে বাস করেন। সেখানে বিছানা বালিশ আছে। একটা স্টোভ আছে। গভীর রাতে স্টোভে চা বানিয়ে খান।

    রূপেশ্বর স্কুলের হেড স্যার তাঁকে বলেছিলেন, আপনার ঘর-সংসার থাকতে আপনি স্কুলে থাকেন, এটা কেমন কথা?

    অমর বাবু গম্ভীর গলায় বললেন, রাত জেগে পড়াশোনা করি, একা থাকতেই ভালো লাগে। তা ছাড়া ওদের সঙ্গে আমার বনে না। তবে স্কুলে রাত্রিযাপন করে যদি আপনাদের অসুবিধার কারণ ঘটিয়ে থাকি তাহলে আমাকে সরাসরি বলুন, আমি ভিন্ন ব্যবস্থা দেখি।

    হেড স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে না–এই কথা হচ্ছে না। আপনার যেখানে ভালো লাগবে আপনি সেখানে থাকবেন।

    তিনি অমর বাবুকে ঘটালেন না। কারণ, অমর বাবু অসম্ভব ভালো শিক্ষক। অঙ্কের ডুবোজাহাজ! ডুবোজাহাজ বলার অর্থ তাকে দেখে মনে হয় না তিনি অঙ্ক জানেন। ভাবুক ভাবুক ভাব আছে। ক্লাসে কোনো অঙ্ক তাকে করতে দিলে এমন ভাব করেন যেন অঙ্কটা মাথাতেই ঢুকছে না। তারপর পকেট থেকে গোল ঘড়ি বের করে ঘড়ির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, চোখ বন্ধ করে মুখেমুখে অঙ্কটা করে দেন। স্কুলের অনেক ছাত্রের ধারণা এই ঘড়িতে রহস্য আছে। ঘড়ি অঙ্ক করে দেয়। ব্যাপার তা নয়। তাঁর ঘড়ির সেকেণ্ডের কাটাটায় গণ্ডগোল আছে। কখনো দ্রুত যায় কখনো আস্তে তবে গড়ে সমান থাকে। এইটাই তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করেন।

    অমর বাবুকে ভালো মানুষ বলা যেতে পারে তবে তিনি অমিশুক, কথাবার্তা প্রায় বলেন না বললেই হয়। কারোর সাতে-পাঁচেও থাকেন না। টিচার্স কমন রুমে জানালার পাশের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকেন। ঘণ্টা পড়লে ক্লাসে রওনা হন। স্কুলের আরবি শিক্ষক মৌলানা ইদরিস আলি তাঁকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করার চেষ্টা করেন। বিশেষ লাভ হয় না। তিনি ঠাট্টাতামাশা পছন্দ করেন না। কেউ ঠাট্টা করলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন।

    আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল। আগামী কাল ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যেই একটা ছুটি ছুটি ভাব চলে এসেছে। থার্ড পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। তিনি জানালার কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ইদরিস সাহেব তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তারপর অমর বাবু, আপনার সায়েন্সের কী খবর?

    অমর বাবু কিছু বললেন না, তবে চোখ তুলে তাকালেন। মনে-মনে রসিকতার জন্যে প্রস্তুত হলেন। বিজ্ঞান নিয়ে এই লোকটি কঠিন রসিকতা করে যা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।

    ইদরিস সাহেব পানের কৌটা থেকে পান বের করতে করতে বললেন, অনেকদিন থেকে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে। রোজই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব।

    জিজ্ঞেস করলেই পারেন।

    ভরসা হয় না। আপনি তো আবার প্রশ্ন করলে রেগে যান।

    বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা করলে রাগি। এমনিতে রাগী না–আপনার প্রশ্নটা কী?

    ইদরিস সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, পৃথিবী যে ঘুরছে এই নিয়ে প্রশ্ন। পৃথিবী তো ঘুরছে, তাই না?

    জি। পৃথিবীর দুরকম গতি–নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে, আবার সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।

    বাঁই বাঁই করে ঘুরছে?

    জি?

    তাই যদি হয় তাহলে আমাদের মাথা কেন ঘুরে না? মাথা ঘোরা উচিত ছিল না? এমনিতে তো মাঠে দুটা চক্কর দিলে মাথা ঘুরতে থাকে। ওকি, এ-রকম করে তাকাচ্ছেন কেন? রাগ করছেন  না-কি?

    বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা আমি পছন্দ করি না।

    রসিকতা কি করলাম?

    অমর বাবু মোর চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ঘণ্টা পড়বার আগেই ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই তার নিয়ম। পৃথিবী কোনো কারণে হঠাৎ উল্টে গেলেও নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।

    আজ পড়ার বিষয়বস্তু হলো আলো। আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ। বড় চমৎকার বিষয়। আলো হচ্ছে একই সঙ্গে তরঙ্গ ও বস্তু। কী অসাধারণ ব্যাপার। ক্লাস টেনের ছেলেগুলি অবিশ্যি এসব বুঝবে না। তবে বড় হয়ে যখন পড়বে তখন চমৎকৃত হবে।

    অমর বাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আলোর গতিবেগ কত— কে বলতে পার? সাতজন ছেলে হাত তুলল। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সবাই হাত তুলবে। ছেলেগুলি কি সায়েন্সে মজা পাচ্ছে না? তা কি করে হয়? পৃথিবীতে মজার বিষয় তো একটাই। সায়েন্স।

    তুমি বল, আলোর গতিবেগ কত?

    প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।

    ভেরি গুড। এখন তুমি বল, আলোর গতি কি এর চেয়ে বেশি হতে পারে?

    জ্বি-না স্যার।

    কেন পারে না?

    এটাই স্যার নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম।

    ভেরি গুড। ভেরি ভেরি গুড। প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে যে নিয়মের কখনো ব্যতিক্রম হবে না। হতে পারে না। যেমন মাধ্যাকর্ষণ। একটা আম যদি গাছ থেকে পড়ে তাহলে তা মাটিতেই পড়বে, আকাশে উড়ে যাবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?।

    জি-স্যার।

    মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জনক কে?

    নিউটন।

    নামটা তুমি এইভাবে বললে যেন নিউটন হলেন একজন রাম-শ্যাম, যদু-মধু, রহিম-করিম। নাম উচ্চারণে কোনো শ্রদ্ধা নাই–বল মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।

    ছাত্রটি কাঁচুমাচু মুখে বলল, মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।

    একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীর নাম অশ্রদ্ধার সঙ্গে বলার জন্যে তোমার শাস্তি হবে। ক্লাস শেষ হলে বাড়ি যাবে না, পাটীগণিতের বার নম্বর প্রশ্নমালার একুশ আর বাইশ এই দুটি অঙ্ক করে তারপর যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?

    ছেলেটির মুখ আরো শুকিয়ে গেল।

    অমর বাবুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলি তার মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান অবহেলা করছে। অশ্রদ্ধার সঙ্গে পড়ছে। খুবই দুঃখের কথা।

    সন্ধ্যার পর তিনি স্কুল লাইব্রেরিতে খানিকক্ষণ পড়াশোনা করলেন। বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনকৰ্থা। মনের অশান্ত ভাব একটু কমল। তিনি স্কুলের দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে এলেন। তার ছোট ছেলে রতন টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে। মুখ কাঁচুমাচু করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বাবাকে স্কুলের ছাত্রদের চেয়েও বেশি ভয় করে।

    রতন কিছু বলবি?

    মা বলছিলেন, অনেকদিন আপনি বাড়িতে যান না।

    তাতে অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।

    মার শরীরটা ভালো না। জ্বর।

    ডাক্তার ডেকে নিয়ে যা। আমাকে বলছিস কেন? আমি কি ডাক্তার?

    রতন মাথা নিচু করে চলে গেল। অমর বাবুর মনে হলো আরেকটু ভালো ব্যবহার করলেই হতো। এতটা কঠিন হবার প্রয়োজন ছিল না। কঠিন না হয়েই বা কি করবেন–গাধা ছেলে, মেট্রিকটা তিনবারেও পাস করতে পারেনি। জগতের আনন্দময় বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি কিছুই জানল না— আলো কী সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আলো কী জিজ্ঞেস করলে নির্ঘাৎ বলবে—— এক ধরনের তরকারি, ভর্তা করেও খাওয়া যায়। ছিঃ ছিঃ!

    ঘড়ি ধরে ঠিক নটায় তিনি রাতের খাবার শেষ করলেন। খাওয়া শেষ করতেই কেঁপে বৃষ্টি নামল। খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া আসতে লাগল। মেঘ ডাকতে লাগল। অমর বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলেন। তাঁর ঘুমুতে যাবার সময় বাঁধা আছে রাত দশটা কুড়ি। এখনো অনেক বাকি আছে। এই সময়টা তিনি চুপচাপ বসে নানা বিষয় ভাবেন। ভাবতে ভালো লাগে। আগে পড়াশোনা করতেন। এখন চোখের কারণে হারিকেনের আলোয় বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। মাথার যন্ত্রণা হয়। ঢাকায় গিয়ে ভালো ডাক্তার দিয়ে চোখ দেখান দরকার।

    তিনি বিছানায় পা তুলে উঠে বসলেন। শীত শীত লাগছিল, গায়ে একটা চাদর জড়াবেন কি-না যখন ভাবছেন তখন হঠাৎ শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি খানিকটা নড়ে উঠলেন। আর তখন অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হলো— তিনি লক্ষ করলেন বিছানা ছেড়ে তিনি উপরে উঠে যাচ্ছেন। প্রায় হাত তিনেক উঠে গেলেন এবং সেখানেই স্থির হরে গেলেন। চোখের ভুল? অবশ্যই চোখের ভুল। মহাবিজ্ঞানী নিউটনের সূত্র অনুযায়ী এটা হতে পারে না। হতে পারে না। হতে পারে না। নিতান্তই অসম্ভব। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠা যেমন অসম্ভব, এটাও তেমনি অসম্ভব। এ হতেই পারে না।

    কিন্তু হয়েছে। তিনি খাট থেকে তিন হাত উপরে স্থির হয়ে আছেন। ঘরের সবকিছু আগের মতো আছে, শুধু তিনি শূন্যে ভাসছেন। অমর বাবু চোখ বন্ধ করে মনে-মনে বললেন, হে ঈশ্বর। দয়া কর। দয়া কর। শরীরে কেমন যেন অনুভূতি হলো। হয়তো এবার নিচে নেমেছেন। তিনি চোখ খুললেন, না আগের জায়গাতেই আছেন। এটা কী করে হয়?

    প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ধপ করে নিচে পড়লেন। খানিকটা ব্যথাও পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে দিলেন। কী ঘটেছে তা নিয়ে তিনি আর ভাবতে চান না। ঘুমুতে চান। নিশ্চিন্ত ঘুম। ঘুম ভেঙে যাবার পর হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

    রাতে তাঁর ভালো ঘুম হলো। শেষ রাতের দিকে তিনি একবার জেগে উঠে বাথরুমে যান। আজ তাও গেলেন না, এক ঘুমে রাত পার করে দিলেন। যখন ঘুম ভাঙল—— তখন চারদিকে দিনের কড়া আলো, রোদ উঠে গেছে। তাঁর দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম সূর্য উঠার পর ঘুম ভাঙল। রাতে কী ঘটেছিল তা মনে করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দুঃস্বপ্ন, নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন। বদহজম হয়েছিল। বদহজমের কারণে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এরকম হয়। মানুষ খুব ক্লান্ত থাকলে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখেছেন। দীর্ঘ স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল হয় খুব কম। হয়তো এক সেকেণ্ডের একটা স্বপ্ন দেখেছেন। এই হবে— এ ছাড়া আর কী? স্বপ্ন, অবশ্যই স্বপ্ন। অমর বাবুর মন একটু হালকা হলো।

    পরের দিনের কথা। প্রথম পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। টিচার্স কমন রুমে চুপচাপ বসে আছেন। ইদরিস সাহেব যথারীতি তার পাশে এসে বসলেন। পানের কৌটা বের করতে করতে বললেন, অমর বাবুর শরীর খারাপ না-কি?

    জ্বি-না।

    দেখে কেমন-কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে অসুস্থ। গায়ে কি জ্বর আছে?

    জ্বি-না।

    রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?

    না, তবে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

    কী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?

    অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, দেখলাম শূন্যে ভাসছি।

    আরে ভাই এটা কি দুঃস্বপ্ন? শূন্যে ভাসা, আকাশে উড়ে যাওয়া–এইসব স্বপ্ন তো আমি রোজই দেখি। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি অনেক উঁচু থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেছি, খুজব টেনশানের স্বপ্ন।

    অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, ঠিক স্বপ্ন না, মনে হয় জাগ্রত অবস্থায় দেখেছি।

    কী বললেন? জাগ্রত অবস্থায়? জেগে জেগে দেখলেন আপনি শূন্যে ভাসছেন?

    জি।

    জাগ্রত অবস্থায় দেখলেন শূন্যে ভাসছেন?

    অমর বাবু জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। ইদরিস সাহেব বললেন, রাত-দিন সায়েন্স সায়েন্স করে আপনার মাথা ইয়ে হয়ে গেছে। বিশ্রাম দরকার। আপনি এক কাজ করুন— ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। আজ ক্লাস নেয়ার দরকার নেই। আমি হেড স্যারকে বলে আসি?

    না না, আমার শরীর ঠিকই আছে।

    অমর বাবু যথারীতি ক্লাসে গেলেন। তাঁর পড়াবার কথা আলোর ধর্ম। তিনি শুরু করলেন মাধ্যাকর্ষণ।

    দুটি বস্তু আছে। একটির ভর m; অন্যটির ভর m; তাদের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ হবে

    (m1m2)/r

    এটি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। স্যার আইজাক নিউটনের বিখ্যাত সূত্র। এর কোনো নড়চড় হবে না। হতে পারে না। বাবারা বুঝতে পারছ?

    ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আজ পড়াবার কথা আলোর ধর্ম, প্রতিফলন, প্রতিসরণ; স্যার মাধ্যাকর্ষণ পড়াচ্ছেন কেন?

    বাবারা কি বলছি বুঝতে পারছ?

    ছাত্ররা জবাব দিল না।

    যদি কেউ বুঝতে না পার হাত তোল।

    কেউ হাত তুলল না। একসময় ঘণ্টা পড়ে গেল। কোনোদিনও যা হয় না তাই হলো। অমর বাবু ঘণ্টা পড়ার পরেও চুপচাপ বসে রইলেন। পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন না বা উঠেও গেলেন না। চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো বসে রইলেন। ছাত্রদের বিস্ময়ের কোনো সীমা রইল না।

    .

    সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অমর বাবু স্কুল লাইব্রেরিতে বসে আছেন। হাতে একটা বই। নাম– মৌমাছিদের বিচিত্র জীবন। পড়তে বড় ভালো লাগছে। কত ক্ষুদ্র প্রাণী অথচ কী অসম্ভব বুদ্ধি! কী অসম্ভব জ্ঞান! মৌচাকের ভেতরের তাপমাত্রা তারা একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থির করে রাখে। বাড়তেও দেয় না, কমতেও দেয় না। এই কাজটা তারা করে অতি দ্রুত পাখা কাঁপিয়ে। তাপমাত্রা এক হাজার ভাগের এক ভাগ বেশ-কম হয় না। মানুষের পক্ষেও যা বেশ কঠিন।

    তিনি রাত আটটার দিকে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু জ্বর জ্বর লাগছে। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে গেছে। তিনি কিছু খাবেন না বলে ঠিক করলেন। না খাওয়াই ভালো হবে। অনেক সময় পেটের গণ্ডগোল থেকে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। তাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা ঘটতে পারে। না খেলে তা হবে না। লেবুর শরবত বানিয়ে এক গ্লাস শরবত খেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়লেন।

    কাল শীত শীত লাগছিল, আজ আবার গরম লাগছে। জানালা খোলা, সামান্য বাতাস আসছে। সেই বাতাস মশারির ভেতর ঢুকছে না। তিনি মশারি খুলে ফেললেন। মশা কামড়াবে। কামড়াক। গরমের চেয়ে মশার কামড় খাওয়া ভালো।

    মশারি খুলে ফেলে বিছানায় শোয়া মাত্র আবার গত রাতের মতো হলো। তিনি ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে যেতে লাগলেন। দেখতে-দেখতে তার মাথা ঘরের ছাদ স্পর্শ করল।

    তিনি হাত দিয়ে সেই ছাদে ধাক্কা দেয়া মাত্র খানিকটা নিচে নেমে আবার উপরে উঠতে লাগলেন। একী অদ্ভুত কাণ্ড! আবারো কি স্বপ্ন? না, স্বপ্ন না। আজকেরটা স্বপ্ন না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার উপর কাজ করছে না। পৃথিবীর ভর যদি হয় m1 তিনি যদি হন m2 এবং তাঁর ভর m2 যদি হয় শূন্য তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বল হবে শূন্য। তাঁর ভর কি এখন শূন্য? তিনি পাশ ফিরলেন, শরীরটা চমৎকারভাবে ঘুরে গেল। সাঁতার কাটার মতো করলেন। তেমন লাভ হলো না। যেখানে ছিলেন সেখানেই রইলেন। এটাই স্বাভাবিক, বাতাস অতি হালকা। হালকা বাতাসে সাঁতার কাটা যাবে না।

    ব্যাখ্যা কী? এর ব্যাখ্যা কী? একটা মানুষের ভর হঠাৎ শূন্য হয়ে যেতে পারে না। নিচে নামার উপায় কী? মনে-মনে আমি যদি চিন্তা করি নিচে নামব তাহলে কি নিচে নামতে পারব? তিনি মনে-মনে চিন্তা করলেন— নেমে যাচ্ছি, দ্রুত নেমে যাচ্ছি। লাভ হলো না। যেখানে ছিলে সেখানেই রইলেন।

    আচ্ছা তিনি যদি থুথু ফেলেন তাহলে থুথুটার কী হবে? মাটিতে পড়ে যাবে না শূন্যে ঝুলতে থাকবে? তিনি থুথু ফেললেন। খুব স্বাভাবিকভাবে থুথু মাটিতে পড়ল। গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ছেড়ে দিলে সেটিও কি শূন্যে ভাসতে থাকবে? না-কি নিচে পড়ে যাবে? অতি সহজেই এই পরীক্ষা করা যায়। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেললেন। ছেড়ে দিতেই দ্রুত তা নিচে নেমে গেল। তার মানে এই অদ্ভুত ব্যাপাটির সঙ্গে শুধুমাত্র তিনিই জড়িত। তার গায়ের পোশাকের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তিনি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন মাধ্যাকর্ষণ বল যদি হয় F তাহলে–

    F=(m1m2)/ r^2

    m1 পৃথিবীর ভর। m2 তাঁর নিজের ভর। r হচ্ছে তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব। m2 যদি ‘0’ হয়, F হবে শূন্য। কিংবা r যদি হয় অসীম তাহলেও F হবে ‘0’ কোনো বিচিত্রি কারণে কি তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব অসীম হয়ে যাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে অমর বাবুর ঘুম পেয়ে গেল। একসময় মাটি থেকে ছফুট উঁচুতে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম। তার নাকও ডাকতে লাগল। ঘুমের মধ্যেই তিনি পাশ ফিরে শুলেন। কোনো রকম অসুবিধা হলো না।

    ঘুম ভাঙলো ভোরবেলা।

    অনেক বেলা হয়েছে। ঘরে রোদ ঢুকেছে। তিনি পড়ে আছেন মেঝেতে। কখন মাটিতে নেমে এসেছেন তিনি জানেন না। গায়ে কোনো ব্যথ্যা বোধ নেই, কাজেই ধপ করে পড়েন নি— আস্তে-আস্তে নেমে এসেছেন।

    অমর বাবু স্বাভাবিক মানুষের মতো হাত-মুখ ধুলেন। মুড়ি গুড় দিয়ে সকালের নাশতা সারলেন। পুকুর থেকে গোসল শেষ করে যথাসময়ে স্কুলে গেলেন। আজ প্রথম পিরিয়ডেই তার ক্লাস। তিনি ক্লাস না নিয়ে নিজের চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। মনে হলো ঘুমুচ্ছেন। আসলে ঘুমুচ্ছিলেন না, ভাবার চেষ্টা করেছিলেন–তার জীবনে এসব কী ঘটছে?

    ব্যাপারটা শুধু রাতেই ঘটছে। দিনে ঘটছে না। আচ্ছা তিনি যদি তার নিজের ঘরে না ঘুমিয়ে অন্য কোথাও থাকেন তাহলেও কি এই ব্যাপার ঘটবে? রাতে খোলা মাঠে যদি ঘুমিয়ে থাকনে তাহলে কি ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে চলে যাবেন? মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি বা সূর্যের কাছাকাছি? কিংবা আরো দূরে এন্ড্রোমিড়া নক্ষত্রপুঞ্জে… সুদূর কোনো ছায়াপথে…?

    স্যার।

    অমর বাবু চমকে তাকালেন। দপ্তরি কালিপদ দাঁড়িয়ে আছে।

    হেড স্যার আপনারে বুলায়।

    হেড স্যার তাকে কেন ডেকে পাঠালেন তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ইদরিস সাহেব কি হেড স্যারকে কিছু বলেছেন? বলতেও পারেন। পেট পাতলা মানুষ। বলাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা ব্যাপারটা কি তিনি নিজে গুছিয়ে হেড স্যারকে বলবেন? বলা যেতে পারে। মানুষ ভালো। শুরুতেই অবিশ্বাসের হাসি হাসবেন না।

    হেড স্যার বললেন, কেমন আছেন অমর বাবু?

    জি ভালো।

    দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। বসুন। চা খাবেন?

    চা তোর স্যার আমি খাই না।

    এক-আধবার খেলে কিছু হয় না। খান। কালিপদকে চা দিতে বলেছি।

    কালিপদ চা দিয়ে থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা দিতে গেল। হেড স্যার বললেন, শুনলাম গত কাল ক্লাস নেননি। আজও ফাস্ট পিরিয়ড মিস গেছে।

    ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে স্যার।

    ও আচ্ছা। আপনার তো সব ঘড়ি-ধরা। ঘুম ভাঙতে দেরি হলো কেন?

    অমর বাবু চুপ করে রইলেন।

    পারিবারিক কোনো সমস্যা যাচ্ছে না-কি?

    জি-না।

    আপনার মেয়ে গত কাল আমার কাছে এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করল। আপনি বাড়িতে থাকেন না। এই নিয়ে বেচারির মনে খুব দুঃখ। দুঃখ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

    আমি একা থাকতেই পছন্দ করি।

    নিজের পছন্দকে সব সময় খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। অন্যদের কথাও ভাবতে হয়। আমরা সামাজিক জীব…

    স্যার উঠি?

    বসুন খানিকক্ষণ। গল্প করি— অমর বাবু আমি বলি কি যদি অসুবিধা না থাকে তা হলে, আপনার সমস্যাটা আমাকে বলুন। ইদরিস সাহেব স্বপ্নের কথা কি সব বলছিলেন—

    অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, বিজ্ঞানের সূত্র মিলছে না স্যার।

    হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন সূত্র মিলছে না?

    স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র–মধ্যাকর্ষণ সূত্র।

    আপনার ধারণা সূত্রটা ভুল?

    অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। একসময় বললেন, আচ্ছা আপনি বরং বাড়িতে চলে যান। আপনাকে দশ দিনের ছুটি দিয়ে দিলাম। বিশ্রাম করুন। বিশ্রাম দরকার। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাঝে মাঝে মানুষের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।

    স্যার, আমার মাথা ঠিকই আছে।

    অবশ্যই ঠিক আছে। কথার কথা বললাম। যান, বাসায় চলে যান… বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে আছে।

    অমর বাবু বাড়ি গেলেন না। কমন রুমে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। হাতে একটা ফুল স্ক্যাপ কাগজ। সেই কাগজে নিউটনের সূত্র নতুনভাবে লিখলেন—

    F = k.[(m1m2)/r^2]

    এখানে k-এর মান ১ তবে মাঝে মাঝে ‘k’ এর মান হচ্ছে শূন্য। যেমন তার ক্ষেত্রে হচ্ছে। একসময় কলম দিয়ে নির্মমভাবে সব কেটেও ফেললেন। নিউটন যে সূত্র দিয়ে গেছেন–তার মতো সামান্য মানুষ সেই সূত্র পাল্টাতে পারেন না।

    অমর বাবু টিফিন পিরিয়ডে অনেক সময় নিয়ে ইংরেজিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির বাংলা অনুবাদ অনেকটা এই রকম—

    জনাব,

    আমি রূপেশ্বর হাইস্কুলের বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র দিতেছি। সম্প্রতি আমার জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটিতেছে যাহার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি খুঁজিয়া না পাইয়া আপনার দ্বারস্থ হইলাম। আমি শূন্যে ভাসিতে পারি। আপনার নিকট খুব অদ্ভুত মনে হইলেও ইহা সত্য। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়া বলিতেছি–আপনাকে যাহা বলিলাম সবই সত্য। কোনো রকম চেষ্টা ছাড়াই আমি শুন্যে উঠিতে পারি এবং ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাইতে পারি। জনাব, বিষয়টি কী, বুঝিবার ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহা হইলে এই অধম আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবে। আপনি বলিলেই ঢাকায় আসিয়া আমি আপনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটি চাক্ষুষ দেখাইব। জনাব, আপনি আমার প্রতি দয়া করুন— বিষয়টি বুঝিতে আমাকে সাহায্য করুন।

    বিনীত
    অমর দাস পাল
    B.Sc. (Hons)

    দশ দিনের পুরোটাই তিনি নিজের ঘরে কাটালেন— বাড়িতে গেলেন না। তাঁকে নিতে তাঁর ছোট মেয়ে অতসী এসেছিল। তাকে ধমকে বিদায় করলেন। এই মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ছিল– তাকে এত করে বললেন সায়েন্স পড়তে, সে ভর্তি হল আর্টস-এ। কোনো মানে হয়? তাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র কী জিজ্ঞেস করলে সে হা করে তাকিয়ে থাকবে। কী দুঃখের কথা!

    অতসীকে ধমকে ঘর থেকে বের করে দিলেও সে গেল না। বারান্দায় পঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তিনি বাইরে এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কাঁদছিস কেন?

    সে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তোমার শরীর খারাপ বাবা। তুমি বাড়িতে চল।

    শরীর খারাপ তোকে কে বলল?

    সবাই বলাবলি করছে। তুমি না-কি কি সব স্বপ্ন-টপ্ন দেখ।

    কোনো স্বপ্ন দেখি না। আমি ভালো আছি। নির্জনে একটা পরীক্ষা করছি। পরীক্ষা শেষ হোক— তোদের সঙ্গে এসে কয়েক দিন থাকব।

    কীসের পরীক্ষা।

    কীসের পরীক্ষা বললে তো তুই বুঝবি না। হা করে তাকিয়ে থাকবি। এত করে বললাম সায়েন্স পড়তে।

    অঙ্ক পারি না যে।

    অঙ্ক না পারার কী আছে! যোগ, বিয়েগ, গুণ, ভাগ— অঙ্ক তো এর বাইরে না। কাঁদিস না। বাসায় যা। আমি ভালো আছি।

    তিনি যে ভালো আছেন তা কিন্তু না।

    রোজ রাতে একই ব্যাপার ঘটছে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমুতে যান— মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেখেন শূন্যে ভাসছেন। তখন আতঙ্কে অস্থির হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। তিনি ইচ্ছে করলেই নিচে নামতে পারেন না।

    নিচে কীভাবে নামেন তাও জানেন না। রাতটা তার অঘুমেই কাটে। তিনি ঘুমুতে যান দিনে। এমন যদি হত তিনি দিনরাত সারাক্ষণই শূন্যে ভাসছেন তাহলেও একটা কথা ছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন যে, কোনো-এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তাঁর ভর শূন্য হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে রকম না। এমন কেউ এখানে নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে তাঁর কাছে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যান সাহেবও কিছু লিখছেন না। হয়তো ভেবেছেন পাগলের চিঠি। কে আর কষ্ট করে পাগলের চিঠির জবাব দেয়?

    ন দিনের মাথায় অমর বাবু চিঠির জবাব পেলেন। অতি ভদ্র চিঠি। চেয়ারম্যান সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডে লিখেছেন—

    জনাব,

    আপনার চিঠি কৌতূহল নিয়ে পড়লাম। আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। কাজেই বুঝতে পারছেন আপনি যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন ঐ বিজ্ঞান স্বীকার করে না। আপনি যদি আমার অফিসে এসে শূন্যে ভাসতে থাকেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করব না। ভাবব এর পেছনে ম্যাজিকের কোনো কৌশল কাজ করছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাদুকররা শূন্যে ভাসার খেলা সব সময়ই দেখায়।

    যাই হোক, আপনার চিঠি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে আপনার সমস্যাটি মানসিক। আপনি মনে-মনে ভাবছেন— শূন্যে ভাসছেন। আসলে ভাসছেন না। সবচেয়ে ভালো হয় যদি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। একমাত্র তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি।

    বিনীত
    এস. আলি
    M.Sc. Ph.D., F.R.S.

    অমর বাবু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ, তিনি জানেন বিষয়টা সত্যি। তিনি দু-একটা ছোটখাট পরীক্ষা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। যেমন স্কুল থেকে লাল রঙের চক নিয়ে এসেছিলেন। শূন্যে উঠে যাবার পর সেই লাল রঙের চক দিয়ে ছাদে বড় বড় করে লিখলেন,

    হে পরম পিতা ঈশ্বর, তুমি আমাকে দয়া কর।
    তোমার অপার রহস্যের খানিকটা আমাকে দেখতে দাও।
    আমি অন্ধ, তুমি আমাকে পথ দেখাও।
    জ্ঞানের আলো আমার হৃদয়ে প্রজ্বলিত কর।
    পথ দেখাও পরম পিতা।

    আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, চক ফুরিয়ে যাওয়ায় লেখা হলো না। এই লেখাটা ছাদে আছে। তিনি তাকালেই দেখতে পান। এমন যদি হতো লেখাটা তিনি একা দেখতে পাচ্ছেন তাহলেও বোঝা যেত সমস্যাটা মনে। কিন্তু তা তো না। অন্যরাও লেখা পড়তে পারছে। গত কাল বিকেলে হেড মাস্টার সাহেব তাঁকে দেখতে এসে হঠাৎ করেই বিস্মিত গলায় বললেন, ছাদে এইসব কী লেখা?

    অমর বাবু নিচু গলায় বলেন, প্রার্থনা সংগীত।

    প্রার্থনা সংগীত ছাদে লিখলেন কেন?

    শুয়ে শুয়ে যাতে পড়তে পারি এইজন্যে।

    লিখলেন কীভাবে? মই দিয়ে উঠেছিলেন না-কি?

    অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেড মাস্টার সাহেব জবাবের জন্যে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, আপনার ছুটি তো শেষ হয়ে গেল, আপনি কি ছুটি আরো বাড়াতে চান?

    জ্বি-না।

    আপনি বরং আরো কিছুদিন ছুটি নিন। শরীরটা এখনো সেরেছে বলে মনে হয় না। আপনাকে খুব দুর্বল লাগছে।

    আমার শরীর যা আছে তা-ই থাকবে স্যার। আর ভালো হবে না।

    এইসব কী ধরনের কথা! কোনো ডাক্তারকে কি দেখিয়েছেন?

    জ্বি-না।

    ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার না দেখালে কীভাবে হবে? বিধু বাবুকে দেখান। বিধু বাবু এল.এম.এফ. হলেও ভালো ডাক্তার। যে কোনো বড় ডাক্তারের কান কেটে নিতে পারে। বিধু বাবুকে দেখানোর কথা মনে থাকবে?

    জি স্যার, থাকবে।

    না আপনার মনে থাকবে না। আমি বরং নিয়ে আসব। আমার ছোট মেয়েটার জ্বর। বিধু বাবুকে বাসায় আসতে বলেছি। এলে, আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।

    জি-আচ্ছা।

    এখন তাহলে উঠি অমর বাবু?

    একটু বসুন স্যার।

    হেড মাস্টার সাহেব উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন। তিনি খানিকটা বিস্মিত, কারণ অমর বাবু একদৃষ্টিতে ছাদের লেখাগুলির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি স্যার–যদি কিছু মনে না করেন।

    বলুন কী বলবেন। মনে কড়াকড়ির কী আছে?

    অমর বাবু প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমি শুন্যে ভাসতে পারি।

    বুঝতে পারলাম না কী বলছেন।

    আমি আপনা-আপনি শূন্যে উঠে যেতে পারি।

    ও আচ্ছা।

    হেড মাস্টার সাহেব ‘ও আচ্ছা’ এমন ভঙ্গিতে বললেন যেন শূন্যে ভেসে থাকবার ব্যাপারটা রোজই ঘটছে। তবে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব চিন্তিত বোধ করছেন।

    ছাদের লেখাগুলি শূন্যে ভাসতে ভাসতে লেখা।

    ও আচ্ছা।

    আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?

    হেড মাস্টার সাহেব জবাব দিলেন না। অমর বাবু বললেন, আমি স্যার এই জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলিনি। ছেলেবেলায় হয়তো বলেছি, জ্ঞান হবার পর থেকে বলিনি।

    আমি বিধু বাবুকে পাঠিয়ে দেব।

    জি আচ্ছা।

    হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, উনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা বলার দরকার নেই। জানাজানি হবে। ইয়ে মানে–লোকজন হাসাহাসি করতে পারে।

    আমি আপনাকেই খোলাখুলি বলেছি। আর কাউকে বলিনি।

    ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন।

    বিধু বাবু এসে খানিকক্ষণ গল্পটল্প করে যাবার সময় ঘুমের অষুধ দিয়ে গেলেন। বললেন, দুঃস্বপ্ন না দেখার একটাই পথ। গভীর নিদ্রা। নিদ্রা পাতলা হলেই মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি ফোনোবারবিটন ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। শোবার আগে দুটা করে খাবেন।

    অমরবাবু দুটো ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। তবে ঘুমুতে যাবার আগে এক কাণ্ড করলেন–কালিপদকে বললেন, লম্বা একগাছি দড়ি নিয়ে তাঁকে খুব ভালো করে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখতে।

    কালিপদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

    অমর বাবু বিরক্ত মুখে বললেন, আমার মাথা খারাপ হয়নি, মাথা ঠিক আছে। তোমাকে যা করতে বলেছি কর। ব্যাপারটা কি পরে বুঝিয়ে বলব। লম্বা। দেখে একগাছি দড়ি আন। শক্ত করে আমাকে চৌকির সঙ্গে বাঁধ।

    কালিপদ তাই করল। তবে করল খুব অনিচ্ছার সঙ্গে।

    অমর বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ট্যাবলেটের কারণে তার গাঢ় নিদ্রা হলো। ঘুম ভাঙল বেলা উঠার পর। তিনি দেখলেন–এখনো চৌকির সঙ্গে বাঁধা আছেন তবে চৌকি আগের জায়গায় নেই, ঘরের মাঝামাঝি চলে এসেছে। তার একটিই মানে— চৌকি নিয়েই তিনি শূন্যে ভেসেছেন। নামার সময় চৌকি আগের জায়গায় নামেনি। স্থান পরিবর্তন হয়েছে।

    তিনি সেদিনই বিছানাপত্র দিয়ে বাড়িতে চলে এলেন। অতসী তাঁকে দেখে কেঁদে ফেলল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, নাকে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?

    অতসী কাঁদতে কাঁদতেই বলল, তোমার শরীর এত খারাপ হয়েছে কেন বাবা? কী ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে গেছো!

    ভালো ঘুম হচ্ছে না, এইজন্যে শরীর খারাপ হয়েছে, এতে নাকে কাঁদার কী হলো?

    সবাই বলাবলি করছে তোমার না-কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কালিপদ নাকি রোজ রাতে দড়ি দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখে।

    কী যন্ত্রণা! একবারই বাঁধতে বলেছিলাম— এর মধ্যে এই গল্প ছড়িয়ে গেছে?

    তোমার কী হয়েছে বাবা বল?

    কিছু হয়নি।

    অমর বাবু ছদিন বাড়িতে থাকলেন। এই ছদিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করলেন। শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা তিনি একা একা থাকার সময়ই ঘটে। অন্য কেউ তার সঙ্গে ঘুমুলে ঘটে না। যে করাত তাঁর স্ত্রী তার সঙ্গে ঘুমিয়েছেন সে করাত তিনি শূন্যে ভাসেননি। দুরাত ছিলেন একা একা, দুরাতেই শূন্যে উঠে গেছেন।

    পূজার ছুটির পর স্কুল নিয়মিত শুরু হলো। তিনি স্কুলে গেলেন না। লম্বা ছুটির দরখাস্ত করলেন। আবার বাড়ি ছেড়ে বাস করতে শুরু করলেন স্কুলের ঘরে। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকতে তার ভালো লাগে না।

    শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা রোজ ঘটতে লাগল। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘটতে লাগল। এখন বিছানায় শোয়ামাত্র শূন্যে উঠে যান। সারারাত সেখানেই কাটে। শেষ রাতের দিকে নিচে নেমে আসেন। ব্যাপারটা ঘটে শুধু রাতে, দিনে ঘটে না। কখনো না। এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সামনেও ঘটে না।

    হেড স্যার এবং ইদরিস স্যার পরপর দুরাত অমর বাবুর ঘরে জেগে বসে ছিলেন। দেখার জন্যে ব্যাপারটা কী। তাঁরা মুহূর্তের জন্যেও চোখের পাতা এক করেননি। লাভ হয়নি, কিছুই দেখেননি। হেড স্যার বললেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি মানসিক।

    অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনার কি ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি?

    না, তা না। পাগল হবেন কেন? তবু আমার ধারণা ব্যাপারটা আপনার মনে ঘটছে। একবার ঢাকায় চলুন না, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি।

    না।

    ক্ষতি তো কিছু নেই। চলুন না।

    আমি যেতে চাচ্ছি না স্যার, কারণ আমি জানি ব্যাপারটা সত্যি। সত্যি না হলে ছাদে এই লেখাগুলি আমি কীজ্ঞকে লিখলাম। দেখেছেন তো ঘরে কোনো মই নেই।

    হেড স্যার চুপ করে রইলেন। অমর বাবু বললেন, আপনারা ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমি আবার শূন্যে উঠে ছাদে একটা লেখা লিখব।

    হেড স্যার বললেন, তার দরকার নেই কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি আমাদের সামনে ব্যাপারটা পারছেন না কেন?

    আমি জানি না। জানলে বলতাম। জানার চেষ্টা করছি, দিন-রাত এটা নিয়েই ভাবছি।

    এত ভাবাভাবির দরকার নেই, আপনি আমার সঙ্গে ঢাকা চলুন। দুদিনের ব্যাপার। যাব, ডাক্তার দেখাব, চলে আসব। আমার একটা অনুরোধ রাখুন। প্লিজ। আপনার হয়তো লাভ হবে না কিন্তু ক্ষতি তো কিছু হবে না।

    .

    অমর বাবু ঢাকায় গেলেন।

    একজন অতি বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দীর্ঘ সময় ধরে তাকে নানান প্রশ্ন করলেন। পরপর কয়েক দিন তাঁর কাছে যেতে হলো। শেষ দিনে বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক বললেন, আপনার যা হয়েছে তা একটা রোগ। এর উৎপত্তি হচ্ছে অবসেসনে। বিজ্ঞানের প্রতি আপনার তীব্র অনুরাগ। সেই অনুরাগ রূপান্তরিত হয়েছে অবসেসনে। কেউ যখন বিজ্ঞানকে অবহেলা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলে তখন আপনি তীব্র আঘাত পান। এই আঘাত আপনি পেয়েছেন আপনার অতি নিকটজনের কাছ থেকে। যেমন ধরুন আপনার কন্যা। সে বিজ্ঞান পড়েনি। আর্টস পড়ছে। এই তীব্র আঘাত আপনার মন গ্রহণ করতে পারেনি। আপনার অবচেতন মন ভাবতে শুরু করেছে–বিজ্ঞানের সূত্র অভ্রান্ত নয়। ভুল সূত্রও আছে। মাধ্যাকর্ষণ সূত্রও ভুল। একসময় অবচেতন মনের ধারণা সঞ্চারিত হয়েছে চেতন মনে। বুঝতে পারছেন?

    জি না, বুঝতে পারছি না।

    মোদ্দা কথা হলো, আপনার রোগটা মনে।

    না— আমি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচারবিবেচনা করেছি। আমি যে শূন্যে উঠতে পারি এটা ভুল না। পরীক্ষিত সত্য।

    মোটেও পরীক্ষিত সত্য নয়। আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি দেখেনি যে আপনি শূন্যে ভাসছেন। দেখলেও কথা ছিল, কেউ কি দেখেছে?

    জ্বি-না।

    আমি ট্রাংকুলাইজার জাতীয় কিছু অষুধ দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন, ব্যায়াম করবেন। মন প্রফুল্ল রাখবেন। বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়াশোনা করবেন না।

    অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি কিন্তু আমি যা বলছি সত্য বলছি–।

    ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সত্যি। কিন্তু সবার কাছে নয়। আপনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করলেওই সিদ্ধান্তে আসবেন।

    অমর বাবু ভগ্নহৃদয়ে রূপেশ্বরে ফিরে এলেন। স্কুলে যোগ দিলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই মাথা খারাপের সব লক্ষণ তার মধ্যে একে-একে দেখা দিতে লাগল। বিড়বিড় করে কথা বলেন, একা একা হাঁটেন। হাঁটার সময় দৃষ্টি থাকে আকাশের দিকে নিতান্ত অপরিচিত কাউকে দেখলে থমকে দাঁড়িয়ে যান, শান্ত গলায় বলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি নিউটনের গতিসূত্র জানেন?

    পাগলের অনেক রকম চিকিৎসা করানো হলো। কোনো লাভ হলো না। বরং লক্ষণগুলি আরো প্রকট হওয়া শুরু করল। গভীর রতে ছাত্রদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে উঁচু গলায় ডাকেন, জব্বার, ও জব্বার, উঠে আয় তো বাবা। খুব দরকার।

    জব্বার উঠে এলে তিনি কারণ গলায় বলেন, নিউটনের সূত্র মনে আছে? ভালো করে পড়। এস.এস.সি তে আসবে। সাথে অঙ্ক থাকবে— ভূমি থেকে দশ ফুট উচ্চতায় ১ গ্রাম ভর বিশিষ্ট একটি আপেল ছাড়িয়া দিলে তার গতিবেগ পাঁচ ফুট উচ্চতায় কত হইবে? অঙ্কটা চট করে কর। মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ কত মনে আছে তো?

    আমাদের সমাজ পাগলদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। অমর বাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বছরখানিক না ঘুরতেই দেখা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে বলছে— নিউটনের সূত্রটা কি যেন? অমর বাবু দাঁত-মুখ খিচিয়ে এদের তাড়া করছেন। তারা মজা পেয়ে খুব হাসছে। কারণ, তারা জানে পাগলরা শিশুদের তাড়া করে ঠিকই কখনো আক্রমণ করে না।

    .

    পৌষের শুরু। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। এই শীতেও খালি গায়ে শুধুমাত্র একটা ধুতি কোমরে পেঁচিয়ে অমর বাবু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন। নিউটনের সূত্র মনে আছে কি-না এই প্রশ্ন তিনি এখন আর কোনো মানুষকে করেন না। পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গদের করেন। তারা প্রশ্নের উত্তর সংগত কারণেই দেয় না। তিনি তখন ক্ষেপে যান।

    .

    রাত দশটার মতো বাজে। কনকনে শীত।

    অমর বাবু দাঁড়িয়ে আছেন একটা কাঁঠাল গাছের নিচে। কাঁঠাল গাছের অলে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে। তিনি বাদুড়গুলিকে নিউটনের সূত্র সম্পর্ক বলছেন। তখনই দেখা গেল— হারিকেন হাতে হেড স্যার আসছেন। কাঁঠাল গাছের কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অমর বাবুর দিকে তাকিয়ে দুঃখিত গলায় বললেন, কে অমর?

    জি স্যার।

    কী করেছেন?

    বাদুরগুলির সঙ্গে কথা বলিছিলাম স্যার।

    ও আচ্ছা।

    এদের সঙ্গে কথা বললে মনটা হালকা হয়। ওদের নিউটনের সূত্রগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।

    এই শীতে বাইরে ঘুরছেন। বাসায় গিয়ে ঘুমান।

    ঘুম আসে না স্যার।

    হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে অমর বাবু, এখনো কি আপনি শূন্যে ভাসেন?

    জ্বি-না। ঢাকা থেকে আসার পর আর ভাসিনি। যদি আবার কখনো ভাসতে পারি–আপনাকে বলব। আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। ভাসতে ভাসতে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।

    দূরে কোথায়?

    মহাশূন্যে অসীম দূরত্বে। চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সব ছাড়িয়ে…

    ও আচ্ছা।

    যাবার আগে আমি আপনাকে খবর দিয়ে যাব।

    আচ্ছা।

    .

    শীত কেটে গিয়ে বর্ষা এসে গেল। অমর বাবু লোকালয় প্রায় ত্যাগ করলেন। বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকেন। রূপেশ্বরের পাশের গ্রাম হলদিয়ায় ঘন বন আছে। এখন ঐ বনেই তাঁর আস্তানা। তাঁর মেয়ে অতসী প্রায়ই তাকে খুঁজতে আসে। পায় না। মেয়েটা বনে বনে ঘুরে এবং কাঁদে। তিনি চার-পাঁচদিন পরপর একবার বের হয়ে আসেন। তাঁকে দেখে আগের অমর বাবু বলে চেনার কোনো উপায় নেই। যেন মানুষ না–প্রেত বিশেষ। মাথাভর্তি বিরাট চুল, বড় বড় দাড়ি। হাতের নখগুলি বড় হতে হতে পাখির ঠোঁটের মতো বেঁকে গেছে। স্বভাব-চরিত্র হয়েছে ভয়ঙ্কর। মানুষ দেখলে কামড়াতে আসেন। ইট-পাথর ছুঁড়েন। একবার স্থানীয় পোস্টমাস্টারকে গলা টিপে প্রায় মেরে ফেলতে বসেছিলেন। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। অতসীর বিয়ে হয়ে গেছে, সেও এখন আর বাবার খোঁজ আসে না।

    .

    দেখতে-দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। কার্তিক মাস। অল্প অল্প শীত পড়ছে। এগারোটার মতো বাজে। হেড স্যার খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন, হঠাৎ শুনলেন উঠান থেকে অমর বাবু ডাকছেন স্যার! স্যার! স্যার জেগে আছেন?

    কে?

    স্যার আমি অমর। একটু বাইরে আসবেন?

    হেড স্যার অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, খবর্দার, তুমি বেরুতে পারবে না। পাগল মানুষ– কি না কি করে বসে। ঘুমাও।

    অমর বাবু আবার কাতর গলায় বললেন, একটু বাইরে আসুন স্যার! খুব দরকার। খুব বেশি দরকার।

    হেড স্যার ভয়ে ভয়ে বাইরে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনের আমগাছের সমান উচ্চতায় অমর বাবু ভাসছেন। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দৃশ্য। একটা মানুষ অবলীলায় শূন্যে ভাসছে। তার জন্যে পাখিদের মতো তাঁকে ডানা ঝাপ্টাতে হচ্ছে না।

    স্যার দেখুন আমি ভাসছি।

    হেড স্যার জবাব দিতে পারছেন না। প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল চোখের ভুল। এখন তা মনে হচ্ছে না। ফকফকা চাঁদের আলো। দিনের আলোর মতো সব দেখা যাচ্ছে। তিনি পরিষ্কার দেখছেন— অমর বাবু শূন্যে : ভাসছেন। এই তো ভাসতে ভাসতে খানিকটা এগিয়ে এলেন। সাঁতার কাটার মতো অবস্থায় মানুষটা শুয়ে আছে। কী আশ্চর্য!

    স্যার দেখতে পাচ্ছেন?

    হ্যাঁ।

    আজ হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলাম। বন থেকে বের হয়ে রূপেশ্বরের দিকে আসছি হঠাৎ শরীরটা হালকা হয়ে গেল। দেখতে-দেখতে দশ-বারো ফুট উঠে গেলাম। প্রথমেই ভাবলাম আপনাকে দেখিয়ে আসি। ভাসতে ভাসতে আসলাম।

    আর কেউ দেখেনি?

    না। কয়েকটা কুকুর দেখেছে। ওরা ভয় পেয়ে খুব চিৎকার করছিল। এরকম দেখে তো অভ্যাস নেই। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে স্যার?

    হ্যাঁ, হচ্ছে।

    আমি ঠিক করেছি— ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাব।

    ও আচ্ছা।

    আমার মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল— সারাক্ষণ ব্যথা করত। এখন ব্যথাও নেই। আগে কাউকে চিনতে পারতাম না। এখন পারছি।

    শুনে ভালো লাগছে অমর বাবু।

    অন্য একটা কারণেও মনে খুব শান্তি পাচ্ছি। কারণটা বলি–মহাশূন্যে ভাসার রহস্যটাও ধরতে পেরেছি।

    হেড মাস্টার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রহস্যটা কী?

    রহস্যটা খুব সাধারণ। এতদিন কেন ধরতে পারিনি কে জানে। তবে স্যার আপনাকে রহস্যটা বলব না। বললে আপনি শিখে যাবেন। তখন দেখা যাবে সবাই শূন্যে ভাসছে। এটা ঠিক না। প্রকৃতি-চায় না। স্যার যাই?

    অমর বাবু উপরে উঠতে লাগলেন। অনেক অনেক উঁচুতে। একসময় তাকে কালো বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল।

    হেড স্যারের স্ত্রী হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে ভীত গলায় বললেন, কী ব্যাপার? পাগলটা কোথায়?

    চলে গেছে।

    তুমি বাইরে কেন? ভেতরে এসে ঘুমাও।

    তিনি ঘরে এঙ্গে শুয়ে পড়লেন।

    .

    অমর বাবুকে এর পর আর কেউ এই অঞ্চলে দেখেনি। হেড স্যার সেই রাতের কথা কাউকেই বলেননি। কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই পাগল ভাববে। আর একবার পাগল ভাবতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পাগল হতেই হয়–এটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন।

    ⤷
    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহিমুর বাবার কথামালা
    Next Article জলপদ্ম – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }