Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মা – আনিসুল হক

    লেখক এক পাতা গল্প410 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪৭. মা

    ৪৭
    ৩১শে আগস্ট ১৯৭১ সকাল ৭টা৷ রমনা থানা৷ বন্দিরা হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ পায়৷ পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে পড়ে৷ বন্দিদের আবার তোলা হয় একটা জানালা-বন্ধ বাসে৷ তাদের নিয়ে আসা হয় আবার এমপি হোস্টেলে৷ একটা কক্ষে সবাইকে কিছুক্ষণ রাখার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পেছনের আরেকটা বিল্ডিংয়ে৷ আজাদ শুনতে পায়, এখানে সবার স্টেটমেন্ট নেওয়া হবে৷ স্টেটমেন্ট মানে একজন আর্মি অফিসার বন্দিদের একে একে প্রশ্ন করবে৷ জবাব শুনে সেগুলো কাগজে লিখে নেবে৷ এই স্টেটমেন্ট নেওয়ার সময় যে টর্চার করা হয়, তা আগের দুদিনের অত্যাচারের চেয়েও ভয়াবহ৷
    আজাদের পালা আসে৷ একজন অফিসার নাম ধরে ডাকে৷ ‘আজাদ৷’ আজাদ ওঠে না৷ ‘আজাদ আলিয়াস মাগফার৷’ আজাদ ওঠে৷
    আজাদকে একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এখানে তিনজন অফিসার একসঙ্গে ঘিরে ধরে আজাদকে৷
    ‘আজাদ৷’
    আজাদ কোনো কথা বলে না৷
    ‘তোমাকে তোমার বন্ধুরা দেখিয়ে দিয়েছে তুমি আজাদ, তুমি সেটাই স্বীকার করছ না৷ এটা ঠিক না৷ আমাদের কাছে সবকিছুর রেকর্ড আছে৷ তুমি সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে গিয়েছিলে৷ ২৫ তারিখে তুমি রাজারবাগ অপারেশনে ছিলে৷ প্রথমটার কম্যান্ডার ছিল কাজী কামাল৷ পরেরটার আহমেদ জিয়া৷’
    ‘এসব ঠিক নয়৷ আমার নাম মাগফার৷ ওরা আমার বাসায় এসেছিল তাস খেলতে৷ ওরা তাসটা ভালো খেলে৷ এছাড়া আমি ওরা কোথায় কী করে না করে কিচ্ছু জানি না৷’
    ‘হারামজাদা৷’ সিপাইদের ডেকে তার হাওলায় সমর্পণ করা হয় আজাদকে, ‘আচ্ছা করকে বানাও৷’ দুজন সিপাই এসে আজাদের পায়ে দড়ি বাঁধে৷ তারপর তাকে ঝোলায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে উল্টো করে৷ ফ্যান ছেড়ে দেয়৷ আজাদ উল্টো হয়ে ঝুলছে, ঘুরতে থাকে ফ্যানের সঙ্গে সঙ্গে৷ আর চলতে থাকে চড়-কিল-ঘুসি৷ আজাদ ‘মা মা’ বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
    তাকে নামিয়ে তার চোখেমুখে পানি দেওয়া হয়৷ জ্ঞান ফিরে পেলে সে প্রথম যা বলে, তা হলো, ‘মা৷’ যেন সে মায়ের কোলে শুয়ে আছে৷
    অফিসাররা আজাদের ফাইলটা আবার দেখে৷ মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক নাই৷ মায়ের একমাত্র ছেলে৷ মায়ের সঙ্গে একা থাকে৷
    অফিসার বলেন, ‘তুমি মাকে দেখতে চাও ?’
    ‘হুঁ৷’
    ‘মায়ের কাছে যেতে চাও ?’
    ‘হুঁ৷’
    ‘তাহলে তুমি বলো, অস্ত্র কোথায় রেখেছ ?’
    আজাদ বলে, ‘জানি না৷’
    আবার একপ্রস্থ প্রহার চলে৷
    আজাদ আবার তার মায়ের মুখ মনে করে নির্যাতন ভোলার চেষ্টা করে৷
    ‘ওকে৷ তোমার মা বললে তুমি সব বলবে ?’
    ‘বলব৷’
    ‘ঠিক আছে৷ তোমার মাকে আনা হবে৷’
    অফিসার ইনটেলিজেন্সের এক লোককে ডেকে বলেন, ‘এর মাকে আনো৷’
    আবুল বারক আলভী দেখে একে একে আলতাফ মাহমুদের বাসার সবাইকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে তো ডাকে না৷ সে নিজেই উঠে যায়, বলে, ‘আমাকে যে ডাকলেন না! আমি তো ওই বাসায় গেস্ট হিসাবে ছিলাম৷’
    তাকে ডাকা হয়৷ অফিসার বলেন, ‘তোমার নাম কী!’
    সে বলে, ‘সৈয়দ আবুল বারক৷’
    অফিসার তালিকায় তার নাম পান না৷ ‘তোমাকে কেন ধরেছে ?’
    ‘জানি না৷ আমি মিউজিক ডিরেক্টর সাহেবের বউয়ের পক্ষের আত্মীয়৷ কালকে বেড়াতে এসেছিলাম এ বাসায়৷ আমাকে ভুল করে ধরে এনেছে৷’
    আবুল বারক আলভীর চেহারা প্রতারণাময়, বয়স বোঝা যায় না, তার ওপর আগের দিনের মারে সমস্ত শরীরে কাটা কাটা দাগ, রক্ত শুকিয়ে ভয়াবহ দেখাচ্ছে, চোখমুখ ফোলা, ঠোঁট কাটা, হাতের আঙুল থেকে নখ বের হয়ে আসছে…
    কর্নেলকে অনেক সহানুভূতিসম্পন্ন মনে হচ্ছে; এমন সময় আগের দিন ও রাতে যে সিপাইটা প্রচণ্ড মেরেছিল, তাকে দেখা যায় এদিকে আসছে, আবুল বারক প্রমাদ গোনে, কারণ ওই সিপাইটা সব জানে, সে জানে যে তার নামই আসলে আলভী, আর একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে আলভী বলে শনাক্ত করে গেছে৷
    আরো খানিকক্ষণ চলে জিজ্ঞাসাবাদ, আবুল বারক জানায় তার চাকুরিস্থলের কথা, সে রোজ অফিসে যায়, ‘এই যে ফোন নম্বর, ফোন করেন,’ এটা সে বলে আত্মবিশ্বাস থেকে যে তার অফিসে কেউ খোঁজ করলে তার সহকর্মী বা বড় কর্তা তাকে বিপদে ফেলবে না…
    কর্নেল তাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন৷
    আবুল বারক বেরিয়ে আসে৷ সে হাঁটতে পারছে না৷ তার ওপর ওই দূরে সেই ভয়ঙ্কর সিপাইটাকে দেখা যাচ্ছে৷ সে ভালো মানুষ সুবেদারটাকে পেয়ে যায়৷ এই সুবেদারটাকে পরশু থেকেই তার ফেরেশতা বলে মনে হচ্ছে৷ প্রথম দিন যখন ওই কসাই টাইপের সিপাইটা প্রচণ্ড মার মারছিল, তখন এক সময় এই সুবেদার সিপাইটাকে বলেছিল, ‘ইতনা মার মাত মারো৷’ আজ সুবেদার সাহেবকে সামনে পেয়ে আবুল বারক বলে, ‘আমি তো দাঁড়াতেই পারছি না৷ আমাকে কি তুমি রোড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারো!’
    শুনে সুবেদার বলে, ‘আমি দোয়া করি তুমি একাই হেঁটে যেতে পারবে৷’
    ‘পারতেছি না চাচাজি৷’
    সুবেদার আরেকজন সিপাইকে বলে, ‘ওকে পার করে দিয়ে আসো৷’
    আবুল বারক হেঁটে হেঁেট সিপাইয়ের সঙ্গে রাস্তায় আসে৷ দূর থেকে সেই ভয়ঙ্কর সিপাইটা তাকিয়ে দেখে তাকে৷ আবুল বারক আলভীর রক্ত হিম হয়ে আসে৷
    আবুল বারক এখনও নিশ্চিত নয়, তাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, নাকি ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ এই সৈন্যটা তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘বাসায় গিয়ে একজন ভালো ডাক্তার দেখাবে৷’ আবুল বারকের মনে হয় সে নবজীবন লাভ করল৷ এয়ারপোর্ট রোডে আসে সে৷ দেখে একটা গাড়ি যাচ্ছে৷ সে হাত তোলে৷ গাড়িটা তাকে অতিক্রম করে চলে যায়৷ তারপর ব্রেক কষে৷ আবার ফেরে৷ আলভী ভয় পায়৷ গাড়ি থেকে বলা হয় : ‘গাড়িতে ওঠো৷’
    আবুল বারক আলভী দেখতে পায়, গাড়ির চালক তার বন্ধু রানা ও নিমা রহমানের বাবা লুৎফর রহমান৷ আলতাফ মাহমুদের বাসার পাশে থাকেন৷ বড় পাট ব্যবসায়ী৷ আলভী তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে আলতাফ মাহমুদের বাসায় আসে৷ মহিলা-মহলে সাড়া পড়ে যায়৷ নিমার মা এসে সব মহিলার সামনে আবুল বারক আলভীকে খালিগা করে শুশ্রূষা করতে থাকেন৷ আলভী লজ্জা পায়, আবার মহিলাদের এই আদর সে উপভোগও করে৷
    ঘরে ফিরে আসে জামী, রুমীর বাবা শরীফ ইমাম৷ রুমী আসে না৷
    এইভাবে কেউ ছাড়া পায়, কেউ পায় না৷
    আজাদের মা মগবাজারের বাসায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই মহুয়া বলে, ‘আম্মা, আপনে কই আছিলেন৷ কামরুজ্জামানে এক লোকরে আনছিল৷ কয় বলে, আজাদের মা কই৷ জরুরি দরকার আছে৷ আজাদরে ছাড়নের ব্যাপারে কথা আছে৷’
    মায়ের বুকের ভেতরটা যেন লাফিয়ে ওঠে৷ আজাদকে ছাড়িয়ে আনা যাবে! ফিরে আসবে তাঁর আজাদ৷ আশার সঞ্চার হয় খানিক৷ পরক্ষণেই কামরুজ্জামানের নাম শুনে তিনি খানিকটা হতাশ হন৷ মিলিটারির দালাল লোকটা৷ ইউনুস চৌধুরীর বাসাতেও ঘুরঘুর করে৷ সে কী মতলবে এসেছিল, আল্লাইই জানে! মহুয়া বলে, ‘আপনেরে থাকতে কইছে৷ আজকা বিকালে ফির আইব৷’
    বিকালের জন্যে অপেক্ষা করেন মা৷ তাঁর বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে৷ কিছুই ভালো লাগছে না৷ মহুয়ার কোলে ছোট মেয়েটা কাঁদে, মহুয়া তাকে স্তন্য পান করায়, মেয়েটা তখন চুপ করে, এই দৃশ্যের দিকে আজাদের মা তাকিয়ে থাকেন৷ তাঁর বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে ওঠে৷ কোথায় তাঁর আজাদ!
    বিকালবেলা কামরুজ্জামান আসে৷ দরজায় আওয়াজ শুনে মা দৌড়ে দরজা খোলেন৷ কামরুজ্জামানের সঙ্গে আরো একটা লোক৷ কামরুজ্জামান বলে, ‘চাচি৷ আল্লাহর কাছে শুকর করেন৷ আমি রইছি বইলা না সুযোগ আইছে৷ আজাদরে ছাইড়া দেওনের একটা ভাও করছি৷ ওনারে ক্যাপ্টেন স্যারে পাঠাইছে৷ কী কয়, মন দিয়া শুনেন৷’
    আজাদের মা তাদেরকে ঘরের ভেতরে আনেন৷ বসতে দেন৷ কামরুজ্জামানের সঙ্গের লোকটার মুখের দিকে তাকান৷ কালো প্যান্ট, শাদা শার্ট পরা৷ চুল ছোট৷ ছোট করে ছাঁটা গোঁফ৷ চেহারাটা পেটানো৷
    লোকটা বলে, ‘আজাদের সঙ্গে দেখা করতে চান ?’
    ‘জি৷’ মায়ের বুক এমনভাবে কাঁপছে, যেন তা তাঁর শরীরের অংশে আর নাই৷
    ‘ছেলেকে ছাড়ায়া আনতে চান ?’
    ‘জি৷’
    ‘আজকা রাতে আজাদ রমনা থানায় আসবে৷ আপনারে আমি দেখা করায়া দেব৷ বুঝলেন ?’
    ‘জি৷’
    ‘তার সঙ্গে দেখা করবেন৷ দেখা করে কী বলবেন ?’
    ‘জি!’
    ‘দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়!’
    ‘জি ?’
    ‘শোনেন, ছেলেকে যদি ফিরে পেতে চান, তাকে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়৷ বুঝেছেন ?’
    ‘হুঁ৷’
    ‘অস্ত্র কোথায় রেখেছে, সে যেন বলে দেয়৷ বুঝেছেন ?’
    ‘হুঁ৷’
    ‘সে যদি সব স্বীকার করে, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে৷ বুঝেছেন ?’
    আজাদের মা তার মুখের দিকে তাকায়৷ শূন্য তাঁর দৃষ্টি৷
    কামরুজ্জামান বলে, ‘রাজসাক্ষী মানে হে সবাইরে ধরায়া দিব৷ যারা যারা আসল ক্রিমিনাল তাগো বিরুদ্ধে সাক্ষী দিব৷ পুরস্কার হিসাবে হেরে ক্ষমা কইরা দিব৷ আপনের ছেলেরে ছাইড়া দিব৷ আমি কইছি, আজাদ ভালো ছেলে৷ হে ইন্ডিয়া যায় নাই৷ আরে বন্ধুবান্ধবগো পাল্লায় পইড়া…’
    আজাদের মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন৷
    লোকটা বলে, ‘আপনি বললে আপনার ছেলে আপনার কথা শুনবে৷ আমাদের কথা শুতেছে না৷ বাজে ছেলেদের সাথে মিশে ও কিছু ভুল করেছে৷ সব স্বীকার করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ এরপর ছেলেকে দেখে রাখবেন৷ আর যেন খারাপ ছেলেদের সাথে না মেশে৷’
    যাওয়ার আগে কামরুজ্জামান বলে যায়, ‘রাতের বেলা রমনা থানায় যাইয়েন৷ আজাদ থাকব৷ যা যা কইছে, ঠিকমতন কইরেন৷ বুঝছেন৷’
    তারা চলে যায়৷ কচি এসে বলে, ‘কী কইল আম্মা, আজাদ দাদাকে ছেড়ে দিবে ? ও আম্মা৷’
    মা কিছুই বলেন না৷ একদিকে তাকিয়ে থাকেন৷ মহুয়ার মেয়েটা আবার কাঁদছে৷ কেন, কাঁদছে কেন৷ মহুয়া কি কাছে নাই ? সে তাকে দুধ দিচ্ছে না কেন!
    রাত্রিবেলা৷ গরাদের এপারে আজাদ৷ ওপারে তার মা৷ ছেলেকে দেখে মায়ের সর্বান্তকরণ কেঁপে ওঠে৷ কেঁদে ওঠে৷ কিন্তু তিনি ছেলেকে কিছু বুঝতে দিতে চান না৷ আজাদের চোখমুখ ফোলা৷ ঠোঁট কেটে গেছে৷ চোখের ওপরে ভুরুর কাছটা কাটা৷ সমস্ত শরীরে মারের দাগ৷ মেরে মেরে ফুলিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কাটা জায়গাগুলোয় রক্ত শুকিয়ে দেখাচ্ছে ভয়াবহ৷
    এখন আজাদকে তিনি কী বলবেন ? বলবেন, রাজসাক্ষী হও৷ সব স্বীকার করো৷ এটা তিনি তো বলতেই পারেন৷ ওর বাবা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী এই শহরে এখনও সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোকদের একজন৷ গভর্নরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব৷ আর্মির অফিসাররা তার ইয়ার-বান্ধব৷ আজাদের ছোটমা, তিনি শুনতে পান, কর্নেল রিজভী নামের একজনকে ভাই ডেকেছে৷ কর্নেলের ছোট বোনের নামের সঙ্গে নাকি তার নাম মিলে গেছে৷ সাফিয়া বেগম যদি ইঙ্গিতেও চৌধুরীর কাছে ছেলের জন্যে তদবির করেন, তাহলেও তো ছেলে তাঁর মুক্তি পাবে৷ আবার চৌধুরীর নিজের ভাই আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক৷ ওই দিক থেকেও তাঁদের কোনো সমস্যা নাই৷ আজাদের ছোটমা নাকি আজাদের চাচাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে গাড়িতে করে নদীতীরে পৌঁছে দিয়েছেন৷
    কিন্তু তাঁর ছেলেকে তিনি রাজসাক্ষী হতে বলবেন ? অন্যের ছেলেদের ফাঁসানোর জন্য ? মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে ? মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে ?
    ছেলে তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার পরে একদিন বলে, ‘মা, তুমি কিন্তু আমাকে কোনো দিনও মারো নাই৷’ হ্যাঁ, তাঁর ছেলেকে তিনি কোনো দিনও ফুলের টোকাও দেননি৷ সেই ছেলেকে ওরা কী মারটাই না মেরেছে! আর ছেলে তাঁর করাচি থেকে চিঠি লিখেছিল, ‘মা, ওরা আর আমরা আলাদা জাতি৷ অনেক ব্যবধান৷’
    না৷ তিনি আর যা-ই হন না কেন, বেইমান হতে পারবেন না৷ ছেলেকে যুদ্ধে যেতে তিনিই অনুমতি দিয়েছেন৷
    আজাদ বলে, ‘মা, কী করব ? এরা তো খুব মারে৷ স্বীকার করতে বলে৷ সবার নাম বলতে বলে৷’
    ‘বাবা, তুমি কারো নাম বলোনি তো!’
    ‘না মা, বলি নাই৷ কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরো মারে, যদি বলে ফেলি৷’
    ‘বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো৷ সহ্য কোরো৷ কারো নাম যেন বলে দিও না৷’
    ‘আচ্ছা৷ মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে৷ দুই দিন ভাত খাই না৷ কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগ পাই নাই৷’
    ‘আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্যে ভাত নিয়ে আসব৷’
    সেন্ট্রি এসে যায়৷ বলে, ‘সময় শেষ৷ যানগা৷’
    মা হাঁটতে হাঁটতে কান্না চেপে ঘরে ফিরে আসেন৷ পাশেই হলি ফ্যামিলি, জায়েদ আর টগর সেখানে চিকিৎসাধীন আছে, কিন্তু সেখানে যেতে তাঁর ইচ্ছা করছে না৷
    সকালবেলা, যথারীতি গাড়ি এসে বন্দিদের নিয়ে যায় এমপি হোস্টেলের ইন্টারোগেশন সেন্টারে৷
    বদির ওপরে চলছে অকথ্য নির্যাতন, সে আর সহ্য করতে পারছে না, এক সময় সে দৌড়ে ঘরের ভেতরে ইলেকট্রিক লাইনের ভেতরে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করে, চেষ্টা করে সকেটের দুই ফুটোর মধ্যে দু আঙুল ঢোকানোর, ব্যর্থ হয়ে সকেট ভেঙে ফেলতে আরম্ভ করে, শব্দ পেয়ে সেন্ট্রিরা এসে তার দু হাত পেছন দিক থেকে বেঁধে ফেলে৷ তখন সে ভাবে, পালানোর চেষ্টা করলে নিশ্চয় গুলি করবে৷ তাকে যখন এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন সে অকস্মাৎ দৌড়ে গেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে, এ আশায় যে তাকে গুলি করা হবে, কিন্তু সৈন্যরা অতটা উদারতার পরিচয় দেয় না, তাকে ধরে নিয়ে এসে উল্টো রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মারতে থাকে৷
    আজাদকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় কর্নেলের সামনে৷ কর্নেল কাগজ দেখেন৷ আজাদকে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করানো হয়ে গেছে৷ ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্ট৷ এখন নিশ্চয় সে স্বীকার করবে সবকিছু৷ জানিয়ে দেবে অস্ত্রের ঠিকুজি৷
    ‘আজাদ, বলো, সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে আর কে কে ছিল ?’
    আজাদ বলে, ‘জানি না৷’
    ‘বলো, সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের পরে রকেট লাঞ্চারটা কোথায় রাখা হয়েছে ?’
    ‘জানি না৷’
    কর্নেল ইঙ্গিত দেন৷ আজরাইলের মতো দেখতে একজন সৈনিক এগিয়ে আসে৷ আজাদের ঘাড়ে এমনভাবে হাত লাগায় যে মনে হয় ঘাড় মটকে যাবে৷ তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসানো হয়৷ তাকে বাঁধা হয় চেয়ারের সঙ্গে৷ বিদ্যুতের তার খোলামেলাভাবে আজাদের চোখের সামনে খুলে বাঁধা হচ্ছে চেয়ারের সঙ্গে, তার পায়ের সঙ্গে৷ তাকে এখন শক দেওয়া হবে৷ আজাদের একবার মনে হয় ফারুক ইকবালের কথা, ৩রা মার্চ রামপুরা থেকে পুরানা পল্টনের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ে আসার জন্যে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল সে, টেলিভিশন ভবনের সামনে আর্মি গুলি চালায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে ফারুক ইকবালের শরীর, তখন সারাটা শহরে জনরব ছড়িয়ে পড়ে যে ফারুক ইকবাল নিজের বুকের রক্ত দিয়ে রাস্তায় মৃত্যুর আগে লিখেছিল ‘জয় বাংলা’, তখন খবরটা বিশ্বাস হয়নি আজাদের, এখন ঠিক অবিশ্বাস হচ্ছে না৷ তার মনে পড়ে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের মৃত্যুর বর্ণনা, যা সারাটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে কিংবদন্তির মতো, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দু নম্বর আসামি লে. কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে আর্মি ঢুকে পড়ে, তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমহারা নাম কিয়া’, তিনি বলেন ‘কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন’, তারা বলে, ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, তিনি বলেন, ‘এক দফা জিন্দাবাদ’, পুরোটা মার্চে যখন নানা রকমের আলোচনা চলছিল, তখন মোয়াজ্জেম হোসেন এই এক দফার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন, ‘এক দাবি এক দফা বাংলার স্বাধীনতা…’ সৈন্যরা গুলি করল, লুটিয়ে পড়ল তাঁর দেহ…
    প্রচণ্ড অত্যাচার চলছে আজাদের ওপর দিয়ে, কিন্তু আজাদ নির্বিকার, সে শুধু মনে করে আছে তার মায়ের মুখ, মা বলেছেন, ‘বাবা, শক্ত হয়ে থেকো… কারো নাম বোলো না…’
    এক সময় কর্নেল তাঁর হাতের কাগজ রাগে ছুড়ে ফেলেন, তারপর নির্দেশ দেন চূড়ান্ত শাস্তির… আজাদের ঠোঁট তখন নড়ে ওঠে, কারণ সে জানে চূড়ান্ত শাস্তি মানে এই শারীরিক যন্ত্রণার চির উপশম, আজাদের মন এই টর্চারের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হয়ে ওঠে৷
    পরদিন, কখন রাত হবে, কখন তিনি ভাত নিয়ে যাবেন রমনা থানায়, সারা দিন অস্থির থাকেন মা৷ দুপুরে তিনি আর ভাত মুখে দিতে পারেন না৷ তার ছেলে ভাত খেতে পায় না৷ তিনি বাসায় বসে আরাম করে ভাত খাবেন! তা কি হয়!
    সন্ধ্যা হতে না হতেই তিনি চাল ধুতে লেগে পড়েন৷ দিনের বেলায়ই ঠিক করে জোগাড়যন্ত্র করে রেখেছেন কী রাঁধবেন! মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা, বেগুনভাজি৷ একটা টিফিন-ক্যারিয়ারে নেবেন৷ নাকি দুটোয়! তার কেমন যেন লাগে৷
    রাত নেমে আসে৷ সারাটা শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে৷ কারফিউ দেওয়ার আগেই ভাত নিয়ে তিনি হলি ফ্যামিলিতে আশ্রয় নেন৷ রাত আরেকটু বেড়ে গেলে দুটো টিফিন-ক্যারিয়ারে ভাত নিয়ে তিনি যান রমনা থানায়৷
    দাঁড়িয়ে থাকেন, কখন আসবে গাড়ি৷ কখন এমপি হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা হবে আজাদদের৷ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ি আসে৷ একজন একজন করে নামে বন্দিরা৷ কই, এর মধ্যে তো তার আজাদ নাই৷ আর্মিরা চলে গেলে তিনি পুলিশের কাছে যান৷ ‘আমার আজাদ কই ?’
    পুলিশকর্তা নামের তালিকা দেখেন৷ বলেন, ‘না, আজাদ তো আজকে আসে নাই৷’
    ‘মাগফার চৌধুরী ?’
    ‘না৷ এ নামেও কেউ নাই৷’
    ‘আর কি আসতে পারে ?’
    ‘আজ রাতে ? নাহ্৷’
    ‘কালকে ?’
    ‘বলতে পারি না৷’
    টিফিন-ক্যারিয়ারে ভাত নিয়ে আজাদের মা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দঁাঁড়িয়ে থাকেন৷ সারা রাত৷ থানার চত্বরে৷ বাইরে বাঙ্কারে পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এলএমজির পেছনে ঢুলুঢুলু হয়ে আসে, ভেতরে পুলিশের প্রহরী মশা মারে গায়ে চাপড় দিতে দিতে, বিচারপতির বাসভবনের উল্টোদিকের গির্জায় ঘন্টা বাজে, মা দাঁড়িয়ে থাকেন টিফিন-ক্যারিয়ার হাতে, তাঁর কেবলই মনে হতে থাকে সেই দিনগুলোর কথা, বিন্দু মারা যাওয়ার পরে যখন তাঁর পেটে আবার সন্তান এল, প্রতিটা মুহূর্ত তিনি কী রকম যত্ন আর উৎকন্ঠা নিয়ে ভেতরের জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, আর সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে কানপুরের ক্লিনিকেই চৌধুরী সাহেব আজান দিয়েছিলেন, আর ভারতবর্ষের আজাদির স্বপ্নে ছেলের নাম রেখেছিলেন আজাদ, তাঁর পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করছে, যেন তিনি আজাদকে আবার এই পৃথিবীর সমস্ত বিপদ-আপদ-শঙ্কার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে তাঁর মাতৃগর্ভে নিয়ে নেবেন, যদি তিনি পাখি হতেন, এখনই তাঁর পাখা দুটো প্রসারিত করে আজাদকে তার বুকের নিচে টেনে নিতেন৷ আস্সালাতু খায়রুম মিনান্নাউম, ভোরের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৌড় ধরেন তেজগাঁও থানার দিকে৷ ওখানে যদি তাঁর আজাদ থাকে! ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরে, ছোট ছোট ছাঁদে, তিনি কিছুই টের পান না, তেজগাঁও থানার চত্বরে হাজির হন৷ তখনও তাঁর হাতে দুটো টিফিন-ক্যারিয়ার৷
    পুলিশকে দুটো টাকা চা খাওয়ার জন্যে উপহার দিয়ে তিনি আজকের হাজতিদের পুরো তালিকা দেখেন৷ গরাদের এ পাশে দাঁড়িয়ে হাজতিদের প্রত্যেকের মুখ আলাদা আলাদা করে নিরীক্ষণ করেন৷ না, আজাদ নাই৷
    এখান থেকে এমপি হোস্টেল বেশি দূরে নয়৷ তিনি এমপি হোস্টেলের দিকে দৌড় ধরেন৷ একজন সুবেদারের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর৷ সুবেদারকে বলেন, ‘আজাদ কোথায় ? আমি আজাদের মা৷’
    সুবেদার বলে, ‘মাইজি, উনি তো এখানে নাই৷ ক্যান্টনমেন্টে আছেন৷ আপনি বাড়ি চলে যান৷’
    মা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না৷ তাঁর হাতের ভাত ততক্ষণে পচে উঠে গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ তাঁর নিজের পরিপাকতন্ত্রের ভেতরে থাকা পরশুদিনের ভাতও যেন পচে উঠছে…
    ‘মাইজি, আপনি বাড়ি চলে যান৷’
    মা এক সময় বাসায় চলে আসেন৷ তাঁকে পাথরের মতো দেখায়৷ তিনি মহুয়াকে, কচিকে সংসারের স্বাভাবিক কাজকর্ম দেখিয়ে দেন, কিন্তু তবু মনে হয় সমস্তটা পৃথিবী গুমোট হয়ে আছে, কী অসহ্য ভাপসা গরম, বৃষ্টি হলে কি জগৎটা একটু স্বাভাবিক হতো! তিনি হাসপাতালে যান, দেখতে পান, জায়েদের জ্ঞান ফিরে এসেছে, টগরের অবস্থাও উন্নতির দিকে, তিনি জুরাইনের বড় হুজুরের কাছে, বেগম সাহেবার কাছে যান, তাঁরা তাঁকে আশ্বাস দেন যে আজাদ বেঁচে আছে, আজাদ ফিরে আসবে৷ ‘ঘাবড়াও মাত৷ ও আপসা আয়ে গা৷’
    মহুয়া বলে, ‘আম্মা কিছু খান, না খেয়ে খেয়ে কি আপনি মারা যাবেন, আজাদ দাদা ফিরা আসবে তো!’
    মা কিছুই খান না৷ একদিন, দুদিন৷
    মহুয়া বলে, ‘আম্মা, আপনি কি আত্মহত্যা করতে চান ? আত্মহত্যা মহাপাপ৷ আপনি মারা গেলে আমরা কার কাছে থাকব আম্মা৷’
    মায়ের হুঁশ হয়৷ তিনি তাঁর চোখের সামনে দেখতে থাকেন তাঁর ভাগ্নে-ভাগি্ন চঞ্চল, কচি, টিসুর অপ্রাপ্তবয়স্ক মুখ, জায়েদ, টগরের শয্যাশায়ী শরীর, তিনি মরে গেলে এরা কোথায় যাবে, কার কাছে থাকবে ?
    মহুয়া একটা থালায় ভাত বেড়ে টেবিলে রাখে৷ তাঁকে ধরে জোর করে এনে খাবার টেবিলে বসায়৷ মা খাবেন বলেই আসেন৷ দুদিন খান না৷ পেটে খিদেও আছে৷ তাঁর সামনে থালায় ভাত৷ মহুয়া আনতে গেছে তরকারি৷ ভাত৷ ভাতের দিকে তাকিয়ে মায়ের পুরো হৃৎদপিণ্ডখানি যেন গলা দিয়ে দুঃখ হয়ে, শোক হয়ে, শোচনা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ তিনি ভাতগুলো নাড়েন-চাড়েন৷ তাঁর মনে পড়ে যায়, রমনা থানার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আজাদ কেমন করে বলেছিল, ‘মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে৷ দুই দিন ছেলে আমার ভাত খায় না৷ তারপরেও তো কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন৷ তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে৷ এই প্রথম, আজাদ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে, তিনি কাঁদেন৷
    তাঁকে কাঁদতে দেখে বাড়ির ছেলেমেয়েরাও বিনবিনিয়ে কাঁদতে থাকে৷ আজাদের মায়ের আর ভাত খাওয়া হয়ে ওঠে না৷ তখন সারাটা দুনিয়ায় যেন আর কোনো শব্দ নাই৷ কেবল কয়েকজন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের কান্নার শব্দ শোনা যায়৷ তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে চোখের জল সামলাতে, বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা রোদনধ্বনি দমন করতে, তারা পারে না৷
    রাত্রিবেলা সবাই ভাত খাচ্ছে৷ মহুয়া মায়ের কাছে যায়৷ ‘আম্মা, দুইটা রুটি সেঁকে দেই৷ খাবেন ?’
    মা মাথা নাড়েন৷ খাবেন৷
    তাঁকে রুটি গড়িয়ে দেওয়া হয়৷ একটুখানি নিরামিষ তরকারি দিয়ে তিনি রুটি গলায় চালান করেন৷
    খাওয়ার পরে, শোয়ার সময় তিনি আর খাটে শোন না; মহুয়া, কচি, টিসু অবাক হয়ে দেখছে গত দু রাত ধরে আম্মা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুইছেন৷ তারা বিস্মিত হয়, বলে, ‘আম্মা, এইটা কী করেন, আপনে মাটিতে শুইলে আমরা বিছানায় শুই কেমনে’, কিন্তু আম্মা কোনো জবাব না দিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়েন৷ মাথায় বালিশের বদলে দেন একটা পিঁড়ি৷
    তখন কচি, ১১ বছর বয়স, মহুয়াকে বোঝায়, ‘আম্মা যে দেখছে রমনা থানায় দাদা মেঝেতে শুইয়া আছে, এই কারণে উনি আর বিছানায় শোয় না, না বুজি!’
    এর পরে আজাদের মা বেঁচে থাকেন আরো ১৪ বছর, ১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট পর্যন্ত, এই ১৪ বছর তিনি কোনো দিন মুখে ভাত দেননি৷ একবেলা রুটি খেয়েছেন, কখনও কখনও পাউরুটি খেয়েছেন পানি দিয়ে ভিজিয়ে৷ মাঝে মধ্যে আটার মধ্যে পেঁয়াজ-মরিচ মিশিয়ে বিশেষ ধরনের রুটি বানিয়েও হয়তো খেয়েছেন৷ কিন্তু ভাত নয়৷ এই ১৪ বছর তিনি কোনো দিন বিছানায় শোননি৷
    তিনি আবার যান জুরাইনের মাজার শরিফের হুজুরের কাছে, হুজুরাইনের কাছে৷ হুজুর তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, আজাদ ফিরে আসবে৷ শিগগিরই আসবে৷’
    একদিন জাহানারা ইমাম আসেন আজাদের মায়ের কাছে৷ তাঁরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন৷ অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারেন না৷ তারপর আজাদের মা মুখ খোলেন, ‘বোন, কী সর্বনাশ হয়ে গেল৷ আপনার রুমীকেও নাকি ধরে নিয়ে গেছে!’
    আজাদের মার মুখে আজাদকে কীভাবে ধরা হলো, তার বৃত্তান্ত শোনেন জাহানারা ইমাম৷ তারপর আজাদের মা তাঁকে দেখান সেই ঘরটা, স্টিলের আলমারিতে এখনও রয়ে গেছে গুলির দাগ৷ মেঝেতে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে৷ দেয়ালে গুলি আর রক্তের চিহ্ন৷
    ‘বোন রে, বড় মেরেছে আমার আজাদকে৷ চোখমুখ ফুলে গেছে৷ সারা গায়ে মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে৷ গায়ে রক্তের দাগ৷ মারের দাগ৷’ আজাদের মা বলেন৷
    ‘আপনি দেখেছেন আজাদকে ?’
    ‘হ্যাঁ৷ রমনা থানায়৷’
    ‘দেখা করতে দিল আপনাকে!’
    ‘হ্যাঁ৷’
    ‘কী বলল সে আপনাকে ?’
    ‘বলল, মা, খুব মারে৷ ভয় লাগে, যদি মারের চোটে বলে দেই সবকিছু৷
    ‘আপনি কী বললেন ?’
    ‘বললাম, বাবা, কারো নাম বলোনি তো৷ বোলো না৷ যখন মারবে, শক্ত হয়ে থেকে সহ্য কোরো৷’
    জাহানারা ইমাম ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে যান৷ কী শুনছেন তিনি এই মহিলার কাছে ? তাঁকে তিনি শক্তই ভেবেছিলেন, কিন্তু এত শক্ত! গভীর আবেগে জাহানারা ইমামের দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে৷ তিনি আবারও সাফিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরেন৷
    জুয়েলের মা ফিরোজা বেগম আসেন আজাদদের বাসায়৷ টগরের চাচি হিসেবে তিনি সাফিয়া বেগমের পূর্ব পরিচিত৷ এখন পরিস্থিতি তাদের আরেক অভিন্ন তলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ তাদের দুজনের ছেলেই ধরা পড়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে৷
    দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন নীরবে৷ কী করা যায়, এই বিষয়ে তারা মৃদুকন্ঠে শলাপরামর্শ করেন৷
    তারা একদিন দুজনে মিলে যান সৈয়দ আশরাফুল হকদের বাসায়৷ আশারফুলের মাকে বলেন, বাবু (আশরাফুলের ডাকনাম) যেন বাসায় না থাকে৷ পারলে যেন ইন্ডিয়া চলে যায়…
    আশরাফুল অবশ্য তার আগেই তার বাসা থেকে চলে গেছে অন্য গোপন আশ্রয়ে৷

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাগানবাড়ি রহস্য – আনিসুল হক
    Next Article মাসুদ রানা ৪৪৮ – মৃত্যুঘণ্টা

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }