Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৭ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভাগীরথী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত (অসম্পূর্ণ)

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প284 Mins Read0

    মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ১

    ॥ এক ॥

    পালকি চলেছে দুলকি চালে। হেলে দুলে হেলে দুলে।

    পালকির কাহাররা মধ্যে মধ্যে সামান্য বিরতি দিয়ে একটানা একটা মন্থর ক্লান্ত ঐকতান তুলে পালকি কাঁধে হেলে দুলে সেই নদীর পার থেকে দীর্ঘ মেঠো পথ অতিক্রম করে চলেছে। সঙ্গে বেজে চলেছে সানাই আর ঢোল।

    পৌষ শেষ হয়ে গেছে, মাঘের শীতের হাওয়ায় যেন হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি জাগায় শুরুতেই। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ চলে গিয়েছে দুই পাশের বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে দিয়ে। সারা মাঠ জুড়ে তখন আর মাঠ চোখে পড়ে না। দু’পাশে যতদূর দৃষ্টি চলে শুধু সবুজ আর সবুজ—সরষে আর কলাই বুনেছে চাষীরা। সবুজের ডগায় ডগায় ছোট ছোট হলুদ ফুল—তারই ফাঁকে ফাঁকে বেগুনী ফুল—এলোমেলো শীতের হাওয়ায় দুলছে আর দুলছে। থেকে থেকে মনে হয় যেন সবুজ সাগরে হরিদ্রাভ ঢেউয়ের ফুলকি। আকাশটা একেবারে নীল। ঘন নীল। দূরে দূরে দু’একটা পলাশ গাছে যেন লাল আগুন জ্বলছে। সেই নীলের বুকে মালার মত এক এক ঝাঁক পাখি টি টি করে ডাকতে ডাকতে মধ্যে মধ্যে উড়ে যায় এখান থেকে ওখানে—ঝাঁপিয়ে পড়ে দল বেঁধে ক্ষেতের মধ্যে, আবার ঝাঁক বেঁধে সব উড়ে যায়।

    পালকির দুটো দরজা সামান্য একটু ফাঁক করে বালিকা বধূ—বালিকা ছাড়া আর কি—বয়স তো মাত্র এই সবে নয় বছর পেরুতে চলেছে—দুর্গাপ্রতিমার মত গায়ের রঙ—টানা টানা কাজলকালো দুটি চোখ—এক মাথা চুল—ছোটখাটো গড়ন, কিন্তু কবিরত্ন ভারতচন্দ্র বরিশালে রোগী দেখতে গিয়ে ওই বালিকাটিকে আঙ্গিনায় খেলা করতে দেখে আর যেন দৃষ্টি ফেরাতে পারেন নি।

    লাল রঙের একটি জালি ডুরে শাড়ি কোনমতে কোমরে জড়িয়ে আঙ্গিনার সজিনা গাছটার তলায় বসে রান্নাবাটি খেলছিল মেয়েটি। কোন দিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই–অদূরে একটা কালো কুকুর বসে—হঠাৎ বোধ হয় মেয়েটির তার দিকে নজর পড়ল।

    বললে, এই ভুলো, এত হ্যাংলা কেন রে তুই—এত ক্ষিধে কেন—রান্না হবে তবে তো খাবি।

    কথাগুলো বলে মেয়েটি আবার নিজের কাজে মন দেয়। এখনও মাছের ঝোল আর সুক্তোই তো বাকী।

    গৃহকর্তা শ্রীকান্ত সেন মশাই কবিরত্নের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কি দেখতাছেন কবিরত্ন মশাই?

    সামনে শয্যায় রোগিণী শ্রীকান্ত সেন মশাইয়ের স্ত্রী—এখনও তাঁর নাড়ি পর্যন্ত দেখেন নি। কবিরত্ন বললেন, ওই মেয়েটি কে সেন মশাই?

    কার কথা কতিছেন? শ্রীকান্ত সেন মশাই শুধালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কবিরত্নের দিকে তাকিয়ে।

    ওই যে আঙ্গিনায় সজিনাগাছের তলায় খেলতিছে, রাঙা ডুরে শাড়ি পরনে—

    অ—ও তো আমার পৌত্রী, অন্নদা—

    অন্নদা! আহা, সত্যিই মা আমার অন্নদা—মা যেন আমার সাক্ষাৎ দুর্গা প্রতিমা, কবিরত্ন বললেন। তারপর চোখ ফিরিয়ে রোগিণীর প্রতি এতক্ষণে দৃষ্টিপাত করলেন, দেহি হাতটি আপনার—রোগিণীকে দেখলেন অতঃপর কবিরত্ন, ঔষধপথ্যাদির ব্যবস্থা করে দিলেন, তারপর সেন মশাই যখন দুটি রৌপ্যমুদ্রা কবিরত্নের সামনে এগিয়ে দিলেন, কবিরত্ন মৃদু হেসে হাত গুটিয়ে নিলেন।

    বললেন স্মিতহাস্যে, না।

    শ্রীকান্ত সেন মশাই কেমন যেন একটু বিস্মিতই হলেন, বললেন, আরও দিতে হবে কি?

    না, না, না—দিতি হবে না সেন মশাই। কিছুই দিতি হবে না।

    তবে?

    শ্রীকান্ত সেন মশাই তাকালেন কবিরত্নের দিকে কিছুটা যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই।

    ন মশাই! বললেন কবিরত্ন।

    আজ্ঞা করুন।

    একটি বিনীত অনুরোধ বলুন অনুরোধ—প্রার্থনা বলুন প্রার্থনা ছিল আজ্ঞে আপনার কাছে আমার।

    অনুরোধ! প্রার্থনা! কি বলুন?

    সঙ্কোচ হচ্ছে—, কবিরত্ন বললেন একটু যেন থেমে থেমে।

    না, না—শ্রীকান্ত সেন মশাই বললেন, সঙ্কোচের কি আছে, বলেন না?

    আমার অবস্থা তো কিছুই আপনার অজানা নয় সেন মশাই, কবিরাজী ব্যবসা করে মন্দ উপার্জন করি না, কিন্তু বৃহৎ সংসার—চারটি বোন—চারজনই বিধবা, তা ছাড়া বড় মেয়েটির ও আমার ছেলে আনন্দর পর আরও দুটি মেয়ের বিবাহ কোনমতে দিয়েছি বটে তবে এখনও দুটির—

    বলুন না—বললেন শ্রীকান্ত সেন মশাই কবিরত্নের কথা শেষ হবার আগেই।

    আপনার সংসারের মত সচ্ছলতাও আমার সংসারে নেই। খানচারেক মাটির ঘর—দুটি গাই—কিছু ক্ষেতখামার—সংবৎসরের ধানটা ক্ষেত থেকেই আসে। কতিছিলাম কি—আবার যেন একটু ইতস্তত করে থেমে বললেন কবিরত্ন, আমার একটি মাত্রই পুত্র—–কলকাতায় হিন্দু কলেজে পড়ে—সামনের বছর পাস করে বেরুবে, তারপর ডাক্তারী পড়াবার ইচ্ছা আছে। আনন্দচন্দ্র আমার ছেলে বলে বলতিছি নে, সত্যিই বড় ভাল ছেলে—ব্যবহারে আচরণে দেবদ্বিজে ভক্তিতে কোন ত্রুটি পাবেন না—

    এতক্ষণে শ্রীকান্ত সেন মশাই ব্যাপারটা যেন হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন। মৃদু হাসলেন ভারতচন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে। রোগাটে লম্বা শীর্ণ দেহ—পরনে একটি ধুতি, একটা মের্জাই ও তার উপরে বহিরাবরণ একটি শাল, চমৎকার কল্কার কাজ করা। শালটি ভারতচন্দ্রের পিতার। কাশীধামে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আনানো। পায়ে চর্মপাদুকা

    কিন্তু শীর্ণ লম্বা হলে কি হবে, তেজোদীপ্ত চেহারা এবং চেহারার মধ্যে যেন সমস্ত দারিদ্র্যকে ছাপিয়েও একটা আভিজাত্য ফুটে উঠেছে—বংশমর্যাদার।

    বংশগৌরবে অবিশ্যি খাটো নই আমি, ভারতচন্দ্র বললেন, রামকান্ত ঠাকুর মশাই আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব। তাঁর পিতার আমল থেকেই আমরা যশোহরের ইতিনা গ্রামবাসী। পূর্বে বাস ছিল বরাহনগরে—কলিকাতার নিকটবর্তী গঙ্গার তীরে। বলছিলাম তাই, যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে তো আমার পুত্র আনন্দচন্দ্রের সঙ্গে আপনার পৌত্রীর—

    বিলক্ষণ! আপত্তি কি বলছেন আপনি কবিরত্ন মশাই—এ তো খুব সুখের কথা, আনন্দের কথা। আমার অন্নদাসুন্দরী আপনার গৃহে পুত্রবধূ হয়ে যাবে এ তো ওর সৌভাগ্য। আশেপাশে দশ-বিশ ক্রোশের মধ্যে আপনাদের বংশমর্যাদা ও গৌরবের কথা কে না জানে! আর দারিদ্র্যের কথা বলছেন, দারিদ্র্যই তো মানুষকে গৌরবের পথে নিয়ে যায়। তার পর হাসতে হাসতে যোগ করেন, আমিও কিছু ধনী ব্যক্তি নই, আপনার মত সাধারণ গৃহস্থ কবিরাজ মশাই।

    তবে-আপনি তাহলে রাজী সেন মশাই?

    হ্যাঁ হ্যাঁ, রাজী আবার নই? নিশ্চয়ই রাজী। শ্রীকান্ত সেন মহাশয় বললেন।

    আনন্দে আত্মহারা কবিরত্ন প্রথমটায় কি বলবেন বুঝতে পারেন না। তাঁর দু’চোখে জল ভরে আসে, দুটো হাতে সেন মশাইয়ের একখানি হাত পরম আগ্রহে চেপে ধরে বললেন, তাহলে আমি আর দেরি করতে চাই না, অগ্রহায়ণ চলেছে—সামনের মাঘেই শুভকার্যটা আমি—

    বেশ তো—বেশ তো!

    তাহলে পঞ্জিকাটা নিয়ে আসুন—

    শ্রীকান্ত সেন মশাই তাঁকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে সমাদরে বসালেন। কুলুঙ্গি থেকে নিয়ে এলেন শীর্ণ ছোট একটি পঞ্জিকা।

    পঞ্জিকা দেখে দিন স্থির হয়ে গেল।

    তবে ওই সামনের তেরোই মাঘই দিন স্থির রইল সেন মশাই।

    কিন্তু এত শীঘ্র আমার পক্ষে সম্ভব নয় কবিরত্ন মশাই!

    কেন—কেন?

    সব যোগাড় ব্যবস্থা করতে হবে তো—কন্যাদান বলে কথা!

    কিছু না—কিছু না, কেবল শাঁখাসিন্দূর দিয়ে মা-লক্ষ্মীকে সম্প্রদান করবেন সেন মশাই—মাকে আমি মাথায় করে নিয়ে যাবো।

    তথাপি শ্রীকান্ত সেন মশাই ইতস্তত করেন। ভারতচন্দ্রের যেন আর তর সয় না। বললেন, ডাকুন ডাকুন মাকে আমার, আজই আমি আমার মা জননীকে আশীর্বাদ করে যেতে চাই; আর পঞ্জিকাটা আনুন—এখানে আসার সময় পঞ্জিকা দেখছিলাম, মনে পড়ছে আজ যেন দিনটা ভালই—অমৃতযোগ আছে, আজই –

    হ্যাঁ তা বোধ হয় আছে

    শুভস্য শীঘ্রং—আপনার সম্মতি যখন পেয়েছি, শুভকার্যে আর বিলম্বের প্রয়োজনই বা কি!

    সেই ব্যবস্থাই হল। পঞ্জিকা এল এবং দেখা গেল সত্যিই দিনটি আশীর্বাদের পক্ষে প্রশস্ত।

    শ্রীকান্ত-গৃহিণীও কর্তার মুখে কথাটা শুনে হতচকিত হলেন। বললেন, ওমা, সে কি গো! কোন আয়োজন নেই, ব্যবস্থা নেই—অমনি আশীর্বাদ আজ বললেই হল? এ কি ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে—কাকে-পক্ষীতে জানল না—

    তা হোক—তা হোক বড়বৌ। এমন পাত্র অন্নদার জন্য তুমি পাবে কোথায়? ছেলে কলকাতায় হিন্দু কলেজে পড়ে—সামনের বছরই ডাক্তারী পড়তে শুরু করছে, আর সংসারের কথাই যদি বল তো, জানই তো ডাক্তারী পাস করে বের হয়ে এলে তখন তার উপার্জন খায় কে! না, না—তুমি আর দ্বিমত করো না, ব্যবস্থা করে ফেল।

    অন্নদাসুন্দরী শৈশবে মাতৃহীনা।

    ঠাকুর্দা আর ঠাকুরমার কাছেই মানুষ। পিতা তার সুদূর উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে নবাব সরকারের চাকরি করেন। বৎসরান্তে কখনো কখনো দুই-তিন বৎসর পরে একবার করে আসেন গৃহে। দু’তিন মাস থেকে আবার চলে যান।

    বড় আদরের পৌত্রী অন্নদাসুন্দরী বুড়ো-বুড়ীর।

    যা হোক শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হয়ে গেল। অন্নদাসুন্দরীর আশীর্বাদ হয়ে গেল। নিজের পকেটঘড়ির সঙ্গে একটা বহু পুরাতন সোনার সরু চেন ছিল, সেই চেন আর ধানদূর্বা দিয়ে ভারতচন্দ্র আশীর্বাদ করে চলে এলেন ভাবী পুত্রবধূকে। অন্নদাসুন্দরীর আশীর্বাদ হয়ে গেল।

    মধ্যরাত্রে নৌকাযোগে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে বললেন স্ত্রী বামাসুন্দরীকে, শুনছো, মা-লক্ষ্মীকে আর্শীবাদ করে এলাম—

    আশীৰ্বাদ!

    হ্যাঁ গো, এই অগ্রহায়ণ—মাঝখানে পৌষ মাস—তার পরই সামনের চৌঠা মাঘ বিয়ে গোধূলি লগ্নে।

    কার বিয়ে? গৃহিণী বামাসুন্দরীর তখনো বিস্ময় ঘোচে নি যেন। স্বামীর কথাগুলো তখনো সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন নি।

    ভারতচন্দ্র বললেন, কার আবার—আনন্দের——আমাদের ছেলের!

    আনন্দের জন্য কন্যা দেখে এলে, তা ঠাকরুনদের বলেছো? বামাসুন্দরী আবার বললেন, যেন কতকটা ভয়ে ভয়েই।

    সবাইকেই বলবো, আগে তোমায় বললাম—তোমারই তো ছেলে। তারপরই বললেন একটু থেমে যেন, শুধু দেখা—বুঝলে বড়বৌ, একেবারে মা আমার সাক্ষাৎ দুর্গাপ্রতিমা—তাই একেবারে বাক্যদান ও আশীর্বাদও সেরে এলাম। দিদি মেজদিকে ও বলব, সরো আর বিন্দুকেও বলব। এবারে কোমর বেঁধে লেগে পড় বিবাহের জোগাড়যন্ত্র করতে তোমরা সকলে।

    ***

    সেই বিয়ে দিয়েই পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে আজ ফিরছেন ভারতচন্দ্র নিজ গৃহে। দশে এখনো পড়ে নি—বালিকা বধূ অন্নদাসুন্দরীর কাছে সবটাই যেন একটা চরম বিস্ময়।

    শুভদৃষ্টির সময় অন্নদাসুন্দরী সকলের পীড়াপীড়িতে ভীরু দুটি চক্ষু মেলে একটিবার সামনের দিকে তাকিয়েছিল।

    লম্বা ঢ্যাঙা রোগা কালো এক কিশোর—যৌবন যেন সবে ছুঁই-ছুঁই করছে। বয়স আনন্দের তখন সবে ষোল উত্তীর্ণ হতে চলেছে। মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মধ্যে সিঁথি কাটা।

    সরু গোঁফের একটা কালো দাগমাত্র দেখা যায়।

    ড্যাব্ ড্যাব্ করে তাকিয়ে ছিল আনন্দ নববধূর মুখের দিকে।

    অন্নদা সঙ্গে সঙ্গে একটিবার তাকিয়েই চোখের পাতা দুটি নমিত করেছিল। আর চোখ খোলে নি।

    বাসরঘরেও একগলা ঘোমটা দিয়ে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। এমনিতে অন্নদার লাজলজ্জা খুব একটা ছিল না, কিন্তু বাসররাত্রে যেন রাজ্যের লজ্জা এসে তাকে চেপে ধরেছিল কোথা থেকে।

    চোখের পাতাই খোলে নি।

    অনেকরাত্রে বাসরঘরের ভিড় কমলে বর একবার মৃদুকণ্ঠে ডেকেছিল, বৌ!

    কিন্তু সাড়া দেয় নি অন্নদা।

    সাড়া দেবে কি! সে কি তখনো ভাবতে পারছে নাকি যে সে কারো বৌ হয়েছে? কারো সঙ্গে তার ওইদিন গোধুলি লগ্নে বিবাহ হয়েছে? অবিশ্যি ওই বয়েসেও বিবাহের ব্যাপারটা যে অন্নদার কাছে একেবারে অজ্ঞাত ছিল তা নয়, তবু সেটাও কেবল একটা শোনা কথাই মাত্র এর ওর মুখ থেকে—বিবাহের স্পষ্ট অর্থ তার কাছে তখনো অজ্ঞাত, সবে তো নয় বৎসর বয়সটাও তার পার হয় নি।

    মেয়েদের বিবাহ হয়—একদিন বর আসে, তারপর বিবাহ করে চলে যায়—নিয়ে যায় নববধূকে শ্বশুরগৃহে। শোনা কথা—দেখা ব্যাপার

    মেয়েদের সে এক নতুন জীবন নাকি—তাও তো শোনা কথাই মাত্ৰ অন্নদাসুন্দরীর।

    আর সেটাই নাকি মেয়েদের আসল সংসার—আসল গৃহ। কিন্তু সে গুরুত্বপূর্ণ একটা শোনা কথাই মাত্র—তার গুরুত্ব-তাৎপর্য উপলব্ধি করার মত সামর্থ্য কোথায় মাত্র নয় বৎসর উত্তীর্ণ হতে চলেছে এমন এক বালিকার? কি কান্নাই না কেঁদেছিল অন্নদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নদীর ঘাটে নৌকায় উঠবার সময়! একটা দিন ও একটা রাত নদীপথে, তারপর পালকিতে—–—কারণ তখনো ওই অঞ্চলে স্টীমার চলাচল শুরু হয় নি। অনেকটা পথ। সেই সন্ধ্যা নাগাদ নাকি পৌঁছাবে শ্বশুরগৃহে, নতুন এক গাঁয়ে। পালকির মধ্যে ঠায় একভাবে বসে থাকতে থাকতে দুলুনিতে চোখের কোলে কেমন যেন তন্দ্রা নেমে এসেছিল। হঠাৎ পালকি বেহারাদের কাঁধ বদলাবার ঝাঁকুনিতে তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। পালকির দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে সামনের দিকে তাকাল অন্নদা।

    যতদূর দৃষ্টি চলে সবুজ আর হলুদের সমারোহ

    হঠাৎ ওই সময় সেই পরিচিত পাখীর ডাকটা কানে ভেসে এল—বৌ কথা কও, বৌ কথা কও। নিশ্চয়ই সেই হলদে রঙের পাখিটা কোন গাছের ডালে বসে ডাকছে—বৌ কথা কও, বৌ কথা কও! আঃ গেল যা, ডাকবার আর সময় পেলি না? যখন তখন ডাকলেই বুঝি হল? কিন্তু ওই ডাক তার পরিচিত—বৌ কথা কও।

    ওদের লাল চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হলে নাকি, ছোট পিসী বলতো, চোখ ওঠে—চোখ লাল হয়ে ফুলে ওঠে, জ্বালা করে, জল পড়ে চোখ দিয়ে, খবরদার তাকাবি না ওই হলুদ পাখির লাল চোখের দিকে। খালি সবুজ আর হলুদের একটা বিরাট সীমাহীন বিস্তৃতি, তারই মধ্য দিয়ে পালকিটা হেলতে দুলতে হেলতে দুলতে চলেছে।

    কোথায় চলেছে অন্নদা?

    শ্বশুরবাড়ি। একটা নতুন বাড়িতে—সেখানে এক নতুন সংসার। সব নতুন নতুন লোক—সেখানে দাদু নেই, ঠাম্মা নেই, ছোট পিসী নেই—বুড়ো বামাচরণ নেই— খেলার সাথী ক্ষেন্তি, সরলা, ভাদু, আন্নাকালী কেউ নেই। কেউ নেই—সব অচেনা, অজানা। সেখানে সে একেবারে একা। এতদিনকার চেনা মানুষগুলোকে আর ও দেখতে পাবে না।

    আন্নাকালীটা কি কান্নাই কাঁদছিল ওকে জড়িয়ে ধরে নৌকায় ওঠবার আগে! হঠাৎ যেন অন্নদার দু’চোখে জল ভরে আসে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়—কিছুই আর ওর চোখে পড়ে না, বুকের ভিতরটা কি এক শূন্যতায় যেন হাহাকার করে ওঠে।

    ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে ওই মুহূর্তে যেন।

    ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয় অন্নদা। এই—এই মেয়েটা, কাঁদছিস কেন রে? এই

    স্বামী আনন্দচন্দ্রের কথায় ওর কান্নার বেগটা যেন আরও বেড়ে যায়, হু হু করে দুই কাজলটানা চোখের কোল বেয়ে ওর গাল ও চিবুক যেন অশ্রুতে ছাপিয়ে যায়।

    কি হল রে, কাঁদছিস কেন বৌ?

    আনন্দচন্দ্র আবার ওকে বলে। হাত বাড়িয়ে আনন্দচন্দ্র অন্নদার চিবুকটি স্পর্শ করবার চেষ্টা করে, কিন্তু অন্নদা তাড়াতাড়ি দু’হাতে মুখ ঢাকে।

    অনেক—অনেক বছর পরে বড় নাতিকে অন্নদাসুন্দরী গল্পটা বলছিল, আমারও কান্না থামে না, তোর দাদুও কেবলই জিজ্ঞাসা করে—কেন—কেন কাঁদছো বৌ?

    আট বছরের নাতি নীরদচন্দ্র ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, কেন কাঁদছিলে তুমি ঠাম্মা—খুব কাঁদছিলে বুঝি?

    কি জানি ভাই—ভারি কান্না পাচ্ছিল—

    খুব কষ্ট হচ্ছিল, তাই না ঠাম্মা? নাতি আবার সাগ্রহে শুধায়।

    বোধ হয় তাই—

    তা তুমি এক কাজ করলে না কেন ঠাম্মা—নীরদচন্দ্র বলে।

    কি কাজ ভাই?

    পালকি থেকে লাফিয়ে পড়ে এক ছুটে পালিয়ে গেলে না কেন?

    কোথায় পালিয়ে যেতাম রে! হাসতে হাসতে অন্নদাসুন্দরী নাতির মুখের দিকে তাকায়।

    কেন, তোমার বাড়িতে?

    তোর দাদু কি পালাতে দিত রে!

    ইঃ, অমনি না দিলেই হল!

    তারপরই অন্নদাসুন্দরী প্রশ্ন করেছিল নাতিকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে, তোর বৌ যদি অমনি করে পালিয়ে যায়, দিবি তুই পালাতে?

    যে বৌ কাঁদে সে বৌ আমি চাই না।

    অন্নদাসুন্দরীর সে কি হাসি নাতির কথায়!

    কিন্তু নাতবৌয়ের মুখ দেখে যাবার সৌভাগ্য হয় নি অন্নদাসুন্দরীর। নয় বৎসর পার হতে চলেছে। বালিকা বয়সে যে গৃহে পাথরের থালাভর্তি দুধের মধ্যে আলতাপরা দুটি পা ভিজিয়ে সেই যে এসে প্রবেশ করেছিলেন স্বামীর সঙ্গে, গাঁটছড়া বাঁধা তাঁর পিছনে পিছনে—সে গৃহ ছেড়ে যখন তিনি গেলেন সেই তাঁর শেষ যাত্রা, যে যাত্রা করে আর কেউ কোনদিন ফিরে আসে না।

    মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স তখন অন্নদাসুন্দরীর।

    ভরাভর্তি সংসার তখন তাঁর।

    সাত ছেলে পাঁচ মেয়ে।

    বড় মেজ ও সেজ ছেলের বৌরা এসেছে ঘরে—ছোট দুই মেয়ে ছাড়া বড় তিনটির বিবাহ হয়ে গিয়েছে—নাতি-নাতনী—বড় ছেলে কলকাতা শহরে ডাক্তারী পড়ছে—

    কিন্তু সে তো আরো অনেক অনেক পরের কথা।

    তাছাড়া অন্নদাসুন্দরীর সেই নাতি আরো বড় হয়ে কলকাতা শহরের মেডিকেল কলেজে পড়তে পড়তে বার চারেক ফার্স্ট এম. বি. পরীক্ষা ফেল করার পর চলে যায় বিলেতে, সেখানে গিয়ে ভালোবেসে সে এক বিড়ালাক্ষী শ্বেতাঙ্গিনীকে বিবাহ করে নিজের পছন্দে।

    মধুমতী—পদ্মা হয়ে গঙ্গার জল অনেক বহে গিয়েছে তখন।

    গ্রামের সে চেহারাও তখন আর নেই অন্নদাসুন্দরীর কালের।

    তাই বলছিলাম সে এই কাহিনীর অনেক—অনেক পরের কথা এবং এ কাহিনীর বিস্তৃতিও তত দূরে নয়—

    তার বহুপূর্বেই এই কাহিনীর শেষ পৃষ্ঠাটা এসে যাবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম
    Next Article অশান্ত ঘূর্ণি (অখণ্ড) – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৭ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    যুগলবন্দী – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    সামনে সমুদ্র নীল – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    মানসী তুমি – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৭ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.