Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভাগীরথী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত (অসম্পূর্ণ)

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প284 Mins Read0

    মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ১৫

    ॥ পনেরো ॥

    অন্নপূর্ণা কিন্তু তথাপি নিরস্ত হয়নি সে রাত্রে। অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিল তার স্বামীকে। বলেছিল—আমি ভাবতেই পারি না তোমার বংশ থাকবে না। তাছাড়া এর মধ্যে অন্যায়েরই বা কি আছে? একাধিক বিয়ে তো কত পুরুষরাই করে। তোমার পূর্বপুরুষরাও তো করেছেন।

    করেছেন তা জানি। আমার বিবেচনায় তাঁরা অন্যায় করেছেন। তা ছাড়া একটা কথা ভুলে যাচ্ছ কেন বড় বৌ, পুত্র যদি আমার থাকবারই হত তবে তোমার দু’দুটি পুত্রসন্তান সুতিকাগৃহেই মারা গেল কেন? ভবিতব্য—বুঝলে ভবিতব্য! একটা কথা তুমি বুঝছ না কেন বড় বৌ, আবার বিবাহ করলেই যে আমার একটি পুত্রসন্তান হবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? তার কোন সন্তান নাও হতে পারে বা কন্যাসন্তানও হতে পারে!

    হবে—হবে। নিশ্চয়ই পুত্রসন্তান হবে।

    সে সন্তান হবার বয়স তো তোমারও এখনো উত্তীর্ণ হয়নি। তোমারও তো একটি পুত্রসন্তান হতে পারে।

    না হবে না।

    কে বললে তোমায় সে কথা?

    আমি জানি।

    রাধারমণ মল্লিক হেসে ফেলেন, হ্যাঁ, তুমি তো সব কিছু জেনে বসে আছ। সবজান্তা। এস, রাত অনেক হয়েছে, এবার শুয়ে পড়।

    দিন দুই বাদে ভবতারিণী আবার পুত্রবধূকে বললেন, বলেছিলে বৌমা কথাটা রাধারমণকে?

    বলেছি মা—

    বলেছ? আনন্দে ভবতারিণীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! তিনি বললেন, তা কি বলল সে? রাজী হয়েছে নিশ্চয়ই?

    রাজী তিনি হোন বা না হোন, আপনি তার মা—আপনি একটা কিছু করলে তিনি নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবেন না। আপনি সব ব্যবস্থা করুন।

    ভবতারিণী অতীব বুদ্ধিমতী মহিলা। ব্যাপারটা তিনি সহজেই অনুমান করতে পারলেন। মৃদুকণ্ঠে বললেন, তাহলে সে রাজী হয়নি? তুমি তাকে রাজী করাতে পারনি?

    আমার যথাসাধ্য আমি বলেছিলাম মা—

    অন্তরের থেকে নিশ্চয়ই বলোনি।

    বিশ্বাস করুন মা, ঈশ্বর জানেন—আমি —

    থাক বৌমা। সবই অদৃষ্ট। নচেৎ এমনটি হয়! ভবতারিণী কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না, সোজা গৃহদেবতার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

    ঠাকরুনের মনের ব্যথাটা বোধ করি অন্নপূর্ণা অনুমান করতে পেরেছিল, তাই সে সেরাত্রেও পুনর্বার স্বামীকে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু রাধারমণ কান দেন নি স্ত্রীর কথায়। পূর্বের মত বলেছেন—না, আর নয়।

    অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন ভবতারিণী।

    .

    সুহাসিনীই সকলের চোখের মণি হয়ে বড় হতে লাগল। অন্নপূর্ণার আর কোন সন্তান হল না। সুহাসিনীর অত অল্প বয়সে বিবাহ দেবার এতটুকুও ইচ্ছা ছিল না রাধারমণ মল্লিকের। নতুন যুগের হাওয়া রাধারমণের মনেও লেগেছিল। কিন্তু ভবতারিণী কারো কথায় কর্ণপাত করেন নি। দৌহিত্রীর বিবাহের জন্য পুত্রকে ঘন ঘন তাগিদ দিতে লাগলেন। সুহাসের এবার বিয়ে দে একটি ভাল পাত্র দেখে!

    রাধারমণ বলেছেন—ব্যস্ত হচ্ছ কেন মা, ও তো এখনো শিশু।

    শিশু! কি বলছিস তুই? নয় পেরুতে চলল। তোর বড়মার বিবাহ হয়েছিল সাত বৎসর বয়সে। আমার নয় বৎসরে। আর তোর বৌ এ-বাড়িতে এসেছে আট বৎসর বয়সের বালিকা। না না, তুই পাত্র দেখ্‌।

    চৌধুরীবাড়ির সম্বন্ধটা এনেছিল ক্ষেমঙ্করী ঘটকী। ছেলের একটু বয়েস বেশী, তাতে আর কি হয়েছে? অমন বাড়িঘর, বিষয়সম্পত্তি, বোলবোলাও! একমাত্র ছেলে চৌধুরীদের, রাজপুত্রের মত চেহারা।

    তা সত্যি। যথেচ্ছ অত্যাচার করা সত্ত্বেও নবীনের চেহারাটা তখনও ভালই ছিল। দেহমধ্যে যকৃতের ব্যাধি শুরু হলেও তখনো ভাঙন শুরু হয়নি শরীরের। তাই নবীনকে দেখে রাধারমণের কোন অপছন্দের কারণ ছিল না। তা ছাড়া বয়েসের অনুপাতে নবীনকে দেখতে বরং কমবয়েসীই মনে হয়েছে তখন। মহা ধুমধামে বিবাহ হয়ে গেল, নয় বৎসর সবে উত্তীর্ণ হয়ে দশে পা দিয়েছে সুহাসিনীর নবীনের সঙ্গে।

    কয়েকদিনের জন্য বালিকাবধূ শ্বশুরগৃহে গিয়ে আবার পিতৃগৃহে ফিরে এল। রাধারমণ মল্লিক তাঁর বেয়াই জগৎ চৌধুরীকে আগেই কথাটা বলে রেখেছিলেন। বৎসর খানেক বাদে সুহাসিনী শ্বশুরগৃহে যাবে। জগৎ চৌধুরী আপত্তি করেননি। সুহাসিনী বিবাহের পরও পিতৃগৃহেই থেকে গেল।

    কিন্তু বৎসর উত্তীর্ণ হল না, আটমাসের মাথায় নবীনের যকৃতের ব্যাধিটা হু-হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় সে যেন রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রথম দিকে কয়েকটা মাস জগৎ চৌধুরী পুত্রের অসুস্থতার কোন সংবাদই দেননি রাধারমণ মল্লিককে, কিন্তু ক্রমশ যখন রোগ বৃদ্ধির দিকেই যেতে লাগল, সংবাদ পাঠাতে বাধ্য হলেন জগৎ চৌধুরী। তাও তিনি পাঠাতেন কিনা সন্দেহ, স্ত্রীর পীড়াপীড়িতেই লোক মারফৎ সংবাদটা প্রেরণ করেছিলেন।

    জামাতার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে অন্নপূর্ণাই কন্যাকে অবিলম্বে তার শ্বশুরালয়ে পাঠিয়ে দেবার জন্য স্বামীকে বললে। সুহাসিনী তখন দশ উত্তীর্ণা হয়ে একাদশ বৎসরে পদার্পণ করেছে। সুহাসিনীর বাড়ন্ত গড়নের জন্য তাকে বয়েসে তখন বড়সড়ই দেখাত ওই বয়েসেই।

    সুহাসিনী শ্বশুরগৃহে গেল এবং বৎসর উত্তীর্ণ না হতেই মাথার সিন্দুর ও হাতের লোহা খুইয়ে বিধবা হয়ে ফিরে এল। সে ইতিহাস পূর্বাহ্নেই বর্ণিত হয়েছে। কন্যার— বিশেষ করে একটি মাত্র সন্তানের অকাল বৈধব্যে অন্নপূর্ণা যতখানি না আঘাত পেয়েছিল, তার দ্বিগুণ আঘাত পেয়েছিলেন রাধারমণ মল্লিক। পাথরের মতই যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন রাধারমণ মল্লিক। ক’টা দিন অন্নজল পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। ঘরের মধ্যে একাকী চুপটি করে বসে থাকতেন। কারো সঙ্গে দেখা করতেন না, কথা বলতেন না। কাজকর্ম সব বন্ধ। অনেকেই ভেবেছিল, রাধারমণ মল্লিক মশাই বুঝি কন্যার বৈধব্যশোক সহজে ভুলতে পারবেন না। কিন্তু সংসার এমনই একটি বিচিত্র জায়গা যে একটু একটু করে অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়। এবং ভুলতে না পারলেও আঘাতটা ক্রমশ একদিন সহনীয় হয়ে যায় সকলের কাছেই।

    রাধারমণ মল্লিকেরও তাই হয়েছিল। রাধারমণ মল্লিক কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার কাজকর্মে মন দিলেন বটে কিন্তু মেয়ের দিকে যেন তাকাতে পারতেন না। পাছে মেয়ের সামনাসামনি পড়তে হয় তাই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। মেয়ের দিকে তাকালেই তাঁর মনে হত, ওর ওই অকালবৈধব্য ও চরম দুর্ভাগ্যের জন্য তিনিই দায়ী। আদৌ তো তাঁর ইচ্ছা ছিল না ওই বয়েসে মেয়ের বিবাহ দেবার, কেবল মায়ের পীড়াপীড়িতেই বিবাহ দিতে হল।

    সুহাসিনীর অকালবৈধব্যে ভবতারিণী দেবীরও যেন নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হত। তাই পুত্র রাধারমণ যখন মেয়েকে বৈধব্যের সাজে সাজাতে গৃহিণীকে মানা করলেন, ভবতারিণী দেবী তার কোন প্রতিবাদ জানাননি! ভেবেছেন- আহা থাক, দুটো দিন পাড়ওলা শাড়ি পরলেই এবং দু’চারটে অলংকার গায়ে দিলে কিই বা ক্ষতি! যখন ভাল করে বুঝতে শিখবে তখন ওসব নিজে থেকেই হয়ত বর্জন করবে। যে ক’টা দিন ওই করুণ মর্মান্তিক দৃশ্যটা এড়ানো যায় যাক না।

    অন্নপূর্ণা দেবী কিন্তু গজগজ করেছে। কিন্তু শাশুড়ী ও স্বামীর প্রতিবাদ করতে পারেনি। যদিও ভবতারিণী দেবী সংসারে যাবতীয় দায়দায়িত্ব পুত্রবধূ অন্নপূর্ণার স্কন্ধেই তুলে দিয়েছিলেন, তথাপি মল্লিকবাড়ির আসল কর্ত্রী যে ভবতারিণী দেবীই, তাঁর হুকুমই যে ‘শেষ হুকুম, এমন কি রাধারমণের হুকুমের উপরেও তাঁর হুকুম চলে, সেটা বুঝতে কারো কষ্ট হত না।

    মেয়ে সুহাসিনীর যত বয়েস হচ্ছে ততই যে একটু একটু করে তার রীতিচরিত্র বদলে যাচ্ছে, সেটা আর কারো নজরে না পড়লেও সুহাসিনীর জননী অন্নপূর্ণার নজরে পড়েছিল। মেয়ে হুটহাট করে যখন তখন অন্দরমহল থেকে বহির্মহলে চলে যায়, সকলের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করে—ব্যাপারটা অন্নপূর্ণার আদৌ ভাল লাগত না।

    প্রথম প্রথম ওই ব্যাপারে মেয়েকে নিষেধ করত অন্নপূর্ণা, নানাভাবে উপদেশ দিত। বলত, মেয়ে হয়ে তুই যখন তখন অমন হুটহাট করে বাইরের মহলে যাস কেন? কত লোক বাইরের মহলে আসছে যাচ্ছে!

    মেয়ে বলেছে, কেন, তাতে কি হয়েছে?

    না, ভাল দেখায় না। অমন করে যাস না।

    কেন? ভাল না দেখার কি আছে?

    হতভাগী, ভুলে যাস কেন তুই মেয়েছেলে, তায় বয়েস হয়েছে!

    হয়েছে তো কি?

    সুহাসিনী মায়ের কথাটা বুঝতে চাইত না—বুঝবার চেষ্টাও করত না। তার কারণও ছিল। বস্তুত সুহাসিনীর মনটা বরাবরই একটু বেশী সরল। বয়েসের অনুপাতে তার বুদ্ধি হয়নি। অন্নপূর্ণা সে-কারণে বলেছে, হয়—অনেক কিছু হয়। দশজনে দেখলে জানলে দশ কথা বলবে!

    তা বলুক—যার যা খুশী বলুক!

    সমাজে দশ কথা হবে, তোর জন্মাদাতার মাথা হেঁট হবে!

    বাড়ির মধ্যে সারাক্ষণ তাই বলে ভূতের মত চুপটি করে আমি বসে থাকতে পারব নি বাপু।

    তা পারবে কেন? নেচে নেচে বেড়াবে! আমি এই বলে রাখলাম খুকী, তুই বাইরে যাবি না। কেন ভূতের মতই বা বসে থাকবি কেন, রামায়ণ মহাভারত পড় না!

    ওসব আমার ভাল লাগে না।

    তা লাগবে কেন? ভাল লাগে ঢলাঢলি করতে!

    কিন্তু দেখা গেল, অন্নপূর্ণা যাই বলুক সুহাসিনী যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগল।

    অন্নপূর্ণা অতঃপর গালাগালি করতে শুরু করল, কিন্তু তাতেও কিছু হল না। সুহাসিনীর স্বভাব বদলাল না। কথাটা অন্নপূর্ণা স্বামীকেও বলতে পারে না। বাড়ির মধ্যে যারা আত্মীয়ের দল আছে তাদেরও বলতে পারে না।

    বাড়ির মধ্যে যারা আত্মীয়-পোষ্যর দল তারা যে আড়ালে-আবডালে সুহাসিনীর বেহায়াপনা নিয়ে নানা ধরনের তিক্ত মন্তব্য করে, অন্নপূর্ণার সে সবগুলো যখন কানে আসে লজ্জা দুঃখ আক্রোশ যেন তার আরো বেশী হয়। কাকে কি বলবে অন্নপূর্ণা? চিৎ হয়ে থুতু ফেললে তা নিজের মুখেই এসে পড়ে!

    সংসারের কাজকর্ম আছে, সারাটা দিন তো অন্নপূর্ণাকে তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। সেই কোন্ সকালে কাক ডাকতে শয্যা ছেড়ে উঠে আসে, তারপর গভীর রাত্রে শয়নকক্ষে যায়। তবু কাজের ফাঁকে-ফাঁকেই মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ নেয় অন্নপূর্ণা।

    ভোলানাথের সঙ্গে যে সুহাসিনী মেশে, আর ভোলানাথটা যে যত রাজ্যের আজেবাজে কথা ফাঁক পেলেই সুহাসিনীকে বলে, বাড়ির কাদম্বিনী ঠাকরুন অর্থাৎ কাদু. ঠাকরুনই সর্বপ্রথমে অন্নপূর্ণাকে বলেছিল একদিন।

    কাদম্বিনী রাধারমণের দূর-সম্পর্কীয় জ্যাঠতুত বোনের মেয়ে—মল্লিকবাড়ির আশ্রিতা। কুলীন কায়েতের সঙ্গে কাদম্বিনীর বিবাহ হয়েছিল।

    স্বামীর ঘর সে কোনদিনই করতে পারেনি। কাদম্বিনীর স্বামীদেবতা মল্লিনাথ যে কত মেয়েকে বিবাহ করেছিল তা সে বোধ করি সে নিজেও জানত না! কিছু থোক টাকা পেলেই সে কুমারীর পাণিগ্রহণ করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তার ধর্মরক্ষা করত। এবং ধর্মরক্ষা করে সেই যে সে চলে যেত আর দ্বিতীয়বার বড় একটা শ্বশুর-গৃহে পদার্পণ করত না। কারণ সে ভুলে যেত কোথায় কোন্ কুমারীর পাণিগ্রহণ করে তার ধর্মরক্ষা করেছে! কাদম্বিনীর বেলায় অবিশ্যি ঠিক তেমনটি হয়নি। এবং তার বোধ হয় দুটি কারণ ছিল। প্রথমত কাদম্বিনীর কাছে এলেই তার কিছু অর্থ প্রাপ্তি হত ভালরকম, যেটা ভবতারিণী দেবীই দিতেন এবং দ্বিতীয়ত কাদম্বিনীর রূপ না থাক তার দেহের একটা আকর্ষণ ছিল। যৌন আকর্ষণ।

    কোন কোন নারীর দেহে যৌবন যেন স্থির দামিনীর মতই দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে বয়েস হওয়া সত্ত্বেও। যেন তাদের দেহের মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায় না। কাদম্বিনী ছিল সেই শ্রেণীর নারী। আরো হয়ত কিছু ছিল, যে কারণে মল্লিনাথ ঘুরে ঘুরে আসত বৎসরে অন্তত একবার বা দুবার রাধারমণ মল্লিকের গৃহে।

    ভবতারিণী দেবী অর্থ দিয়েছেন মল্লিনাথকে এই কারণে যে, মল্লিনাথের মতিগতি যদি বদলায়, কাদম্বিনীকে নিয়ে যদি সে সংসারী হয়। কিন্তু মল্লিনাথ প্রতিবারই তার শাশুড়ি ঠাকরুনকে প্রতিশ্রুতি দিত মাত্র, প্রতিশ্রুতি পালনের কোন লক্ষণই কখনো দেখা যেত না। আসত, আট-দশদিন রাধারমণ মল্লিকের গৃহে থেকে নানারকম ভালমন্দ দু’বেলা পেট পুরে খেয়ে যেই অর্থ তার হাতে আসত, পরের দিনই সে সকলের অজান্তে গৃহ ত্যাগ করত।

    কাদম্বিনীর নিজের কি সে কারণে খুব দুঃখ ছিল? বোধ হয় না? কারণ সে জানত মল্লিনাথের সাংসারিক অবস্থার কথাটা। স্বামীর ভিটা বলতে খান দুই পতনোন্মুখ খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর, পঞ্চাশ-ষাট বিঘের মত নিষ্কর জমি। তার ভাগের ধানটুকুই যা সম্বল। এবং সেখানে থাকত মল্লিনাথের সর্বপ্রথমা স্ত্রী মোহিনীসুন্দরী তার গোটাদশেক সন্তান নিয়ে। স্ত্রী নয়ত, খাণ্ডারনী। মোহিনীর স্রেফ কথা—স্বামী তার আরো একশজনের পাণিগ্রহণ করুক, কিন্তু ভিটেতে এনে তুললে খেংরা দিয়ে বিদায় করবে। করেছে ও দুজনকে।

    বয়েসের অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিবাহের পর কাদম্বিনীর যে স্বামীর ঘর করার একেবারে ইচ্ছা ছিল না তা নয়। কিন্তু স্বামীর মুখে সে ইতিহাস শোনবার পর মল্লিনাথের ঘর করবার বাসনা উবে গিয়েছিল কাদম্বিনীর সতীনের সঙ্গে। ভবতারিণী দেবী অবিশ্যি কথাটা জানতেন না এবং তাকে কাদম্বিনী জানায়ওনি কোনদিন। কাজেই কাদম্বিনী মল্লিক-গৃহেই চিরস্থায়ী হয়ে ছিল। তা ছাড়া মল্লিকবাড়ির মত এত ঢালোয়া প্রাচুর্যই বা কোথায় সে পাবে? বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন, কাজকর্মের লোকের অভাব নেই মল্লিকবাড়িতে, কাদম্বিনীর তাই গল্পগাছা করে, শুয়ে বসে সময় কেটে যেত।

    ভোলানাথ ও আনন্দচন্দ্র ছাড়াও মল্লিকবাড়িতে আর চার-পাঁচটি জোয়ান পুরুষ ছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাধারমণকে তার ব্যবসায়ে সাহায্য করত। সুধাকান্ত তাদের অন্যতম।

    বহির্মহলে মল্লিক-গৃহে যে সব পুরুষ আশ্রিতজন ছিল, অন্দরমহলে তাদের যাতায়াত ছিল দুই বেলা, একমাত্র আহারের সময়টিতে। ব্যতিক্রম ছিল কেবল ভোলানাথ ও আনন্দচন্দ্র। তাদের ছিল অবারিত দ্বার।

    সেই সুযোগেই ভোলানাথের সঙ্গে কাদম্বিনীর একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল বাড়ির সকলের অলক্ষ্যে। সে কথাটা আর কেউ না জানলেও ভোলানাথের জননী মঙ্গলার নজর এড়ায়নি। পুত্রকে মঙ্গলা দু’চারদিন নিষেধও করেছে, কারও সঙ্গে মিশিস না বেশী!

    কে বলেছে তোমাকে এসব কথা, কাদম্বিনীর সঙ্গে আমি মেলামিশি করি?

    আমি জানি—

    কি জান শুনি?

    মঙ্গলা বলেছে, জানি রে, আমি সব জানি। ভুলিস না, এ বাড়িতে দয়ার আশ্রয়ে আমরা আছি। কর্তাবাবুর কানে কথাটা গেলে —

    তোমার কত্তাবাবু আমার গলা কেটে নেবে!

    জুতিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নেবে।

    ওঃ! নিলেই অমনি হল, না? একবার দেখুক না চেষ্টা করে। আমিও ভোলানাথ, চেঁচিয়ে ওঠে ভোলানাথ।

    .

    মঙ্গলা আর কি করবে, চুপ করে যেতে বাধ্য হয়েছে।

    কাদম্বিনী প্রথমটায় জানতে পারেনি যে ভোলানাথের নজর পড়েছে সুহাসিনীর উপরে। কিন্তু যে মুহূর্তে সে জানতে পারল বা বুঝতে পারল ব্যাপারটা, বুকের মধ্যে তার জ্বলে ওঠে। কথাটা ভোলানাথকে প্রকাশও করে একদিন কাদম্বিনী।

    ভোলানাথ কিন্তু কথাটা হেসেই উড়িয়ে দেয়, দূর দূর, তুমি কি পাগল হলে কাদম্বিনী! আমার বুকের সরোবরে তুমি একমাত্র পদ্মফুলটি।

    কাদম্বিনী মুখে কিছু বলে না বটে, তবে সর্বক্ষণ তীক্ষ্ণ নজর রাখতে থাকে।

    সুহাসিনীকে একা শুতে দিত না অন্নপূর্ণা। সুহাসিনীর ঘরেই কাদম্বিনী শুত রাত্রে। তা ছাড়া বাড়ির মধ্যে সুহাসিনীর বেশী সৌহার্দ্য ছিল ওই কাদম্বিনীর সঙ্গেই।

    বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও দুজনার মধ্যে একটা প্রীতির ও সখীত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তা ছাড়া সুহাসিনী সরল প্রকৃতির তো বটেই খানিকটা নির্বোধও। অকপটে সব কথাই সে কাদম্বিনীর কাছে বলত।

    ভোলানাথ যে ছলছুতো করে সুহাসিনীর সঙ্গে দেখা করে, নানা রসের কথা বলে, সুহাসিনী অকপটে সব কথাই কাদম্বিনীকে বলত। কাদম্বিনী ভিতরে ভিতরে জ্বলতে থাকে। অবশেষে আর অন্য কোন পথ না পেয়ে নিজের স্বার্থেই অন্নপূর্ণার কানে কথাটা সে তুলেছিল।

    অন্নপূর্ণা তো প্রথমটায় কথাটা শুনে একেবারে তাজ্জব। বললে, বলিস কি কাদু!

    হ্যাঁ মামী, ব্যাপারটা আমার চোখে আদৌ ভাল ঠেকছে না। সুহাসিনী ছেলেমানুষ, অতটা ত বোঝে না। তুমি সুহাসিনীকে একটু সাবধান করে দিও।

    অন্নপূর্ণা প্রথমটায় কি করবে বুঝে পায় না। একবার মনে হয় স্বামীকে সব কথা বলবে, ভোলানাথকে বাড়ি থেকে তাড়াবে। কিন্তু তাতে করে যদি ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে মেয়েকেই বোঝাবার কথা মনে হয়। কিন্তু অন্নপূর্ণা জানত না, বুঝতেও পারেনি ভোলানাথের আকর্ষণ তখন সুহাসিনীর অন্তরের কোন্ গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে।

    ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অন্নপূর্ণা যেন চারিদিকে অন্ধকার দেখে। এমন একটা ব্যাপার যে দশজনের কাছে বলাও চলে না। তাছাড়া অন্নপূর্ণা ভেবেছিল, ব্যাপারটা বোধ হয় খুব বেশী জানাজানি হয়নি। কিন্তু আজ দীঘির ঘাটে আনন্দচন্দ্রের কথা শুনে বুঝতে পারল ব্যাপারটা আনন্দচন্দ্রের চোখেও পড়েছে।

    না, আর তো চুপ করে থাকা যায় না। থাকা সমীচীনও নয়। রাত্রে স্বামীকে বলবে কথাটা। কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না অন্নপূর্ণা। কর্তা যে সেই সন্ধ্যারাত্রে সিন্দুক খুলে টাকার থলি নিয়ে বের হয়ে গেলেন, ফিরলেন একেবারে পরের দিন সকাল আটটায়।

    সারাটা রাত ছট্‌ফট্ করেছে অন্নপূর্ণা। রন্ধনশালায় ছিল অন্নপূর্ণা, কর্তা ফিরেছেন শুনে তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ঢুকলেন।

    মাথার চুল রুক্ষ, চোখ দুটো লাল। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অন্নপূর্ণা, সারাটা রাত কোথায় ছিলে? আমি ভেবে মরি।

    রাধারমণ স্ত্রীর কথার কোন জবাব দেন না, জামাকাপড় ছেড়ে গামছা নিয়ে স্নানের জন্য বেরিয়ে যান।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম
    Next Article অশান্ত ঘূর্ণি (অখণ্ড) – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.