Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভাগীরথী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত (অসম্পূর্ণ)

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প284 Mins Read0

    মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ২০

    ॥ কুড়ি ।।

    চিঠিপত্র যখন পূর্বাহ্নে দেয়নি আনন্দচন্দ্র, সে জানত কেউ তাকে এগিয়ে নিতে ঘাটে আসবে না।

    কতকটা ইচ্ছা করেই পূর্বাহ্নে কোন পত্রাদি দেয়নি বাড়িতে আনন্দচন্দ্ৰ। ইচ্ছা অন্নদাসুন্দরীকে একটু চমকে দেবে।

    কিন্তু একবারে যে সন্ধ্যারাত্রি হয়ে যাবে গাঁয়ের ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাও ভাবেনি আনন্দচন্দ্র। ভেবেছিল বেলাবেলিই ঘাটে পৌঁছে যাবে।

    বেশ অন্ধকার চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিকের ঝোপেঝাড়ে অন্ধকারে জোনাকিগুলো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আলোর টিপ জ্বেলে। একটানা ঝিঁঝির ডাক ঝিঁ-ঝি, ভেজা মাটির একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ—তার সঙ্গে মিশে গেছে ঘেঁটু ফুলের কটু গন্ধ একটা।

    বর্ষাকালে এই একটা সুবিধা—একেবারে ঘাটে এসে নামা যায়, বিল পার হয়ে, কিন্তু গ্রীষ্মকালে সেই নদীর ধার থেকে চার ক্রোশ মাঠ ভাঙা ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। অবিশ্যি সকলকেই গ্রীষ্মকালে এই দীর্ঘ চার ক্রোশ পথ মাঠের মধ্যে দিয়ে ভাঙতে হয়। সবটাই আবার মাঠ নয়—চষা জমির ভিতর দিয়ে উঁচুনীচু আলপথেও আসতে হয় কোথাও কোথাও।

    ঘাটের সামনেটায় কলমী আর কচুরিপানায় ভরে আছে। রহমৎ মাঝি লগি দিয়ে নাওটাকে ঠেলে যথাসম্ভব পাড়ের কাছাকাছি নিয়ে এল। আনন্দচন্দ্র লাফিয়ে ডাঙায় নামল।

    মাঝি! কন কর্তা?

    আমার বিছানাটা আর বাক্সটা নিয়ে এস।

    আপনে যায়েন কর্তা, আমি নাওডারে বাঁধি আইতেছি। তা অন্ধকারে যাতি পারবেন তো?

    হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি এস—

    বিলের একেবারে কোণ থেকে একটা অপ্রশস্ত পায়ে-চলা পথ—দু’পাশের নালা থেকে বেশ কিছুটা উঁচু। নালা একেবারে জলে টেটম্বুর। বেনো ঘাস আর রাংচিতার গাছে জঙ্গল হয়ে আছে। কিছুটা এগোলেই বিরাট বিরাট দুটো বট গাছ। ডাইনে একটু এগিয়ে কালীতলা।

    ছোটবেলা এই কালীতলার পাশ দিয়ে রাতের অন্ধকারে যাতায়াত করতে বুকের মধ্যে ছমছম করত। কেমন একটা ভয়াবহ নির্জন শূন্যতা যেন অন্ধকারে মুখব্যাদান করে থাকে।

    পৌষের অমাবস্যায় ওই কালীতলায় মহাসমারোহে গভীর রাত্রে কালীপূজা হয়—সে কালীমূর্তির চেহারা দেখলেই ভয় করে।

    পূজার রাত্রে সারাটা রাত থেকে থেকে শিয়াল ডাকে। ওই প্রাচীন বটগাছ দুটো যেন কালীতলায় প্রহরীর মত দিবারাত্র প্রহরা দেয়। নানা ভৌতিক কাহিনী ওইপ্রাচীন বিশাল বটগাছ দুটির সঙ্গে জড়িয়ে।

    আনন্দচন্দ্রের ভয়ডর একটু কম চিরদিনই, তবু রাত্রে বটগাছের তলায় ঠাণ্ডা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে কেমন যেন গা’টা শিরশির করে ওঠে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে বেশ একটু দ্রুতপায়েই যেন আনন্দচন্দ্ৰ জায়গাটা পার হয়ে গেল।

    দু’পাশে ঘন গাছপালা—সরু পথ, কাঁচা মাটির পথটা এত সরু যে ওই পথ ধরে চলতে গেলে দু’ পাশের ঘন রাংচিতা, আকন্দ ও বাসক গাছের পাতাগুলো গায়ে লেগে যায়।

    ওই সরু পথটা পেরিয়ে গেলেই চারিদিকে নালার জলে ঘেরা একটা উঁচু ডাঙা মত জায়গা, স্থানীয় লোকেরা বলে চাঁদামণির আড়া।

    পাশ দিয়ে সামান্য চওড়া যে রাস্তাটা, তারও এক পাশে নালা, অন্য পাশে বেত গাছের ঘন জঙ্গল। দিনের বেলায় দেখা যায় সেই বেতবনে লতিয়ে লতিয়ে উঠেছে তেলাকুচা লতা—সবুজ লাল হলুদ অজস্র তেলাকুচা ফল

    সারাটা দিন টুনটুনি ও বুলবুলি পাখি বেতবনে উড়ে উড়ে পাকা তেলাকুচা ফল খায় আর কিচিরমিচির করে। ওই রাস্তায় পড়লেই বাড়ির আলো দেখা যায় অন্ধকারে। সোজা একেবারে চোখে পড়ে দক্ষিণের পোতার টিনের চাল ছাওয়া ঘর, আর রাত্রে ঘরে আলো জ্বললে তারই খোলা জানালাপথে আলোর আভাস পাওয়া যায়। ওই ঘরটারই একাংশে ভারতচন্দ্রের কবিরাজী সব ঔষধ—বড় বড় চীনামাটির বয়াম ও ছোট-বড় শিশিতে থরে থরে সাজানো—দ্রাক্ষারিষ্ট, মহাবলচূর্ণ বটিকা, সারিবাদি সালসা, চ্যবনপ্রাশ শঙ্খচূর্ণ, লৌহচূর্ণ, পারদভস্ম—সব নাম আনন্দচন্দ্র জানে না। বোঝেও না সব

    কবিরত্ন ভারতচন্দ্রের সহকারী দ্বিজপদ ওই অংশে একটা কাঁঠাল গাছের সরু রেঞ্চের ওপরে রাত্রে শয়ন করে। একটা দেওয়ালগিরি জ্বলে প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ওই ঘরটার মধ্যে।

    আরো কিছুটা এগোতেই আনন্দচন্দ্রের চোখে পড়ল ঘরের বাইরে সরু বেঞ্চটার উপরে জনকয়েক লোক বসে আছে। এই সময়টা ভারতচন্দ্র রোগী দেখেন, তাদেরই কেউ কেউ হয়ত অপেক্ষা করছে।

    আনন্দচন্দ্র একটু এবার দ্রুতপায়েই বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বাঁ দিকে খড়ের ছাউনি দেওয়া বিস্তৃত নাটমণ্ডপ, একেবারে পূজামণ্ডপের মুখোমুখি এগোতেই চোখে পড়ল সুকান্ত পাল প্রতিমায় রং চড়াচ্ছে। পাশে একটা কেরোসিনের ছোট ল্যাম্প বাঁ হাতে ধরে একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে প্রতিমার মুখে রং চড়াচ্ছে। ল্যাম্পের আলোয় প্রতিমার মুখখানি চোখে পড়ে। এখনো চক্ষু আঁকা হয়নি।

    থমকে দাঁড়ায় নিজের অজ্ঞাতেই যেন আনন্দচন্দ্র। সন্ধ্যার মন্থর বাতাসে শিউলি ও স্থলপদ্মের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। মনে পড়ে যায় আনন্দচন্দ্রের, পূজার মাত্র তিন দিন বাকি।

    ভারী গলায় প্রশ্ন ভেসে এল, কেডা–ওহানে দাঁড়ায়ে কেডা? ভারতচন্দ্রের গলা।

    দক্ষিণের পোতার ঘরের বারান্দা থেকে ভারতচন্দ্রের গলা শোনা গেল। আনন্দচন্দ্ৰ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে পিতার চরণের ধুলো নিল।

    আনন্দ!

    হ্যাঁ, বাবা। আনন্দচন্দ্ৰ মৃদু গলায় বললে, নদীতে উজান ঠেলে আসতে হয়েছে তাই একটু দেরি হয়ে গেল পৌঁছাতে।

    তা একটা পত্র দাও নাই কেন যে তুমি আসতিছ?

    ভেবেছিলাম পূজায় এবার আসব না—

    আসবা না? ক্যান?

    মানে পরীক্ষা তো কাছেই—

    তাই বলে বৎসরান্তে মায়ের পূজায় আসবা না! তারপরই একটু থেমে ভারতচন্দ্র বললেন, আমার পত্ৰ তুমি পাও নাই?

    আজ্ঞে না, কোন পত্ৰ তো পাইনি।

    পাও নাই! অ—

    কোন জরুরী ব্যাপার ছিল কি পত্রের মধ্যে? আনন্দচন্দ্র প্রশ্ন করে।

    তোমার মেজ পিসীমা—

    মেজ পিসীমার দেহটা কি ভাল নেই?

    না, মানে—মেজদিদি গত হয়েছেন।

    মেজ পিসীমা নেই!

    না।

    কি হয়েছিল তাঁর?

    এখন ভিতরে যাও, হাতমুখে জল দাও, শোনবা পরে।

    আনন্দচন্দ্রের মনটা হঠাৎ যেন কেমন খারাপ হয়ে যায়। পিসীমাদের মধ্যে একমাত্র ছোট পিসীমাকেই আনন্দচন্দ্র বেশী ভালবাসত। কারণ ছোট পিসীমা বিন্দুবাসিনী দেবী অন্যান্য পিসীমাদের মধ্যে অনেক বেশী সহজ ও কিছুটা বোধ করি স্বাভাবিকও ছিল। কিন্তু অন্য তিন পিসীমাদের মধ্যে দুইজন—বড় পিসীমা ও সেজ পিসীমা চন্দ্ৰকলা দেবী ও সরোজিনী দেবী দুজনের কাছে বড় একটা ঘেঁষতে আনন্দচন্দ্র সাহসই পেত না, রীতিমত ভয়ই করত ওঁদের দুজনকে।

    আর মেজ পিসীমা নিভাননী দেবী, সংসারের সঙ্গে তাঁর বড় একটা সম্পর্কই ছিল না, সে নিজের মনে তার আচারনিষ্ঠা, ছোঁয়াছুঁয়ি ও পূজাআহ্নিক নিয়ে পশ্চিমের পোতার ছোট ঘরটিতে যেন নিজেকে নির্বাসিত করে রেখেছিল বেশ কিছুদিন ধরে।

    নিজের হাতেই সামান্য কিছু রন্ধন করে নিত নিজের জন্য, হবিষ্যি-ঘরেও যেত না। তাও প্রতিদিন যে রান্না করত তাও নয়, সপ্তাহে তিন-চার দিন উপবাসেই কাটত। নিজের নির্জন ঘরটি ছেড়ে বড় একটা বের হত না বলে নিভাননীকে দেখাও যেত না বড় একটা।

    সেদিন ফুলশয্যার রাত্রে প্রায় বৎসরাধিকাল পরে আনন্দচন্দ্র মেজ পিসীমাকে দেখেছিল। তাহলেও কলকাতায় যাবার আগে ও কলকাতা থেকে ফিরে একবার মেজ পিসীমার ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে একটিবার দাঁড়াত। ধীরে ধীরে ডাক দিত, মেজ পিসীমা!

    দু’তিন ডাকের পর সাড়া আসত বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে, কেডা?

    পিসীমা আমি—আনন্দ-

    কিছু বলবা মণি?

    গলার স্বরটা ভাঙা-ভাঙা কর্কশ নিরাসক্ত, তবু যেন মনে হত গলার স্বরটা যথাসাধ্য কোমল করবার চেষ্টা করছেন নিভাননী।

    কাল আমি সকালেই চলে যাচ্ছি!

    নিভাননী দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াত। সেই রুক্ষ মূর্তি, কোটরগত চক্ষু, দু’চোখের দৃষ্টি হতে যেন ঝরে পড়ছে একটা তীব্র অনীহা সব কিছুর উপর। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা, কদম ছাঁট, পরনে একটা গরদের মলিন থান।

    বলত ভাইপোর দিকে তাকিয়ে, কোথায় যাবা মণি!

    কলকাতায়। ছুটি ফুরিয়ে গেল।

    ভাল করে পড়াশুনা করবা, বুঝিছো? তোমায় মানুষ হতে হবে।

    দূর থেকেই দাওয়ায় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করত আনন্দ ওই শুদ্ধচারিণীকে।

    বাঁইচে থাকো। আবার কবে আসবা?

    কলেজ বন্ধ হলে—

    গঙ্গার জল আনিতে ভুলো না, বুঝিছো!

    আনব।

    নিভাননী আর দাঁড়াত না, ঘরের মধ্যে ঢুকে যেত—দরজা বন্ধ হয়ে যেত, আর শিবস্তোত্র শোনা যেত গুন গুন করে

    হে নীলকণ্ঠ বৃষভধ্বজ পঞ্চবক্ত্রো
    লোকেশ শেষবলয় প্রমথেশ সর্ব
    হে ধূর্জটে পশুপতে গিরিজাপতে মাং
    সংসারদুঃখদহনাৎ জগদীশ রক্ষ—

    কলকাতা থেকে এসেও একবার যেত গঙ্গাজলের একটা কমণ্ডলু নিয়ে আনন্দ নিভাননীর ঘরের সামনে। আশ্চর্য! এবারে কেমন করে যেন কমণ্ডলু ভরে মেজ পিসীমার জন্য গঙ্গাজল প্রতিবারের মত আনতে ভুলে গিয়েছে। কথাটা তার মনে পড়েছিল ট্রেনে উঠবার পর।

    মনটা আনন্দচন্দ্রের খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন ভুলটা হল কেন? এমন ভুল তো কোনদিনই তার আজ পর্যন্ত হয়নি।

    গঙ্গাজলের কমণ্ডলুটা দেখে আনন্দচন্দ্রের মনে হত পিসীমার শুকনো মুখেও ক্ষণেকের জন্য যেন একটা হাসির ঝিলিক দেখা দিত।

    মেজ পিসীর সংবাদটা আকস্মিক যেন একটা আঘাত হানে আনন্দচন্দ্রের মনে। মেজ পিসীমা নেই—আর কোনদিনই তাকে আনন্দচন্দ্র দেখতে পাবে না। পশ্চিমের পোতার সেই ছোট ঘরটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আজ আর পিসীমা বলে ডাকলে কেউ সাড়া দেবে না— কেডা?

    তারপর বের হয়ে এসে কেউ বলবে না ঘর থেকে, কবে আয়লে মণি! কিংবা যাবার সময় দাওয়ায় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করবার পর কেউ বলবে না, বাঁইচে থাকো। আবার করে আসবা!

    কিংবা সেই কথাটা, গঙ্গার জল আনতি ভুলো না, বুঝিছো?

    আনন্দচন্দ্ৰ আবছা-আবছা অন্ধকারেই অন্দরের দিকে পা বাড়াল।

    একটা প্রদীপ হাতে বিন্দুবাসিনী পূজামণ্ডপের দিকে আসছিল, আনন্দচন্দ্ৰকে দেখে থমকে দাঁড়াল, কেডা রে—আনন্দ?

    হ্যাঁ, ছোট পিসীমণি। আনন্দচন্দ্র নীচু হয়ে বিন্দাবাসিনীর পায়ের ধুলো নিল।

    আনন্দচন্দ্রের যেন মনে হয় বিন্দুবাসিনী কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না শেষ পর্যন্ত, নিজেকে সংবরণ করে নিল। একমাত্র বিন্দুবাসিনী ছাড়া আর তিন বোনই ভারতচন্দ্র থেকে বয়েসে বড়।

    কথা বললে সামান্য একটু ইতস্তত করে আনন্দচন্দ্রই। বললে, বাবার সঙ্গে দেখা হল—মেজ পিসীমা—

    মেজদির পুণ্যের শরীর। স্বর্গে চলে গেছেন।

    কি হয়েছিল মেজ পিসীমার? তোমরা তো আমাকে কিছুই জানাওনি পিসীমণি, কবে গেলেন?

    দিন-কুড়ি আগে—

    কি হয়েছিল?

    কি যে হয়েছিল কিছুই বোঝা গেল না। জ্বর না, জ্বালা না, কিছু না –

    তবে?

    সে এক আশ্চর্য ব্যাপার!

    পরে সেই রাত্রেই মেজ পিসীমার মৃত্যুকাহিনী আনন্দচন্দ্র শুনেছিল বিন্দুবাসিনীর কাছে আহারের পর।

    সেদিনটা ছিল ভাদ্রের অমাবস্যা। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার উপরে আকাশে মেঘ করে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। বোধ করি রাত্রি তখন বারোটা সাড়ে বারোটা। বিন্দুবাসিনীর ঘুম আসছিল না চোখে। একাকী শয্যায় শুয়েছিল চোখ বুজে। হঠাৎ একটা দীর্ণ চিৎকার তার কানে আসে—নারীকণ্ঠের চিৎকার।

    ধড়ফড় করে উঠে বসে বিন্দুবাসিনী শয্যার উপরে। কে চিৎকার করল অমন করে!

    কিছুক্ষণ কান পেতে শুনে মনের মধ্যে কিরকম একটা সন্দেহ জাগায় বিন্দুবাসিনী শয্যা থেকে উঠে পড়ে, বড়দিদি চন্দ্রকলা ও মেজদি সরোজিনী তখন ঘুমাচ্ছে একপাশে অঘোরে। বিন্দুবাসিনী উত্তরে পোতার বড় ঘর থেকে বের হয়ে দক্ষিণের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দায়ই ভারতচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

    কেডা ওহানে? ভারতচন্দ্র শুধাল। দাদা আমি—বিন্দু।

    বিন্দী? কে যেন মনে হল চেঁচায়ে উঠলো একটু আগে?

    আমিও শুনেছি দাদা-

    শুনিছো!

    হ্যাঁ, মনে হল যেন—

    কি?

    ওই পশ্চিমের পোতার ঘর থেকেই—

    হুঁ। আমারও তাই মনে হইছিল। মেজদির গলার মতই। চল্ তো দেখে আসি। চলেন—

    ভাই-বোনে এগিয়ে যায় পশ্চিমের পোতার ছোট ঘরটার দিকে। ঘরের দরজাটা ঈষৎ ভেজানো, দুই কবাটের মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে আলোর আভাস চোখে পড়ে। ভারতচন্দ্র ডাকেন মৃদু কণ্ঠে, মেজদিদি!

    কোন সাড়া এল না।

    এবারে একটু অনুচ্চ কণ্ঠেই ডাকলেন—মেজদিদি!

    তবু কোন সাড়া নেই।

    বিন্দুবাসিনীও ডাকে। কিন্তু সাড়া এল না।

    ভারতচন্দ্র অতঃপর যেন একটু ইতস্তত করেই আলগা ভাবে দরজার কবাট দুটো ফাঁক করে ভিতরে দৃষ্টিপাত করেই থমকে দাঁড়ালেন।

    মেজদি!

    ঘরের মেঝেতে নিভাননী পড়ে আছেন। দুটি বাহু প্রসারিত। সামনে মাটির গড়া শিবলিঙ্গ, কোষাকুষি টাট ফুল বিল্বপত্র—

    ভারতচন্দ্র আর কালবিলম্ব না করে ঝুঁকে পড়ে ডাকলেন, মেজদিদি?

    একটা ক্ষীণ গোঁ গোঁ অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা গেল।

    ভারতচন্দ্র তাড়াতাড়ি মাটিতে বসে পড়ে নিভাননীর মাথাটা কোলে তুলে নিলেন। বিন্দুবাসিনী মেজদিদির চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়।

    ভারতচন্দ্র নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলেন, নাড়ির গতি অতীব ক্ষীণ।

    মেজদিদি, মেজদিদি! ডাকলেন ভারতচন্দ্র।

    অতি কষ্টে যেন চোখের পাতা খুলে তাকাল নিভাননী। চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ।

    মেজদিদি, কি কষ্ট হতিছে তোমার?

    ঠাকুর—আমার দেবতা—আমার—যাই—আমি যাই—তারপর ক্ষীণ একটা স্তোত্রের অংশ জড়িত কণ্ঠে উচ্চারিত হল—

    হে ধূর্জটে পশুপতে গিরিজাপতে মাং
    সংসারদুঃখদহনাৎ—জগদীশ রক্ষ জগদীশ রক্ষ
    জগদীশ রক্ষ …

    স্বর রুদ্ধ হয়ে গেল নিভাননীর—চোখের পাতা বুজে এল।

    নাড়ি ধরে বসেছিলেন ভারতচন্দ্র। বুঝলেন সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রাণের স্পন্দন নাড়ির গতিতে ক্রমশ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে এক সময় একেবারেই থেমে গেল।

    বিন্দুবাসিনী বলেছিলেন সে রাত্রে আনন্দচন্দ্রকে, শিবপূজা তো এ বাড়িতে সবাই করে, আমিও করি, কিন্তু অমন নিষ্ঠা ও ভক্তিতে শিবপূজা বোধ হয় মেজদির মত আমরা কেউ করিনি আনন্দ, তাই আমার কি মনে হয় জানিস?

    কি পিসীমণি!

    মেজদিদি সেরাত্রে শিবের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, ভক্তের ভগবান ভক্তের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি। আর সেই সাক্ষাৎই হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ।

    আচ্ছা পিসীমণি—

    কি রে?

    সত্যি ভগবান বলে কিছু আছে!

    নিশ্চয়ই, ভগবান না থাকলে এই সৃষ্টি-স্থিতি কেমন করে সম্ভব?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম
    Next Article অশান্ত ঘূর্ণি (অখণ্ড) – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.