Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভাগীরথী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত (অসম্পূর্ণ)

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প284 Mins Read0

    মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ৩

    ।। তিন ।।

    কালরাত্রি পথেই অতিবাহিত হয়েছিল অন্নদাসুন্দরীর। কাজেই শাস্ত্রমতে যেদিন সে এসে শ্বশুরগৃহে পদার্পণ করল সেদিনই ফুলশয্যা। পরের দিন পাকস্পর্শ বা বৌভাত।

    ভারতচন্দ্রের বড় বোন চন্দ্রকলা ও তৃতীয় বোন সরোজিনী সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল।

    ঘর তো মাত্র চারটি, দুটোর উপরে টিনের চাল। অন্য দুটি খড়ে-ছাওয়া- মধ্যিখানে নিকানো ঝকঝকে তকতকে একটি আঙ্গিনা।

    উত্তরের পোতার ঘরটিই আকারে সর্বাপেক্ষা বড়। সেই ঘরটিতেই থাকত প্রথম প্রথম চার বিধবা বোন। বর্তমানে অবশ্য দ্বিতীয় বোন নিভাননী থাকেন না। ঘরের মধ্যে দুধারে দুটো কাঁঠাল কাঠের তৈরি তক্তাপোশ। বিরাট একটা কাঁঠালকাঠের সিন্দুক। উপরে আড়াআড়ি দুটো মোটা মোটা বাঁশ—সেই বাঁশ থেকে দড়ির শিকেয় ঝুলানো নানা আকারের হাঁড়িকুড়ি। কোনটার মধ্যে তার চিঁড়ে, কোনটায় নাড়ু, কোনটায় পুরাতন তেঁতুল, কোনটায় আমসি, গুড়ের নাগরি, মুগ অড়হর মুশুর বিউলির ডাল সংবৎসরের। একটি বেঞ্চ, তার উপর রাজ্যের ময়লা ছেঁড়া বিছানাপত্র ও খানদুই ট্রাংক বা প্যাটরা। অন্য এক কোণে, বিরাট আকারের দুটি মাটির জালা। তার একটির মধ্যে আতপ চাল, অন্যটায় সিদ্ধ চাল।

    নিভাননী তো সংসারের মধ্যে থেকেও নেই মন্ত্র নেওয়ার পর থেকে। বিন্দুবাসিনী একটু শান্ত ও ধীর প্রকৃতির। নিভাননী মন্ত্র নিয়েছিল কুলগুরুর কাছে। দিনের মধ্যে সব সময়টাই প্রায় পূজাআর্চা নিয়ে থাকত পশ্চিমের পোতার ছোট নির্জন ঘরটার মধ্যে, আর সরোজিনী সংসারের কাজ নিয়েই থাকত সর্বদা ব্যস্ত।

    ধান ভানা, ডাল কোটা, চিঁড়ে কোটা আর ছিল বাগানে ঘুরে ঘুরে শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করা।

    রন্ধনের ব্যাপারে কয়লার প্রচলন তখনো হয়নি গাঁয়ে, কাঠের আগুনেই রান্নার কাজ হত। কিন্তু কাঠ কিনবার মত সংগতি ছিল না ভারতচন্দ্রের। তাই বিন্দুবাসিনীকেই একটা ঝাঁকা নিয়ে বাগানে বাগানে ঘুরে শুকনো ডালপালা পাতা সংগ্রহ করে এনে রন্ধনশালার দাওয়ায় স্তূপীকৃত করে রাখতে হত।

    ভারতচন্দ্র ছিলেন চিরদিন একটু আয়েসী ও অলস প্রকৃতির। দক্ষিণের পোতার বড় ঘরটির একাংশে গোছানো ছিল তার কবিরাজীর সব সাজ-সরঞ্জাম। দুটো সেগুনকাঠের আলমারি কাচের পাল্লা বসানো। আলমারির মধ্যে ছোট বড় নানা আকারের সব বড়ির বয়াম। কোনটার মধ্যে চ্যবনপ্রাশ, কোনটায় দ্রাক্ষারিষ্ট, মহাবলচূর্ণ, নানা ধরনের বটিকা। অন্য অংশে একটি কাঁঠাল কাঠের তক্তাপোশ, তার উপরে মলিন একটি শতরঞ্জি বিছানো গোটা দুই মলিন তাকিয়া।

    তক্তাপোশের নীচে রাজ্যের রাশীকৃত গাছপালা, শিকড়-বাকল, লতাপাতা, গোটা দুই কড়াই ঔষুধ জ্বাল দেবার জন্য। ঘরের একটি দরজা আর দুটি ছোট ছোট জানালা। এবং সে জানালাপথে সামান্যই আলো প্রবেশ করে। লতাপাতা ও ঔষধের বিচিত্র এক তীব্র কটু মিশ্র গন্ধে ঘরের বাতাস ভারী। গোটা দুই বেঞ্চ—রোগীরা এসে ওই বেঞ্চেই উপবেশন করে।

    সহকারী একজন আছে—দ্বিজপদ সেন। কোন্ সতেরো বৎসর বয়েসের সময় ভারতচন্দ্রের কাছে কবিরাজী বিদ্যাটা আয়ত্ত করবার জন্য এসেছিল প্রায় পনেরো বৎসর পূর্বে, বিদ্যা গ্রামের পাঠশালা পর্যন্ত।

    কবিরাজী বিদ্যাকে আয়ত্ত করতে হলে সংস্কৃতে ভাল জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সংস্কৃতে দ্বিজপদ ছিল মহাপণ্ডিত। অনুস্বার বিসর্গ তার মাথার মধ্যে প্রবেশই করত না, কাজেই শেষ পর্যন্ত কবিরাজী বিদ্যার যেটুকু সে আয়ত্ত করেছিল, সেটা হচ্ছে নানা গাছপালা, পাতা, শিকড় থেকে ভারতচন্দ্রের নির্দেশমত প্রয়োজনীয় ঔষধ তৈরি করা, সেটাই সে করত।

    নাদুসনুদুস চেহারা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ।

    কবিরত্ন ভারতচন্দ্রের কাছে যারা আসত তার সমবয়েসী গ্রামের বন্ধুরা, তারা বলত—তুই চিরটা কাল গণেশের বাহন ইঁদুর হয়েই রইলি!

    দ্বিজপদ দাঁত বের করে হাসত।

    কবিরাজ হিসাবে আশেপাশে দশ-বিশটা গ্রামে ভারতচন্দ্রের সত্যিই নামডাক ছিল এবং চেষ্টা করলে তিনি দুহাতে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু চিরআয়েসী অলসপ্রকৃতির ভারতচন্দ্রের সেদিকে আদৌ মন ছিল না।

    আড্ডা আর গল্প—গল্প আর আড্ডা।

    প্রত্যহ সন্ধ্যায় তাঁর ঘরে তাঁর বয়েসী গ্রামবাসীরা এসে হাজির হত—ওহে কবিরত্ন, ব্যস্ত নাকি?

    আধো আলো আধো অন্ধকার ঘরের মধ্যে তক্তাপোশের উপর উপবিষ্ট গড়গড়ার নলটি হাতে ভারতচন্দ্রের গলা শোনা যেত—আরে কেডা! ও রামলোচন ভায়া! এস—এস।

    রামলোচন ঘরে ঢুকে বলতেন—ওহে কবিরত্ন, শুনিছ মিত্তিরবাড়ির ব্যাপারডা। কোন্ মিত্তির? ভারতচন্দ্র শুধাতেন।

    আরে আমাগো রতিকান্ত মিত্তির। কাঠের চালানী ব্যবসা করে খুলনা শহরে দুটো পয়সা করছে তো।

    ভারতচন্দ্র গড়গড়ার নলটায় মৃদু টান দিতে দিতে বলতেন—তা—তার আবার কি হল হে চাটুজ্যে।

    ততক্ষণে আগন্তুক রামলোচন চাটুজ্যে তক্তাপোশের এক ধারে জুত করে বসতে বসতে বলতেন—কই রে কৈলাস, এক ছিলিম তামাক ভাল করে সাজ দেহি!

    প্রৌঢ় ভৃত্য কৈলাস দরজার বাইরেই বসে বসে ঝিমোচ্ছিল। ডাক শুনে উঠে বসল এবং দাওয়ার এক পাশে তামাকের সাজ-সরঞ্জাম সর্বদাই প্রস্তুত থাকত। একটা কলকেতে তামাক ভরে পাশেই একটা মালসা থেকে কয়েকটা কাঠকয়লার টুকরো চাপিয়ে দিয়ে রন্ধনশালার দিকে চলে গেল একটু আগুনের জন্য।

    রন্ধনশালায় সর্বক্ষণই উনুন জ্বলে, বলতে গেলে অষ্টপ্রহরই। বাড়ির মধ্যে নিভাননী পূজা-আর্চা নিয়েই আছে। বিন্দুবাসিনীর কাজ বাগানে, সে বাগানে কাঠকুটো ডালপালা শুকনো পাতা কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে। থাকার মধ্যে সরোজিনী ও চন্দ্রকলা। তা তারাও তখন গৃহে বড় একটা থাকে না। পাড়ার মধ্যে এ-বাড়ি ওবাড়ি টহল দিয়ে গল্প করে বেড়ায়। ফেরে সেই সন্ধ্যায়

    শুধু একটিমাত্র প্রাণী, ওই বাড়ির নিঃশব্দচারিণী বধূ বামাসুন্দরী, একটা মাটির বড় পাত্রে ধানসিদ্ধ করছিলেন আর উনুনে মধ্যে মধ্যে কাঠপাতা গুঁজে দিচ্ছিলেন। কৈলাস এসে রন্ধনশালার দাওয়ার সামনে দাঁড়াল একটি মৃৎপাত্র হাতে। ডাকল—বৌঠান!

    বামাসুন্দরীকে গৃহে ওই নামেই সকলে সম্বোধন করে।

    বামাসুন্দরীর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। যদিও ডাকটা তাঁর কর্ণে ঠিকই প্রবেশ করেছিল এবং কৈলাসও জানত সাড়া না পেলেও তার ডাকটা বৌঠানের কানে পৌঁচেছে।—বৌঠান একটু আগুন দেন দেহি এ মালসাডায়!

    একটা লোহার হাতায় বামাসুন্দরী এক হাতা আগুন এনে ঢেলে দিলেন মালসাটায়।

    সেই এক গলা ঘোমটা। নিঃশব্দে চলাফেরা। আগুনটা হাতা থেকে ঢেলে দিয়ে বামাসুন্দরী আবার রন্ধনশালায় গিয়ে প্রবেশ করলেন।

    বেলা তখন প্রায় পড়ে এসেছে। দক্ষিণের পথে বাগানে, কাঁঠাল ও গাব গাছগুলোর মাথায় মাথায় অপরাহ্ণের ম্লান বিচ্ছিন্ন ছায়া নেমেছে। ভুলো কুকুরটা উত্তরের পোতার সামনে টান টান হয়ে ঘুমাচ্ছে। কোথাও কোন পত্রান্তরাল থেকে ক্লান্ত ঘুঘুর ডাক ভেসে আসছে। শেষ বৈশাখের তপ্ত হাওয়া মধ্যে মধ্যে এলোমেলো বয়ে যাচ্ছে।

    কৈলাস চলে গেল।

    ভারতচন্দ্র তখন বলছেন—তা আমাগোর রতিকান্ত মিত্তির কি করলে বললে না তো হে ভায়া!

    কৈলাস কলকেতে ফুঁ দিতে দিতে এসে ঘরে ঢুকল।

    এই নেন কত্তা।

    রামলোচন ততক্ষণে একটি কড়িবাঁধা হুঁকো হুঁকোদান থেকে তুলে এনে বসেছিলেন কলকের অপেক্ষায়। কৈলাসের হাত থেকে আগুন ধরানো কলটো নিয়ে হুঁকোর মাথায় বসাতে বসাতে বললেন—সে নয় হে, সে নয়—

    তবে আবার কার কথা কতিছো!

    তার বিধবা কন্যাটি—ওই যে আমাদের পাঁচী।

    পাঁচী আবার কি করল হে মিত্তিরের। মেয়েটি তো বড় লক্ষ্মী।

    লক্ষ্মীই বটে! হুঁকোতে একটা টান দিয়ে রামলোচন বললেন—কাণ্ড যা ঘটিয়েছে না!

    তা কি কাণ্ড আবার ঘটালো?

    তবে আর বলতিছি কি!

    আহা, বলবা তো চাটুজ্যে, ব্যাপারডা কি?

    ভারতচন্দ্রের কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে রামলোচন বললেন— মেয়েটি গর্ভবতী হয়েছে

    অ্যাঁ—বল কি! ভারতচন্দ্র বেশ চমকে ওঠেন।

    তবে আর বলতিছি কি?

    না, না—–এ আমি বিশ্বাস করি না রামলোচন।

    তুমি ভাবুক—কবি মানুষ, সংসারের ঘোরপ্যাঁচ বোঝ না। দিনে দিনে সমাজের যে কি হতিছে তার কোন খবরাখবর তো আর রাখ না।

    পাঁচীকে ভারতচন্দ্র বহুবার দেখেছেন, তাঁর গৃহেও যাতায়াত আছে পাঁচীর। বিন্দুবাসিনী, তাঁর বিধবা বোন মেয়েটিকে খুব স্নেহ করে।

    দুর্ভাগা মেয়েটার সত্যিই আট বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল কাসুন্দিতে। কিন্তু ছয় বছরও গেল না। চোদ্দ বছর বয়সের সময়ে বিধবা হয়ে ফিরে এল পিতৃগৃহে। তা তারই বা দোষ কি? বিয়ে হয়েছিলও তো একটা সত্তর বছরের হেঁপো রোগী বৃদ্ধের সঙ্গে। তাও অনেক কষ্টে বৃদ্ধের হাতে-পায়ে ধরে রতিকান্ত কন্যাদায় থেকে উদ্ধার হয়েছিল।

    মেয়েটির গড়ন-পেটন বয়সের আন্দাজে একটু বেশীই। দেখলে মনে হবে চোদ্দ নয়, সতেরো-আঠারো বছরের ভরভরন্ত তরুণী।

    কালোর উপর গড়ন-পেটনের জন্য দেখতেও মন্দ নয়।

    কিন্তু বড় শান্ত ধীর স্বভাব মেয়েটির। সেই পাঁচুবালা অর্থাৎ পাঁচী কিনা

    দিনে দিনে কি হতিছে কও দি কবিরত্ন!

    ভারতচন্দ্রকে নিশ্চুপ দেখেই রামলোচন পুনরায় প্রশ্নটা করলেন—জাতধর্ম নিয়ে এ গাঁয়ে আর টেকা যাবে না দেখতিছি।

    কে একজন ওই সময় এসে দোরগোড়ায় দাঁড়াল, কবিরত্ন মশাই!

    কেডা? ভিতরে এস।

    আজ্ঞে আমি ছিচরণ দাস—অর্থাৎ শ্রীচরণ দাস। নত হয়ে প্রণাম জানাল।

    রোগা প্যাকাটির মত ঢ্যাঙা, লম্বা একটা লোক কুণ্ঠিতভাবে ঘরে এসে ঢুকল। কি খবর শ্রীচরণ? শুধালেন ভারতচন্দ্র।

    আজ্ঞে মেয়েটার বার-দুই দাস্তবমি হয়েলো, এখন কেমন হাত-পায় খিচুনি ধরতিছে।

    রামলোচন বললেন—দেখ গে যাও, এবার কি বৈশাখের শেষেই গ্রামে ওলাওঠা দেখা দিল!

    ভারতচন্দ্র বললেন—তুমি যাও শ্রীচরণ, আমি যাতিছি।

    একটু তাড়াতাড়ি আয়েন কর্তা—

    হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি যাও, আমি আসতিছি।

    শ্রীচরণ আভূমি নত হয়ে প্রণাম জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

    কথাটা মিথ্যা নয়।

    বর্ষাকালে ম্যালেরিয়া আর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে ওলাওঠা তো গাঁয়ের ঘরে-ঘরেই দেখা দেয় প্রতি বৎসর। এই সময়টা ভারতচন্দ্র যেন নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় পান না। ইদানীং আবার শীতকালেও ঘরে ঘরে সর্দি জ্বর কাশির প্রাদুর্ভাব হয়। বিশেষ করে একটু বয়েস হয়েছে যাদের। তার উপরে বুকে সর্দি বসে গেলে তো কথাই নেই।

    কিন্তু সময় পেলেও আয়েসী ভারতচন্দ্রের বড় একটা বাড়ির বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না। ছোটাছুটি করা কেমন যেন তাঁর পোষায় না।

    তবে গাঁয়ের মধ্যে নামকরা বদ্যি বলতে তো তিনিই। আর একজন অবিশ্যি আছে, হারাণচন্দ্র। কিন্তু তাঁর বয়েস হয়েছে যথেষ্ট। তাই দেহে তেমন সামর্থ্য নেই বলে লোকে গ্রামের তো বটেই, আশপাশের দশ-বিশটা গ্রাম থেকে ছুটে আসে ওই ভারতচন্দ্রের কাছেই

    ভারতচন্দ্রের বাড়ির নামই তো হয়ে গিয়েছিল বদ্যিবাড়ি।

    .

    সেই বদ্যিবাড়ির কবিরত্নর একমাত্র ছেলে আনন্দচন্দ্রের বিবাহ। গ্রামের আবাল বৃদ্ধ যুবক যুবতী শিশু নারী যেন একেবারে ভারতচন্দ্রের আঙ্গিনায় বৌ দেখার জন্য ভেঙে পড়েছিল।

    উত্তরের শোবার বড় ঘরটাতেই এনে তুলেছিল চঞ্চলা নতুন বৌ অন্নদাসুন্দরীকে। মানুষের ভিড়ে ঘরের মধ্যেও তিল ধারণের স্থান নেই যেন।

    চঞ্চলা বলে ওঠে—ওগো, তোমরা একটু ঘরের থেকে ভিড় কমাও তো বাছা, দেখছো দুটি দিন ধরে নৌকায় পালকিতে আসতে আসতে ছেলেমানুষ বৌটা একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে। বৌ তো আর কোথায়ও পালিয়ে যাচ্ছে না। দেখবে, সবাই দেখবে বৌ।

    কিন্তু কে কার কথা শোনে!

    ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে। ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতি চলতে থাকে।

    ওই সময় বড় পিসশাশুড়ি চন্দ্রকলা এগিয়ে এল, তার কাংসবিনিন্দিত কর্কশ গলায় বলে উঠল—আ মোলো যা, এ কি হাট পেয়েছিস নাকি সকলে! সর সর, ঘর থেকে সব বেরো।

    চন্দ্রকলার কণ্ঠ ও রসনাকে ভয় করে না এমন মানুষ গ্রামের মধ্যে খুব কমই ছিল। খানিকটা ভিড় পাতলা হয়ে যায় অতঃপর।

    ওলো, ও বিনু—

    বিন্দুবাসিনী একপাশে দাঁড়িয়েছিল। বললে—কি বলছো বড়দি?

    সন্ধ্যা তো প্রায় হয়ে এল, আর বেশী দেরি নেই।

    সত্যিই সন্ধ্যার ম্লান ছায়া তখন আমবাগানের মধ্যে দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে।

    চঞ্চলা!

    কি বলতিছো বড় পিসী?

    তোদের যা যা স্ত্রীআচার করবার চটপট সেরে নে বাপু। তারপর বৌকে নিয়ে যা পাঁচদুয়ারের পুকুরে। হাত-পা ধুয়ে শাড়িটা বদলাক, তারপর কিছু খাতি দে।

    চঞ্চলা বললে—এখুনি কি খাবে গো বড় পিসী! মা বোধ হয় এখনো ভাতই চাপায়নি-

    কেন? বৌকে যে বলেছিলাম—এক হাঁড়ি ভাত তাড়াতাড়ি করে রাঁধতে। ঠিক আছে তোরা যা করবার সব কর, আমি ওইদিকটা একবার দেখে আসি।

    চন্দ্রকলা হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আবার সব বৌ দেখার জন্যে ঠেলাঠেলি শুরু করে।

    কে একজন বললে—একটা সেজবাতি আনো না গো ঠাকরুন, বৌয়ের মুখটা একটিবার দেহি!

    সরোজিনী বাইরে গিয়ে হাঁক পাড়ে—কৈলেস! ও কৈলেস! বড় ঘরে একটা সেজবাতি দিয়ে যা।

    কৈলাস তখন পথশ্রমে ক্লান্ত ভারতচন্দ্রের হাতে গড়গড়ার নলটা তুলে দিচ্ছিল। বাইরের ঘরে তক্তাপোশের উপরে তখন আট-দশজন নানা বয়েসী প্রৌঢ় বৃদ্ধ জমায়েত হয়ে বসেছে। তামাকের গন্ধে ও ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কৈলাস তাড়াতাড়ি বাতিগুলো রাত্রের জন্য যেখানে সাফ-সুতরো করে রেখেছিল, আঙ্গিনা পার হয়ে সেই দিকে চলল দ্রুত পায়ে। সরোজিনীর কাঠ-কাঠ রসকষহীন ভাষাকে এ বাড়ির সকলেই ভয় করে।

    বাজনাদারেরা তখন বাজনা থামিয়ে আঙ্গিনার এক পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। কৈলাসকে ওই পথ দিয়ে যেতে দেখে দলের প্রৌঢ় ঢাকী বললে—ঠাকরুন আমাগোর চারডি জলপান দেন না।

    কৈলাস ঢাকীর কথায় খিঁচিয়ে ওঠে—পাবা, পাবা—কি এমন সব রাজ্যি জয় করে আলেন! এখুনি পাত পাতি দিতে হবে ওঁয়াদের। কথাগুলো বলে কৈলাস আর দাঁড়াল না, হনহন করে চলে গেল।

    সেজবাতিটা জ্বেলে কৈলাস যখন বড় ঘরে উত্তরের পোতায় গিয়ে ঢুকল, ঘরের মধ্যে তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে— শীতের মশা গুনগুন শব্দে ঘরের মধ্যে জমতে শুরু করেছে। পাড়াপড়শী বৌ-ঝিরা অনেকেই তখন চলে গিয়েছে—ভিড়টা অনেক পাতলা। বিন্দুবাসিনীও ওই সময় এসে ঘরে প্রবেশ করল, হ্যাঁরে বড়দি, বৌ তার ছেলের বৌয়ের মুখ এখনো দেখলো না।

    বড়ঠাকরুন চন্দ্রকলা তার স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে—নবাবনন্দিনী, হয়ত হেঁসেল নিয়েই ব্যস্ত আছেন। বুড়ো মাগী, এখনো কিছু জ্ঞানগম্যি হল না; যত সব অনাছিষ্টি অলুক্ষুণে কাণ্ড। যা তো রিনু, ডেকে নিয়ে আয় তো সেই মহারাণীকে—গুষ্টির পিণ্ডি সেদ্ধ আজ না হয় একটু পরেই হবে।

    বিন্দুবাসিনী নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ঘর থেকে বের হয়ে ছোট আঙ্গিনাটা পার হয়ে রন্ধনশালার দাওয়ায় উঠে দরজাপথে ভিতরে উঁকি দিল। কথাটা মিথ্যা নয়। বিরাট একটা পেতলের হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে আবক্ষ অবগুণ্ঠন টেনে বামাসুন্দরী উনুনে কাঠ আর শুকনো পাতা ঠেলে ঠেলে দিচ্ছিলেন। বাড়িতে যে এত বড় একটা উৎসব তার কোন সংবাদই যেন তাঁর কাছে পৌঁছায়ইনি।

    তিনি যেন বিচ্ছিন্ন একক, নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত।

    বিন্দুবাসিনী ডাকল—বৌ!

    বামাসুন্দরীর দিক থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

    ও বৌ, শুনতিছ? বড়দি তোমাকে ডাকতিছে যে!

    কেন? ক্ষীণ শঙ্কিত গলায় বামাসুন্দরীর জবাব শোনা গেল।

    ওমা! কেন কি গো? তুমি হলে গে সত্যি শাশুড়ি। তা তুমিই এখনো একটিবার তোমার একমাত্র ছেলের বৌয়ের মুখ দেখলে না?

    তোমরাই তো আছ।

    আমরা আছি মানে—এক গুষ্টি বিধবা পিসশাশুড়ি। ওঠো ওঠো চল—ছেলের বৌয়ের মুখ দেখে বৌকে আশীর্বাদ করবে চল।

    ভাত যে উনুনে ফুটছে–বামাসুন্দরী মৃদু গলায় বললেন।

    ফুটুক, তুমি চল দেহি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম
    Next Article অশান্ত ঘূর্ণি (অখণ্ড) – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.