Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভাগীরথী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত (অসম্পূর্ণ)

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প284 Mins Read0

    মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ৮

    ॥ আট ।।

    ভ্রাতুষ্পুত্র আনন্দচন্দ্রের কথাটা শুনে বিন্দুবাসিনীর বিস্ময়ের যেন অবধি থাকে না। বলে, সে কি রে! বাড়ির একটা মাত্র ছাওয়াল, সে সেই বেহান বেলা থেকে কিছু মুখে দিল কি দিল না সেটুকু খোঁজ নেওয়ার কেউ প্রয়োজন বোধ করলো না! ছাওয়ালডারে দুটি খাতি দেবে সেটুকু সময়ও কারো হল না!

    কথাটা বলে বিন্দুবাসিনী বোধ হয় চেঁচিয়ে বড় বোনেদের কাউকে ডাকতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আনন্দচন্দ্ৰই বাধা দিয়ে বললে—না পিসিমণি, আমি খাইনি ইচ্ছা করেই—

    খাসনি কেন?

    আমার-আমার বোধ হয় জ্বর হয়েছে-

    জ্বর! কই দেখি, বিন্দুবাসিনী ব্যাকুল হয়ে দু’পা এগিয়ে এসে ভ্রাতুষ্পুত্রের কপালটা কয়েকবার স্পর্শ করে বললে, কই না! গা তো বেশ ঠাণ্ডাই আছে দেখছি।

    আনন্দচন্দ্র যেন কথাটা বলে ফেলে বিপদে পড়ে। তাই তাড়াতাড়ি বলে, বাইরে ঠাণ্ডা হলে কি হবে পিসিমণি, ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারছি জ্বর আসছে—

    তো দাদাকে বললি না কেন হাতভাগা!

    বললেই তো এখুনি সেই তেতো পাঁচন এক বাটি গিলতে হবে!

    বিন্দুবাসিনী হেসে ফেলে বলে, তা ঔষধ তেতো হবে না তো কি মিষ্টি হবে!

    তা ছাড়া বিশ্রী কেমন গন্ধ—বমি ঠেলে আসে!

    তা তুই তো ডাক্তারী পড়বি—এলোপ্যাথি ঔষধ কুইনিনও তো তেতো—

    তেতো হলে কি হবে, লাল সিরাপ মিশিয়ে দেন না ডাক্তার পরেশবাবু—তাছাড়া দেখ না আমি ডাক্তারী পাস করে ডাক্তার হলে কাউকে কখনো তেতো ঔষধ দেবো না।

    তাই করিস। দাদা ফিরে এলে একবার নাড়ীটা দেখাস—এটা ঋতু পরিবর্তনের সময়, খুব জ্বর-জ্বারি হচ্ছে।

    দেখবো আর কখন, বাবার তো ফিরতে সেই বিকেল।

    তখনই দেখাবি।

    আমাকে তো তার আগে আজ দুপুরেই যাত্রা করতে হবে-

    আজ দুপুরেই!

    হ্যাঁ, সকালেই আমাকে ডেকে বাবা তাই বললেন তো। বেলা দুটোর পরে নাকি অমৃতযোগ আছে—সেই সময়ই যাত্রা করতে হবে—

    না, না—সে কি করে হবে! বিন্দুবাসিনী বলে, আজ তো যাওয়া হতেই পারে না—যত সব অনাসৃষ্টি কাণ্ড—তেরাত্তির পোহাল না—

    বিন্দুবাসিনীর কথাগুলো শুনে আনন্দচন্দ্রের বুকের মধ্যে যেন একটা আশার আনন্দের হিল্লোল জাগে। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করে না, বরং একটু গম্ভীর হয়েই বলে, কলেজ কামাই হচ্ছে যে—

    তা হোক। তাই বলে—না, না—এ হতেই পারে না।

    কেন—কেন হবে না পিসিমণি?

    তা হবে কি করে, বিয়ে বলে কথা—পিঁড়িতে বসে বিয়ের মন্ত্র উচ্চারণ করেই বর বিদেশ যাত্রা করবে নাকি? তাছাড়া যজ্ঞিবাড়ি আত্মীয় পরিজনরা সব এসেছে—দুটো দিন ছেলে, ছেলের বৌকে নিয়ে সব আমোদ আহ্লাদ করবে—

    কিন্তু ওদিকে যে কলেজ কামাই হবে?

    এবারে বেশ স্পষ্ট গলাতেই কথাটা উচ্চারণ করে আনন্দচন্দ্র, কারণ ততক্ষণে সে বুঝেছে পিসিমণির যখন মত নেই—যেতে আজ আর তাকে হবে না। অমৃতযোগ মাহেন্দ্রযোগ থাকলেও নয়।

    পিসিমণি বিন্দুবাসিনী তার বাপের সব চাইতে আদরের বোনটি! ভারতচন্দ্রের কাছে বিন্দুবাসিনীর যেমন সমস্ত আবদারের প্রশ্রয় তেমনি সমস্ত অন্যায়ের ক্ষমা, যে কারণে অন্যান্য বোনেরা বিন্দুবাসিনীর ভাগ্যকে একটু বুঝি হিংসাই করে।

    আনন্দচন্দ্র নিশ্চিন্ত হয়ে আবার বলে, কিন্তু কলেজ যে কামাই হবে-

    হোক্, কিছু হবে না। কিছু ক্ষেতি হবে না দুটো দিন পরে কলকাতায় গেলি। ক্ষতি হবে না বলছো?

    হ্যাঁ, ক্ষেতিটা কিসের শুনি! কলেজ কেউ কামাই করে না নাকি? অসুখ-বিসুখ হলি মানুষ করে কি?

    না পিসিমণি, বাবা বলছিলেন-

    কি বলছিল দাদা?

    এবার পাস আমাকে ভাল ভাবে করতে হবে—নচেৎ নাকি ডাক্তারী পড়া হবে না। তা ছাড়া বাবা রাগ করবেন—

    আচ্ছা, আচ্ছা, সে আমি বুঝবো নেযা তো তুই গিয়ে শুয়ে পড়

    শুয়ে পড়বো কেন?

    বাঃ, এই তো একটু আগে বলছিলি জ্বর-জ্বর লাগতিছে——জ্বর আসবো—দেখি গা- টা! বলে কপালে গায়ে হাত ঠেকিয়ে বলে, হ্যাঁ, একটু ছ্যাঁকছ্যাকই তো করে—যা শুয়ে পড় গে, এই যজ্ঞিবাড়িতে আবার একটা জ্বর-জ্বালা বাধলে—না, না সাবধান হওয়া ভাল——যা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। তারপর দাদা এলে দেখে যা ঔষধ দেবার দেবেন—আয় আমার সঙ্গে।

    অনন্যোপায় আনন্দচন্দ্র বিন্দুবাসিনীর পিছনে পিছনে অগ্রসর হয়। এক বিপত্তি এড়াতে গিয়ে আর এক বিপত্তি।

    বিন্দুবাসিনী তখন আপন মনেই বলতে বলতে চলেছে, তা জ্বর হবেই বা না কেন, কটা দিন শরীরের উপর দিয়েও কম ধকলটা যাচ্ছে না! কচি শরীরে এত সইবে কেন? জ্বরটর যেন না হয় মা-দুর্গা—

    বাড়ির সকলেই প্রায় যশুরে ভাষায় কথা বললেও, ইদানীং মধ্যে মধ্যে তাদের কথায় একটা-আধটা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ও কথা এসে পড়ে। বিন্দুবাসিনীও ওই দলেই ছিল, কিন্তু বিধবা হওয়ার পর শ্বশুরগৃহ হতে ফিরে এসে দেশের গ্রামের ভাষায় বড় একটা সে কথা বলতো না। ওই ধরনের কথাবার্তা যেন সে ভুলেই গিয়েছিল একেবারে। সে কলকাতার ভাষাতেই কথা বলে। খাতি, নাতি, শুতি ইত্যাদি আর বলে না। বলে, খাওয়া, নাওয়া, শোওয়া। কারণ হচ্ছে বিন্দুবাসিনীর স্বামী ভগবতীচরণ সেনমশাই দীর্ঘকাল কলকাতা শহরেই কার্যব্যপদেশে কাটিয়েছিলেন, যার ফলে দেশগাঁয়ের ভাষাটাও ভুলে গিয়েছিলেন। বিন্দুবাসিনী বিবাহের পর স্বামীর সঙ্গে কলকাতার ভাষায় কথা বলতে বলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, ওই ভাষাতেই কথা বলতো।

    আনন্দচন্দ্রও দীর্ঘ সাত বৎসর কলকাতায় থেকে পড়াশুনা করতে করতে দেশগাঁয়ের ভাষাটা ভুলে গিয়েছিল বললেই হয়। তবে দেশে এলে গাঁয়ে এলে গাঁয়ের ভাষাতেই কথা বলতে চেষ্টা করতো। হলে কি হবে, কলকাতার ভাষাই রের হয়ে পড়তো।

    আনন্দচন্দ্র অনন্যোপায় হয়ে বিন্দুবাসিনীর পিছনে পিছনে চলছিল বটে, কিন্তু ভাবছিল এখন কি করা যায়—কারণ জ্বরের প্রয়োজন তো তার তখুনি ফুরিয়ে গিয়েছে যখনই বুঝতে পেরেছিল আর যাই হোক তাকে আজ আর যাত্রা করতে হবে না। যা করবার পিসিমণিই করবে, পিসিমণির যখন মনে হয়েছে আজ তার যাওয়া হতে পারে না—অতএব সে যাচ্ছে না ঠিকই। আনন্দচন্দ্র বিন্দুবাসিনীর পিছনে পিছনে যেতে যেতে বলে মিনমিনে গলায়, গা গরম হবে কেন, জ্বর হয়নি—বেহান বেলায় একটু কেমন জ্বর- জ্বর লাগছিল—এখন তো ঠিকই আছি।

    তবু যা, শুয়ে থাকবি চল।

    ও কিছু না পিসিমণি, দীঘিতে ভাল করে স্নান-টান করলেই ঠিক হয়ে যাবে। বিন্দুবাসিনী ফিরে দাঁড়াল। বললে, কি বললি, দীঘি? তা আর নয়—তারপর নিমুনিয়া একটা বাধাও!

    ‘নিমুনিয়া’ শব্দটার সঙ্গে বিন্দুবাসিনী অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবেই পরিচিত। তার স্বামী ভগবতীচরণ সেনমশাই যে ওই নিমুনিয়া রোগেই মারা যান। সামান্য ঠাণ্ডা লেগে জ্বর—সবে প্রথম ঠাণ্ডাটা তখন পড়েছে, পাড়াগাঁয়ে ওরকম প্রথম ঠাণ্ডায় জ্বর-জারি তো ঘরে ঘরেই হয়। একটু-আধটু পাঁচন বা বাসকের পাতা ছেঁচে খেলেই সেরে যায়। নিজের বাপের বাড়িতেও দেখেছে বিন্দুবাসিনী ছোটবেলায় কত।

    গা-টা ছ্যাঁকছ্যাঁক করেছে—সর্দি-সর্দি একটা ভাব। স্বামীকে বলেছিল বিন্দুবাসিনী, তাহলে আজ আর স্নান-টান করো না, ভাত খেয়ো না, চারটি মুড়ি বা চিড়েভাজা খাও।

    সাবধানী মানুষ ছিলেন বরাবর ভগবতীচরণ, কিন্তু সেদিন স্ত্রীর কথায় কেন জানি কর্ণপাত করলেন না।

    ভাল করে তৈলমর্দন করে স্নান করে ভাত খেলেন। বিকেলের দিকেই ধুম জ্বর। কালীদর্শনে গিয়েছিলেন স্বামী-স্ত্রী ‘কালীঘাটে—সেখানেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন।

    রীতিমত যেন ব্যস্ত হয়ে ওঠে বিন্দুবাসিনী।

    পরের দিন ডাক্তার ডাকা হল।

    দুটো দিন ডাক্তারের চিকিৎসায় জ্বর তো কমলোই না—সেই সঙ্গে বুকে ব্যথা। ভগবতীচরণের পয়সার অভাব ছিল না—বিন্দুবাসিনী সাহেব ডাক্তারকে আনলেন, তিনি বললেন, দুটো বুকেই নিমুনিয়া

    ছয় দিনের দিন ভোরবেলা মারা গেলেন ভগবতীচরণ।

    ভ্রাতুষ্পুত্রের দীঘির জলে স্নান করার কথায় তাই যেন ক্ষেপে যায় বিন্দুবাসিনী। বলে, স্নান-টান নয়—যাও শুয়ে পড়গে, তারপর দাদা আসুন—দেখুন, যা ব্যবস্থা হবে তখন হবে।

    প্রমাদ গনে আনন্দচন্দ্ৰ।

    দীঘিতে সাঁতার কেটে স্নান করা আনন্দচন্দ্রের একটা বিশেষ আকর্ষণ ও আনন্দের ব্যাপার। বেশী দূরে তো নয়, বাড়ির কাছেই চাঁদামণিতলার সরু খালটা পেরুলেই বিরাট দীঘি। টলটলে কাকচক্ষু জল।

    কতবার খেলার সাথীদের সঙ্গে ওই বিরাট দীঘিটা সাঁতরে এপার ওপার করেছে আনন্দচন্দ্র। সাঁতারে সে অত্যন্ত দক্ষ—অত্যন্ত পটু।

    কি কুক্ষণেই যে কলকাতা যাওয়া এড়াবার জন্য আনন্দচন্দ্র পিসিমণির কাছে বলেছিল, জ্বর-জ্বর লাগছে, জ্বর হয়ত আসতে পারে! সব ভেস্তে গেল।

    ভ্রাতুষ্পুত্রকে একেবারে বড় ঘরে পৌঁছে দিয়ে বিন্দুবাসিনী চলে গেল।

    কি আর করে আনন্দচন্দ্ৰ—শয্যায় শুয়ে থাকে।

    এই ঘরটায় বড় একটা কেউ আসে না। তার পিসিদের এক্তিয়ারে ঘরটা। খোলা জানলা-পথে আমবাগানটা দেখা যায়।

    অনেক গাছের জন্য আবছা আলোআঁধারি বাগানটার মধ্যে একটা দোয়েল আর শ্যামা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।

    পরবর্তীকালে আনন্দচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র ওই ঘরটা ভেঙে যেখানে দালান তোলবার সময় বিরাট একটা হলঘর তৈরি করেছিল।

    চকচকে পা পিছলানো মোমপালিশ করা মেঝে—টকটকে লাল সিমেন্টের।

    অবিশ্যি আনন্দচন্দ্রের সেই ঘর বা দালান দেখে যাবার সৌভাগ্য হয়নি।

    অর্থের সাচ্ছল্য যখন আসতে সবে শুরু করেছে, জ্যেষ্ঠ পুত্র ডাক্তার হয়ে দূর দেশে চাকরি নিয়ে গিয়েছে, আনন্দচন্দ্রের জীবন-প্রদীপের তেলও নিঃশেষ হয়ে এসেছে।

    অন্নদাসুন্দরীর পাঁচ মেয়ে ছয় ছেলে।

    পরবর্তী জীবনে ছেলেরা সবাই কৃতী হয়েছে—অর্থোপার্জনও করেছে, কিন্তু যে দুটি ছেলে তার সর্বাপেক্ষা মেধাবী ও লেখাপড়ায় ভাল ছিল—তৃতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্ৰ, তারাই পারেনি অন্যান্য ভাইদের মত অর্থ উপার্জন করতে।

    জীবনভোর তারা নিষ্ঠুর সংগ্রামই করে গিয়েছে কেবল।

    কিন্তু সে সংগ্রামের কাহিনী বর্তমান কাহিনীর প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। এ কাহিনী সেই ছোটখাটো গড়ন দুর্গাপ্রতিমার মত গায়ের রঙ, একঢাল কালো চুল, সেই সর্বক্ষণ অবগুণ্ঠন টানা নিঃশব্দচারিণী বদ্যিবাড়ির বধূ অন্নদাসুন্দরীকে নিয়ে তাঁর সময়ের কাহিনী—আনন্দচন্দ্রের কাহিনী। এবং যে অন্নদাসুন্দরী সেই যে নয় বৎসর বয়সে শ্বশুরগৃহে এক শীতের অপরাহ্ণে এসে প্রবেশ করেছিল আবক্ষ ঘোমটা টেনে, তারপর দীর্ঘ চৌত্রিশ বৎসর পরে দু’পা ভর্তি আলতা, মাথাভর্তি সিন্দূর ও লালপাড় এক শাড়ি পরে—ছেলেদের কাঁধে চেপে নিঃশব্দে বিদায় নিয়ে গিয়েছিল, সেই অন্নদাসুন্দরী ও আনন্দচন্দ্রকে নিয়ে।

    চুপচাপ শুয়েছিল আনন্দচন্দ্র বিরাট একটা কাঁঠাল গাছের তক্তা দিয়ে তৈরি পালঙ্কটার উপরে। বিরক্তিতে মন ভারী হয়ে উঠেছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। নিজের হঠকারিতার জন্য নিজের হাত নিজেরই কামড়াতে ইচ্ছা করছে।

    যাওয়া তো একরকম বন্ধ হল, কিন্তু তাতে হলটা কি!

    এইভাবে ঘরের মধ্যে কতক্ষণ বন্দী হয়ে থাকতে হবে তাই বা কে জানে! বাবা এসে রায় দেবেন তাকে পরীক্ষা করে, তারপর যদি ছুটি মেলে, এই বন্দি-দশার অবসান হয়।

    কিন্তু বাবা যে রোগী দেখে কখন ফিরবেন তাই বা কে জানে! কত সময় তো ফিরতে ফিরতে তাঁর সন্ধ্যা হয়ে যায় রোগী দেখে!

    হঠাৎ-হঠাৎই নজর পড়ল অন্যমনস্ক ভাবে বাঁ দিককার জানলাটার দিকে তাকাতে।

    অন্নদাসুন্দরী জানালার ধারে বসে আছে বাইরের বাগানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। মাথার গুণ্ঠন কখন খসে পড়েছে—সারা পিঠ ঢাকা একরাশ কালো চুল।

    সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা বিদ্যুত্তরঙ্গ খেলে যায় আনন্দচন্দ্রের সারা দেহে। সবাই সংসারের কাজে ব্যস্ত—তাছাড়া এটা তো পিসিদের ঘর, এ সময় কেউ আসবে না এদিকে। তবু এদিক ওদিক তাকিয়ে শয্যার উপর উঠে বসল আনন্দচন্দ্ৰ।

    পালঙ্ক থেকে নেমে পা টিপে টিপে একেবারে অন্নদাসুন্দরীর পিছনটিতে গিয়ে দাঁড়াল। কি দেখছিস রে অন্নদা?

    কে! ও মাগো তুমি? যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অন্নদাসুন্দরী তাড়তাড়ি স্খলিত গুণ্ঠন মাথার উপরে তুলে দেয়।

    জড়োসড়ো হয়ে বসে।

    কি দেখছিলি রে জানালা দিয়ে!

    অন্নদাসুন্দরী বোবা। কোন সাড়া নেই, শুনতেও যেন সে পাচ্ছে না।

    এই, কথা বলছিস না কেন বৌ, কি দেখছিলি বল্‌ না?

    সাড়া নেই তবু।

    বলবি না! এখানে তো কেউ নেই রে।

    তবু বধূ সাড়া দেয় না দেখে বধূর পিঠ স্পর্শ করে আনন্দচন্দ্র আবার প্রশ্ন করে, বল্ না!

    কি বলবো? অন্নদাসুন্দরী যেন ফিসফিস করে বলে।

    কি দেখছিলি জানালা দিয়ে? বলতে বলতে আনন্দচন্দ্ৰ হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বধূর মাথার গুণ্ঠনটা টেনে নামিয়ে দেয়।

    অন্নদাসুন্দরী ভয়ে লজ্জায় যেন আরো গুটিয়ে নেয় নিজেকে।

    কে এ ঘরে আছে! কেউ তো নেই—এ ঘরে কেউ এখন আসবেও না, ঘোমটা দিতে হবে না। বললে আনন্দচন্দ্ৰ।

    অন্নদাসুন্দরী যেন আরো সংকুচিত আরো জড়োসড়ো হয়ে যায়।

    হঠাৎ রাতারাতি কোথা থেকে এল এত লজ্জা অন্নদাসুন্দরীর!

    দুদিন আগেও তো ছোট ছয় হাতি ডুরে শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে গাছতলায় বসে রান্নাবাড়ি নিয়ে মেতে থাকতো। পাতার লুচি—শুকনো মাটির ভাত—নিমফলের তরকারি মনের সুখে রাঁধতো।

    না ছিল গায়ে কাপড়—না ছিল মাথায় ঘোমটা।

    দাদু আদর করে ডাকতেন, কোথায় গো ছোটগিন্নী, রান্না হল! আর খেতে দেবে কখন?

    অন্নদাসুন্দরী জবাব দিয়েছে, এই হল—শুধু অম্বলটা হলেই হয়।

    সেই অন্নদাসুন্দরী হঠাৎ কি রাতারাতি বধূ বনে গেল? বিচিত্র সংসারের এই বুঝি নিয়ম—রাতারাতিই যেন পরিচিত ঘরের চৌকাঠটা ডিঙ্গিয়ে অন্য এক ঘরের মধ্যে পৌঁছে দেয় মেয়েদের। অন্য এক জীবনে—অন্য এক সংসারে।

    সে যুগের বালিকারা বুঝি এমনি করেই খেলাঘর ছেড়ে সত্যিকারের সংসারে গিয়ে ঘোমটা টেনে বধূ হয়ে বসত।

    এখানে আসার আগে পইপই করে ঠাকুরমা বলে দিয়েছিল, বৌ হয়ে যাচ্ছিস—সব সময় মাথায় ঘোমটা টেনে থাকবি, কারো মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাবি না—পায়ের দিকে তাকাবি, গুরুজনদের প্রণাম করবি, ক্ষিদে পেয়েছে বলেই দুমদাম করে রান্নাঘরে হেঁসেলে গিয়ে ঢুকবি না। উঁচু গলায় কারো সঙ্গে কথা বলবি না।

    হেনো ত্যানো কত উপদেশ।

    সব উপদেশ কি আর মনে রাখতে পেরেছে অন্নদাসুন্দরী, না তাই কিছু মনে থাকে!

    আনন্দচন্দ্র বধূকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে, কি হল রে—কথা বলছিস না কেন? বোবা নাকি! কি দেখছিলি, বল্ না?

    পেয়ারা-

    পেয়ারা!

    হ্যাঁ, ওই যে দেখুন না গাছে।

    আনন্দচন্দ্র হেসে ফেলে। সত্যি, জানালার অল্প দূরে বাগানের ছোট পেয়ারা গাছটায় বড় বড় সব ডাঁশা পেয়ারা।

    পেয়ারা খাবি?

    মাথা নাড়ে অন্নদাসুন্দরী, জানায়, না।

    দাঁড়া, গাছ থেকে পেড়ে আনছি। ঘরের পিছনের দরজাটা খুলে আনন্দচন্দ্র বাগানে চলে যায় এবং একটু পরে গোটা-সাতেক ডাঁসা বড় বড় পেয়ারা নিয়ে আসে। বলে, নে, খা।

    অন্নদাসুন্দরী কিন্তু খায় না।

    ছোট ছোট কচি হাতের পাতায় পেয়ারাগুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকে!

    খা। খা না—জানিস—এ দেখছিস কি, আরো বড় হয় পেয়ারাগুলো আর যা মিষ্টি হয় না খেতে!

    আপনি খান না পেয়ারা।

    না।

    কেন?

    পেয়ারা তো বাচ্চারা খায়, বিজ্ঞের মত বলে আনন্দচন্দ্র। যেন কতই বয়েস হয়েছে। সাতবুড়োর এক বুড়ো!

    তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে আনন্দচন্দ্র; পাকা গাব খাস না?

    খাই।

    বিলিতী পাকা গাব খেয়েছিস কখনো? খেয়েছিস বিলিতী আমড়া?

    না।

    কেক্ খেয়েছিস? বিলিতী বিস্কুট?

    না।

    আনবো, এবার যখন কলকাতা থেকে আসবো। তোর জন্য নিয়ে আসবো।

    কিন্তু কখনো কোন কিছুই আনন্দচন্দ্র আনেনি অন্নদাসুন্দরীর জন্য। কখনো বোধ হয় মনেও পড়েনি তার ওই সব আনবার কথা একজনের জন্য—যে তাদের গৃহে মাথায় গুণ্ঠন টেনে উদয়-অস্ত ঘরের কাজই করে চলেছে।

    অন্নদাসুন্দরীও কোন কথা ভুলেও উচ্চারণ করেনি। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্নদাসুন্দরী বুঝতেই পেরেছিল, ওই মানুষটি নিজের কথা ছাড়া বুঝি কারো কথাই ভাবে না। নিজের সুখ-সুবিধা ছাড়া যে আর কারো কোন কিছু আশা থাকতে পারে, বাসনা থাকতে পারে, শখ থাকতে পারে সে কথা বুঝি কখনো কোনদিন তার মনেই পড়েনি।

    সে সময় কলকাতা থেকে যশোর পর্যন্ত রেল হয়েছিল। তার পরেও লাইন আরো এগিয়ে এসেছিল—দৌলতপুর খুলনা।

    সিটি বাজিয়ে হুস্ হুস্ করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছোট ছোট ঘরের মত একটার সঙ্গে একটা বাঁধা—কত লোকজন নিয়ে চলে যায়—ছয় দণ্ডে চলে যায় ছয় দিনের পথ। রেলের গাড়ি।

    অন্নদাসুন্দরীর মনের মধ্যে ভারী বাসনা ছিল একটিবার সেই রেলের গাড়িতে চাপবার। রেলের গাড়িতে তার চাপা হয়নি। বাড়ির চৌকাঠটাই তার পার হওয়া হয়নি- তা রেলের গাড়ি!

    বড় মেয়ে কুসুমের বিয়ের পর সে চলে গেল স্বামীর ঘর করতে।

    বর্ধমান না কোথায় তার স্বামী থানার দারোগা—যেতে হয় ওই রেলের গাড়িতে চেপে। মেয়ের মুখে সেই গল্প শুনে অন্নদাসুন্দরী নাকি তার বড় মেয়েকে একদিন বলেছিল, কুমী, আমায় একবার রেলের গাড়ি চাপাতি পারিস!

    তা কেন পারবো না। খুব পারবো-

    কেমন নাকি ঝক্‌ঝক্ ঝম্‌ঝম্ শব্দ হয়—ভোঁ দেয়—হুস হুস করে ছুটে যায়।

    তা তুমি যখন বোলতিছ, যাবা নে একদিন তোমারে নিয়ে। কুসুম আশ্বাস দিয়েছিল তার মাকে।

    কিন্তু ওই পর্যন্তই।

    কুসুমের বাপের বাড়িতে আসা তো সেই দু বছর আড়াই বছর অন্তর অন্তর। দোজবরে বিয়ে হয়েছিল কুসুমের—শালারা ডাকত ‘সেন ঝি মশাই’ কুসুমের সঙ্গে বয়সের অনেক তফাৎ, তা প্রায় বছর কুড়ি তো হবেই। থানার দারোগা—সচ্ছল অবস্থা—মুঠো মুঠো টাকা।

    নিম্ন-মধ্যবিত্ত দারিদ্র্যের সংসার থেকে স্বামীর ঘরে গিয়ে গ্রামের দরিদ্র বালিকা কুসুম যেন হঠাৎ হকচকিয়ে গিয়েছিল তার স্বামীর সংসারের সাচ্ছল্য দেখে।

    সব দেখিয়ে সেনমশাই বলেছিলেন, এই তোমার ঘর কুসুম!

    আমার?

    হ্যাঁ, যা দেখছো সব কিছু তোমার। খাট পালঙ্ক—বাসনপত্তর—টাকাপয়সা— গয়নাগাঁটি সব তোমার।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম
    Next Article অশান্ত ঘূর্ণি (অখণ্ড) – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.