Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    লেখক এক পাতা গল্প766 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩.০৯ শেকড় – ইস্‌মত চুগ্‌তাই

    শেকড় – ইস্‌মত চুগ্‌তাই

    প্রত্যেকটি মানুষের মুখ শুকিয়ে গেছে। বাড়িতে রান্না পর্যন্ত হয়নি। আজ ষষ্ঠ দিন। ছেলেপুলে ইস্কুল ছেড়ে বাড়িতে বসে বসে নিজেদের এবং বাড়ির লোকজনের প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলছে। সেই মারামারি-ধস্তাধস্তি, সেই হুটোপুটি-লাফালাফি। যেন পনেরোই আগস্ট আসেইনি। হতভাগাগুলোর এ খেয়াল পর্যন্ত নেই যে, ইংরেজ চলে গেছে এবং যাওয়ার বেলায় এমন গভীর আঘাত দিয়ে গেছে, যা শুকোতে বহুদিন লেগে যাবে। ভারতবর্ষকে এমন পঙ্গু হাতে আর ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে যে, হাজার হাজার শিরা ছিঁড়ে গেছে, রক্তের স্রোত রয়ে যাচ্ছে। সেলাই করে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও কারো নেই।

    অন্য কোনো সাধারণ দিন হলে হতভাগাগুলোকে বলা যেত, বাইরে গিয়ে হৈ-হল্লা কর। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ শহরের অবস্থা এমন বিশ্রী হয়ে রয়েছে যে, সমস্ত মুসলমান একরকম নজরবন্দিই হয়ে আছে। দরজায় তালা পড়েছে। বাইরে পুলিশের পাহারা। ছেলেপুলেকে তাই বুকের ওপরই দুরমুশ পিটতে দেওয়া হচ্ছে। এমনিতে সিভিল-লাইন্‌স্ শান্ত– এসব পাড়া সাধারণত যেরকম থাকে। যেখানে পাঁক-কাদা, নোংরামি সেইখানেই বেশি। যেখানে দারিদ্র্য, সেইখানেই অশিক্ষার আঁস্তাকুড়ে ধর্মের নামে জঞ্জাল জমে ভুড়ভুড়ি ওঠে। সেই জঞ্জালই ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে। তার ওপর পাঞ্জাব থেকে আগত শরণার্থীর সংখ্যা দিন-কে-দিন বেড়ে উঠে সংখ্যালঘুদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করছে। জঞ্জালের স্তূপেও আরো ক্ষিপ্র হাত পড়ছে। তারপর দুর্গন্ধ ক্রমশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এলাকায় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছচ্ছে। দুই-এক জায়গায় খোলাখুলিভাবেই হাঙ্গামা হয়ে গেছে। কিন্তু মারোয়াড়ের হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি এমনি মিশ্রিত যে, নাম, চেহারা, কি, কাপড়-চোপড় দেখে তাদের আলাদা করে চেনা বাইরের লোকের পক্ষে মুশকিলের ব্যাপার। বাইরের সংস্কৃতির লোক– যাদের সহজেই চেনা যেত– পনেরোই আগস্টের গন্ধ পেয়েই পাকিস্তানে গিয়ে পাড়ি জমিয়েছে। রয়ে গেছে শুধু এ রাজ্যের পুরনো বাসিন্দারা। তাদের না আছে তেমন বুদ্ধি, না আছে তেমন ক্ষমতা যে, হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানের জটপাকানো সমস্যাটি কেউ তাদের বুঝিয়ে দেবে। যাদের বুঝবার কথা, তারা বুঝে নিয়েছে। এবং তারা নিরাপদও হয়ে গেছে। বাকি যারা শুনে গিয়েছিল, চার সের গম আর চার আনায় এক হাত লম্বা পাউরুটি পাওয়া যাবে সেখানে, তারা ফিরে আসছে। কারণ, সেখানে গিয়ে তারা এ-কথাও জেনেছে, চার সের গমের জন্যে একটা টাকারও দরকার হয় এবং এক হাত লম্বা পাউরুটির জন্যে গোটা একটা সিকিও দিতে হয়। আর, সে টাকা-সিকি না পাওয়া যায় কোনো দোকানে, না জন্মে কোনো ক্ষেতে। জান বাঁচাতে হলে যেমন কঠিন সংগ্রাম করতে হয়, টাকা-সিকি পেতে হলেও তাই।

    সুতরাং বিভিন্ন মহল্লা থেকে যখন খোলাখুলিভাবে সংখ্যালঘুদের বার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল, ভারি মুশকিল বাধল তখন। কর্তাব্যক্তিরা পরিষ্কার বলে দিলেন, মশাই, লোকে এমন খিচুরি পাকিয়ে রয়েছে যে, মুসলমান বেছে বার করতে হলে রীতিমতো কর্মচারী লাগাতে হবে। সে একটা অকারণ বাজে খরচ। এমনিতে আপনারা যদি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্যে জমি কিনতে চান, তাহলে খালি করে দেওয়া যাবে জমি। জানোয়াররা তো রয়েছেই। যখনই বলেন, জঙ্গল খালি করে দেওয়া যাবে।

    এবার বাকি রইল শুধু কয়েকটি গোনা-গাঁথা, বাছা-বাছা পরিবার– তারা মহারাজার চেলা-চামুণ্ডা। তাদের যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যারা যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে, তারা বিছানাপত্র বাঁধছে। আমাদের বাড়িও এই দলে। যদ্দিন আজমির থেকে বড় ভাই আসেননি, ততদিন তেমন তাড়াহুড়ো ছিল না; কিন্তু তিনি এসে আমাদের ভড়কে দিয়ে তবে ছাড়লেন। তবু সেকথার কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিল না। এমনিতে হয়তো কেউ কানেও তুলত না কথাটা এবং বিছানাপত্রও বাঁধা হত না কোনো কালে। সুতরাং খোদার মর্জি ছাব্বা মিয়ার পাঁয়তারাও চলত না। বড় ভাই তো যাওয়ার জন্য তৈরিই ছিলেন। তিনি বলে বলে হয়রান হয়ে গেছেন। এবার ছাব্বা মিয়া হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলেন– তিনি ইস্কুলের দেয়ালে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লিখে রেখে এলেন। রূপচাঁদজির ছেলেরা এর প্রতিবাদে কথাটি মুছে ফেলে চট করে ‘অখণ্ড হিন্দুস্তান’ লিখে দিল। অমনি শুরু হয়ে গেল জুতো পেটাপিটি এবং পরস্পর পরস্পরের প্রাণ নেয়ার চেষ্টা। হাঙ্গামা ক্রমশ বেড়ে উঠল। শেষকালে পুলিশ ডাকা হল। যে-কটি মুসলমান বেঁচে ছিল, লরিতে করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল তাদের।

    যে মায়েরা গালাগালি দেওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের কলেরা-প্লেগের মুখে তুলে দেয়, ছেলেরা বাড়ি আসতেই তারা মমতায় অস্থির হয়ে ছুটে এসে তাদের বুকে চেপে ধরল। অন্য কোনো দিন হলে এবং রূপচাঁদজির ছেলেপুলের সঙ্গে ছাব্বা মারামারি করে এলে নতুন ভাবী তাকে এমনভাবে জুতোপেটা করতেন যে, সে জন্মে ভুলত না। তারপর তাকে উঠিয়ে রূপচাঁদজির বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত– খাওয়ান ওকে ক্যাস্টর অয়েল আর কুইনাইন। রূপচাঁদজি শুধু আমাদের বাড়ির বাঁধা ডাক্তারই নন, বাবার পুরনো বন্ধুও। বাবার সঙ্গে ডাক্তারবাবুর, আমার ভাইদের সঙ্গে তাঁর ছেলেদের, আমার ভাবীদের সঙ্গে তাঁর বউদের এবং আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাঁর নাতি-নাতনির বন্ধুত্ব একেবারে অচ্ছেদ্য। দুই বাড়িরই বর্তমান তিন পুরুষ পরস্পরের সঙ্গে এমনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ যে, সন্দেহমাত্র হত না, ভারত-বিভাগের পর এই ভালোবাসায় ফাটল ধরবে। সে যাই হোক, দুই বাড়িতেই লীগপন্থি, কংগ্রেসি এবং মহাসভাপন্থী লোক ছিল। ধর্ম এবং রাজনীতির তর্কও জোরসে চলত। কিন্তু সে যেন ফুটবল কিংব ক্রিকেট ম্যাচের মতো। এদিকে বাবা যদি কংগ্রেসি হলেন তো ওদিকে ডাক্তারবাবু আর বড় ভাই হলেন লীগপন্থি, আর, জ্ঞানচাঁদজি মহাসভাপন্থী। মেজো ভাই কমিউনিষ্ট, গুলাবচাঁদ সোস্যালিস্ট। এইভাবে বেটাছেলের বউ-ছেলেমেয়েও তাদের পার্টির। সাধারণভাবে হিসাব করলে কংগ্রেসের দল ভারি হয়ে যায়। কমিউনিস্ট, সোস্যালিস্টরাও গালাগালি খায়। কিন্তু তারা কংগ্রেসের দলেই ভিড়ে যায়। বাকি থাকে মহাসভা আর লীগের দল। এই দুটি দল সবসময় একজোট থাকে। ওরা তো পরস্পরের শত্রুই। তবু, দুটিতে মিলে কংগ্রেসের ওপর আক্রমণ চালায়।

    কিন্তু এদিকে কয়েক বছর যাবৎ লীগের ক্ষমতা বেড়ে চলছিল, ওদিকে মহাসভারও। কংগ্রেসের তো পতনের যুগ চলছে। দুই-একটি ছাড়া বাড়ির সমস্ত ছেলেপুলে বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ গোছের কংগ্রেসিদের ছেড়ে ন্যাশনাল গার্ডের মতো দল করে ফেলল; ওদিকে জ্ঞানচাঁদের নেতৃত্বে সেবক সংঘের একটা ছোটখাটো দল গড়ে উঠল। কিন্তু ভালোবাসায় তবু ফাটল ধরল না।

    মহাসভাপন্থী জ্ঞানচাঁদ মুন্নির লীগপন্থি বাপকে বলে, আমার খোকার বিয়ে তো মুন্নির সাথেই দেব। সোনার পাঁয়জোর দেব আমি

    : গিল্‌টি সোনার মাল যেন চালিয়ে দিও না হে।– অর্থাৎ বড় ভাই জ্ঞানচাঁদের মহাজনির ওপর কটাক্ষ করেন।

    এদিকে, ন্যাশনাল গার্ড দেয়ালে দেয়ালে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লিখে রাখে, সেবক সংঘ সেটা মুছে দিয়ে ‘অখণ্ড হিন্দুস্তান’ লিখে দেয়। এ হল সেই সময়ের কাহিনী, যখন পাকিস্তানের কথা ছিল হাসি-ঠাট্টার বিষয়।

    বাবা আর রূপচাঁদজি এইসব শোনেন, আর, মিটমিট করে হাসেন; তারপর সারা এশিয়াকে এক করবার প্ল্যান করেন।

    মা আর কাকিমা রাজনীতির আওতার বাইরে ধনে, হলুদ আর মেয়েদের যৌতুকের আলোচনা করেন। বউয়েরা পরস্পরের ফ্যাশন চুরির তাকে থাকে। নুন-লঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়িতে ডাক্তার বাবুর ওষুধও কেনা হয়। প্রত্যেকদিন কারো না কারো হাঁচি পড়লেই অমনি ছুটে যাও ডাক্তারবাবুর কাছে। কিংবা যখন কারো অসুখ হল, আর, মা ডাল-ভরা রুটি বা দই-বড়া বানাতে শুরু করলেন, অমনি ডাক্তারবাবুকে বলে পাঠালেন, খেতে হয় তো আসুন।– ডাক্তারবাবু তখন নাতি-নাতনির হাত ধরে পৌঁছে যান।

    বেরোবার সময় স্ত্রী বলেন, খেয়ো না যেন, শুনলে?

    : হুঁ। তাহলে ফি আদায় করব কেমন করে? দেখ, বাপু, খোকা আর চুনিকেও পাঠিয়ে দিও।

    কাকিমা গজর গজর করে বলেন, হায় রাম! লজ্জাও করে না তোমার!

    মজা বাধে তখন, যখন মা’র শরীর খারাপ হয়। মা কেঁপে ওঠেন

    : না, বাপু, আমি ওই হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাব না।

    কিন্তু বাড়ির ডাক্তার ছেড়ে শহরের ডাক্তার আনতে যাবে কে?– সুতরাং ডাক্তারবাবু খবর শুনেই দৌড়ে আসেন। মাকে তাতিয়ে বলেন, একা একা পোলাও-জর্দা ওড়ালে তো অসুখে পড়বেই!

    : তুমি যেমন পেটুক, অন্য লোককেও সেইরকম ঠাওরাও।– মা পর্দার আড়াল থেকে ঝনঝনিয়ে ওঠেন।

    ডাক্তারবাবু দুষ্টুমি-ভরা চোখে মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, আরে, এ তো হল অসুখের বাহানা। ভাবী, তুমি এমনিই ডেকে পাঠিও, আমি চলে আসব। এসব ঢঙ কর কেন?

    মা জ্বলে উঠে হাতখানা টান মেরে সরিয়ে নিয়ে গালাগালি দিতে থাকেন। বাবা মিটমিট করে হাসেন।

    এক রোগীকে দেখতে এলে বাড়ির সমস্ত রোগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে– কেউ পেট নিয়ে এগিয়ে আসে, কারো গায়ে ফুসকুড়ি বেরিয়েছে, কারো কান পেকেছে, কারো-বা নাক ফুলেছে।

    : কী বিপদ, ডিপ্‌টি সাহেব! দুই-একটাকে বিষ দিয়ে দিই। আমায় পশু-ডাক্তার ঠাওরেছে নাকি যে, দুনিয়ার যত জানোয়ার ভেঙে পড়ল।– ডাক্তারবাবু রোগী দেখেন আর গজর গজর করতে থাকেন।

    ছেলেপুলে হওয়ার আভাস পেলে ডাক্তারবাবু সারা সৃষ্টিকে গালাগালি দিতে শুরু করেন।

    : হুঁহ্! মুফতের ডাক্তার! পয়দা করে যাও, হতভাগার বুকের উপর দুরমুশ পিটে বেড়াক।

    কিন্তু ব্যথা উঠলেই তিনি নিজের বারান্দা থেকে আমাদের বারান্দা পর্যন্ত টহল দিতে থাকেন, আর চিৎকার করে করে সকলকে অতিষ্ঠ করে তোলেন। পাড়া-পড়শি মেয়েদের আসা মুশকিল হয়ে ওঠে। আসতে-যেতে হবু বাপকে পটাপট চাঁটি বসান, আর, সে নির্বোধের মতো সাহস দেখিয়েছে বলে শাপ-শাপান্ত করেন।

    অথচ শিশুর প্রথম আওয়াজ কানে যাওয়া মাত্র তিনি বারান্দা থেকে দরজার সামনে এবং দরজা থেকে ঘরের ভেতরে চলে আসেন। পাগলের মতো হয়ে বাবাও চলে আসেন তাঁর সাথে সাথে। মেয়েরা গালাগালি দিতে দিতে পর্দা করে। তিনি প্রসূতির নাড়ি দেখে নিয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলেন, বারে আমার বাঘিনী!– তারপর শিশুর নাড়ি কেটে তাকে গোসল করাতে শুরু করেন। বাবা অপ্রতিভ হয়ে অনভিজ্ঞ নার্সের মতো ব্যবস্থাদি করে দেন।

    তারপর মা চেঁচাতে শুরু করেন, নাও, গজব খোদার! কপাল-পোড়া আঁতুড়ঘরে ঢুকে পড়ল!

    বেগতিক বুঝে দুজনেই গাল-খাওয়া ছেলেপুলের মতো বাইরে ছুটে পালান।

    এরপর, বাবার যখন পক্ষাঘাত হয়, তখন রূপচাঁদজি হাসপাতাল থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর সমস্ত প্র্যাকটিস নিজের আর আমাদের বাড়িতে সীমাবদ্ধ হয়েছে। চিকিৎসা তো আরো কয়েকজন ডাক্তার করছিলেন। কিন্তু নার্স এবং মা-র সাথে সাথে রাত জাগতেন ডাক্তারবাবুই। তারপর, বাবাকে দাফন করে আসার পর থেকে পারিবারিক প্রীতি ছাড়াও দায়িত্ববোধ দেখা গেল তাঁর। ছেলেমেয়েদের ফি মাফ করাতে ইস্কুলে দৌড়ে যান, মেয়েদের যৌতুকের কান-বালির জন্যে জ্ঞানচাঁদের প্রাণ অতিষ্ঠ করে রাখেন। বাড়ির কোনো বিশেষ কাজ ডাক্তারবাবুর মত ছাড়া হয় না। পশ্চিমের উইংটা ভেঙে দুটো কামরা বাড়াবার কথা উঠলে ডাক্তারবাবুর মত অনুসারে সেটা চাপা দিয়ে দেওয়া হল। তিনি রায় দিলেন, এর চাইতে উপরে দুটো কামরা বাড়িয়ে নাও।– তাই করা হল। মজ্জন এফ.এ.-তে সায়েন্স নিতে চাইছিল না। ডাক্তারবাবু জুতো নিয়ে তেড়ে গেলেন, হাঙ্গামার নিষ্পত্তি হয়ে গেল। ফরিদা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি এসে উঠল। স্বামী ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে হাজির হল। পরদিনই তার বউ বাড়ি পৌঁছে গেল।

    মেজো বউ শীলা ও বাড়িতে এলে দাইয়ের ঝঞ্ঝাটও চুকে গেল। বেচারি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে পালিয়ে আসত। ফিস তো দূরের কথা, উল্টে ছয় দিনের দিন কোর্তা আর টুপি নিয়ে এল।

    .

    কিন্তু আজকে যখন ছাব্বা মারামারি করে এল, তখন তার সংবর্ধনাটা এমনি হল, যেন গাজি পুরুষ লড়াই জিতে এসেছে। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার বীরত্বের কথা শুনতে লাগল। অনেকগুলো গলার সামনে মা’র গলা চুপ হয়ে রইল। আজ থেকে নয়, পনেরোই আগস্ট থেকে– যেদিন ডাক্তারবাবুর বাড়িতে তিরঙা ঝাণ্ডা, আর, আমাদের বাড়িতে লীগের ঝাণ্ডা ওড়ানো হয়, সেইদিন থেকেই মা’র মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। এই দুটি ঝাণ্ডার মাঝখানে মাইলের পর মাইল প্রসারিত উপসাগর এসে দেখা দিয়েছে। চিন্তিত দৃষ্টিতে তার ভয়ঙ্কর গভীরতাটা দেখে দেখে মা কেঁপে ওঠেন। তারপর এল শরণার্থীর জোয়ার। বড় বউয়ের বাপের বাড়ির লোকজন যখন ভাওয়ালপুর থেকে মালপত্র লুটারুর হাতে খুইয়ে এবং কোনোরকমের প্রাণ বাঁচিয়ে এসে উঠল, তখন উপসাগরের মুখ প্রশস্ত হয়ে গেল। তারপর, রাওয়ালপিণ্ডি থেকে যেদিন নির্মলার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আধমরা অবস্থায় এসে পৌঁছল, সেদিন এই উপসাগরে অজগর ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। ছোট ভাবী ছেলের পেট দেখাতে পাঠালে শীলা বউদি অমনি চাকরকে হাঁকিয়ে দিলেন।

    এ ব্যাপার নিয়ে কেউ তর্কবিবাদ করল না। সারা বাড়ির রোগ হঠাৎ সেরে গেল। বড় ভাবি হিস্ট্রিরিয়ার মূর্ছা ভুলে ঝটপট বিছানাপত্র বাঁধাছাঁদা শুরু করে দিলেন।

    : আমার ট্রাঙ্কে তোমরা হাত দিও না।– অবশেষে মা’র মুখে কথা ফুটল। সবাই হকচকিয়ে গেল।

    বড় ভাই তিক্ত স্বরে বললেন, আপনি যাবেন না নাকি?

    : তওবা! আমি সিন্ধুতে মরতে যাব? আল্লার গজব পড়ুক ওদের ওপর। পর্দা-পুশিদার ধারও ধারে না ওরা।

    : তাহলে সেজোর কাছে ঢাকায় চলে যান।

    সেজো মামি-শাশুড়ি খোঁটা দিলেন, উনি কেন ঢাকায় যাবেন? বললেন, হতচ্ছাড়া বাঙালিরা হাত দিয়ে চটকে চটকে ভাত খায়।

    খালা-মা বললেন, তাহলে রাওয়ালপিন্ডি চল ফরিদার ওখানে।

    : তওবা! আল্লাহ পাক যেন পাঞ্জাবিদের হাতে কারো গোরের মাটি নাপাক না করায়।

    মুখে তো জাহান্নামিদের ভাষা।– আজ স্বল্পবাক মা পটপট করে বলে যান।

    : ওপরেও চিতাবাঘ, নিচেও চিতাবাঘ, বোম্বাই তোমার বাড়ি নয়, তোমার তো হল, বুবু, সেই বিত্তান্ত। আরে বোন, এ যে কাঠবেড়ালের মতো খুঁতখুঁতানি! বাদশাহ ডাক দিল তো ‘কী করি, কী করি!’ হাতি পাঠাল তো ‘ছি, ছি, এ যে কালো!’ ঘোড়া পাঠাল তো ‘ছি, ছি, এ তো পিছাড়া মারে!’…

    করুণ পরিবেশ। তবু সবাই হো হো করে হেসে উঠল। মা’র মুখখানা আরো গম্ভীর হয়ে গেল।

    ন্যাশনাল গার্ডের সর্দারে-আ’লা বললেন, কী ছেলেমানুষের মতো কথা বলছেন! মাথাও নেই, মুণ্ডুও নেই। ইচ্ছেটা কী? এখানে থেকে ছুরি খেয়ে মরবেন?

    : তোমরা যাও। আমি এখন কোথায় যাব? আমার শেষ সময়।

    : তাহলে শেষ সময়ে কাফেরদের হাতে ধোলাই হবে!– খালা-মা বলেন।

    খালা-মা পোঁটলা-পুঁটলি গুণে চলেছেন। পোটলার মধ্যে সোনা-রুপোর গয়নাগাটি থেকে শুরু করে হাড়ের মাজন, শুকনো মেথি এবং মুলতানি মাটি পর্যন্ত রয়েছে। এইসব জিনিস এমনভাবে বুকে ধরে যাচ্ছেন, যেন পাকিস্তানি স্টার্লিং-ব্যালান্স কম হয়ে যাবে এগুলো না গেলে। বড় ভাই তিনবার চটে উঠে তাঁর পুরনো চাদরের পোঁটলাগুলো ফেলে দিলেন। কিন্তু খালা-মা এমনভাবে আর্তনাদ করে উঠলেন, যেন এ দৌলত না গেলে পাকিস্তান গরিব থেকে যাবে। বাধ্য হয়ে ছেলেপুলের পেশাবে-ভেজা গদির তুলোর পোঁটলা বাঁধতে হল, বাসন-কোসন বস্তায় ঢুকল, খাটের পায়া-কাঠামো খুলে খাটেরই দড়ি দিয়ে বেঁধে নেয়া হল। দেখতে দেখতেই সাজানো-গোছানো সংসার বাঁকা-ট্যাড়া গাঁঠরি-বোঁচকায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। যেন সমস্ত জিনিস আপনা-আপনি বাঁধাছাঁদা হয়ে নেচে-কুঁদে বেড়াচ্ছে। একটুখানি জিরোতে বসেছে এবার। এক্ষুনি আবার উঠে নাচ শুরু করে দেবে।

    কিন্তু মা-র ট্রাঙ্ক যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল।

    শেষে ভাই বললেন, আপনার যদি এখানে মরবার ইচ্ছে থাকে, তাহলে আর কে ঠেকাতে পারে!

    সরলদর্শন, আপনভোলা মা শূন্য-দৃষ্টিতে ঘোলাটে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। বুঝি-বা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলেন, কে মারবে? কখন?

    মেজো ভাই ফিসফিস করে বললেন, মা’র বুদ্ধিসুদ্ধি শেষ হয়ে গেছে। এ-বয়েসে মাথার ঠিক নেই।

    : কাফেররা নির্দোষ মানুষের ওপর আরো বেশি করে অত্যাচার করে। তা উনি কী জানবেন! নিজের দেশ হলে জানমাল নিরাপদ থাকবে।

    স্বল্পবাক্ মা’র মুখে যদি জোর থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বলতেন, নিজের দেশ আবার কোন চিজের নাম? ওগো, তোমরা বল তো, কোথায় সেই নিজের দেশ? যেখানকার মাটিতে জন্ম নিলাম, যেখানে গড়াগড়ি দিয়ে মানুষ হলাম, সেই দেশই যখন নিজের দেশ হল না, তখন যেখানে দুদিনের জন্যে গিয়ে বাস করব, সে নিজের দেশ হবে কী করে? তারপর, ওখান থেকে যে আবার কেউ তাড়িয়ে দেবে না, তাই-বা কে জানে! বলতে থাক তোমরা নতুন দেশ বানানোর কথা। আমি এখানে বসে আছি শেষ রাত্তিরের বাতিটা হয়ে। একটুখানি দমকা বাতাস এলে হয়। ব্যস, দেশের কথা খতম। দেশ ধ্বংস করবার আর বানানোর এই খেলাও তো এমন কিছু মিষ্টি বস্তু নয়। একদিন মোগলরা নিজের দেশ ছেড়ে নতুন দেশে এসে উঠেছিল। আজ আবার চল নতুন দেশে। দেশ তো নয়, পায়ের জুতো। একটু পুরনো হল কি, দাও ছুঁড়ে ফেলে, আর-এক জোড়া পায়ে ঢুকিয়ে নাও।

    কিন্তু মা চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখখানা আগের থেকে আরো ক্লান্ত দেখাতে লাগল। যেন কত-শত বছর পাতি পাতি করে দেশ খুঁজে বেড়াবার পর ক্লান্ত হয়ে এসে বসে রয়েছেন এবং সেই খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছেন।

    কত কী এল, গেল। কিন্তু মা নিজের জায়গাটি আঁকড়ে বসে রইলেন। ঠিক যেমন করে বটের শেকড় দাঁড়িয়ে থাকে ঝড়-তুফানের মধ্যে।

    কিন্তু যখন ছেলেমেয়ে, বউ-জামাই, নাতি-নাতনির পুরো দলটি বড় ফাটক পার হয়ে পুলিশ-পাহারায় লরিতে উঠতে লাগল, তখন তাঁর বুকখানা খানখান হয়ে গেল। অধীর দৃষ্টিতে অসহায়ভাবে ওপারের দিকে তাকালেন তিনি। দুখানা বাড়ির মাঝখানে শুধু একটি রাস্তার ব্যবধান। কিন্তু ওধারের বাড়িখানা এত দূরে বলে মনে হল, যেন দূর দিগন্তে ভাসমান একফালি মেঘ। রূপচাঁদজির বারান্দা খাঁ খাঁ করছে। দুই-একবার ছেলেপুলে বাইরে এল। কিন্তু হাত ধরে টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল তাদের। তবু, মা’র ছলছল চোখদুটি দরজার ফাঁক আর চিকের আড়ালের বিষণ্ন চোখগুলো দেখে ফেলল। লরিগুলো যখন দলবল নিয়ে ধুলো উড়িয়ে রওনা হয়ে গেল, তখন বাম দিকের নিষ্প্রাণ চিকটির দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। দরজা খুলে চোরের মতো দৃষ্টিতে সামনের শূন্য, নিস্তব্ধ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভারি পায়ে রূপচাঁদজি বেরিয়ে এলেন।। ধুলোর মেঘের মধ্যে হারানো মূর্তিগুলো খুঁজলেন তিনি কিছুক্ষণ। তারপর তাঁর ব্যর্থ দৃষ্টিটা অপরাধীর মতো নিঝুম দেয়ালে প্রত্যাহত হয়ে ফিরে এসে মাটিতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল।

    সারাজীবনের সঞ্চয় খোদার দয়া এবং অনুগ্রহের ওপর ছেড়ে দিয়ে মা যখন নিঝুম বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালেন, তখন বৃদ্ধ মনটা ছোট্ট শিশুর মতো ভয়ে কুঁকড়ে গেল। যেন চারদিক থেকে ভূত এসে গলা টিপে ধরবে। টলতে টলতে তিনি থাম ধরে নিজেকে সামলে নিলেন। সামনের দিকে চাইতেই প্রাণটা পাঁজরে আছড়ে পড়ল। এই ঘরটিতেই তো তিনি নববধূরূপে স্বামীর স্নেহময় কোলে লাফিয়ে এসে উঠেছিলেন। এইখানেই তো কাঁচা বয়েসের ভীরু-চোখ আপনভোলা বধূর চাঁদের মতো মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে সারাজীবনের জন্যে দাসখত লিখে দিয়েছিলেন। সামনের দিকের ওই ঘরটায় প্রথম মেয়ের জন্ম হয়েছিল। বড় মেয়ের স্মৃতি অকস্মাৎ তীর হয়ে তাঁর অন্তরে গিয়ে বিঁধল। ওই কোণের দিকটায় তার ফুল পোঁতা রয়েছে। একটি নয়, দশটি। দশটি রুহ এইখানেই প্রথম নিশ্বাস ফেলেছিল। দশটি রক্তমাংসের মূর্তি, দশটি কাহিনী এই পবিত্র ঘরেই জন্ম নিয়েছিল। এই পবিত্র জঠর থেকে, যে-জঠর ছেড়ে আজ ওরা চলে গেছে। যেন তিনি পুরনো খোলস, সে-খোলস কাঁটায় আটকে রেখে তরতর করে সরে গেছে ওরা। গেছে শান্তির সন্ধানে, টাকায় চার সের গমের আশায়। কচি কচি সেই প্রাণগুলোর মধুর কলধ্বনি যেন কামরাটিতে এখনো গুঞ্জরিত হচ্ছে। লাফ দিয়ে তিনি কোল বাড়িয়ে কামরাটির দিকে ছুটে গেলেন। কিন্তু কোল ভরল না। যে-কোল এয়োতিরা ভক্তি ভরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পেটে হাত ঠেকাত, সে-কোল আজ শূন্য। শূন্য ঘরটা খাঁ খাঁ করছে। আতঙ্কিত হয়ে মা ফিরে এলেন। কিন্তু মনের সন্দেহ আর মেটাতে পারলেন না। টলতে টলতে তিনি অন্য ঘরে চলে গেলেন। এইখানেই তো জীবনের সাথি পঞ্চাশটা বছর কাটিয়ে চোখ বুজেছিল। তার কাফন-পরানো লাশ এইখানেই দরজার সামনে রাখা হয়েছিল। বাড়ির সমস্ত লোক তার চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার নসিবের জোর ছিল, আপনজনদের মাঝখানে গিয়ে পৌঁছেছে। কিন্তু জীবনের সাথিকে সে ফেলে গেছে। জীবনের সাথি তার আজ কাফনহীন লাশের মতো লা-ওয়ারিশ হয়ে পড়ে রয়েছে। পা দুখানা আর চলে না। বাবা যেখানে মারা গিয়েছিলেন, সেইখানটিতেই বসে পড়লেন মা। দশটি বছর তিনি এক কম্পিত হাতে মৃতের জায়গায় শিয়রে বাতি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ বাতির তেল ফুরিয়ে গেছে। বাতিও গেছে নিভে।

    সামনে রূপচাঁদজি নিজের বাড়ির বারান্দায় জোরে জোরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি একবার গালাগালি দেন, তারপর আবার জোরে জোরে পায়চারি করতে থাকেন। সবাইকে গালাগালি দিচ্ছেন তিনি। নিজের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, চাকর-বাকর, সরকার, সামনে প্রসারিত মূক রাস্তাটি, ইট-পাথর, ছুরি-চাকু– এমনকি গোটা সৃষ্টিই তাঁর গালাগালির বোমাবাজির সামনে ভয়ে কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে গাল দিচ্ছেন তিনি রাস্তার ওপারের খালি বাড়িটিকে। সে যেন তাঁকে মুখ-ভ্যাঙচানি দিচ্ছে, যেন তিনিই নিজের হাতে এর এক-একখানা ইট ভেঙে ফেলেছেন। কী একটা জিনিস যেন মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন তিনি। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে তিনি তাকে টেনে বার করে ফেলতে চাইছেন। কিন্তু না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। পারিবারিক সম্পর্কের রূপে যে জিনিসটি তাঁর ভেতর দৃঢ়মূল হয়ে বসে গেছে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে ধরে টানছেন তিনি। কিন্তু সেই সাথে যেন তাঁর মাংসও ছিঁড়ে চলে আসছে, আর, তিনি আর্তনাদ করে উঠে টান ছেড়ে দিচ্ছেন। তারপর হঠাৎ তাঁর গালাগালি বন্ধ হয়ে গেল। মোটর নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

    রাত্তিরে গলির মোড়টা নিস্তব্ধ হয়ে গেলে রূপচাঁদজির স্ত্রী খাবারসুদ্ধ দুখানা থালা ওপরে-নিচে করে সাজিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে চোরের মতো ভেতরে এসে ঢুকলেন। দুই বৃদ্ধাই নির্বাক। দুজনে মুখোমুখি বসে পড়লেন। মুখ বন্ধ রইল, চোখই সবকিছু বলতে আর শুনতে লাগল। থালা দুখানার খাবার যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল। মেয়েরা কারো নিন্দে করতে বসলে জিভ চলতে থাকে কাঁচির মতো। কিন্তু মনে আবেগ এলেই মুখে তাদের তালা পড়ে যায়।

    রাত্রির নিঃসঙ্গতায় দুশ্চিন্তার সীমা রইল না। রাস্তাতেই সব চুকে না যায়। আজকাল তো একটা-দুটো নয়, গোটা রেলগাড়ির সমস্ত লোককেই কেটে ফেলছে। পঞ্চাশ বছর ধরে রক্ত ছেঁচে ছেঁচে ক্ষেত আবাদ করেছে লোকে। আর, আজ তারা দেশ থেকে তাড়া খেয়ে পড়ি-কি-মরি করে নতুন জমির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। এই চারাগুলোর ভাগ্যে নতুন জমি জুটবে কিনা, কে জানে! শুকিয়ে তো যাবে না চারাগুলো! এরা দেশ-কাঙাল। ছোট বউয়ের তো খোদার মর্জি যখন-তখন। কোনো জঙ্গলেই প্রসব হয়ে যায় কিনা, কে জানে! ঘরবাড়ি, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য– সবকিছু ছেড়ে চলে গেছে ওরা। নতুন দেশে চিল-কাকে কিছু রাখলে হয় আবার! নইলে ওদেশের মুখখানা দেখেই ফিরে আসবে। তারপর ফিরে এসে নতুন করে শেকড় গাড়বার সুযোগ পায় কি না পায়। বসন্ত ফিরে আসতে আসতে এই বুড়ো গুঁড়িতে জান থাকবে কিনা, তাই-বা কে বলতে পারে!

    পাগলের মতো দেয়ালে আর দরজার কোণায় হেলান দিয়ে বসে উলটে-পালটে কত কথাই যে দুজনে বললেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে! তারপর শ্রান্ত হয়ে গা এলিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘুম আসে কই? সারারাত জোয়ান ছেলেদের কাটা লাশ, কাঁচা বয়েসী বউদের আহাজারি আর নাতি-নাতনির ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে মা’র জরাগ্রস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। এরই মধ্যে কখন জানি তন্দ্রা এসে পড়েছিল। হঠাৎ মনে হল, দরজার সামনে সারাদিনের হাঙ্গামা ভেঙে পড়ল বুঝি-বা। প্রাণের মায়া নাই-বা থাক। তবু, তেলহীন প্রদীপও নিভবার আগে একবার কেঁপে ওঠেই। সাদাসিধে মরণই বা কী এমন স্বাদের জিনিস। তার উপর আবার মানুষের প্রেত হয়ে আসে! শুনেছি, বুড়িদেরও চুল ধরে রাস্তার ওপর হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়। এমনকি, ছাল ছড়ে গিয়ে হাড় বেরিয়ে পড়ে। তারপর যে আজাবের কথায় দোজখের ফেরেশতারও মুখ শুকিয়ে যায়, পথের উপরেই সেই আজাব নেমে আসে।

    ঘন ঘন টোকার আওয়াজ উঠছে দরজায়। মালেকুল-মউতের তাড়াতাড়ি পড়েছে যে! তারপর, আপনা-আপনিই সমস্ত ছিটকিনি খুলে গেল, বাতিগুলো জ্বলে উঠল এবং দূরে কোন অতল থেকে কার যেন আওয়াজ এল। বোধহয়, বড় ছেলে ডাকছে। না, এ ছোট্ট সেজো ছেলের ডাক। আর এক জগতের শূন্য কোনো কোণ থেকে ডাক আসছে।

    তাহলে পেয়েছে সবাই দেশ? এত শিগগির? এখানে সেজো ছেলে, তারপর ছোটটি। পরিষ্কার দাঁড়িয়ে আছে। কোলে ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বউয়েরা। তারপর হঠাৎ সারা বাড়ি প্রাণ ফিরে পায়। সমস্ত প্রাণ জেগে উঠে দুখিনী মা’র চারপাশে ভিড় করে দাঁড়ায়। ছোট-বড় হাত ভালোবাসায় দুলতে থাকে। সহসা শুকনো ঠোঁটে ছোট ছোট কুঁড়ি ফুটে ওঠে। পরিপূর্ণ আনন্দে সারা চেতনা আত্মহারা হয়ে অন্ধকারে পাক খেতে খেতে তলিয়ে যায়।

    চোখ যখন খুলল, কব্জিতে পরিচিত আঙুল নড়ে বেড়াচ্ছে।

    : ও ভাবী, আমায় এমনি ডেকে পাঠিও, আমি চলে আসব। এরকম ঢং কর কেন? পর্দার আড়াল থেকে রূপচাঁদজি বলে চলেছেন।– আর, ভাবী, আজ ফি দিয়ে দাও তো। এই দেখ, তোমার কুপুত্তুরদের কলোনি জংশন থেকে ধরে এনেছি। পালাচ্ছিল, বদমাশের দল কোথাকার! পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্টকেও বিশ্বাস করছিল না।

    আবার জরাগ্রস্ত ঠোঁটে কুঁড়ি ফুটে উঠল। মা উঠে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর রূপচাঁদজির লোলচর্ম হাতের উপর দুটি উষ্ণ মুক্তাবিন্দু ঝরে পড়ল।

    অনুবাদ : আতোয়ার রহমান

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
    Next Article এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }