Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    লেখক এক পাতা গল্প766 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩.১২ কোল্ড ওয়েভ – খাজা আহমদ আব্বাস

    কোল্ড ওয়েভ – খাজা আহমদ আব্বাস

    বলদেব যেখানটায় বসেছিল তার সামান্য দূরেই ফকিরটি বসে বসে বড় করুণ আর প্রকম্পিত স্বরে বিড়বিড় করতে লাগল– ‘বড় কনকনে ঠাণ্ডা বাবা, গরিবকে একখানা কম্বল দিয়ে যাও; ভগবান তোমার মঙ্গল করবে বাবা।’ এবং যেহেতু ফকিরটি অন্ধ, অতএব সে জানে না রাত তখন গম্ভীর হয়ে গেছে। সমস্ত ক্যানাট প্যালেস নীরব, নিস্তব্ধ, কোথাও একটি পথিকের টিকিটিও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।– ফকিরটি যে শব্দ শুনে কাতর মিনতি জানিয়েছিল ওটা কোনো মানুষের পদশব্দ নয়। হাওয়ায় দোল-খাওয়া ছেঁড়া কাগজ এবং শুকনো পাতার শব্দ।

    দমকা হাওয়া একখানা পুরনো খবরের কাগজের পাতা উড়িয়ে নিয়ে এল। আর বলদেব ব্যস্ত হয়ে ওটা ধরে ফেলল। হয়তো-বা কাগজখানা চাদরের কাজ দিতেও পারে নিছক এই খেয়ালে। কোনো এক উপন্যাসে সে যেন পড়েছিল। পড়েছিল শীতবহুল দেশে যেসব গরিবদের গরম জামাকাপড় থাকে না, তারা জামার নিচে বুকের উপর খবরের কাগজ লাগিয়ে নেয়। আজকে হয়তো-বা সেও তাই করবে। কিন্তু যখনি খবরের কাগজখানা হাতে এসে পৌঁছল, সে আশ্চর্য হয়ে দেখল প্রতিটি কলামের কিছু না কিছু অংশ কাটা। অতি সাবধানে যেন ধারালো কাঁচি অথবা ব্লেড দিয়ে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং বিজ্ঞাপনগুলো কেটে রেখে দিয়েছে। এখন তো এই দুটি পাতায় ডজনেরও বেশি জানালা হাঁ করে আছে। বলদেব ভাবল, এই কাগজের চালুনি তীক্ষ্ণধার ঠাণ্ডা বাতাস কীভাবে রোধ করবে! পত্রিকাটা খুলেই দেখল ওটা দু-তারিখের। প্রথম পৃষ্ঠায় তার চোখে পড়ল– ‘স্থানীয় আবহাওয়া’। কাঁচিচালকের সন্ধানী দৃষ্টি থেকে এ অংশটুকু কীভাবে যে রক্ষা পেয়ে গেছে কে জানে। লাল অংশটুকুর নিচে লেখা,– ‘দিল্লি ৬ জানুয়ারি, মহকুমা আবহাওয়ার সরকারি খবরে প্রকাশ, আগামী দুইদিন পরই দিল্লি এবং তার আশপাশ অঞ্চলে কঠিন ‘কোল্ড ওয়েভ’ অর্থাৎ কনকনে ঠাণ্ডা পড়িবে। কারণ শিমলার পাহাড়গুলোতে বরফ তৈয়ার করা হইতেছে। এই বছর দিল্লিতেও অন্যান্য বৎসরের তুলনায় অধিক ঠাণ্ডা পড়িবে বলিয়া অনুমান করা যাইতেছে। এই জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ারও আশঙ্কা করা যাইতেছে।’

    এরপরের অংশটুকু পড়ার প্রয়োজন নেই বলদেবের। এ বছর দিল্লির ঠাণ্ডার ওপর সে এর চেয়েও অধিক বিশ্লেষণ করে মর্মস্পর্শী ভাষায় রিপোর্ট লিখতে পারে।

    প্রতিদিন টেম্পারাচার নিচের দিকেই নামতে থাকে। রাতে তো এমন বরফ পড়তে শুরু করে যে, সকালে উঠে দেখে কুয়া আর পুকুরের পানির উপর পাতলা বরফ জমে আছে। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক হচ্ছে হাওয়া– যেগুলো শিমলা থেকে আসছিল। বলদেব ভাবল– আমি জানতাম না হাওয়াও যে বরফের মতো ঠাণ্ডা আর ব্লেডের মতো তীক্ষ্ণধার। আর এত চালাক যে, বারান্দার কোণে, দেয়ালের আড়ালে অথবা সিঁড়ির নিচে লুকোলেও সে ঠিক ধরে ফেলবে এবং বুকের উন্মুক্ত অংশ, কলার এবং আস্তিন দিয়ে প্রবেশ করে চামড়া মাংস ধরে একেবারে হাড়ে গিয়ে পৌঁছে যাবে।– কথাটা বারকয়েক ভাবল বলদেব। ভাবল, এ বছরের শীতকে নিয়ে অর্থাৎ ‘কোল্ড ওয়েভ’কে নিয়ে গোটা কয়েক কবিতা লিখে ফেললে কেমন হয়। বেশ সুন্দর করে– যাতে প্রয়োজনের সময় (অর্থাৎ মৃত্যুর পর) কাজে লাগে। কিন্তু এই কনকনে শীতে রক্ত, মন-মেজাজ উভয় জমে যায়, চিন্তা আর অনুভূতির সূত্র বরফ হয়ে যায় এবং মানুষের ধ্যান-ধারণা চিন্তার পরিবর্তে জড়িয়ে যায়।

    সে ভাবল, এভাবেই যদি ঠাণ্ডা পড়তে থাকে তাহলে আমার শিরার সমস্ত রক্ত জমে যাবে। মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। আমার স্মরণশক্তি, অনুভূতি, অন্তর্দৃষ্টি সবকিছুই ঠাণ্ডার কবলে বেকার হয়ে পড়বে। অথচ আমার কিছু করা প্রয়োজন। কিছু বলা প্রয়োজন। এবং যদি না-ও পারি তাহলেও এই অন্ধ ফকিরটির মতো বিড়বিড় করা প্রয়োজন– ‘বড় কনকনে ঠাণ্ডা বাবা, একখানা কম্বলের প্রশ্ন, ভগবান তোমার মঙ্গল করবে।’

    কিন্তু না, সে ফকির নয়। একজন কবি, একজন অনুভূতিশীল, বিচক্ষণ, শিক্ষিত যুবক। সে কোনো অন্ধ ফকির নয় যে, প্রকম্পিত স্বরে বিড়বিড় করবে। কিন্তু কে জানে হয়তো-বা আমার স্বরও ঠাণ্ডায় জড়িয়ে গেছে, হয়তো-বা আমার মুখ থেকেও কাঁপা কাঁপা স্বর বেরুবে। কিছু একটা বলে যে পরীক্ষা করা দরকার!– সুতরাং সে বলল, ‘সুরদাসজি, কার কাছে মিনতি করছ। এখানে তো সমস্ত কিছুই এখন ঘুমে অচেতন।’– এবং সে অনুভব করল, ঠাণ্ডার তীব্রতায় তার দাঁত কটাকট করে শব্দ তুলেছে। আর ফকিরের গলার আওয়াজের মতো তার আওয়াজও কম জড়িয়ে যায়নি। সে বেচারা ছিল অন্ধ। অতএব সে দেখতে পায়নি, প্রশ্নকর্তার পরনে ফ্লালিনের পাতলুন, গায়ে রেশমীর জামা এবং প্রশ্নকর্তা একজন শিক্ষিত বিচক্ষণ যুবক। অথচ ফকিরটি ভাবল, এ-ও ফকির। ‘কোনো চক্ষুষ্মান ফকির, আমার আড়ালে বসে আছে। অতএব এখানে আর আমার কিছু পাবার আশা নেই। এদিক থেকে যেই আসবে সব পয়সা সেই নিয়ে নেবে আগে।’ অতএব নিজের লাঠি এবং নিচে পাতানো কাপড়টা তুলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। এবং ক্যানাট প্যালেসের কামানের মতো বারান্দায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত লাঠির আওয়াজ খট্ খট্ শব্দ তুলে মিলিয়ে গেল, বরং বলা যায় রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে বিলীন হয়ে গেল।

    ঠাণ্ডার সাথে সাথে বলদেবকে নিঃসঙ্গতাও আক্রমণ করল। সে ভাবল– নিঃসঙ্গতাও একরকমের ঠাণ্ডা। অথবা ঠাণ্ডাও একরকমের নিঃসঙ্গতা। যেখানে কোনো সঙ্গী থাকে না, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়তমা থাকে না এবং থাকে না বাজারের জনকোলাহল– সেখানে নিঃসঙ্গতাও নিজের মধ্যে একরকমের হিমশীতলতা এনে দেয়।–শোনা যায়, একটা নরক হবে– সেখানে পাপীদের আগুনে পোড়ানো হবে না। বরফের শেলের উপর শুইয়ে দেবে। এবং আরেকটা নরক এর চেয়েও ভয়ানক। সে নরকে পাপীদের একটি বদ্ধকক্ষে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বছরের পর বছর আবদ্ধ করে রাখবে। আর বলদেব ভাবল, আমি এমন এক নরকে এখন আছি– যেটা ঠাণ্ডাও এবং নিঃসঙ্গও। এবং অনুভূতির প্রবল চাপে নিঃসঙ্গতার কঠিন অনুভব বরফমাখা বিজলির মতো তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল।

    আমার কিছু করা দরকার। সে ভাবল– না হয় ঠাণ্ডা আর নিঃসঙ্গতায় আমি পাগল হয়ে যাব। আমার কিছু বলা দরকার- কিছু ভাবা দরকার– না হয় মস্তিষ্ক বরফের মতো জমে একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। যেরকম পানির উপর জমে যাওয়া ভারি বরফ ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর এ-ও ভুলে যাব যে, আমি কে, আমি কী, আমি কোথায় এবং কেন?

    আমি কে? আমি কী?

    আমি বলদেবরাজ শর্মা, জাতফাত বিশ্বাস করি না– কিন্তু জন্ম থেকেই ব্রাহ্মণ। মিরাট কলেজের গ্রাজুয়েট। আমার বাবা ওকালতি করে মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করেন। স্বাধীনতা পাওয়ার আগে রায়বাহাদুর রবণীরাজ শর্মা, বি.এ., এল.এল.বি. অ্যাডভোকেট হাইকোর্ট বলে ডাকত। এখন শুধু পণ্ডিত রবণীরাজ শর্মা বলেই ডাকে। আমি শুধু বাবার ছেলেই নই,– নিজেও কিছু। মানুষের ধারণা রঙ-চেহারা আর শরীরে আমি অদ্বিতীয়। তাছাড়া আমার অধ্যাপকদের বক্তব্য হচ্ছে– আমি তীক্ষ্ণ প্রতিভাসম্পন্ন, যদিও মাত্র দ্বিতীয় বিভাগে বি.এ. পাস করেছি। তবে এর কারণ, আমি কলেজের অন্যান্য অনুষ্ঠানাদিতে অবাধে অংশ নিতাম। ডিবেটিং সোসাইটি, টেনিস ক্লাব, ড্রামেটিক ক্লাব, মিটিং, কবিতা আবৃত্তি প্রভৃতি ছাড়াও আমি নিজেও ছিলাম একজন কবি। আমার ছদ্মনাম ছিল নির্মল। আমাকে আবৃত্তি অনুষ্ঠানে জনাব নির্মল মিরাঠি নামে ডাকত। কোথাও কোথাও পণ্ডিত নির্মলজি বলেও সম্বোধন করত। বলা হত আমার গজল আর কবিতায় প্রেমের বর্ণনা এমন তীব্রতা লাভ করত এবং সৌন্দর্য বর্ণনা এমন পূর্ণতা পেত– যা আমার সমসাময়িক কোনো তরুণ কবিদের কবিতায় পাওয়া যেত না।

    আমি কোথায়? এবং কেন?

    আমি এখন আমার বাবার সুরম্য প্রাসাদে নেই– যেখানে এখন আমার বেডরুমের আতসদানে হয়তো-বা আগুন জ্বলছে, স্প্রিংয়ের পালঙ্কে নরম কম্বল এবং রেশমি লেপ শোভা পাচ্ছে। হয়তো-বা শিয়রে সিল্কের চীনা স্লিপিং স্যুট ঝুলছে। কাশ্মিরি দর্জির তৈরি রেশমি ড্রেসিং গাউন এবং আলমারিতে মিলটন, বায়রন, কালিদাস ও গালিবের বাঁধানো পুস্তকের পেছনের ব্র্যান্ডির বোতলও আগের মতো হয়তো-বা পড়ে রয়েছে।

    আমি এখন রাধার কুঠিতেও নই। সেখানে নৃত্যানুষ্ঠান হয়তো-বা জমকালোভাবে জমে উঠেছে এবং রক্তগরমকরা মদের পালা চলছে। আর একমাত্র আমি ছাড়া মিরাটের অন্যান্য সব শৌখিন মেজাজের অভিজাত যুবকেরা এগিয়ে গিয়ে প্রশংসায় ফেটে পড়ছে। আর রাধা সম্ভবত আমারই রচিত কোনো গজল অথবা আমারই নির্দেশিত কোনো ঠুমরি গেয়ে শুনাচ্ছে। রাধা…! যার সাথে আমার এত প্রণয় ছিল যার দরুন আমি ঘর ছেড়েছি। বাবা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু আমি ভ্রূক্ষেপ করিনি। গায়ের সেই এক জামা এক পাতলুন নিয়েই আমি হন্ হন্ করে চলে এসেছি। আর আমার মা উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ে পেছনে থেকে আমাকে ডাকতে থাকলেন। কিন্তু আমার কানে তখন রাধার রহস্যময় ঘুত্রুর ছন্‌ছনানি বাজছিল। আমি সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিলাম যে, আমি প্রমাণ করব কবিরা শুধু প্রেমের বর্ণনাই দেয় না, প্রেমও করে এবং মনপ্রাণ ঘরদোর সবকিছুকেই ছাড়তে পারে। রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি মজনু, শিরি-ফরহাদ, চারুদত্ত এবং বসন্ত সীতা এরা সব তো শুধুমাত্র কাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু নির্মল ও রাধা, রাধা ও নির্মল সত্যিকার প্রেমের আগুনে পুড়ে এ পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবে। অতএব আমি সেই পোশাকেই– পাতলুন আর জামা পরে বাজার হয়ে রাধার কুঠিতে এসে পৌঁছি। তখন আমার কাছে ঠাণ্ডা তেমন অনুভূত হয়নি। তৃতীয় প্রহরে সোনালি রোদে মোড়া ছিল এই বিশ্বপ্রকৃতি, এবং যৌবনের উত্তপ্ত রক্তও বয়ে চলেছিল আমার শিরায় শিরায়। আমার হৃদয় প্রেমরোগে আক্রান্ত এবং আমার বিশ্বাস ছিল (কেননা রাধা আমাকে বিশ্বাস করিয়েছিল) সে-ও আমার মতো প্রেমাগ্নিতে জ্বলছে।

    রাধা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আতসদানে নিজের লম্বা ঘন কালো চুল শুকাচ্ছিল। আতসদানের প্রজ্বলিত অঙ্গারের গোলাপি প্রতিচ্ছায়া ফুটে উঠেছে তার রক্তিম গণ্ডদ্বয়ে। আমি ভাবলাম– রাধার ভালোবাসা যার সৌভাগ্যে আছে– তার কাছে তীক্ষ্ণধার ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কোনো ভয় নেই। পৃথিবীর যে-কোনো বিপদের মোকাবেলা করতে পারে।

    ‘আসুন আসুন নির্মলজি।’ রাধা পেশাগত হাসিতে আমায় অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু সাথে সাথেই নিজের বড় বড় চোখজোড়া তুলে যখন সে আমার দিকে তাকাল– তার মধ্যেও আমি দেখতে পেলাম যেন প্রেমের উষ্ণ মদ টপ্‌কাচ্ছে।

    ‘রাধা তোমার জন্য আমি ঘর ছেড়ে দিয়েছি। বাবা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছেন। ওঠ, চল আমার সাথে, আমার দিল্লি গিয়ে বিয়ে করে ফেলব…

    ‘এবং খাব কী?’

    ‘আমি চাকরি করব। তুমি চাও তো রেডিওতে গাইতেও পার।’

    ‘নির্মল, তুমি বড্ড ভুল করছ। তুমি বোধহয় জান না সরকারি রেডিওতে কোনো বাইজি গাইতে পারে না। যাও প্রাণনাথ, বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও গে। কেন লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি পা দিয়ে ঠেলে দিচ্ছ!’

    ‘শুধু এজন্যে যে, আমার কাছে সম্পত্তির চেয়েও প্রিয় তুমি। রাধা, আমি ইস্কুলে মাস্টারি করব, কেরানিগিরি করব, কিন্তু সেই ঘরে আর ফিরে যাব না– যে ঘরে তোমাকে স্ত্রী করে রাখা যাবে না।’

    ‘তো যাও বাবু, যা ইচ্ছে করগে। কিন্তু আমি এই লাইলি-মজনু নাটকের নায়িকা হতে প্রস্তুত নই।’– পরে সে এমন এক স্বরে বলল– যা বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা, তরবারির চেয়েও তীক্ষ্ণধার– ‘তুমি এখন যাও বাবু, আমাকে এখন ড্রেস করতে হবে। কাজের সময় হয়ে এল।’

    অগত্যা তার কুঠি থেকে নেমে এলাম। তখন রোদ পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। সম্মুখের পার্কের পাতায় ঠাণ্ডা বাতাস ঈষৎ কাঁপন তুলেছে। আমার শরীরেও সে বাতাস এক অদ্ভুত শিরশির জাগিয়ে তুলল। এবং এই প্রথমবারের মতো আমার মনে পড়ল ঘর থেকে আমি কোট অথবা পুলওভার ছাড়াই বের হয়েছি।

    গতকালের ঘটনা মাত্র। কাল– ত্রিশ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। আর এখন আমি মিরাট থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে নয়াদিল্লিতে। কিন্তু এই সময়ের ব্যবধান আর দূরত্বের ব্যবধান আমার গোটা পৃথিবীটাই পাল্টে দিয়েছে।

    কালকেও আমি ছিলাম এক ধনীপুত্র, একজন নিশ্চিন্ত যুবক। সমাজের স্বীকৃত আর সম্মানিত ব্যক্তি। পিতারা নিজের পুত্রের সামনে আমার বুদ্ধিমত্তা এবং যোগ্যতার প্রশংসা করত। প্রতিটি মা-ই নিজের কন্যাকে আমার কাছে বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কলেজের কত মেয়ে আমার নামে পাগল ছিল। দুটো কথা বলার জন্য কত ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিত। আমার আজ–! আজ আমি একজন বেকার, আশ্রয়হীন ভবঘুরে–! যার পকেটে না আছে পয়সা না আছে শরীরে একখণ্ড গরমবস্ত্র। আর যে কিনা ক্যানাটপ্যালেসের বারান্দায় থামের কাছে ঠাণ্ডা পাথরের বিছানায় বসে বসে কাঁপছে। দাঁত কড়কড় করছে। শিরায় শিরায় রক্ত জমে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে জড়িয়ে আসছে… হতেও পারে এটা আমার একগুঁয়েমিরই ফল। ফিরে গিয়ে যদি বাবার পায়ে পড়তাম তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করে দিতেন। তখন আমিও হয়তো-বা একসময় পশমি ড্রেসিং গাউন পরে আতসদানের কাছে বসে বসে ব্যান্ডি পান করতাম। কিন্তু আতসদানের উষ্ণতার চেয়েও বেশি প্রয়োজন আমার প্রেমের উষ্ণতার। আমি তারই প্রত্যাশী। আমার দেহের চেয়েও বেশি কাঁপছে আমার হৃদয়। কেননা দেহে অন্তত একটা গেঞ্জি এবং একটা জামা আছে। কিন্তু গত ত্রিশ ঘণ্টায় আমার হৃদয় থেকে এক এক করে সমস্ত কাপড় খুলে ফেলেছি। এবং এখন সে স্বভাবতই বস্ত্রহীন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুগের বরফমাখা বাতাসে কাঁপছে।

    মিরাট থাকলে বাবার দুর্নাম বাড়বে, অতএব দিল্লি চলে এলাম। স্টেশনে থার্ডক্লাস ওয়েটিংরুমে রাতটা কোনোরকমে কাটালাম। এবং এই প্রথম অনুভব করলাম গরিব আর সাধারণ মানুষ থার্ডক্লাসে ভ্রমণ করতে গিয়ে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হয়। নিচে মানুষ এমনভাবে পড়ে আছে যেন যুদ্ধের ময়দানে মৃতদেহ পড়ে আছে। পায়খানার দুর্গন্ধে প্ৰাণ ওষ্ঠাগত একাধিক নাসিকা-ধ্বনির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু গাড়িতে একনাগাড়ে একঘণ্টা তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস খাওয়ার পর ওয়েটিংরুমের এই উষ্ণতা আমার জন্য কত মধুর। মেঝেতে একখানা পুরনো কাগজ পেতে আমি শুয়ে থাকলাম। সারাদিনের উত্তেজনা আর কোলাহলের ভারে পর্যুদস্ত দেহে ঘুমের নামগন্ধও নেই। তবুও আমি আশ্বস্ত; এখানে ঠাণ্ডা নেই। এবং তখনি, ঠিক তখনি আমার মনে পড়ল এখানে কোনো আতসদান নেই, শরীর গরম করার কোনো উপাদানই এখানে নেই। এই সুন্দর উষ্ণতা মানুষের দেহের সংবদ্ধ উত্তাপ– যা এ মুহূর্তে সকলের মৃত প্রাণ সজীব করে তুলছে। আমি ভাবলাম,– এই সুবৃহৎ ওয়েটিংরুমে আমি একা হলে মরেই যেতাম। হয়তো-বা প্রত্যূষে এখান থেকেই আমার মৃতদেহ বেরুত। এই আড়াইশো-তিনশো লোক এই কৃষকের দল, ছোটখাটো বাবু, ভারবাহী, রেলওয়ের ছোট চাকুরে, ফকির, সাধু– এদের সকলেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমার প্রাণটা বেঁচে গেছে। তদ্রূপ আমিও নিজের দেহের উত্তাপ দিয়ে তাদের চাঙ্গা করার প্রয়াস পেয়েছি। এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমি ভাবতে থাকলাম, এই ওয়েটিংরুমে, এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত-নিদ্রিত মানুষের মধ্যে তাদের এই আকাশফাটা নাসিকা-ধ্বনির মধ্যে, এই সজীব করা উষ্ণতার মধ্যে এমন কী দার্শনিক সূক্ষ্মতা লুকিয়ে আছে! এমন সময় ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজার সময়-সংকেত এসে যুক্ত হল একরাশ নাসিকাধ্বনির মধ্যে। এবং সম্মুখের প্রলম্বিত দুটি ইস্পাতের উপর দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলে একটি ইঞ্জিন চলে গেল সুদূরের পানে। আর তার চেয়েও এক ভীতিপ্রদ স্বরে হাঁক দিয়ে উঠল স্টেশনের বড়বাবু,– ‘হেই পাহারাদার, মৃত লোকগুলোকে জাগিয়ে দাও। চলাফেরা করার জন্যও একটু জায়গা রাখে না– যেন তাদের বাবার ঘর।’

    আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং বেরিয়ে পড়লাম। বাইরের বিশ্বপ্রকৃতি নীরব নিস্তব্ধ। দারুণ ঠাণ্ডা পড়ছে। রাস্তার আলো একটা একটা করে নিভতে শুরু করেছে।

    কত বন্ধুর বাড়ি ধরনা দিলাম। প্রথমে রামদয়ালের বাড়ি। রামদয়াল এককালে আমার সাথে পড়ত। চাঁদনিচকে তার বাবার একখানা বড় কাপড়ের দোকান ছিল। আমাকে দেখেই অত্যন্ত হৃদ্যতার সাথে অভিনন্দন জানাল রামদয়াল।

    ‘এস বন্ধু নির্মল, আগে নাস্তাটা হয়ে যাক। পরে প্রোগ্রাম তৈরি করছি। কী বল নিৰ্মল মর্নিং শো একটা হয়ে যাক। ‘দিল দেকে দেখো’– সম্বন্ধে তোমার কী অভিমত! বন্ধু, ওই যে আশা পারেখ না– আগুন, সাংঘাতিক আগুন! আমি তো ফিল্মটা ইতোমধ্যেই তিনবার দেখে ফেলেছি। আজ তোমার সাথে আবার দেখি, কী বল!’

    আমি বল্লাম, ‘বাবার সাথে ঝগড়া করে আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি। তিনি বলেছেন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন। সুতরাং আমি চাকরির খোঁজে দিল্লি এসেছি।’

    অকস্মাৎ বন্ধু দমে গেল। নিতান্তই নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা ভাই চেষ্টা করব। তুমি বরং এক কাজ কর, পরশু আমার সাথে দেখা কর। আজ আমার একটা জরুরি কাজ আছে। বাবা আজকাল দোকান থেকে উঠতেই দেন না।’

    আবার পথে নামলাম আমি। চাঁদনি এসেই দেখি সমস্ত আকাশ মেঘে ছেয়ে ফেলেছে এবং মিউনিসিপ্যাল পার্কের সব গাছপালা ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।

    সেখান থেকে সোজা আমজাদের ওখানে এলাম। তার বাবা জুতোর ব্যবসা করেন। তাদের বাড়ি ছিল হিলিমারান। গিয়ে দেখি দালানে দস্তরখান পাতানো। তাতে পরোটা, তরকারি, গাজরের হালুয়া এবং শুকনো ফল সাজানো। চায়ের কেটলি থেকে গরম গরম ধোঁয়া উড়ছে। আমজাদও এককালে আমার সহপাঠী ছিল। তার সাথে আমার বেশ ভাবও ছিল। প্রথমেই আমি বেশ ডাঁটের সাথে নাস্তা-পর্বটা শেষ করলাম। পরে আমজাদকে বললাম– ‘বন্ধু পঁচিশটা টাকা ধার দে, আট-দশ দিনের মধ্যে দিয়ে দেব।’

    সে বলল– ‘হাঁ, হাঁ,… কিন্তু ব্যাপারখানা কী, টাকার এমন কী প্রয়োজন হয়ে পড়ল হঠাৎ!’ পরে যখন সব অবস্থা জানালাম তখন তার কণ্ঠস্বরও মালাইয়ের বরফের মতো মোলায়েম আর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বলল, ‘আজকাল পয়সার একটু টানাটানিতে আছি নির্মল। টাকা-দুটাকা চাস তো দিয়ে দিই!’

    পুরনো দিল্লি থেকে নয়াদিল্লি পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম। প্রায় দুপুরের দিকে হরবচনের কুঠিতে গিয়ে পৌঁছলাম। হরবচন সিংয়ের পিতা ‘গভর্নর অব ইন্ডিয়া’র ডিপুটি সেক্রেটারি। হরবচন পড়ত দিল্লি কলেজে। কিন্তু টেনিস টুর্নামেন্টেই তার সাথে আমার বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। ডবল টেনিসে সে আমার পার্টনারও ছিল। আর আমরা বরাবরই জয়লাভ করেছিলাম।

    কিন্তু হরবচন ঘরে নেই। বাইরে গেছে। জিগ্যেস করে জানতে পেলাম চিমসফোর্ড ক্লাবে টেনিস প্র্যাকটিস্ করতে গেছে। সুতরাং ক্লাবে গিয়ে দেখি হরবচন টেনিসের বদলে কার্ডরুমে বসে বসে ‘রামি’ প্র্যাটিস্ করছে।

    ‘হ্যালো নির্মল-বয়।’ সে চেঁচিয়ে উঠল– ‘এস বস, বল কী পান করবে!

    আমি বললাম, ‘তোমার সাথে নিরালা কিছু কথা বলতে চাই।

    রাউন্ড শেষ করে সে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এল। –‘কেন, কী ব্যাপার!

    তাকেও আমি সমস্ত ঘটনাটা জানালাম।

    ‘Sorry old boy–’সে বলল, –‘তা চাকরি এখানে একদিনের মধ্যে পাওয়া দুষ্কর। সুপারিশের জোরেও অন্তত এক মাস ধরবে গিয়ে। আমি বলি, বরং বাড়ি ফিরে যা। মিরাটের ভাড়ার প্রয়োজন হলে আমিই দিচ্ছি।’

    আমি বললাম, ‘নো, থ্যাঙ্কয়ু হরবচন।’

    ‘আচ্ছা আমি চলি, আমার পার্টনার অপেক্ষা করছে।’

    ক্লাব থেকে বেরিয়ে দেখি শুধু মেঘে ছেয়ে ফেলেনি, দু-এক ফোঁটা করে পড়তেও

    শুরু করেছে।– সামনে একখানা খালি ট্যাক্সি যচ্ছিল। আমাকে দেখে ড্রাইভার গতি কমিয়ে দিল।

    ‘ট্যাক্সি বাবুজি!’

    ‘হাঁ, তা তো চাই!’

    ‘যাবেন কোথায়!’

    ‘মিরাট।’

    ‘এতদূর যাওয়া-আসা পঞ্চাশ টাকা লাগবে।’

    আমি বললাম, ‘তা-ও দিয়ে দিতাম, কিন্তু আজ শনিবার, ব্যাংক বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে।’ বলতে বলতে আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।

    ড্রাইভার তখন তার সঙ্গীকে বলল, ‘বন্ধু গরমে মানুষ পাগল হতে শুনেছি, শীতে পাগল আজই দেখলাম।’

    ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমি এমপ্লয়মেন্ট একচেঞ্জে এসে পৌঁছলাম। সব অফিস ঘুরলাম। দোকানপাট সব জরিপ করলাম, কিন্তু একজন বি.এ.পাস সুস্থসবল বুদ্ধিদীপ্ত যুবকের জন্য কোনো চাকরি নেই। সন্ধ্যাও ক্রমশ ঘনিয়ে আসতে লাগল, সাথে সথে ঠাণ্ডা ও বাড়তে শুরু করল। টেম্পারেচার নামতে থাকল আর আমার হৃৎকম্প বাড়তে থাকল।

    এখন রাত অর্ধেক চলে গেছে। ক্যানাট-প্যালেসে একরাশ নীরবতা জমাট বেঁধে আছে। শিমলা থেকে আগত ঠাণ্ডা হওয়ায় গা শিরশির্ করছে। বলা হয়েছে কোল্ড ওয়েভ (Cold wave ) আসবে। বোধহয় এসে গেছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ার ভয় আছে। বুকেও একরকমের ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। আমি এবং আমার আত্মা এই বরফমাখা নিস্তব্ধতায় উলঙ্গ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছি, কিন্তু আত্মার তো নিউমোনিয়া হতে পারে না!

    ‘বাবু–!’

    দৃঢ় অথচ চাপা একটা কণ্ঠস্বর বলদেবের চিন্তার সূত্র ছিন্ন ভিন্ন করে দিল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বারান্দার আরেকটি থামের আড়ালে একটি ভিখারিনি বসে বসে ঠাণ্ডায় কাঁপছে।

    ‘ম্যাচ আছে বাবু–?‘

    বলদেব পাতলুনের পকেটে হাত ঢোকাল। সিগ্রেট তো সেই কখন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ম্যাচ-বাক্সে এখনো গোটা দু-তিনেক কাঠি রয়ে গেছে। ম্যাচটা নিয়ে সে ভিখারিনির দিকে ছুঁড়ে দিল।

    ভিখারিণি ম্যাচ জ্বালাল। এক মুহূর্তের জন্য তার চেহারায় আলো চমক মেরে গেল। কুচকুচে কালো, যেন সাপ। সমস্ত দেহে কয় মাসের ময়লার আস্তরণ জমেছে কে জানে। মাথায় একরাশ ধুলো মাখা।– ‘তওবা তওবা, কী বিশ্রী।– বলদেব ভাবল, এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে হয়।

    বিড়ির ক্ষীণতম অগ্নিকণা ভিখারিনিটির প্রকম্পিত দেহে যেন নবজীবনের সঞ্চার করল। বলদেব দেখল, এখন সে আর কাঁপছে না। নিশ্চিন্তে একটা টান মেরে ধোঁয়া উদ্‌গীরণ করতে করতে বলল– ‘বাপরে বাপ, কী ভয়ানক ঠাণ্ডা। কী বল বাবু, বিড়ি খাবে।’

    বলদেব ভাবল, না করে দেয়, ভিখারিনির ময়লা ঠোঁট-স্পর্শ-করা বিড়ি।

    কিন্তু ভিখারিনিটি আবার তাড়াতাড়ি বলে উঠল ‘এটাই তো সবচাইতে শ্ৰেষ্ঠ প্ৰতিদান বাবু, তোমার ম্যাচ আমার বিড়ি– এ নাও।’– বললেই সে বিড়ির প্যাকেট তার দিকে ছুঁড়ে দিল এবং নিজেও সরে এসে তার পাশে বসল। ম্যাচে আগুন ধরিয়ে সে বলল, ‘নাও, বিড়ি জ্বালাও।’

    জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে তার হাতখানা বলদেবের চেহারার কাছে এসে থামল। আর আশ্চর্য হয়ে তার চেহারা দেখতে থাকল। সে আশ্চর্য হয়ে ভাবছিল– এই ময়লা অথচ রেশমি জামাপরা লোকটি ভিখারিদের এই বিড়ম্বিত জীবনে কীভাবে এসে পড়ল। এবার বলদেব তার চেহারাখানা অতি নিকট থেকে দেখার সুযোগ পেল। কালো রং, একরাশ ময়লার নিচে এবং তার ছোট ছোট চকচকে চোখজোড়ার নিচে এমন একরকমের চাপা আগুন ছিল– যা ম্যাচের ক্ষীণ আলোয় আরো জ্বলে উঠল। উদ্‌গতবক্ষে যৌবনের স্বভাবজাত সাক্ষী দুটো ঈষৎ কাঁপছে। এবং তার দেহ থেকে এক অদ্ভুত গন্ধের আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে– যার ভেতর ময়লা, ঘাম, দারিদ্র্য, যৌবন, কামনা এবং আমন্ত্রণ সবকিছুই মিশে একাকার হয়ে গেছে–। তারা উভয়ে একে অন্যকে দেখতে থাকল। এমনকি ম্যাচের কাঠি জ্বলতে জ্বলতে ভিখারিনিটির আঙুল পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিল। তারা উভয়ে আবার সেই একরাশ কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেল। আর বলদেব একটা উষ্ণ নিশ্বাসের তপ্তস্পর্শ অনুভব করল নিজের চেহারায়। কিন্তু পরমুহূর্তে আবার ম্যাচ জ্বলে উঠল এবং বলদেব একটা বিড়ি জ্বালল।

    স্ব-স্ব থামে ঠেস দিয়ে তারা বিড়ি ফুঁকতে লাগল। চারিদিকে ছড়ানো কালো অন্ধকারে তাদের বিড়ির ক্ষীণ অগ্নিকণাকে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন আকাশের সব নক্ষত্র ডুবে গেছে, শুধুমাত্র দুটি নক্ষত্র একে অন্যের দিকে তাকিয়ে জোনাকির মতো টিম টিম করে যেন ক্ষীণ আলো বিকিরণ করছে। একটা টান দেয়ার জন্য বলদেব হাত উপরে তুলে দেখল আঙুল কাঁপছে। মস্তক স্পর্শ করে দেখল মাথা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বিড়িতে কষে একটা টান দিয়ে দেখল বুকে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে– নিউমোনিয়া? কথাটা মনে পড়তেই তার সমস্ত দেহ প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠল।

    ‘বাবু।’

    ‘উঁ।’

    ‘তোমার খুব ঠাণ্ডা লাগছে তাই না?’

    ‘না তো!’

    কিন্তু সে মুহূর্তে কে জানে কোথা থেকে বরফমাখা এক ঝটকা বাতাস এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং তার বুকের ঈষৎ ফাঁক দিয়ে যেন তীক্ষ্ণ চাকুর মতো বিদ্ধ হল।

    ‘বাবু, তুমি তো ঠাণ্ডায় বেশ কাঁপছ!

    ‘না, এমন কিছু না।’

    কিন্তু কথাটা বলার সময়ও তার ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল। দাঁত ঠক্‌ঠক্ করে উঠল।

    ‘বাবু এ ঠাণ্ডা বড় খারাপ, নিউমোনিয়া হবে যাবে।’

    ‘হতে দাও।’

    এবার ঠাণ্ডা তার শিরায় শিরায় গিয়ে বুকের নিশ্বাস চূর্ণ করতে থাকল। তার জ্ঞানবুদ্ধি এক অদ্ভুত হতাশার মাঝে বিলীন হয়ে যেতে লাগল আস্তে আস্তে। বহু কষ্টে তার ক্ষীণকণ্ঠ বলে উঠল।

    ‘এখন আর এছাড়া উপায়-বা কী।

    ‘আমার কাছে চলে এস বাবু।’

    বহুকষ্টে চোখজোড়া খুলে সে ভিখারিনির দিকে তার নিষ্প্রভ দৃষ্টি ছেড়ে দিল। ভিখারিনিটি ছেঁড়া শাড়ি জড়িয়ে একটা কাপড়ের পুঁটলির মতো জড়সড় হয়ে পড়ে আছে।

    ‘তোমার কাছেও তো কম্বল নেই।’

    ‘কম্বল নেই, তা আমি তো আছি বাবু।’

    জ্বর আর বিশীর্ণ পাঁজর– এ মুহূর্তে সে কোনো কিছুর ইশারাই বুঝতে সমর্থ নয়। কিন্তু বিষাক্ত বরফমাখা আরেক ঝট্‌কা বাতাস এসে তাকে আক্রমণ করল। আর বলদেবের বোধশক্তি এক বিরাট চিৎকারের মাঝে হারিয়ে গেল।

    ‘কোল্ড ওয়েভ– কোল্ড ওয়েভ– কোল্ড ওয়েভ–’

    ‘বিষাক্ত ঠাণ্ডার ফণা আসছে– ইনফ্লুয়েঞ্জা– নিউমোনিয়ার ভয়– নিউমোনিয়া, মৃত্যু– ‘

    ‘কোল্ড ওয়েভ– কোল্ড ওয়েভ কোল্ড ওয়েভ—’

    এবং সেই বোধশক্তির মধ্যে আরেকটি বোধশক্তি, কোটি মানুষের নাসিকাধ্বনির চিৎকার, কিন্তু সেই চিৎকারে ঠাণ্ডা নেই। বিষ নেই। আছে ওষুধ, বিশীর্ণতা নেই– আছে জীবন সঞ্জীবনী নিশ্বাসের স্পর্শ।

    এবং বলদেব অনুভব করল যেন কোমলতায় ভরা, উষ্ণতার ভরা এবং প্রেমময়তায় ভরা একখানা লেপের ভেতর সে ডুবে যাচ্ছে। এবার আর তার জীবনে কোনো কোল্ড ওয়েভের ভয় নেই।

    অনুবাদ : আখতার-উন-নবী

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
    Next Article এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }