Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    লেখক এক পাতা গল্প766 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.০১ ভাড়াটে বাড়ি – ফিকর তওনসভি

    ভাড়াটে বাড়ি – ফিকর তওনসভি

    ইতিবৃত্তটি বলি, শুনুন। শহরে আমার চাকরির ব্যবস্থা আধপাকা হয়ে গেলে ভদ্দরলোকদের মতো আমিও একটা কামরা ভাড়া নেওয়াই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করলাম। কামরা ভাড়া নেওয়ার আরও একটি বিশেষ কারণ হল, আমার পৈতৃক ভিটে মাত্র একটি। ইতিহাস এবং রাজনীতির সঙ্গে বাবা-মা’র কোনওরকম সম্পর্ক না-থাকলেও তাঁরা সে বাড়ি হিন্দুস্থানে করেননি, করেছিলেন পাকিস্তানে। এবং পৈতৃক বাড়ি পাকিস্তানে হলে হিন্দুস্থানে কামরা ভাড়া নিতে হবেই, এ তো জানা কথাই।

    কিন্তু এ তো হল ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়াটাও এক আজব চিজ এই দুদিনের দুনিয়ায়। সংক্ষেপে বলি। এ ব্যাপারে একদিন রেল কোম্পানির রিটায়ার্ড গুড্‌ড্স ক্লার্ক লালা পিন্ডি দাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমার। তিনি আমায় অন্যান্য ভাড়াটেদের সাথে তিনতলায় একটা কামরা দিয়ে দিলেন। ভাড়া মাসে বিশ টাকা। লালা পিন্ডি দাসকে বললাম, আপনি দেবতুল্য মানুষ।

    তিনি একটু হেসে বললেন, আপনিও খুব ভদ্রলোক, মনে হচ্ছে।

    আমি বললাম, যখন যেমন তখন তেমন

    লালা পিন্ডি দাস আমায় প্রথমদিনের অতিথি বিবেচনা করে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন আমার। অর্থাৎ, এক গ্লাস জল খাওয়ালেন এবং একটা বিড়ি বাড়িয়ে দিলেন। আর, আমি এই খাতির-যত্নের প্রতিদানে বিশ টাকা ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দিলাম। আমাদের সম্পর্ক এমন নিবিড় হয়ে উঠল, যেন বাঘে-ছাগলে এক ঘাটে জল খাচ্ছে।

    ভাড়া নেওয়ার সময় লালা পিন্ডি দাস বুঝিয়ে দিলেন, ভাড়াটা তিনি অগ্রিম নিয়ে থাকেন। কারণ, এই হল তাঁর নিয়ম।

    আমি বললাম, আপনি যথার্থই বলেছেন। নিয়ম-কানুন যার নেই, তাকে কেউ শ্রদ্ধা করে না।

    কথাটা শুনে লালা পিন্ডি দাস ফুলে উঠলেন। তাঁর দাঁত বেরিয়ে পড়ল। দেখলাম, দাঁতগুলো ময়লা। লোকটি যদি আমার দেওয়া বিশটি টাকা থেকে এক টাকার টুথপেস্ট কিনে আনে, তা হলে দাঁতগুলোর উন্নতি ঘটতে পারে। কিন্তু আবার ভাবলাম, অন্যের দাঁতের মধ্যে আমার নাক গলানো উচিত নয়। প্রত্যেকেরই আপন আপন নিয়ম-কানুন আছে।

    অতএব, আমার কামরা-বাস শুরু হল। কামরাটা বেশ। অর্থাৎ, আলো-হাওয়া আসে এবং চব্বিশ বর্গইঞ্চি মাপের চতুষ্কোণ একটি জানালাও আছে। শোবার, থাকার, রান্না করবার, কাপড় ধোওয়ার, লেখাপড়া করার এবং মুগুর ভাঁজবার সমস্ত ব্যবস্থা এই একটি কামরার ভেতরেই রয়েছে। একটি ইলেকট্রিক্ বাল্বও লাগানো ছিল। লালা পিন্ডি দাস সেটা সন্ধেবেলায়ই খুলে নিয়ে গেলেন। বললেন, বাল্বটা আগের ভাড়াটের। সে অগ্রিম ভাড়া না-দিয়েই ঘর ছেড়ে দিয়ে গেছে। আপনি যদি বাল্বটা রাখতে চান, তা হলে সাবেক ভাড়াটের ভাড়াটা চুকিয়ে দিন।

    কিন্তু আমি ভাবলাম, সে লোকটা ভদ্র, না বদমায়েশ কেমন মানুষ, তা কে জানে। না জেনে-শুনে তার ভাড়া আমি কেমন করে দিই। সুতরাং, লালা পিন্ডি দাসের কথায় রাজি হলাম না। নিজের জন্যে নতুন বাল্‌ব কিনে নিয়ে এলাম।

    লালা পিন্ডি দাস আমার এই বাল্বটি দেখবার জন্যে ঘরে এসে ঢুকলেন, বললেন, কত পাওয়ারের আনলেন?– তার পর, চোখ পাতরে বাল্বটি দেখতে লাগলেন, যাতে আমি মিথ্যে না-বলতে পারি।

    আমি কিন্তু সত্যি কথাই বললাম, ষাট পাওয়ারের।

    : কথা কি, জানেন, মশাই– আমি এই ইলেক্‌টরি-ফিলেক্‌টিরির ব্যাপারে একটু পষ্ট-বক্তা। এটা ষাট পাওয়ারের বাল্ব। বেশি কারেন্ট টানবে।

    আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, আজ্ঞে, তা তো নয়। ষাট পাওয়ারই টানবে, বেশি টানবে না।

    : তাই যদি হয়, তা হলে তো আপনাকে বাল্ব পিছু এক টাকার জায়গায় দু টাকা দিতে হবে।

    আমি মন্তব্য করলাম, আমি কিন্তু এক টাকা দেওয়াই ভালো মনে করি।

    : তা হলে আপনাকে তিরিশ পাওয়ারের বাল্ব আনতে হবে।

    : কিন্তু লালাজি, পড়াশোনা করা আমার পেশা। এবং পড়াশোনার জন্যে বেশি আলো চাই। নইলে অকালেই অন্ধ হয়ে যেতে হয়।

    : তা হলে দু টাকা করে দেবেন। এই সঙ্গে একথাটাও নিবেদন করে রাখি– নটার পর নিচে থেকে ইলেক্‌টরির মেন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এটা আমার নিয়ম।

    : কিন্তু লালাজি, আমারও একটা নিয়ম আছে। সে হল, আমি রাত একটা পর্যন্ত লেখাপড়া করি। সারাটা জগৎ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে থাকি। মানে, কবিতা লিখি, গল্প লিখি, আর সারা দুনিয়ার ব্যথা নিজের বুক থেকে বের করে কাগজের উপর ঢেলে দিই। তাই জন্যে―

    তাই জন্যে বেশি তর্ক করেও লাভ নেই। আমার নিয়ম অসংগত বলে প্রমাণিত হল, আর লালা পিন্ডি দাসের নিয়মটাকেই মেনে নিতে হল সংগত বলে। তার পর আমি বাজার থেকে একটা কেরোসিনের কুপি কিনে নিয়ে এলাম। পিন্ডি দাসজি আমার বিজলির তার কেটে দিয়ে গেলেন। আর, আমি সুখে-স্বচ্ছন্দে ঘরটায় বাস করতে লাগলাম।

    এমনিভাবে হেসে-খেলে চার-পাঁচটা দিন কেটে গেল। ইতোমধ্যে আমার মনে হতে লাগল, লালা পিন্ডি দাস আর আমার সম্পর্ক শুধু ভাড়া দেওয়া-নেওয়াতেই নয়, মানুষ যখন প্রথম কুঁড়েঘর বানিয়ে বাস করতে শেখে, সেই পাথর আর তীর-ধনুকের যুগে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে সম্পর্কটি।

    ঘরে যে জানালাটি ছিল, সেইটির আমার আলো-হাওয়ার অদ্বিতীয় উৎস। সুতরাং, আমি জানালাটা বেশি করে খুলে রাখি। লালা পিন্ডি দাস যখন সেটা পরপর পাঁচ দিন খোলা অবস্থায়ই দেখলেন, তখন একদিন সকালবেলা আমার অফিসে বেরোবার সময় ইশারা করে আমায় ডাক দিলেন। তার পর নসিহত করলেন, জানালাটার সামনে কয়েকজন মানী লোক থাকেন। সুতরাং, আপনার মতো লোকের পক্ষে জানালাটা সবসময় খোলা রাখা উচিত নয়।

    আমি বললাম, লালা পিন্ডি দাসজি, দুজন মানী লোকের মধ্যে কখনও ঝগড়া হওয়া সম্ভব নয়। জ্যামিতির হিসাব বলে, দুটো সমান্তরাল রেখা কোনওদিনই পরস্পরের সঙ্গে মিলতে পারে না।

    কিন্তু জ্যামিতি বস্তুটি বোধহয় লালা পিন্ডি দাসজির মাথায় একেবারেই ঢোকে না। আমার কথাটা তাই ভালো লাগল না তাঁর। ভাবলাম, ওঁকে বুঝিয়ে বলি, সামনের বাড়িতে কোনও ভদ্রমহিলা থাকেন না, থাকে ষাট বছরের এক বুড়ি। সে রোদ্দুরে বসে উকুন মারে।– কিন্তু লালা পিন্ডি দাসকে একথা বলার অর্থ তো আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকি, এই অভিযোগটা মেনে নেওয়া। সুতরাং আমি নীরব থেকে ষাট বছরের রূপসীর প্রেমের পথটা নিজেই বন্ধ করে ফেললাম। অর্থাৎ জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। অন্যের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করা এমনিতেও আমার স্বভাবের বাইরে। তার ওপর, জানালা বন্ধ করায় লালা পিন্ডি দাসের চোখে আমার যে সম্মান বেড়ে গেল, সেটুকু উপরি লাভ।

    জানালা বন্ধ হওয়ায় আলো-হাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। তিন-চার দিন ভয়ানক রাগ হতে লাগল আমার। সে রাগ কমতে কমতে ক্রমে এসে ঠেকল বিস্ময়ে। কয়েকবার ইচ্ছে হল, লালা পিন্ডি দাসকে বলে দিই, জানালা খোলাই থাকবে। আমার যা করতে চান, করুনগে। কিন্তু আবার ভাবলাম, পাড়ার লোকে আমায় ঝগড়াটে ঠাওরাবে। সুতরাং সামনাসামনি লালা পিন্ডি দাসের সঙ্গে লেগে পড়াটা আর উচিত মনে করলাম না। ফলে আলো-হাওয়া ছাড়াই আমি জ্যান্ত থাকবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কোনও এক প্রাচীন কবির সেই বিখ্যাত লাইনটি এই অবস্থায় আমায় যথেষ্ট সাহস জোগাতে লাগল– ‘হিম্মত করে ইনসান তো কিয়া হো নেহি সতা!’

    সারাটা বাড়িতে মাত্র একটা পায়খানা। জানা গেল, সে পায়খানা শুধু যারা সপরিবারে থাকে, তাদেরই জন্যে রিজার্ভ করা। যাদের বউ নেই, তারা চলে যায় মাঠে। লালা পিন্ডি দাস আমায় কয়েকবার শোনালেন, বাড়িটা তৈরি করবার সময় তাঁর পিতৃদেবের সঙ্গে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এই ব্যাপার নিয়ে মিটিং হয়েছিল যে, মাসিক বিশ টাকা তক্ ভাড়াঅলা কামরা শুধু একলা মানুষদের দেওয়া হবে কি না। শেষে যখন কয়েক সপ্তাহের তর্কবিতর্কের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, এসব ঘরে একলা মানুষদেরই রাখা হবে, তখন তাদের জন্যে পায়খানা তৈরি করবার প্রশ্নই আর ওঠেনি।

    ভদ্রতার এই স্তরে পৌঁছে লালা পিন্ডি দাস তাই নিতান্তই পিতৃভক্তের মতো জানিয়ে দিলেন, পিতৃদেবের সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে তিনি যেতে পারবেন না।

    কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তিটা আমার মাথায় ঢুকল না। এর সঙ্গে পিতৃদেবের চুক্তির কী সম্পর্ক আছে, বাবা! এ তো ভাড়াটের প্রয়োজনের প্রশ্ন।

    যুক্তিটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না দেখে বেশ কিছুক্ষণ পর লালা পিন্ডি দাস ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, লেখাপড়া শিখেছ, না ঘাস কেটেছ?

    আমি উত্তর দিলাম, ঘাস কাটা মনে না-করে এটাকে মানুষের দুর্বলতা ভেবে নিয়ে আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।

    সাত-সকালে যখন মাঠে যাই, তখন মনে হতে থাকে, সত্যি সত্যিই ঘাস কাটতে যাচ্ছি। মাঠে যাওয়ার সময় সাবান, তোয়ালে, টুথব্রাশ ইত্যাদিও নিয়ে যেতে হয়। কারণ, বাসা থেকে আধ মাইল দূরে কুয়োও আছে। স্নানটাও সেখান থেকে সেরে আসতে হয় আমায়। কুয়োয় স্নান করতে যাওয়ার শুরুটা হয় এইভাবে :

    একদিন লালা পিন্ডি দাসের বাড়িতে নিচের তলা থেকে এক বালতি জল ভরে এনে নিজের ঘরে স্নান করছিলাম। হঠাৎ নিচে থেকে গালাগালি শুনতে পেলাম, অভদ্র কোথাকার! লজ্জাও করে না!

    আমি-যে কোনও অভদ্রতা করছিনে, এ তো জানা কথাই। সুতরাং, যথারীতি গুনগুন করে ‘পিয়া মিলন কো জানা’ গানখানা গাইতে গাইতে স্নান করতে লাগলাম। : চিড়িয়াখানা খুলে রেখেছে ওপরতলায়! বলি, তোমরা কি মানুষ, না গাধা? এটা যে গলি, তোমার বাবার ইমারত নয়, এটুকুও মাথায় ঢোকে না?

    মনে হল, কথাটা যেন আমার উদ্দেশেই বলা হচ্ছে। জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখি, সাদা কাপড় পরা এক বাবুজি আমার কামরার দিকে ঘাড় উঁচিয়ে গালাগালি দিচ্ছেন। তাঁর সাদা কাপড়-জামা ময়লা জলে যাচ্ছেতাই রকম ভিজে গেছে। দোষটা আমার, না সাদা পোশাকঅলার– এর আশু মীমাংসা করা আমার পক্ষে শক্ত। একটু পরেই লালা পিন্ডি দাস এসে মুশকিল আসান করলেন এবং প্রমাণ করে দিলেন, দোষটা আমারই।

    আমি বললাম, আপনার টিনের নালিটা যদি ভাঙা না-হত, তা হলে দোষটা কখনও আমার ঘাড়ে পড়ত না।

    লালাজি চণ্ডমূর্তি ধারণ করে বললেন, টিনের নালির কোনও দোষ নেই, দোষ জলের, যে জল আপনার গা থেকে গড়িয়ে ওই সাদা পোশাক-পরা ভদ্রলোকের কাপড়ে গিয়ে পড়েছে। আপনি যদি এখানে স্নান না করতেন, তা হলে জলও–

    আমি বুঝিয়ে বললাম, কিন্তু মশাই, কামরাটা–

    লালাজি ফোঁস করে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কামরাটা থাকবার জন্যে, স্নান করবার জন্যে নয়। কারণ, এটা বাথরুম নয়, কামরা।

    আমি বললাম, বাথরুমটা কোথায়?

    উত্তর পেলাম, বিশ টাকায় বাথরুম পাওয়া যায় না, শুধু একটা কামরা পাওয়া যায়।

    : তা হলে স্নান হবে কোথায়?

    এই ‘কোথায়’-এর উত্তরে লালা পিন্ডি দাস আমায় কুয়ো দেখিয়ে দিলেন। সে কুয়োর কাছে টিনের নালিও নেই, সাদা পোশাক-পরা লোকের যাতায়াতও নেই। তবু, আমার মাথায় কিছুই ঢুকতে চায় না। টিনের নালি ভেঙে গেলে তা মেরামত করবার দায়িত্ব লালা পিন্ডি দাস ছাড়া আর কার? আবার নালির সঙ্গে যদি লালাজির সম্পর্ক চুকে গিয়ে থাকে, তা হলে কামরার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রয়েছে কী করে?

    কিন্তু এসব উদ্ভট কল্পনা। নালির সঙ্গে লালা পিন্ডি দাসের সম্পর্ক নিশ্চয়ই চুকে গেছে। কিন্তু কামরার ছাদ আর দেয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক এখনও ভালোমতোই রয়েছে। কামরার প্রতিটি ইটেও তাঁর ভালোবাসার ছাপ আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম পরে।

    মাস দুই-তিন নিরাপদে কেটে যাওয়ার পর আমার মনে হল, বাজারের তন্দুর আর হোটেলের খাবারে আমার স্বাস্থ্যে ঘুণ ধরে যাচ্ছে। সুতরাং, ঠিক করলাম, নিদেনপক্ষে স্ববজি-তরকারিটা আমার বাড়িতেই রান্না করে নেওয়া উচিত। তার পর বাজার থেকে কয়লা আর চুলো কিনে এনে এক সন্ধেয় কাজ শুরু করে দিলাম!

    অবাক কাণ্ড! নতুন কিছুর গন্ধ পেলেই লালা পিন্ডি দাসজি চুপচাপ কানে তালা লাগিয়ে ফেলেন। চুলোর ধোঁয়া দেখে তিনি ভাবলেন, আগুন লেগেছে। তার পর বাড়িতে আগুন লাগবার আগেই আমার ঘরে শুভাগমন করে বললেন, এসব কী হচ্ছে?

    আমি সোজা কথায় বুঝিয়ে দিলাম, চুলো জ্বলছে।

    : তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু বলি, এটা কি বাড়ি, না হোটেল? জানেন, কামরাটা আপনি ভাড়া নিয়েছেন, কিনে নেননি?

    শুনুন কথা! কামরাটা আমি কিনে নিয়েছি বলে কখনও দাবি করিনি। জানিনে, লালা পিন্ডি দাসজি এই মিথ্যে অভিযোগ আমার ঘাড়ে কেন চাপাচ্ছেন! অভিযোগটা শুনে ভারি রাগ হল আমার। বললাম, লাল-পিন্ডি দাসজি, বাজারের খাবার খুব ক্ষতি করে। আপনি আমার স্বাস্থ্যটার কথা একটু ভেবে দেখুন।

    : খুব দেখেছি ভেবে। চুলো আর ধোঁয়ায় কামরার দেয়ালে আর ছাদে কালি পড়ে যাবে। কামরার তখন দু পয়সার মূল্যও থাকবে না।

    : তা হলে বলুন, আমি কোথায় রান্না করব?

    : চুলোটা বাইরে গলিতে রেখে দিন। সেইখানেই রান্না করবেন।

    প্রস্তাবটা বেশ। সত্যি, কামরার দেয়াল এবং ছাদে কালি পড়লে লোকের কোমল অনুভূতি এবং রুচিবোধে লাগবেই। অথচ, আমি হলাম কি না একজন শিল্পী। এরকম কাজ করবার সময় আমার অন্তত ভেবে দেখা উচিত ছিল। লজ্জায় তাই মাথা নত করে লালা পিন্ডি দাসের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। তার পর, চুলো উঠিয়ে গলিতে নিয়ে গেলাম।

    দিনদুয়েক গলিতে হোটেল খুলে দেখলাম, লোক আসতে-যেতে মিটমিট করে হাসে। কয়েকজন মহিলাকে আঙুল তুলে ইশারা করতেও দেখলাম। অতএব, চুলোটা আবার ঘরে এনে রাখলাম। ঠাণ্ডা, উত্তাপহীন চুলো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে এককোণে চুপসে পড়ে রইল। তার পর থেকে আর লালা পিন্ডি দাসকে জানাইনি, তোমার ঘরের মান বাঁচাবার জন্যে আমি নিজের স্বাস্থ্য বলি দিচ্ছি। এর জন্যে মাঝে মাঝে প্রতিদান দেব কিন্তু।

    আস্তে আস্তে আমার মনে হতে লাগল, আমি ঘরটা ভাড়া নিইনি, ঘরটাই আমায় ভাড়া নিয়েছে। কারণ, ক্রমে ক্রমে এমন সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, যার ফলে ঘর আর আমার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। চৌকিখানায় টান দিলেও ঘরটা কেঁপে ওঠে, আর লালা পিন্ডি দাস তাঁর ঘরের মেঝে থেকে ইট খসে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন। দরজা বন্ধ করবার সময় ‘মুড’ এসে গেল, একটু-বা জোরেই বন্ধ করে দিলাম। অমনি লালা পিন্ডি দাসের বুকে হাতুড়ির ঘা পড়ল। তার পর, তিনি নিচে থেকেই হাঁক ছাড়লেন: দরজাটা ভাঙছে কে? ক্যালেন্ডার টাঙাবার জন্যে দেয়ালে পেরেক ঠুকতে গেলাম। সে পেরেক গিয়ে ঢুকল যেন লালাজির মাথায়। গরমের দিন এলে ঘুমোনোর জন্যে রাত্তিরে গলিতে যেতে হয়। কারণ, ছাদে ঘুমোন স্ত্রী-পরিবারঅলা মানী লোকেরা। এবং এ নিয়ম চলে আসছে লালা পিন্ডি দাসের পিতৃদেবের আমল থেকে। অতীতের সুস্থ বিধি-নিষেধ অমান্য করতে গেলে আমার নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হতে থাকে।

    অবশেষে পরিস্থিতি একদিন সংকটজনক হয়ে দাঁড়াল। আমি লালা পিন্ডি দাসের সামনে সকল কথা ঢেলে দিলাম।

    ঘটনাটি হল : সেদিন যথারীতি রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরলাম। সদর দরজাও তখন যথারীতি বন্ধ। এবং এই দরজা দিয়ে ঢুকেই আমাকে সিঁড়িতে উঠতে হবে। অতএব, যথারীতি আমি দরজা খুলে দেওয়ার জন্যে লালা পিন্ডি দাসকে ডাক দিলাম। লালাজি বিড়বিড় করতে করতে নিচে নেমে এলেন। কটমট করে আমার দিকে চেয়ে বললেন, এত রাত তক্ কোথায় ছিলেন?

    : ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্প করছিলাম।

    : তা হলে বাউণ্ডুলেপনাও করেন বুঝি!

    : আজ্ঞে, না। পুলিশ আজ পর্যন্ত এ অপরাধে গ্রেফতার করেনি।

    : কিন্তু এটা ভদ্রলোকের কাজ নয়, এ আমি আপনাকে বলে দিলাম –আমার বাড়িতে এসব চলবে না। দয়া করে আপনি অন্তত নটার মধ্যে ফিরে আসবেন। নইলে দরজা খোলা হবে না। বুঝলেন?

    : আজ্ঞে হ্যাঁ। ভবিষ্যতে আর এমন ভুল হবে না। আমার শোবার ব্যবস্থা আমি অন্য জায়গায় করে নেব।

    এই স্পষ্ট কথার পর আর আমার নিজের ঘরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। আমি এক সরাইখানার মালিকের সঙ্গে আলাপ করলাম। সে আমায় রাত প্রতি ছ’আনায় শোবার জায়গা এবং চৌকি দিতে রাজি হয়ে গেল। তার পর বিছানাটা নিজের ঘর থেকে উঠিয়ে সরাইখানায় নিয়ে এলাম।

    দুসপ্তাহের মধ্যেই অবস্থা অন্যরকম হয়ে গেল। এখন আমি মাসে একবার করে লালা পিন্ডি দাসের বাড়ি গিয়ে মাসিক বিশ টাকা ভাড়া তাঁর হাতে দিই, আর, নিচে দাঁড়িয়েই করুণ চোখে একবার কামরাটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে সরাইখানায় ফিরে আসি। কিন্তু কামরাটি আমি কেন ভাড়া নিয়ে রেখেছি– বিশেষ করে, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যখন কার্যত প্রায় ঢুকেই গেছে,–একথার মীমাংসা আজও করতে পারলাম না।

    এবং মজার ব্যাপার হল, এরপর থেকে লালা পিন্ডি দাস একটিবারও খুঁতখুঁত করেননি আমার কাছে। বরং, দেখা হলেই শুধু বলেন, আপনি ভারি ভদ্র ভাড়াটে।

    অনুবাদ : আতোয়ার রহমান

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
    Next Article এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }