Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    লেখক এক পাতা গল্প766 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.০৭ আঘাত – হামিদ কাশ্মিরী

    আঘাত – হামিদ কাশ্মিরী

    সন্ধ্যার অনেক আগেই আগুন লেগেছিল। কিন্তু সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত সে-আগুন বাজার ও পাড়াকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মনে হচ্ছিল আগুন যেন মাটিতে নয় বরং আকাশে লেগেছে। এক হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলময় পরিবেশ তখন দেখা দিয়েছে। চারদিকে ভীতিপ্রদ রব, শিশুদের ক্রন্দন, নারীদের বিলাপ উচ্চতর হয়ে উঠেছে; কিন্তু কেউই কারওর দিকে তাকাবার সময় পাচ্ছে না। বরং কতক সুযোগসন্ধানী ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট লুঠতরাজ আরম্ভ করে। কয়েক জায়গায় মেয়েছেলের প্রতি উত্ত্যক্ত করার ঘটনাও সংঘটিত হয়। এছাড়া আরও অনেক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়, যা হয়তো কোনওদিন দূর ভবিষ্যতে আমি ভুলে যেতে পারিও-বা, অথবা সেই আগুনের দৃশ্য আমার মন থেকে মুছে যেতেও পারে, কিন্তু সেই অগ্নিকাণ্ডের ফলে উদ্ভূত মানুষের অসহায়তা ও হট্টগোলের মাঝে যে-আঘাত সেই লোকটি আমায় দিয়ে গেল তা কোনওদিনই ভুলতে পারব না। সেই আঘাত আমার মনে এক অক্ষয়চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। আর এর ফলে এক ব্যথার যন্ত্রণা আমায় সর্বদা সেই লোকটির কথা স্মরণ করিয়ে রাখে। অনেক সময় আমি ব্যাকুল হয়ে শহরের অলিগলিতে তাকে অনুসন্ধান করে বেড়াই; এবং প্রায়ই পথের প্রতিটি ভিড়ের মধ্যে তাকে শনাক্ত করার জন্য আমার দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু কোথাও তার দেখা পাই না। মনে হয় সে আমার অনুসন্ধানের সব খবরই রাখে; তাই সন্ত্রস্ত হয়ে সে কোথাও আত্মগোপন করে আছে। কিন্তু আমিও সংকল্প করেছি সারাজীবন তার অনুসন্ধান চালিয়ে যাব।

    তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল নিচে ফুটপাতের উপর। সেই সময় বাজারে পলায়নের এক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। চারদিকে ভীতিপ্রদ রব। আগুনের স্ফুলিঙ্গ ও মানুষের হৃদয়বিদীর্ণকারী চিৎকার ব্যাপকতর হয়ে উঠেছে। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঠন্ ঠন্ শব্দ করে দ্রুতগতিতে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করছে। পুলিশের লোকেরা অগ্নি-আক্রান্ত অঞ্চলটিকে ঘিরে লোকগুলোকে টেনে টেনে বাইরে বার করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। আর আমি সাহায্যলাভের জন্য অন্যান্য আরও অনেক সাহায্যপ্রার্থীর মতো কোনও লোকের সন্ধানে ব্যস্ত রয়েছি যাতে কিছু জিনিসপত্র ফ্ল্যাট থেকে বার করতে পারি। কিন্তু এমন ভয়াবহ পরিবেশে সাহায্যের লোক পাওয়া খুবই দুরূহ। প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রাণ রক্ষা করতে ব্যস্ত। আমি অবশ্য নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিলাম। তাছাড়া ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসমূহ বার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মূল্যবান দুটি বড় সিন্দুক বার করতে পারিনি, যা অন্য সব জিনিসপত্রের মতো আগুনে ভস্ম হওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। আমার কাছে সেই সিন্দুকদুটি ছিল খুবই মূল্যবান। কারণ মেয়েছেলের জামাকাপড়, গহনাপত্র, নগদ টাকা, এমনকি মরা-বাঁচার সমস্ত জিনিসপত্র সেই সিন্দুকদুটির মধ্যে বন্ধ ছিল। আর সেই সিন্দুকদুটি উদ্ধার করায় একটি পরিবারের সমস্ত পুঁজিপাটা ধ্বংস হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারত। তাই মজুরি দিয়েও যদি কোনও লোক পাওয়া যায় তার সন্ধানে আমি এদিক-সেদিক ছুটাছুটি আরম্ভ করি। অন্যদিকে আমার দৃষ্টি ছিল আগুনের ঝাঁপটা-পরিবৃত আমার ফ্ল্যাটের প্রতি, যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ করে লুটপাট আরম্ভ না-করে দেয়। আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক সৌভাগ্যক্রমে প্রত্যেকবার মোট বহনের জন্য বিশ টাকার চুক্তিতে এক কুলি পেয়েছিলেন। আমি অবশ্য ত্রিশ-চল্লিশ টাকাও দিতে প্রস্তুত ছিলাম, যদি কোনও কুলি পাওয়া যেত। কিন্তু কেউই রাজি হচ্ছিল না।

    আমার ফ্ল্যাট সম্পূর্ণরূপে আগুনের গ্রাসের মধ্যে এসে পড়েছিল। এবং তা ছিল উপরতলায়। সুতরাং ত্রিশ-চল্লিশ টাকার জন্য প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে উপরে উপস্থিত হওয়ার বিপদ কেনার জন্য কেউ রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে নিরাশ হয়ে আমি সিদ্ধান্ত করি একাই উপরে গিয়ে দুটি সিন্দুক নিচে ফেলে দেব। যদি কেউ লুটেও নেয়, তাতে কী; কমপক্ষে আগুনে ভস্ম হওয়া থেকে তো রক্ষা পেয়ে যাবে। একথা চিন্তা করে আমি উপরে দৌড়ে যেতে উদ্যত হচ্ছি এমন সময় কানের কাছে এক সহানুভূতিপূর্ণ স্বর শুনতে পেলাম :

    ‘আপনার কি কুলির দরকার?’

    পিছন ফিরে তাকালাম। বাহ্যত একটি সাধারণ প্রকৃতির লোক আমার উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। তার দিকে করুণাপ্রার্থী দুই চোখ তুলে মাথা নাড়লাম। এবং তার সাথে কোনও মজুরির চুক্তি না-করেই উভয়েই দৌড়ে উপরে গেলাম। পুলিশের লোক ছাড়া কতক অন্য লোকও আমাদের উপরে যেতে বাধাদানে চেষ্টা করে; কিন্তু আমরা তাদের দু হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে উপরে পৌঁছে যাই। কয়েকবার আগুনের প্রসারিত শিখা আমাদের পরিধেয় বস্তু এবং শরীরকে প্রায় স্পর্শও করে; কিন্তু সেই শিখাগুলোর সাথে সংগ্রাম করতে করতে আমরা উভয়েই এক-একটি সিন্দুক তুলে নিতে সফল হই। এবং প্রসারিত অগ্নিশিখা থেকে নিজেদের রক্ষা করে দ্রুতবেগে নিচে নেমে আসি। নিচে নেমে দেখলাম কুলির পিঠের কয়েক জায়গায় কাপড় পুড়ে গেছে। জানি না তার শরীর পর্যন্ত আগুনের স্পর্শ লেগেছিল কি না। কিন্তু আমি সেকথা তাকে আর জিগ্যেস করিনি, তাছাড়া সে-ব্যাপারে চিন্তা করার সময়ও ছিল না। রাস্তায় অন্য বাড়িগুলোর দরজা-জানালা- ছাদে আরও ভয়ংকর প্রলয় সৃষ্টি হয়েছে। করুণ বিলাপ ও আর্ত রব পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করেছে। কুলিকে উপদেশ দিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে যেন ভিড় থেকে বেরুবার চেষ্টা করে। নিজেও আমি পূর্ণশক্তিতে ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে চললাম। অনেকক্ষণ সম্মুখে এগিয়ে গেছি, কিন্তু জনতার ধারা আর শেষ হয় না। হঠাৎ এই চিন্তায় আমি চমকে উঠলাম যে, কুলির মাথায় যে সিন্দুকটি আছে তা গয়না ও নগদ টাকায় পূর্ণ রয়েছে। এই চিন্তার সাথে সাথেই আমার একথাও খেয়াল হল যে, কুলিটা চলতে চলতে আমার পেছনে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত রয়েছে। কয়েকবার তাকে আমার আগে চলবার কথা বলেছি, কিন্তু ভিড়ে সুযোগ পেয়ে সে আবার পিছনে হয়ে যাচ্ছে। তার উদ্দেশ্য আমি ভালোরূপে বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম যে, সে আমার চোখে ধুলো দিয়ে সিন্দুকটি নিয়ে যেতে চায়। এই ধরনের ঘটনাও কতক লোকের ভাগ্যে ঘটে গেছে। কিন্তু অন্য লোকের কথা থাক, আমি সহজে এই চক্রান্তের মধ্যে যাচ্ছি না। আমি খুব সতর্ক হয়ে গেলাম এবং কঠিন স্বরে বললাম :

    ‘তুমি পিছনে থাকার চেষ্টা কোরো না।’

    সে সন্ত্রস্ত হয়ে নীরবে আমার আগে আগে চলতে লাগল। আমি একথা স্বীকার করছি যে, তার মাথায় যে সিন্দুকটি ছিল তা আমার মাথার সিন্দুকটির চেয়ে দ্বিগুণ ভারী ছিল; এবং তা মাথায় নিয়ে হাঁটতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আর আমাদের গন্তব্যস্থানও ছিল বেশ দূরে। কারণ অগ্নি-আক্রান্ত অঞ্চলকে পুলিশেরা ঘিরে পাহারা দেওয়ায় ভিতরের পথগুলোতে প্রবেশ নিষেধ হয়ে যায় এবং আমাদের পথের দূরত্বও বেড়ে যায়। এমনিতেও যেখানে আমাদের পরিবারের লোকজন নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল তা একটু দূরেই ছিল। ভিড়ের জন্য রাস্তা রুদ্ধ থাকায় এখন আমাদের সোজা পথ ছেড়ে এক দীর্ঘ বাঁকা পথ ঘুরতে হবে। এ বাঁকা পথও পার হওয়া যেত, কিন্তু আমাদের প্রথম কাজ ছিল অগ্নি-আক্রান্ত এলাকা থেকে কোনওপ্রকারে বেরিয়ে বাইরে যাওয়া। আমি সিন্দুকটি মাথা থেকে নামিয়ে কাঁধে রাখলাম। বুকে বল আনলাম, কোমর শক্ত করলাম, ইচ্ছাশক্তিকে সতেজ করে দ্রুতগতিতে লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগলাম। সাথে সাথে কুলিকে বললাম যে, সে যেন আমার সাথে চলে।

    হঠাৎ একদিক থেকে জনতার এক উত্তাল তরঙ্গ ঠেলা দিয়ে ওঠে। আমার পা কেঁপে সিন্দুক হাত থেকে ছুটে মাটিতে পড়ে গেল এবং আমি মুখ থুবড়ে মাটির উপর পড়ে গেলাম। তার পর ভূমিকম্পে পতিত গৃহের মতো কতক লোক আমার উপর এসে পড়ল। মনে হল যেন আমি এক ধ্বংসস্তূপের তলায় তলিয়ে গেছি; কিন্তু শিগগিরই আমি চেতনা সামলে উঠি এবং দক্ষ ডুবুরির মতো হাত-পাগুলোকে সক্রিয় করে সিন্দুকটি পুনরায় অধিকারে আনি এবং গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াই। কিন্তু তাকিয়ে দেখি কুলিকে কোথায়ও আর দেখা যায় না। আমি যেন সংবিহারা হয়ে গেলাম। সিন্দুকটি মাথার উপর তুলে আমি পাগলের মতো এপাশ-ওপাশ দৌড়াতে লাগলাম। তাছাড়া সকলেই নিজ নিজ ব্যাপারে এমন ব্যস্ত হয়ে রয়েছে যে, আমার অস্থিরতা কেউ বুঝতেই পারল না। বস্তুত, আমার ধারণা হল এবং একথা বিশ্বাস না-করার কোনও হেতুই রইল না যে, আমি চরম মার খেয়ে গেছি। কিন্তু ঠিক সেই সময় দূর একটি গলিতে মানুষের মাথার উপরে এক সিন্দুক ভাসতে দেখা গেল। বুঝতে পারলাম, ওই সিন্দুকটি আমারই। আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। সিন্দুকটিকে অনুসরণ করে আমি দ্রুতগতিতে সেই গলিতে প্রবেশ করলাম। কুলির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম তার গতি খুব দ্রুত হয়েছে, বোধহয় সে আমার মনের কথা বুঝতে পারেনি। আমি কুলির পাশে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এই সময় দ্রুত চলার ফলে সে হাঁপাচ্ছিল। তার পাদুটি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে কাঁপছিল। আমি পিছন থেকে তার কাঁধে হাত দিয়ে কঠিন স্বরে বললাম :

    ‘পালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ কোথায়?’

    ‘কোথাও নয়।’ সে হাঁপাতে হাঁপাতে পিছন ঘুরে বলল : ‘আমি তো আপনাকেই খুঁজছিলাম।’

    ‘আমাকে খুঁজছিলে? না আমার কাছ থেকে পালাচ্ছিলে? এ চালাকি আমার সাথে চলবে না।’ আমি বুক ফুলিয়ে বললাম।

    একথায় সে মনঃক্ষুণ্ণ হল। তার চেহারায় রোষের ছায়া পড়ে; কিন্তু সে কিছুক্ষণ আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখল। যেন কিছু বলবার প্রয়াস পাচ্ছে; কিন্তু তার সাহস হচ্ছে না। তার পর কিছুক্ষণ পরে নিজেই সিন্দুকটি মাথা থেকে নামিয়ে কাঁধের উপর রাখল এবং ধীর স্বরে বলল :

    ‘আচ্ছা, এখন কোনদিকে যাবেন?’

    ‘ওই সামনের রোডের দিকে চলো।’ আমিও শান্তস্বর ধারণ করলাম, তার পর তাকে পথ দেখালাম।

    ‘চলুন।’ সে আমার পিছন হয়ে চলল।

    কিন্তু আমিও তো কাঁচা ছেলে নই, যে এতকিছু করার পর তাকে আবার পিছনে ছেড়ে দেব। আমি রেগে গিয়ে নিজের সিন্দুকটা মাটিতে নামালাম, এবং তাকে শেষবার সাবধান করে বললাম :

    ‘দ্যাখো মিয়া আমি তোমায় সোজা কথা বলে দিচ্ছি, এখানে তুমি কোনও হাতসাফাই করতে পারবে না। যদি কুলিগিরি করতে চাও তো চুপচাপ আমার আগে আগে চলো, না তো সিন্দুক নামিয়ে দাও।’

    একথা বলে আমি একটু ভয়ও পেয়ে গেলাম যে, সে সিন্দুকটি নিচে আছাড় দিয়ে না-দেয়। কিন্তু সে একটুক্ষণ কী চিন্তা করে পূর্ণদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল এবং কোনওরূপ তর্ক না-করে নীরবে আমার আগে আগে চলতে লাগল। এরপর থেকে তার সম্পর্কে আমি গভীর সতর্কতা অবলম্বন করি এবং একমুহূর্তের জন্যও তাকে না আর আমার পেছনে ছেড়েছি অথবা আমার দৃষ্টির সম্মুখ থেকে তাকে না আর অদৃশ্য হতে দিয়েছি।

    আমরা জনতার মাঝ থেকে পথ করে অগ্নি-আক্রান্ত অঞ্চল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে এক খোলামেলা বড় রাস্তায় উপস্থিত হই। যদিও আমরা সেই আগুন থেকে বেশ দূরে চলে এসেছিলাম, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছিল শেষ সীমা পর্যন্ত অগ্নির লালিমাই দেখা দিচ্ছে। এবং চারদিকে লোকের শঙ্কিত ও নিষ্প্রভ চেহারা যেন আকাশের দিকে মুখ তুলে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি যতই আগে বেড়ে গেলাম, বিপদগ্রস্ত নারী-পুরুষ-শিশুদের চিৎকার ততই কাছে শোনা গেল। আর যদি সেই প্রলয়ংকর ও হৃদয়বিদারক দৃশ্যে কোনওরূপ প্রভাবিত না-হয়ে সেই কুলিটি শুধু আমায় আঘাত হানার চেষ্টায় ছিল, তাতে কী, আমিও তো এত নির্বোধ ছিলাম না যে, মানুষের বিলাপ-আর্তির দুঃখে বিগলিত হয়ে নিজের সমস্ত ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলব। আমিও তো এক কুলির মাথার উপরের সিন্দুক এবং তার মনের চোরটিকে নিজের চিন্তার কেন্দ্র করে রেখেছিলাম। আমিও কোনও দক্ষ গোয়েন্দার মতো তার কাঁপা পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। এবং নিজের মন, বুদ্ধি, চতুরতাকে সতর্ক করে সেই কুলির সাথে হেঁটে হেঁটে দীর্ঘ পথযাত্রা নিরাপদে শেষ করলাম। যখন গন্তব্যস্থানে পৌঁছাই– যেখানে আমার পরিবারের অন্যান্য লোকজন সব অবস্থান করছিল– তখন আমার মনে হল যেন আমি এক নতুন পৃথিবী ও এক নতুন জীবন লাভ করেছি। আত্মীয়স্বজন আমায় ও সিন্দুকদুটিকে অক্ষত দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল। বাড়ির দরজার কাছে উপস্থিত হয়ে কুলিটি একমুহূর্তের জন্য আবার থেমে গেল এবং তিক্তস্বরে বলল :

    ‘লন সাহেব, এখন তো আপনি আগে গিয়ে রাস্তা দেখাবেন।

    তার পর কণ্ঠস্বরে যেন পরাজিতের ভাব দেখা দিল। কিন্তু একথা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল যে, সে আমায় এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে পরাজিত করার চিন্তায় রয়েছে। আমি তাকে কোনও উত্তর দিলাম না, এবং নীরবে পথ দেখাবার জন্য সম্মুখে এগিয়ে গেলাম। সে আমার পেছনে পেছনে কামরার মধ্যে প্রবেশ করল এবং আমার নির্দেশমতো এককোণায় সিন্দুকটি রেখে দিল। সে যখন সিন্দুকটি মাথা থেকে নামিয়ে রেখে দিল আমি তাকে বাইরে বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াতে বলি। সে নীরবে বাইরে চলে গেল। আর আমি গিয়ে তার মজুরি সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলাম।

    যখন মোট বহনের জন্য কোনও লোক পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আমি চল্লিশ টাকা পর্যন্তও দিতে তৈরি ছিলাম। কিন্তু এখন আমি শান্তমনে চিন্তা করে বুঝতে পারি এত টাকা কোনও কুলিকে এই সামান্য কাজের জন্য দেওয়া বোকামি। কোনও বুদ্ধিমান লোক এত টাকা কোনও কুলিকে কীভাবে দিতে পারে! বাড়ির মেয়েছেলেরা ন্যায্যরূপে পরামর্শ দিল যে, পাঁচ টাকা দেওয়া উচিত। পাঁচ টাকা যদিও ন্যায়সংগত ভাড়া, কিন্তু যেহেতু আমি মৌলিকরূপে করুণ হৃদয়ের অধিকারী সেজন্য নিজের করুণা দেখাবার জন্য তার সঙ্গে আরও পাঁচ টাকা যোগ করলাম। দশটাকার নোট হাতে নিয়ে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। কিন্তু বারান্দায় কুলিটিকে দেখতে পেলাম না।

    বাইরের দরজার দিকে দেখলাম, নিচে নেমে উঠানে গেলাম, বাইরে রাস্তায় বহুদূর পর্যন্ত তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু তাকে কোথাও দেখা গেল না। বেশ আশ্চর্য বোধ হচ্ছিল যে, সে ভাড়া না-নিয়ে চলে গেল কোথায়! এমন সময় ঘরের একটি ছোট ছেলে এসে আমায় বলল :

    ‘ভাইয়া, সে তো অনেকক্ষণ চলে গেছে- বলেছে, সাহেবকে বলে দিও, আমি তো আর কোনও কুলি নই।’

    অনুবাদ : বশীর আহমদ

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
    Next Article এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }