Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    লেখক এক পাতা গল্প766 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.০৯ একটি সত্যি গল্প – রিয়াজ রউফি

    একটি সত্যি গল্প – রিয়াজ রউফি

    তার নাম কেউ জানে না। তবে নিজেদের সুবিধের জন্যে অনেকে অনেক নাম তার রেখেছে। এবং যখন যা-খুশি তাই বলে ওরা ডাকে। জুম্মন বাবুর্চি তার কদর সবচেয়ে বেশি বোঝে। সে তাকে সবসময় ‘আবে ও হারামি’ বলে ডাকে। হোটেলের মালিকের পাকা চুল-দাড়িঅলা বাবা তাকে ‘চাচাজি’ বলেন। আর মালিক বড় সাহেব ডাকেন ‘মকরানি’ বলে।

    এই হোটেলে কয়েকজন বাঁধা খদ্দের এসে বসে প্রত্যেক দিন। তারা বারবার সিঙ্গেল চা খায়, খবরের কাগজ পড়ে, আর নিজেদের জীবনের বিরক্তিকর দৈনন্দিন সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করে। এই দলে রয়েছে দিল্লির মোহাজের কাপড়অলা, যার কেবিনগুলো হোটেলের একটা পাশ ঘিরে রয়েছে। আছেন মুনশিজি, যিনি পোস্ট অফিসের সামনে বসে কার্ড আর টিকিট বিক্রি করেন এবং লোকের চিঠি লিখে দেন। রয়েছেন মির্জাজি, যিনি ‘সিলভারের নিচে তৃতীয় শ্রেণির বই বিক্রি করেন। আর রয়েছে এক পাঠান চৌকিদার, সে বড় বড় দোকান, হোটেল আর সিনেমাঘরে রাত্রে পাহারা দেয়। এ দলটি হোটেলে আসে সস্তা খাবার খেতে, আর ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে কল্পনার বেলুন ওড়াতে। এদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এরা তাকে আদর করে ‘আবে ও হারামি’ বলে ডাকে।

    দিল্লির দলটি হল যারা দিনে দু-একবার চা খেতে বা গল্পগুজব করতে আসে, তাদের। এই দলে হরেকরকম পেশার লোক দেখা যায়। প্যারিসিয়ান কাফের সামনে লা-লা-লা-লা শব্দ করে নকল দাড়ি-গোঁফ বিক্রি করে যে লোকটি, কফি-হাউসের সামনে যে একপয়সায় ওজন বলে দেয়, কাঠের হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে যে-লোকটা আমেরিকান নেকটাই আর জাপানি রুমাল বেচে, হরেক মাল ইধার দোআনা উধার চার-আনাঅলা, বুট-পালিশ ও গা-মালিশঅলা, চানাচুর-বাদাম- তিলেখাজা-গজাঅলা, প্যারাডাইসের সামনে যে রঙিন মোড়ক দিয়ে ফল আর চকোলেট বিক্রি করে, কাফে ইরমের পিঠা-পকৌড়িঅলা, ক্যাপিটালের গলির আখঅলা, বাসস্ট্যান্ডে একআনা দরে দুটি সান্ধ্য ইংরেজি দৈনিক বিক্রি করে যে হকারটি, ফেরদৌসের সামনের পান-বিড়িঅলা, কাগজের খেলনাঅলা, অন্ধ হাফেজ– যে রোজ সন্ধ্যায় এলফিনস্টোন স্ট্রিট, প্রেডি স্ট্রিট, ভিক্টোরিয়া রোড এবং ক্লার্ক স্ট্রিটে সকলকে কোরান শরিফ শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ‘প্রাইড অব পাকিস্তান’ রিকশাঅলা এবং এইরকম ছোট ছোট পেশার লোক রয়েছে এই দলে। এরা তার কাছে বিশেষ ভদ্রতা দেখায় না এবং তাকে ‘মকরানি’ বলেই ডাকে।

    মকরানি আজ দু-বৎসর এই হোটেলে কাজ করছে। সে গোটা জাতের মকরানি। তার সাক্ষী তার দেহের মজবুত গড়ন এবং ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল। সে খুব পরিশ্রমী, সকাল পাঁচটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকে। সিনেমার সমস্ত গান তার মুখস্থ। চা-দেওয়া আর বাসন-ধোয়ার সময় তার মুখে নতুন গানের গুনগুনানির তালে তালে তার শিরায় শিরায় যেন নাচন জেগে ওঠে। জুম্মন বলে, ‘মকরানি খুব ভালো সিন্ধি নাচ জানে।’ কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তার নাচ দেখবার জন্যে ফরমাশ করেনি।

    লোকের কথা শুনে তখনি তার ওপর টিপ্পনী দেওয়ার রোগ আছে মকরানির। সে অসীম গাম্ভীর্য সহকারে একেবারে নিশ্চুপ থেকে কথাবার্তা শোনে। তার পর হঠাৎ একটা খাপছাড়া কথা বলে ফেলে। লোকে রেগে উঠে তাকে ধমক মারে আর গালাগালি দেয়, আর সে মুচকি হেসে গুনগুন করে কোনও একটা সিনেমার গান গাইতে গাইতে নিতান্তই ঔদাসীন্যভরে কাজে মশগুল হয়ে যায়।

    এই হোটেলটা সবচেয়ে সুন্দর এলাকায়। এই এলাকায় সন্ধ্যাবেলা সুবেশ লোকের ভিড়ের চোটে পথচলা মুশকিল হয়ে ওঠে। কিন্তু সে জনতার দৃষ্টি এই হোটেল পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না। কারণ, এলাকার বড় বড় আলিশান বাড়িগুলো হোটেলটাকে আড়াল করে রেখেছে; ভিক্টোরিয়া রোডের নতুন তৈরি কাপড়ের কেবিনগুলোর মাঝখান থেকে একটা ছোট্ট গলি বেরিয়ে এই হোটেল পর্যন্ত গেছে। হোটেলের কোনও নাম নেই। গলির মধ্যেকার হোটেলের ভালো নাম রাখা এবং সুন্দর সাইনবোর্ড টাঙানো একদম নিরর্থক– মালিক একথা বোঝেন। ‘৪৮ সালে একজন মালাবারি হোটেলটা তৈরি করেছিল– সেই থেকে আশেপাশে মালাবারি হোটেল নামেই এর পরিচয়, যদিও ইতোমধ্যে কয়েকবার এর মালিক বদল হয়েছে।

    পনেরো বর্গফুট জমির উপর কাঠের খুঁটির মাথায় চিড়ের ছাদ দেওয়া এই ঘরটি। দেয়াল কাঠেরই। তার গায়ে মকরানি আর তার বন্ধুরা সিনেমা-তারকা ও আমেরিকান ম্যাগাজিন থেকে অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েদের ছবি কেটে লাগিয়ে দিয়েছে।

    চাচাজি একটা ছোট চৌকির উপর ময়লা গদি পেতে সামনে কাঠের ক্যাশবাক্স নিয়ে পয়সা উশুল করেন ও মোটা কাঁচের চশমা লাগিয়ে সারাদিন উর্দু খবরের কাগজ পড়েন।

    জুম্মন বাবুর্চি এবং মকরানি ছাড়াও এই হোটেলে আরও চাকর-বাকর রয়েছে। শরফু জুম্মনকে সাহায্য করে। তার কাজ হল আটা-মাখা আর রুটি-বানানো। খাবার আর চা দেওয়ার জন্যে মকরানি ছাড়াও বশির নামে একটা ছেলে আছে। আর আছে ষোলো-সতেরো বছরের পাঠান ছেলে জরগুল খাঁ। সে ঠেলাগাড়ি করে চা দিয়ে বেড়ায়।

    সেদিন সকালে প্যারাডাইসের চাকর জ্যাকিকে ধরে এনেছিল। সিনেমার টিকেট ব্ল্যাক করবার কাজে জ্যাকির হাত পাকা। আগের রাত্রে তারা অনেক টাকা আয় করেছিল। কিন্তু ভাগ-বাঁটোয়ারার সময় ঝগড়া বেধে গেল। হাসান খাঁ আর মাহমুদ খাঁ পাঠান মীমাংসা করে দিতে চাইছিল। এমন সময় বাইরে থেকে জরগুল খাঁ জোরে জোরে পা ফেলে মকরানির পাশে এসে বসে পড়ল। মকরানি পানির ড্রামের কাছে বসে পেয়ালা ধুচ্ছিল। জরগুল মৃদু হেসে মকরানিকে একটা মজার খবর শোনাল। মকরানি এবার অত্যন্ত অধীর হয়ে উঠল, এই খবর সবার আগে কাকে কাকে শোনানো যায়। জুম্মন বাবুর্চির কাছে গিয়ে রহস্যজনকভাবে মুচকি হেসে বলল, ‘ওস্তাদ, শুনেছ কিছু? খুব গণ্ডগোল বেধেছে। বিস্ রোডে হাঙ্গামা হয়েছে।’

    জুম্মন ডেকচিতে চামচ নাড়তে নাড়তে একটু হাসল, ‘হাঙ্গামা হয়েছে? কী বকছিস রে?’ তার পর শরফু’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ সকালবেলায়ই শালার মাথায় নতুন জিনিস ঢুকেছে। ‘

    আমল পেয়ে মকরানির সাহস বেড়ে গেল। এই মজার খবরটা হোটেলে ছড়িয়ে দেওয়া তার পক্ষে এবার জরুরি হয়ে পড়ল। ব্ল্যাকমার্কেটের ঝগড়া জোরসে চলছিল। হাসান খাঁ পাঠানকে উদ্দেশ করে মকরানি বলল, লালা, এখানে কিসের ঝগড়াঝাঁটি করছ? ওদিকে বিস্‌ রোডে যে লাঠি চলছে!’

    এক মুহূর্ত সবাই চুপ করে রইল। হঠাৎ মাহমুদ খাঁ পাঠান চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা, দূর হ এখান থেকে!’– তার পর সবাই মৃদু হেসে নিজের কথায় মন দিল।

    কিছুক্ষণ পর শরীর মালিশঅলা আবদুল্লাহ্ হোটেলে ঢুকে খবরের কাগজ পড়ায় মশগুল চাচাজিকে উদ্দেশ করে বলল, ‘ফিরিয়ার রোডে হাঙ্গামা হয়েছে।’

    মকরানি হাসতে হাসতে জুড়ে দিল, ‘অনেক লোকের মাথা ফেটে গেছে।‘

    জুম্মন চুলোর কাছ থেকে মকরানিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘কী বকছিস তুই!’

    চাচাজি জিগ্যেস করলেন, ‘কীরকম হাঙ্গামা? কোথায় হয়েছে?’

    আবদুল্লাহ্ উত্তর দেওয়ার আগেই মকরানি বলল, ‘ছেলেরা মারামারি করেছে।’

    জুম্মন ধমকে উঠল, ‘চুপ, হারামি! শালা এখানে বসে-বসেই সব জায়গায় মেরে বেড়ায়।’

    মালিশঅলা বলল, ‘চাচাজি, ছেলেদের মিছিল বেরিয়েছে। পুলিশ দু জায়গায় থামাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’

    ‘প্রাইড অব পাকিস্তান’ রিকশাঅলা ব্যস্ত পায়ে হোটেলে এসে ঢুকল।

    : ‘আবে ও মকরানি, এক সিঙ্গেল চা দে! পানি কম, দুধ বেশি। আর, এক গ্লাস পানি। শিগগির আন। লাঠি নিয়ে দু-ট্রাক সেপাই ক্লার্ক স্ট্রিটের দিকে গেল। মিছিল এদিকেই আসছে।’

    ব্ল্যাকমার্কেটের ঝগড়া শেষ হয়ে গেল। সব লোক তার দিকে চোখ ফেরাল।

    চাচাজি জিগ্যেস করলেন, ‘কীরকম মিছিল? ব্যাপারটা কী?’

    মকরানি দুলতে দুলতে বলল, ‘ছেলেদের মিছিল।’

    রিকশাঅলা তাড়াতাড়ি গরম চায়ে মুখ দিচ্ছিল। হোটেল থেকে ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সিনেমার চাকররা আর লালা বাইরে চলে গেল। রিকশাঅলা পয়সা দিতে দিতে বলল, ‘ছাত্রদের মিছিল। মাইনে কমাতে চায়। শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি যাচ্ছে। পুলিশ বাধা দিচ্ছে, কিন্তু তারা থামছে না।’

    সবাই মিছিল দেখতে বেরিয়ে গেল। শুধু জুম্মন আর চাচাজি রইলেন। জুম্মন ডেকচিগুলোর পাশে বসে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘ঠিকই তো। শালারা মাইনে কী নেয়, মানুষের রক্ত চোষে! আমার মতো গরিব লোক তো ছেলেপিলেকে পড়াতেই পারে না।

    .

    প্রেডি স্ট্রিটে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লোকে দোকান থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাণ্ডকারখানা দেখছিল। মকরানি প্রথমে কফি-হাউসের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। তার পর পা দুখানা আপনা থেকেই মিছিলের সাথে চলতে লাগল। এগোতে এগোতে দেখে, জরগুল খাঁ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    : ‘এই জরগুল, ওখানে কী দেখছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? এইমাত্র এদিক থেকে তিন গাড়ি পুলিশ গেছে। সামনে গুলি চলবে। তাদের কাছে বন্দুক আছে।’

    ওরা দু জন জোরে হেঁটে এলফিনস্টোন স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে চলল।

    এলফিনস্টোন স্ট্রিটে খুব গণ্ডগোল হচ্ছিল। পুলিশ মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জোর চেষ্টা করছিল। আর, ছেলেরা চাইছিল এগিয়ে যেতে। পুলিশ পনেরো-বিশজন ছেলেকে গ্রেফতার করল। ছেলেরা আরও জ্বলে উঠল। আকাশ-বাতাস ‘মুর্দাবাদ’ ধ্বনিতে ভরে গেল। ইতোমধ্যে বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজ এল।

    মকরানি চিৎকার করে উঠল, ‘ওই জরগুল, পালা! গুলি চলছে!’

    কিন্তু জরগুল খাঁ মকরানির হাতখানা শক্ত করে ধরে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল।

    এলফিনস্টোন স্ট্রিটে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল। ছেলেরা দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ল আর গলির মধ্যে পালাতে শুরু করল। শুধু একটাই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ‘পানি, পানি!’ দোকানের কলসি খালি হয়ে গেল। হোটেলের চাকররা গেলাস ভরে ভরে ছেলেদের পানি দিতে লাগল। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা রুমাল ভিজিয়ে ছেলেদের দিকে ছুঁড়ে দিল। ক্যাপিটাল সিনেমার সামনে আখঅলার পুরা পানির বালতি যখন খালি হয়ে গেল, তখন ছেলেরা রুমাল আর কাপড় আখের রসে ভিজিয়ে নিতে শুরু করল। কিন্তু কেউ আখ নিল না। তারা চোখ রগড়াচ্ছে, হাসছে আর ভেজা রুমাল চোখে ধরছে।

    এলফিনস্টোন স্টিট চোখের পানি আর কাঁদুনে গ্যাসের ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল। হাওয়া একটু পরিষ্কার হলে ছেলেরা রাস্তায় বেরিয়ে আবার ‘মুর্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে লাগল। মিছিলও আবার চলতে শুরু করল। পুলিশ কিছুক্ষণ পর আবার গ্যাস ছাড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে লাঠিও চালাল। কারও মাথা ফাটল, কারও আঙুল ভাঙল, কারও পায়ে লাঠি পড়ল, কারও-বা কোমরে চোট লাগল। ছেলেদের কাপড় রক্তে ভরে গেল। তারা গলির ভেতর পালাতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আবার যানবাহন চলাচল শুরু হল।

    .

    হোটেলে হাসান লালা বন্ধুদের বলল, ‘এ কেমন জোয়ান? ভয়ে পালিয়ে যায়! আমাদের এদিকে এরকম অত্যাচার করলে শালাদের মাথা ফাটিয়ে দিতাম আমরা।’

    মকরানি ঠাট্টা করে বলল, ‘অই জন্যেই তো তুমি গলির মধ্যে পালিয়ে ছিলে।’ হাসান খাঁ গর্বভরে বলল, ‘আমি হলাম পাঠান, পাঠান! আমরা ইংরেজের কাছে কখনও মাথা নিচু করিনি।’

    জুম্মন বিড়বিড় করে বলল, ‘খুব অত্যাচার হচ্ছে। ছেলেদের লাঠি দিয়ে তাড়া করছে। শালাদের কি লজ্জা নেই?’

    রিকশাঅলা হাসতে হাসতে বলতে লাগল, ‘লজ্জা! কিসের লজ্জা! লজ্জা তো এখানে মোহাজের হয়ে গেছে। কায়েদে আজমের মাজারের নিচে ঝুপড়ি বানিয়ে পড়ে রয়েছে।

    মুনশিজি বললেন, ‘তা-ও আবার এই তুচ্ছ কথাটুকুর জন্যে। কি না, ছেলেরা বলছে, মাইনে কমিয়ে দাও।’

    রিকশাঅলা হাসতে হাসতে বলল, ‘মাইনে কেন কমাবে, সাহেব –যদি সব লোক লেখাপড়া শিখে ফেলে, তা হলে যে রোজ রোজ হাঙ্গামা লাগবে।’

    কাপড়অলা বলল, ‘জি হ্যাঁ। আর, শিক্ষার ব্যয় পূরণ হবে কেমন করে? প্রফেসরের খোঁজে ইউরোপ বেড়িয়ে আসাই-বা চলবে কেমন করে!

    বইঅলা বলল, ‘এখানকার কাণ্ডই আলাদা। ছয় বচ্ছর কেটে গেল, এ পর্যন্ত ছেলেদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হল না। এখানে তো কোনও মন্ত্রী সুপারিশ না-করলে ভর্তিই করা হয় না।’

    কাপড়অলা বলল, ‘প্রত্যেক বছর কোর্স বদলে দেওয়া হয়। সারাবছর বই পাওয়া যায় না। পড়াশোনা এমনি খরচের ব্যাপার যে, গরিব মানুষে তো ছেলেপিলেকে পড়াতেই পারে না।’

    বড় সাহেব এই প্রথম আলাপে যোগ দিয়ে বললেন, ‘একথা সত্যি; কিন্তু বিনা অনুমতিতে মিছিল বের করারই-বা কী দরকারটা ছিল?’

    রিকশাঅলা রেগে গিয়ে বলল, ‘জি! আর, লাঠি চালাবারই-বা কী দরকার ছিল? ছেলেরা কি শহর লুট করছিল?’

    মুনশিজি বললেন, ‘চার বছর থেকে এই তো অবস্থা। সব লোক চিৎকার করে হয়রান হয়ে গেছে। সব খবরের কাগজে লিখেছে। কিন্তু এখানে কেউ তোয়াক্কা করল না। গরিবের কথা কেউ শোনেই না।’

    রিকশাঅলা বলল, ‘ছেলে না কাঁদলে মা-ও দুধ দেয় না।’

    সিল্ক মিলের ছাঁটাই হওয়া মজদুর আল্লা বখ্শ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছিল। সে এবার রেগে উঠে বলতে লাগল, ‘কথা এভাবে চাপা পড়ছে না আর, বড় সাহেব! এবার শুরু হয়ে গেছে ফ্যাসাদ। অত্যাচারেরও একটা সীমা আছে।’

    : ‘আমাদের এখানে যদি এরকম অত্যাচার হত–

    হাসান লালা নিজের কথাটা দোহরাতে চাইছিল। কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই গফুর কাবাবঅলা খবর দিল, ‘লালা, প্যালেস সিনেমা আর করাচি ক্লাবের কাছে ছেলেদের ওপর আবার লাঠিচার্জ করেছে, আর, গ্যাস ছেড়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনেও লাঠিচার্জ করেছে। কিন্তু ওরা ঘাবড়ায়নি।’

    মকরানি আনন্দে নেচে উঠল, ‘বা রে, আবার বাঘ! লালা, আমিও পাঠান।’- হা হা করে হেসে উঠল সে।– ‘ইংরেজের কাছে কখনও মাথা নিচু করিনি।’

    হাসান লালার মুখ আনন্দে লাল হয়ে উঠল। সে মুচকি হেসে বলল, ‘জিন্দাবাদ!’

    .

    পরদিন সকাল থেকেই লোকে হোটেলে বসে জল্পনা চালাচ্ছিল। গতকাল ছেলেরা প্রচার করে দিয়েছিল, তারা আজ আবার মিছিল বের করে নিজেদের দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানাবে।

    চাচাজি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বললেন, ‘পুলিশ অত্যাচারের চূড়ান্ত করেছে।’

    মুনশিজি মন্তব্য করলেন, ‘হ্যাঁ, বড্ড বেশি জুলুম হয়েছে।’

    কাপড়অলা বলল, ‘কমপক্ষে বিশটি ছেলে জখম হয়েছে।’

    বড় সাহেব জানালেন, ‘কিন্তু রেডিওতে বলেছে, মৃদু লাঠিচার্জ হয়েছে। ফলে কয়েকটি ছেলে সামান্য আঘাত পেয়েছে।’

    রিকশাঅলা ক্রুদ্ধভাবে বলল, ‘পাগলামি! ছেলেদের পেছনে শিকারি কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। প্রত্যেক গলিতে তাদের পিছু পিছু ফিরেছে। জায়গায় জায়গায় গ্যাস ছেড়েছে আর লাঠিচার্জ করেছে।

    মুনশিজি বললেন, ‘দেখুন, আজ আবার কী হয়!

    চাচাজি মন্তব্য করলেন, ‘আজ কিছু হবে না। এমন বোকামি আর করবে না পুলিশ। কালকের ঘটনায় সবাই ছি ছি করছে। ‘

    ধ্বনি শুনে সবাই বেরিয়ে এল। আজকের মিছিল খুব বড় হয়েছে। ভারি উৎসাহ ছেলেদের। প্রাইমারি স্কুলের ছোট ছোট ছেলেরাও মিছিলে যোগ দিয়েছে। ভাইস-চ্যান্সেলার, চিফ কমিশনার এবং পুলিশের উদ্দেশে বিরূপ ধ্বনি দিতে দিতে তারা এসে এলফিনস্টোন স্ট্রিটে ঢুকল।

    মিছিল ক্লার্ক স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় পুলিশ আগের মতো কাণ্ডই করে বসল, ধড় ধড় ধড়াস। অমনি দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। সারা এলাকায় গ্যাসের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। বড় বড় ছেলেরা কালকের পথ ধরল– তারা ছোট ছোট মহল্লার মধ্যে বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দিকে রওনা হল। কিন্তু মিছিলের বড় অংশটি– এ দলের সবাই স্কুলের, এই এলাকায়ই রয়ে গেল। ছোট ছোট ছেলেরা দোকান, বাড়ি এবং অলিগলিতে ঢুকে পড়ে কাপড় আর রুমাল ভিজিয়ে চোখে দেয়, তার পর আবার রাস্তায় বেরিয়ে এসে পুলিশের উদ্দেশে টিটকারি দেয় : হু-হুঁ-হুঁ, লু-লু-লু, হা-হা-হা, পিথ-পিথ-পিথ! তারা হো হো করে হাসে, নাচে আর বুক দেখিয়ে দেখিয়ে পুলিশকে শাপশাপান্ত করে। পুলিশ লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করে যায়।

    লুকোচুরি খেলাটি অনেকক্ষণ যাবৎ চলল। দোকান আর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লোকে পুলিশের বর্বরতার তামাশা দেখছিল আর হাসছিল। বড় বড় ছেলেরাও প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে তাদের দলে গিয়ে ভিড়ল। যখন কয়েকটি ছোট ছোট ছেলে পুলিশের লাঠিতে জখম হল, তখন হাওয়া বদলে গেল। ছেলেরা এবার পাথর ছুঁড়তে শুরু করল। অমনি বেধে গেল হাঙ্গামা। দোকানের কাঁচ ভাঙতে লাগল। চৌরাস্তায় আর গলিতে গলিতে হাজার হাজার লোক জমা হয়ে গেল। বাড়ির ছাদ থেকেও পুলিশের ওপর পাথর পড়তে শুরু করল। বাজার বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ এত গ্যাসবোমা ছাড়ল যে, আকাশ-বাতাস ধোঁয়ায় ভরে উঠল।

    কিন্তু মালাবারি হোটেলের জৌলুশ কমল না। প্রত্যেকেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নিজের নিজের কথা বলে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়া রোডে আন্ডারগ্রাউন্ড রাস্তা তৈরি হচ্ছে। এখানকার ইট-পাথরের গাদাটা ছেলেরা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিল। মকরানি আর বশির দশ মিনিট পরপর বাইরে এসে পাথর কুড়িয়ে নিচ্ছে আর পুলিশ দেখলেই ছুঁড়ে মারছে। তার পর হোটেলের ভেতর ফিরে গিয়ে রসালো করে নিজের কীর্তি বর্ণনা করছে।

    এবার পুলিশ পালাচ্ছে।

    ছেলেরা খুব জব্দ করেছে ওদের। পুলিশ আত্মরক্ষার জন্যে ঘাঁটি বেঁধে দাঁড়াল।

    জনৈক মন্ত্রীর মোটরে আগুন লাগল।

    একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি হল।

    এদিকে ভিড় বেড়েই চলেছে।

    তার পর যখন খবর এল, পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, তখন হোটেলে কিছুক্ষণের জন্য সব নীরব হয়ে গেল। শোরগোলের মধ্যে গুলি-চালানোর স্পষ্ট আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। সবাই ভীত হয়ে উঠল এবং আশ্চর্য হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

    চাচাজি ক্রুদ্ধভাবে বললেন, ‘এর মানে কী? কোথায় মকরানি, জরগুল, বশিরঃ কেউ যেন বাইরে না যায়!’

    পুলিশ এবার প্যারাডাইসের সামনে দাঁড়িয়ে গুলি চালাচ্ছে। কতকগুলি ছেলে পালিয়ে এসে হোটেলে ঢুকল। তাদের চোখ লাল হয়ে উঠেছে এবং চোখ থেকে পানি পড়ছে। ছেলেগুলো রাগে কাঁপছে। সবারই সহানুভূতি জাগল এদের দেখে। লোকের ইচ্ছা, এদের বসিয়ে পানি খেতে দেয়। কিন্তু গুলির আওয়াজ হতেই তারা সবাই বেরিয়ে গেল।

    বড় সাহেব চিন্তিতভাবে হোটেলে ঢুকে বললেন, ‘হাসান খাঁ সাহেবের বুকে গুলি লেগেছে। তিনি ওখানেই পড়ে আছেন।’

    সমস্ত ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন।

    একজন এসে সংবাদ দিল, ‘প্রাইড অব পাকিস্তান রিকশাঅলা মারা গেছে।’

    : ‘এলফিনস্টোন স্ট্রিটে দুটো ছেলে মারা গেছে। ‘

    : ‘প্যারাডাইসের সামনে তিনটে লাশ পড়ে রয়েছে।’

    : ফেরদৌসের কাছে একটা এগারো বছরের ছেলে মরে পড়ে আছে।’

    : ‘এলফিনস্টোন স্ট্রিটে একজন লোক একটা আহত ছেলেকে সাহায্য করছিল। পুলিশ তাকেও গুলি করে মেরে ফেলেছে।’

    : ‘একটি ছেলে ছাদের উপর থেকে ঢিল ছুড়ছিল। তাকে ওখানেই শেষ করেছে।’ চাচাজি খুব ধৈর্য ধরে এসব খবর শুনছিলেন। তিনি রাগে এবং দুঃখে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এসব কী হচ্ছে? গুলি কেন চালাচ্ছে? ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি কি একদম লোপ পেয়েছে?’

    মুনশিজি বললেন, ‘যদি লোপই না-পাবে, তা হলে এরকম কাণ্ড কেন হবে?’

    : ‘কিন্তু এর পরিণামটা কী হবে?’

    ‘পরিণাম!’– গফুর কাবাবি চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বেঞ্চ থেকে উঠতে উঠতে বলল, ‘আমরা যেদিন এখানে এসেছিলাম, পরিণাম তো সেইদিনই ঠিক হয়ে গেছে।’

    বলতে বলতে চাচাজির বাক্সের উপর এক আনা পয়সা রেখে সে বেরিয়ে গেল।

    সবাই নীরব। কথাটা তাদের মনে কাঁটার মতো বিঁধছিল। অতীত এবং বর্তমানের কত দৃশ্য মনের সামনে ভিড় করে দাঁড়াচ্ছে। ভবিষ্যৎটা গ্যাসের ধোঁয়া আর গুলির আওয়াজে তলিয়ে গেছে।

    লোকে বাইরে গিয়ে হাঙ্গামায় যোগ দেয়। তার পর হোটেলে ফিরে এসে আজব আজব খবর শোনায়।

    পুলিশ একটি টাই-পরা কলারঅলা আপ-টু-ডেট বাবুকে ধরে লাথি-ঘুসি মারতে মারতে ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। খবরের কাগজের হকার সামির পায়ে গুলি লেগেছে। খেলনাঅলা সামাদের দিকে পুলিশ নিশানা করেছিল। সে শব্দ শুনেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। বোরি বাজারে লোকে পুলিশদের ঘিরে ফেলেছে। তারা বন্দুক নিয়ে একদিকে দৌড়ে যায়, আর পেছন থেকে তাদের ওপর পাথরবৃষ্টি হতে থাকে। ঘুরে অন্যদিকে যায় তো পেছন থেকে আবার পাথর পড়তে শুরু করে। তারা রেগে এদিক-সেদিক দু-চার বার গুলি চালিয়ে শেষে পালিয়ে গেছে।

    জরগুল খাঁ অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে গলির মধ্যে পানের ঠেলা-দোকানের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। হোটেল থেকে বের হবার সময় মকরানি তাকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘কি বাবা, গুল্লু খাঁ, লুকিয়ে রয়েছ এখন! এসো-না ময়দানে! আরে তুই-না সীমান্তের পাঠান!’

    : ‘শালা! হারামি! আমরা গুলি দেখে ভয় করি না। আমাদের কাছে বন্দুক নেই। নইলে শেষ করে দিতাম সবাইকে!’

    : ‘বাহ্! বেটা পাঠান! এরা সব তোমার বাপ যে ভয় পেয়ে গেছে!’

    বলতে বলতে মকরানি ক্যাপিটাল সিনেমার গলিতে ঢুকে গেল।

    হোটেলে গনি হকার অত্যন্ত উত্তেজিত এবং ক্রুদ্ধভাবে বলে চলেছে, ‘এই পাকিস্তান কার জন্যে হয়েছে? কে পাকিস্তানের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করেছে? গরিব মুসলমানরা, না যারা ক্লিফ্টনে থাকে, বিলাতে সফর করে বেড়ায়, আর ব্ল্যাকমার্কেট করে, তারা? আমরা ছয় বছর থেকে ফুটপাথে পড়ে আছি, আমাদের জিগ্যেসটি করার লোক নেই। ছেলেপিলের শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা হয়নি। আর, তারা মাইনে কমানোর কথা বলেছে বলে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে!’

    ফলঅলা বলল, ‘আমাদের বিপদ উদ্ধারের কোনও উপায় কি সরকারের হাতে নেই? কোনওই প্রতিকার নেই?’

    মুনশিজি বললেন, ‘হ্যাঁ, একটা প্রতিকার আছে। চুপ করে থাকো। মুখ বন্ধ করে রাখো। নইলে নিরাপত্তা আইন, জেলখানা…।’

    দিন শেষ হল। ছায়া দীর্ঘ হতে শুরু করল। কোলাহলও সন্ধ্যার অন্ধকারে তলিয়ে গেল। হোটেলে আর লোকজন রইল না। কিন্তু এখনও লোকে দল বেঁধে-বেঁধে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। রক্তের দাগের কাছে যখন ভিড় জমে উঠেছে, তখন প্রচারের গাড়ি থেকে চিৎকার করে বলা হচ্ছে : ‘১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, চার জনের বেশি লোক এক জায়গায় জমা হওয়া নিষেধ।’

    হোটেল আজ শিগগির বন্ধ হয়ে গেল। বড় সাহেব আর চাচাজি আগেই বাড়ি চলে গিয়েছে। রাত ক্রমশ গম্ভীর হয়ে আসছে।

    মকরানি, জরগুল আর বশির থালা-বাসন এবং হোটেল পরিষ্কার করার পর বেঞ্চের উপর নিজেদের বিছানা পাড়তে লাগল। মকরানির মনটা ভালো ছিল। সারারাত সে গুনগুন করে চলল, ‘কোই য়েহাঁ গিরা, কোই ওহাঁ গিরা…’, ‘আয় মেরে দিল কাহি আওর্ চল্…’; কিন্তু বশির আর জরগুলের খুব অসুবিধে হচ্ছিল গানে। ওরা বারবার কটমটে চোখে তার দিকে তাকায়, কিন্তু কিছুই বলে না। যখন সে কারও পাথর ছুড়বার বা গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার কাহিনি শোনায়, তখন বশির রেগে ছুরি নিয়ে তেড়ে যায়, ‘চুপ হারামি, চুপ করে থাক্! নইলে ছুরি মেরে দেব।’ মকরানি মৃদু হেসে চুপ মেরে যায়। আর, জরগুল তো সন্ধ্যাবেলা থেকেই একেবারে উদাস।

    ।

    সকাল থেকেই শহরের অবস্থা খারাপ। ট্রাম, বাস, ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা– সমস্ত বন্ধ। শহরে পূর্ণ হরতাল। হাজার হাজার লোক রাস্তায় এসেছে। তারা দোকান এবং ঠেলা-দোকান বন্ধ করিয়ে দিচ্ছে। ছোট ছেলের দল মোটর এবং ঘোড়ার গাড়ি থামিয়ে সোয়ারিদের হেঁটে যেতে বাধ্য করছে। পুলিশের প্রচারের গাড়ি রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কোথাও চারজনের বেশি লোক জমা হওয়া বেআইনি। আইন-ভঙ্গকারীদের গ্রেফতার করা হবে।– অথচ, শত শত লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    মালাবারি হোটেলের একটা দরজা খোলা। তাতে কালো পর্দা ঝুলছে। ভেতরে বৈঠক খুব জমে উঠেছে।

    : ‘আজ কি কোনও খবরের কাগজ বের হয়নি?’ –চাচাজি জুম্মনকে জিগ্যেস করলেন।

    মুনশিজি বললেন, ‘আজ খবরের কাগজের হরতাল, আর খবরই-বা এমন কী আছে? আমাদের সামনেই তো সবকিছু হচ্ছে। সারা শহরে একটা হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়েছে।’

    আখঅলা জানাল, ‘লরেন্স রোডে লোক পুলিশকে গাড়ি থেকে টেনে টেনে নামিয়ে পিটুনি দিয়েছে।’

    পিঠাঅলা নজির বলল, ‘সোলজার বাজারে লোকে চারজন সেপাইকে ঘিরে ফেলে তাদের ইউনিফর্ম খুলে নিয়েছে। আর কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে।’

    মকরানি চট্ করে জুড়ে দিল, ‘আর, তাদের মুখে কালো পালিশও ঘষে দিয়েছে।’

    : ‘কাল রাত্রে প্রধানমন্ত্রী রেডিওতে ছাত্রদের উদ্দেশ করে বলেছেন, তোমরা আমার ছেলে।’

    চানাচুরঅলা রেগে বলল, ‘জি! এসব প্রথমে মনে হয়নি বাবাজির!’

    কাপড়অলা বলল, ‘না-জানি কত ছেলে রক্তে ভেসে গেছে, কত ঘরের বাতি নিভে গেছে। আর এখন বলা হচ্ছে, ছাত্রেরা আমার কজের টুকরো!’

    চানাচুরঅলা জবাব দিল, ‘আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া হচ্ছে।’ দইবড়াঅলা একটা ভয়ংকর সংবাদ নিয়ে এল, ‘রাজা-ম্যানশনের কাছে গুলি চলেছে। একটা মদের দোকানের মালিক দোকান বন্ধ করতে অস্বীকার করায় জনতা দোকান লুট করে। তার পর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। তিনজন মারা গেছে।’

    মাহমুদ খাঁ পাঠান বলল, ‘ভালো করেছে মদের দোকান লুট করে। শালা! ইসলামি রাজত্ব বলে– এদিকে মদ বেচে!’

    একজন এসে খবর দিল, ‘প্লাজা-কোয়ার্টারে গুলি চলেছে। লোকে একটা মদের দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।’

    চাচাজি চিৎকার করে বললেন, ‘এসব কী কাণ্ড রে, বাবা! এ আগুন তো সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে!’

    কাপড়অলা বলল, ‘সারাদেশে এখন এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।’ মকরানি দৌড়ে এসে নেচে নেচে বলতে লাগল, ‘ওদিকে পেছনে– ফিরিয়ার রোডের মদের দোকানটা পুড়ে যাচ্ছে।’

    সব লোক বেরিয়ে এল। বাইরে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল।

    জনকুড়ি সেপাইভর্তি পুলিশের একটা ট্রাক শেজানের দিক থেকে এসে ভিক্টোরিয়া রোডের চৌমাথায় থেমে গেল। সেপাইরা লাঠি নিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে লাগল। কে যেন জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘মার্ শালাকে!’– তার পর শত শত লোক দাঁড়িয়েছিল বাসস্ট্যান্ড, ভিক্টোরিয়া রোড আর প্রেডি স্ট্রিটে; তারা পাথর, লাঠি আর কাঠ নিয়ে তাদের দিকে ধাওয়া করল। সেপাইরা ভয় পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গির্জায় গিয়ে ঢুকল। জনতার উচ্চহাসি শোনা গেল। মকরানি পাথর হাতে করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একমনে হাসতে লাগল।

    আজ জরগুল এক মিনিটের জন্যে হোটেল থেকে বের হয়নি। সে হোটেলেই কাজ করছিল। আজ সে ভারি বিব্রত এবং বিষণ্ন। জুম্মন জিগ্যেস করল, ‘কেন রে, আজ এমন উদাস হয়ে রয়েছিস কেন?’

    জরগুল কোনও জবাব দিল না।

    শরফু বলল, ‘হাসান খাঁ লালা মারা যাওয়ায় ও দুঃখ পেয়েছে।’

    জরগুল শুধু বলল, ‘ওস্তাদ, আরও অনেক লোক মরেছে।’

    মুনশিজি, কাপড়অলা, বইঅলা, মির্জাজি এবং গা-মালিশঅলা মদের দোকানের অবস্থা দেখে ফিরে এল। শহরের সমস্ত জায়গায় গোলমাল হচ্ছে। পুলিশ দেখলেই লোকে মারতে ছুটছে। কয়েক জায়গায় গুলি চলেছে। প্রত্যেক মুহূর্তে নতুন নতুন খবর হোটেলে আসছে। অবস্থা ক্রমশ খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে চলেছে। বারোটার সময় মকরানি এসে এক খবর দেওয়ায় সবার জান উড়ে গেল। সে বলল, ‘বন্দুকের দোকানগুলো লুট হয়ে গেছে।

    জরগুল নিজের জায়গা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার মুখখানা লাল হয়ে উঠল। সে হনহন করে বেরিয়ে গেল। মকরানি তাকে অনুসরণ করল। ভিক্টোরিয়া রোডে কাপড়ের স্টলগুলোর আড়ালে বারো বছরের একটা ছেলে বন্দুক হাতে করে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বন্দুকটা খোলার চেষ্টা করছিল। জরগুল লুব্ধদৃষ্টিতে নতুন, চকচকে বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিয়ে আয়। আমাকে দিয়ে দে বন্দুকটা।

    ছেলেটা দৃপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, ‘না, দেব না!

    জরগুল একটু হেসে বলল, ‘নিয়ে আয়, গুলি ভরে দিই।’

    ছেলেটি ক্রুদ্ধভাবে জবাব দিল, ‘না, দেব না।’– কিন্তু পরমুহূর্তেই জরগুলকে হাসতে দেখে বন্দুকটা সে তার হাতে দিয়ে দিল।

    জরগুল খুশির চোটে বন্দুকটায় চুমো দিয়ে নিল। তার পর খুলে ফেলে বলল, ‘গুলি কোথায়, নিয়ে আয়।’

    বিস্মিত ছেলেটা একটা ছোট কার্তুজ বের করে দিল।

    : ‘আরে, এটা যে একেবারে ছোট! এতে হবে না।’–জরগুল কার্তুজটা নলের একদিক দিয়ে ভরে অন্যদিক দিয়ে বের করে দিয়ে হাসতে লাগল। কয়েকজন পথিক জমা হয়ে তামাশা দেখতে লাগল।

    ছেলেটা পকেট থেকে অনেকগুলো কার্তুজ বের করে দোকানের চৌকির উপর রেখে দিল। জরগুল গুলি ভরে বন্দুকটা ছেলেটাকে দিতে দিতে বলল, ‘ঐ দ্যাখো, ফেরদৌসের কাছে সেপাই দাঁড়িয়ে আছে। মারো!’

    ছেলেটা বন্দুক নিয়ে নিল। তার মুখে আনন্দের আভাস দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সমস্ত শরীর কাঁপছে। না-জানি কোনদিকে বা নিশানা করে সে ঘোড়া টিপে দিল। তার পর নিজেই এক ঝটকায় পড়ে গেল এবং বন্দুকটা একদিকে ছিটকে পড়ল। লোকে হো হো করে হেসে উঠল। মকরানি পেট চেপে ধরে চৌকির উপর গড়াগড়ি দিতে লাগল। জরগুল বন্দুক উঠিয়ে নিয়ে চৌকির উপর থেকে কার্তুজগুলো তুলে পকেটে ভরে নিল। তার পর স্টলগুলোর আড়াল দিয়ে প্যারাডাইস সিনেমার দিকে চলে গেল।

    ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।

    : ‘আরে! কাঁদছিস?’– মকরানি হাসতে হাসতে বলল, ‘মা’র কথা মনে পড়েছে? আয় আমার সাথে। এক সিঙ্গেল দুধ খাইয়ে দেব।’

    ছেলেটা হু হু করে কাঁদতে লাগল, ‘ওই হারামিরা কাল আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে।’

    তার ভাইয়ের সাথে মকরানির আদৌ পরিচয় ছিল না। তবু সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আরে, ও মরেনি। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে মোটরে করে। আমি নিজে দেখেছি। তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কাল ছাড়া পেয়ে যাবে।’

    তবু ছেলেটি কাঁদতে লাগল।

    .

    হোটেলে বইঅলা অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বলছিল, ‘ওরা ছয় বছরে কী করেছে আমাদের জন্যে? আমাদের কোন্ দুঃখ-দরদ ঘুচিয়েছে? কোন্ বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে? এখন পর্যন্ত শত শত লোক ফুটপাথে পচছে। শত শত লোক বেকার। রুজি মেলে না। রেশনের দোকানে আটা পাওয়া যায় না। আমাদের কোনও দুঃখের খবর রাখে কি ওরা?’

    কাপড়অলা বলল, ‘সারাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। কাপড় আর খাবার জিনিস বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তরিতরকারির দাম দুই-তিন গুণ বেড়ে গেছে।’

    মুনশিজি দুঃখের সাথে বললেন, ‘আর, একসময় অহংকার করে বলা হত, আমাদের খাবার কখনও কম হবে না।’

    বইঅলা বলল, ‘আরে সাহেব, বলে কি না আমাদের টাকার দাম ভারতের পাঁচসিকের সমান। আর বাজারে কেউ দশ আনা দিয়েও পৌঁছে না।’

    মুনশিজি বললেন, ‘জি হ্যাঁ। আরও বলা হয়, আমরা স্বাধীন। ব্রিটিশ মহারানির অধীনে—’

    বইঅলা বলতে লাগল, ‘বাজার তো চড়েই চলেছে। না আছে রোজগার, না বাড়ি, না খাবার, না কাপড়। আর ছাত্রেরা মাইনে কমাতে চেয়েছে তো দেখুন তার পরিণাম।’

    মকরানি ভীতভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘চাচাজি, চাচাজি, জরগুল মারা গেছে।’– তার পর ঝট্ করে আবার বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল।

    জুম্মন ডাক দিয়ে বলল, ‘আবে এই হারামি! তুই কোথায় মরতে যাচ্ছিস?’

    চাচাজি ডাক দিলেন, ‘আরে, এই মকরানি–!’ কিন্তু সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

    তার পর প্রতিমুহূর্তে দুঃসংবাদ আসতে লাগল। চাচাজি, মুনশিজি, কাপড়অলা, মির্জাজি– সবাই মাথা চেপে ধরে এইসব খবর শুনতে লাগলেন। কিন্তু কারও মুখ দিয়ে কথা বের হল না।

    আখঅলা মারা গেছে।

    গফুর কাবাবি মারা গেছে।

    ফলঅলা আহত হয়েছে।

    অন্ধ হাফেজ, গনি, হামিদ আর ইলিয়াসকে গ্রেফতার করেছে। খবরের জাগজের হকার আহমদ এবং জাপানি রুমালঅলা আসলাম আহত হয়েছে। আকাশ-বাতাস গ্যাসের ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ আসতে লাগল। সবাই চুপ করে বসে রয়েছেন। চাচাজি মাঝে মাঝে রাগে চিৎকার করে উঠছেন, ‘এ সমস্ত কী হচ্ছে? কেন? এর পরিণামই-বা কী হবে?’– কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না।

    একখানা মোটরগাড়ি ভিক্টোরিয়া রোডে ঘোষণা করে দিয়ে গেল, ‘পাঁচটার সময় থেকে শহরে কারফিউ চলবে। কোনও লোককে বাড়ির বাইরে দেখা গেলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। গুলিও করা যেতে পারে। আপনারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান।’

    কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় জনতা সেই একইভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

    বড় সাহেব জিগ্যেস করলেন, ‘সে হারামি কোথায় গেল?’

    জুম্মন উত্তর দিল, ‘কী জানি, একঘণ্টা থেকে তার পাত্তা নেই।

    : ‘আর, বশির ‘

    : ‘তারও পাত্তা নেই। ‘

    শরফু বলল, ‘সে তো সকাল থেকেই নিখোঁজ।’

    বড় সাহেব রাগে এবং দুঃখে বললেন, ‘সব শালা মরে গেছে। জুম্মন, তাড়াতাড়ি হোটেল বন্ধ করো! শহর মিলিটারির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচটা থেকে কারফিউ আরম্ভ হবে। চলো চাচাজি, বাসায় যাই। জুম্মন, তুমি রাত্রে এখানেই শোবে।’

    পাঁচটা বাজবার আগেই হোটেল বন্ধ করে দেওয়া হল। সবাই বাড়ি চলে গেল। জুম্মন অনেকক্ষণ একা হোটেলে বসে রইল। যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল, তখন দরজায় তালা লাগিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে এল। লোকজন তখন পর্যন্ত দল বেঁধে বেঁধে এদিক-সেদিক ঘুরছিল, আর মিলিটারি সেপাইরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল; পুলিশের কোথাও পাত্তা পাওয়া গেল না। রাস্তায় পাথরের স্তূপ জমে রয়েছে। আর ফুটপাথে দোকানের কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় রক্তের ছাপ। লোকে সেইসব দাগের কাছে এসে দাঁড়ালে মিলিটারি সেপাইরা তাদের বোঝাচ্ছে। তখন তারা চুপচাপ এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে।

    অন্ধকার আস্তে আস্তে শহরটাকে ছেয়ে ফেলল। পথঘাট নির্জন হয়ে গেল। কোনও বাড়ি থেকে রেডিও’র শব্দও শোনা যাচ্ছে না। একটা ভয়াবহ নীরবতা সমস্ত শহরটাকে চেপে ধরেছে। তবু মিলিটারি ট্রাক্ বা জিপ দ্রুতবেগে চলে যাওয়ার শব্দ মুহূর্তের জন্যে এই নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে। তার পর আবার সব নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।

    .

    সকাল সাতটা বাজবার সাথে সাথে লোকে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ট্রাম, বাস চলাচল শুরু হল। আজ প্রত্যেকের মুখ মলিন। ঘাড় নিচু করে চুপচাপ তারা নিজের কাজে চলে যাচ্ছে। বাজার বন্ধ। কিন্তু দু-একটা দোকান খোলা হয়েছে।

    মালাবারি হোটেলের কপাল পুড়ে গেছে। কয়েকজন মাত্র লোক হোটেলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। জুম্মন আর শরফু নিজের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। বশির খদ্দেরদের চা দিচ্ছে। সে আজ সকালে কাজে ফিরে এসেছে। মুনশিজি পোস্টকার্ড আর টিকিটের বাক্স নিয়ে এসেছেন, কিন্তু আজ তাঁর দোকান খুলতে ইচ্ছা করছে না। মসজিদের হাফেজ সাহেব দিল্লির কাপড়অলার সাথে আস্তে আস্তে কথা বলছেন।

    মাহমুদ খাঁ পাঠান মুনশিজির খোঁজে হোটেলে এসে পৌঁছল, ‘মুনশিজি, একটা চিঠি হাসান খাঁর বাড়ির লোকের কাছে লিখে দাও! ঠিকানা আমি বলে দিচ্ছি। বেচারার তিনটে ছোট ছোট বাচ্চা আছে।’

    জুম্মন বলল, ‘হ্যাঁ, মুনশিজি, জরগুলের চাচাকেও একটা চিঠি লিখে দাও। তার বিধবা বুড়ি-মা আছে। সে-ই তার একমাত্র ছেলে।’

    জুম্মন মুনশিজির সামনে চায়ের পেয়ালা রাখতে রাখতে বিষণ্নসুরে আস্তে আস্তে বলল, ‘আর মকরানি!’

    মুনশিজি চশমার উপর দিয়ে জুম্মনের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘হ্যাঁ, মকরানি!’

    প্রত্যেকেই কেমন জানি উদাস হয়ে গেল। সবার মাথা নুয়ে পড়ল। মুনশিজি জিগ্যেস করলেন, ‘ওর নাম কী ছিল?’

    কেউ কোনও জবাব দিল না।

    : ‘ওর বাড়ি কোথায়?’

    তবু সবাই নীরব।

    : ‘ওর মা-বাপ কোথায়?’

    এবারও কারও মুখে কথা নেই।

    এবং তার পরিণাম যে কী হয়েছে, সে-কথাও কেউ জানে না।

    অনুবাদ : মিলি হোসেন

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
    Next Article এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }