Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প – সম্পাদনা : শহিদুল আলম

    লেখক এক পাতা গল্প766 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫.১০ ওভারকোট – গোলাম আব্বাস

    ওভারকোট – গোলাম আব্বাস

    জানুয়ারির কোনো এক শনিবারের সন্ধেয় সুন্দর পোশাক পরা একটি যুবক ডেভিস রোড থেকে বেরিয়ে মল রোডে এসে নামল। তারপর, ফুটপাত ধরে আস্তে আস্তে চেয়ারিং ক্রসের দিকে চলতে লাগল। হাবভাব দেখে তাকে বেশ রুচিশীল ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে। লম্বা লম্বা জুল্ফি। ঝক্‌ঝকে চুল। পাতলা একজোড়া গোঁফ (যেন সুর্মার শলা দিয়ে আঁকা)। গায়ে বাদামি রঙের গরম ওভারকোট (হালকা রঙের দু-একটি ফুটন্ত গোলাপফুলের কাজ করা)। একপাশে বিশেষ কায়দায় কাত করা মাথার ওপর একটি ফেল্ট হ্যাট। সিল্কের সাদা মাফলার গলায় জড়ানো এক হাত ওভারকোটের পকেটে, অন্য হাতে বেতের একটি ছড়ি। মাঝে মাঝে ছড়িটাকে সে ঘুরিয়ে চলেছে।

    তীব্র শীতের মরশুম তখন। জোর ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে এসে সুচের মতো বিঁধছে। কিন্তু যুবকটির এসবে বিশেষ কিছু এসে-যাচ্ছে বলে মনে হয় না। আর-সব পথচারী জোরে জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল– শরীর কিছুটা গরম হবে এই ভরসায়। কিন্তু যুবকটির এসবের যেন কোনো প্রয়োজনই নেই। এই কন্কনে শীতে পায়চারি করে বেড়িয়েই যেন তার তৃপ্তি

    দূর থেকে তার চলন দেখেই টাঙাঅলা ভুল করে ঘোড়া ছুটিয়ে কাছে এল। কিন্তু ছড়ির ইশারায় অসম্মতি জানাল সে। একটি খালি ট্যাক্সিও একসময় কাছে এসে থামল। কিন্তু সে শুধু ‘নো, থ্যাংক্‌স্’ বলেই এগিয়ে গেল সেখান থেকে।

    মলের সুসজ্জিত এলাকার দিকে যতই সে এগিয়ে চলল, চলার কায়দা তার ততই ভদ্রোচিত হতে লাগল। শিস কেটে, চলনের মধ্যে একটা ইংরেজি নাচের ঢং ফুটিয়ে তুলল মাঝে মাঝে। দেহের সাথে সাথে পা দুটিও নাচতে লাগল। আশপাশে তাকিয়ে নিয়ে মিছিমিছি বল ছোঁড়ার কায়দার একবার সে ছুটে গেল। সত্যি-সত্যিই ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে যেন।

    চলতে চলতে লরেন্স গার্ডেনসের দিকে যাবার পথ দেখা গেল। কিন্তু সন্ধের অন্ধকার, ঠাণ্ডা বাতাস আর অবিরাম শিশির পড়ার জন্যে বাগান জনশূন্য, তাই সেদিক পানে সে আর এগুলো না। সোজা চেয়ারিং ক্রসের দিকেই চলতে থাকল সে।

    রানির মূর্তির কাছে গিয়ে তার গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে এল। পকেটের বদলে আস্তিনের ভাঁজের ভেতর থেকে একখানা রুমাল বের করে আলতোভাবে মুখের ওপর বুলিয়ে নিল একবার। ধুলো জমে থাকলে পরিষ্কার হয়ে যাবে– এই উদ্দেশ্যে।

    পাশেই ঘাসের একটি চত্বরে কয়েকটি ইংরেজ-শিশু বল নিয়ে খেলা করছে। খুব মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখতে লাগল তাদের। তার এই উপস্থিতিকে আমল না-দিয়ে ছেলেরা আগের মতোই খেলে যেতে লাগল। কিন্তু লোকটাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্রমেই তারা লজ্জা পেতে লাগল। তারপর, হঠাৎ বলটা উঠিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে সেখান থেকে তারা সরেই পড়ল অবশেষে

    সিমেন্টের একটি খালি বেঞ্চের উপরে গিয়ে যুবকটি বসে পড়ল। সন্ধের অন্ধকার বাড়বার সাথে সাথে ঠাণ্ডাও বেড়ে চলেছে খুব। শীত বেশ তীব্র বটে, কিন্তু লোকে আরাম-প্রীতির তীব্রতা তীব্র শীতেই বেশি করে অনুভব করে। বিশেষ করে একথা সত্যি শহরের যারা আয়েসি, তাদের কাছে। তারা এমন ঠাণ্ডায় কখনো চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। যারা নিতান্তই একা থাকতে ভালোবাসে, তারাও এমন সময় সঙ্গ খোঁজে। ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে, সভা-বৈঠকে গিয়ে গা গরম করার কথা চিন্তা করে। সঙ্গী পাওয়ার আনন্দ তাদের বাইরে বের করে আনে। সাধ্যমতো কেউ রেস্তোরাঁ-কফিখানায়, কেউ নাচশালা-প্রেক্ষালয়ে কিংবা অন্য কোনো আড্ডায় মজলিশে গিয়ে নিরাপদ হতে চায় শীতের হাত থেকে।

    মল রোডে মোটর-ট্যাক্সি, টাঙা আর বাই-সাইকেল তো হরদম চলছেই, ফুটপাতের উপর দিয়ে পায়ে-হাঁটা লোকের যাতায়াতেরও কমতি নেই। তাছাড়া, রাস্তার দু-পাশের সারিবদ্ধ দোকানগুলোয় কেনাবেচাও পুরোদমে চলছে। যেসব হতভাগার পয়সা খরচ করে আড্ডা জমানোর বা বাজার-সওদা করে সময় কাটানোর ক্ষমতা নেই, দূর থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের আড্ডা দেয়া আর দোকানের রং-বেরঙের আলো দেখে নিচ্ছে তারা।

    যুবকটি পাকা বেঞ্চের উপর বসে সামনের রাস্তা দিয়ে চলমান মেয়ে-পুরুষের ভিড়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের মুখের চাইতে পোশাকের দিকেই তার বেশি নজর। হরেক শ্রেণির লোক রয়েছে পথচারীদের মধ্যে– বড় বড় ব্যবসায়ী, সরকারি অফিসার, লিডার, শিল্পী, কলেজের ছাত্র, বেকার কর্মপ্রার্থী, নার্স, খবরের কাগজের রিপোর্টার, অফিসের কেরানি। তাদের বেশিরভাগই ওভারকোট পরা। নানান ধরনের রং-বেরঙের ওভারকোট। অতি মূল্যবান রংচঙে থেকে শুরু করে নিলামে কেনা ছাই-রঙের পুরনো মিলিটারি ওভারকোট পর্যন্ত– সবরকমেরই চোখে পড়ছে।

    যুবকের ওভারকোটটি যথেষ্ট পুরনো হলেও এর কাপড় কিন্তু বেশ দামি। তাছাড়া, এটা সেলাই করাও হয়েছে কোনো দক্ষ দর্জির কাছ থেকেই। কোটটি দেখলে সহজেই বোঝা যায়, মালিক এর বেশ যত্ন নেয় এখনো। কড়া ইস্তিরি করা শক্ত কলার। রঙের জৌলুস সর্বত্র স্পষ্ট। কোথাও ভাঁজের চিহ্ন নেই। শিঙের বড় বড় বোতাম চক্‌চক্ করছে। ওভারকোটটির জন্যে সে যেন খুব গর্বিত বলেও মনে হয়।

    পান-বিড়ি-সিগারেটের ডালা গলায় ঝুলিয়ে একটি ছেলে সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল।

    সে ডাক দিল, ‘ওই পানঅলা!’

    ‘জি হুজুর?’

    ‘দশ টাকার চেঞ্জ হবে?’

    ‘না হুজুর। ভাঙিয়ে আনতে পারি। কী নেবেন?’

    ‘নোট নিয়ে যদি পালিয়ে যাস?’

    ‘বা সাহেব! চোর নাকি যে পালিয়ে যাব? বিশ্বাস না-হলে আমার সঙ্গে চলেন। নেবেন কী আপনি?’

    ‘না, না, আমি নিজেই ভাঙিয়ে আনতে পারব। এই যে এক আনা পয়সা পাওয়া গেছে। একটা গোল্ডফ্লেক দিয়ে যা!’

    ছেলেটা চলে যাওয়ার পর আরাম করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল সে। এমনিতেই তাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছিল। কিন্তু গোল্ডফ্লেকের স্বচ্ছ ধোঁয়ার আমেজে সে-খুশি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেল যেন।

    একটি ছোট্ট সাদা বেড়াল ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বেঞ্চের নিচে তার পায়ের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ম্যাও-ম্যাও করতে লাগল। বেড়ালটির গায়ে হাত বুলোতেই লাফিয়ে সে বেঞ্চের উপর উঠে পড়ল। আদর করে তার পিঠের উপর হাত বুলোতে বুলোতে সে বলল, ‘পুওর সোল!’

    বেঞ্চ থেকে উঠে রাস্তা পেরিয়ে রঙিন আলোয় উজ্জ্বল সিনেমাহাউসের দিকে সে এগিয়ে গেল। শো তখন শুরু হয়ে গেছে। সিনেমার বারান্দায় ভিড় নেই। দু-চারজন লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসছে-হপ্তার ছবিগুলো দেখে নিচ্ছে। ছোট-বড় বোর্ডের গায়ে সেগুলো লাগানো রয়েছে। সিনেমার বিশেষ বিশেষ দৃশ্যের ছবিই কেবল স্থান পেয়েছে তাতে।

    তিনটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তরুণী গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি দেখছিল। সে-ও নিরাপদ দূরত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সমঝদার দর্শকের মতো ছবি দেখতে লাগল। মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মত্ত। ফিল্মের ওপরে মন্তব্যও করেছিল কেউ কেউ।

    হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে একটি সুন্দরী এবং মুখরা মেয়ে বিকট অট্টহাসি জুড়ে দিল। তারপর, তিনজনেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। যুবকটির ওপর এর কোনো প্রভাব পড়ল বলে মনে হয় না। সে-ও একটু পরেই বেরিয়ে এল সিনেমা হাউস ছেড়ে।

    সাতটা বেজে গেছে। মলের ফুটপাতের উপর দিয়ে সে আবার পায়চারি করতে লাগল। একটি রেস্তোরাঁয় অর্কেস্ট্রা বাজছে। ভেতরের চাইতে বাইরেই বেশ ভিড়। বাইরের শ্রোতাদের মধ্যে মোটরের ড্রাইভার আর গাড়ির কোচওয়ানেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর রয়েছে ফল বিক্রি করে টুরি হাতে বাড়ি-ফেরতা কিছু পথিক, ফেরিঅলা, কিছু ভিখিরি। এরা সব সংগীতের সমঝদার শ্রোতা বলেই কোনোরকম গণ্ডগোল না-করে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্কেস্ট্রা শুনছে– যদিও সুর সম্পূর্ণ বিদেশি। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আবার এগিয়ে গেল যুবকটি।

    কিছুদূর যেতেই ইংরেজি বাদ্যযন্ত্রের একটি বড়মতো দোকান চোখে পড়ল। বিনাদ্বিধায় ভেতরে ঢুকল সে। চারদিকে কাঁচের আলমারিতে রকমারি ইংরেজি বাজনার সরঞ্জাম সাজানো। একটি লম্বা টেবিলের উপর পশ্চিমা সংগীতের দুই পৃষ্ঠার কয়েকটি পুস্তিকা রাখা। নতুন গানের স্বরলিপি রয়েছে তাতে। পুস্তিকাগুলোর প্রচ্ছদপট সুন্দর রংচঙে, কিন্তু ভেতরের গানগুলো নিম্নস্তরের। উড়ো উড়ো একনজর সে দেখে নিল সেগুলো। সেখান থেকে সরে এসে যন্ত্রগুলোর ওপর নজর বুলোতে লাগল। খুঁটির সাথে ঝোলানো একটি স্পেনীয় গিটারের দিকে সমালোচকের দৃষ্টিতে তাকাল। গিটারের সাথে লাগানো প্রাইস-টিকেটটা পড়ল। সেখান থেকে সরে গিয়ে একটি জার্মান পিয়ানো আঙুল দিয়ে নেড়ে চেড়ে, বাজিয়ে দেখে নিয়ে, বন্ধ করে রাখল!

    দোকানের একজন কর্মচারী তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘গুড ইভ্নিং স্যার। বলুন, আপনার কী চাই?’

    ‘না, ধন্যবাদ। হ্যাঁ, এ মাসের নতুন গ্রামোফোন রেকর্ডের একটা লিস্ট আমাকে দিতে পারেন

    লিস্টখানা ওভারকোটের পকেটে ফেলে রাস্তায় নেমে পড়ল সে। তারপর, আবার চলতে লাগল। রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট বুক-স্টলে গিয়ে সে দাঁড়াল। কয়েকটি নতুন পত্রিকার পাতা উল্টে, নেড়েচেড়ে দেখে, আবার যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিল। সেখান থেকে আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কার্পেটের একটা দোকান চোখে পড়ল তার। লম্বা চোগা আর মাথায় লম্বা তুর্কি টুপি পরা দোকানের মালিক তাকে বেশ সাদর সম্ভাষণ জানালেন।

    ‘ইরানি কর্পেটটা দেখার ইচ্ছে ছিল।… ঠিক আছে, নামাতে হবে না। আমি এমনিই দেখে নেব। এটার দাম কত পড়বে?’

    ‘চোদ্দ শো বত্রিশ টাকা।’

    যুবকটি ভ্রু কুঁচকাল– ভাবখানা এই, এত দাম?

    ‘আপনি আগে পছন্দ করে নিন, তারপর যতটুকু সম্ভব, আপনার কাছ থেকে কম নেবার চেষ্টা করব।’

    ‘ধন্যবাদ। আমি এখন শুধু একনজর দেখতে এসেছিলাম।

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, দেখবেন বইকি। আপনার নিজের জিনিস মনে করে দেখুন, স্যার।’

    দু-তিন মিনিট পরে কার্পেটের দোকান থেকেও বেরিয়ে এল সে। ওভারকোটের জায়গায় জায়গায় ফুটন্ত গোলাপফুলের যে কাজ করা রয়েছে, কোথাও কোথাও তার সুতো খুলে গেছে দেখে সেগুলো ঠিক করে দিতে দিতে তার ঠোঁটের কোণায় মৃদু, অথচ অর্থপূর্ণ হাসি ফুটে উঠল। তারপর, আবার ফুটপাতের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।

    চলতে চলতে এখন সে হাইকোর্টের সামনে এসে পড়েছে। এত হাঁটার পরেও তার মুখের মধ্যে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। এক অপরিবর্তনীয় উদ্যম নিয়ে সে হেঁটেই চলেছে। এখন পায়ে-হাঁটা লোকের ভিড় অনেক কমে এসেছে। অনেকক্ষণ পরে পরে দু-একজন লোক ফুটপাতের উপর দিয়ে আসছে-যাচ্ছে। বেতের ছড়িটাকে এক আঙুলে নিয়ে ঘোরাবার চেষ্টা করল সে। পারল না। ঘোরাতে গিয়ে ছড়িটা নিচে পড়ে গেল। ‘ওহ্ সরি’ বলে ছড়িটা উঠিয়ে নিল হাত বাড়িয়ে।

    ইতোমধ্যে একজোড়া তরুণ-তরুণী পেছন পেছন আসছিল। পাশ দিয়েই তারা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ছেলেটা লম্বা স্বাস্থ্যবান। কালো কর্ডের প্যান্ট পরনে। গায়ে চামড়ার জ্যাকেট। মেয়েটির পরনে সার্টিনের ছক-কাটা শালওয়ার আর সবুজ রঙের কোট। তার চলনভঙ্গি বেশকিছুটা গম্ভীর। একটিমাত্র চুলের বেণি পিঠের উপর দিয়ে কোমর পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। চলার তালে তালে বেণিটিও সুপুষ্ট দেহের উপর দাপাদাপি করছে।

    পেছন থেকে এই দৃশ্যটি যুবকটির কেন জানি উপভোগ্য বলে মনে হল। কিছুদূর নীরবে চলার পর তরুণ-তরুণীর মধ্যে শুরু হল বাক্যালাপ।

    ছেলেটির কী কথার জবাবে মেয়েটি হঠাৎ চমকে উঠে বলল, ‘না। না। না। কক্ষনো না। কক্ষনো না।’

    ‘আমার কথা শোনো লক্ষ্মীটি!’ উপদেশের ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল, ‘ডাক্তার আমার বন্ধু লোক। কেউ জানতে পারবে না।’

    ‘না। না। না।’

    ‘আমি বলছি, তোমার একটুও কষ্ট হবে না।’

    মেয়েটি নিরুত্তর।

    ‘তোমার বাবা-মা কত দুঃখ পাবেন। তাঁদের মান-ইজ্জতের কথাটাও কি ভাববে না?’

    ‘চুপ কর, চুপ কর, বলছি! নইলে আমি পাগল হয়ে যাব।’

    এতখানি পথ সন্ধের পর থেকে চক্কর দিতে দিতে যত মুখ সে দেখেছে, যত মানুষের কথা শুনেছে– কারুর দিকেই সে আকৃষ্ট হয়নি। হয়নি হয়তো আসলে নিজের ধ্যানেই আগাগোড়া মগ্ন ছিল বলে; না-হয়, তাদের মধ্যে আকর্ষণীয় তেমন কিছু আদৌ পায়নি বলে। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্রের মতো অভিব্যক্তিময় তরুণ-তরুণী দুটি তাকে যেন মোহাচ্ছন্ন করে ফেলল। আকর্ষণ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের আরো কথা শোনার, এমনকি সম্ভব হলে কাছে থেকে তাদের মুখ দুটি দেখে নেয়ারও প্রবল ইচ্ছে হতে লাগল তার।

    ততক্ষণে জি.পি.ও.-র চৌরাস্তার কাছে পৌঁছে গেছে ছেলে-মেয়ে দুটি। দুজনেই এক মুহূর্তের জন্যে থেমে আবার মেলোড রোডের উপর দিয়ে চলতে লাগল। যুবকটি দাঁড়িয়ে রইল মল রোডের উপরেই। হয়তো সে ভাবল, সঙ্গে সঙ্গে পেছনে গেলে তারা যদি কোনোরকম সন্দেহই করে বসে, তাই কিছুক্ষণ দেরি করে যাওয়াই ভালো।

    ছেলে-মেয়ে দুটি একশো গজের মতো আগে চলে যেতেই একলাফে তাড়াতাড়ি গিয়ে সে তাদের ধরতে চাইল। কিন্তু অর্ধেক পথ পেরোতে না-পেরোতেই একটা লরি পেছন থেকে এসে তাকে চাপা দিয়ে মেলোড রোড দিয়ে বেরিয়ে গেল। আহতের চিৎকার শুনে এক নিমেষে ড্রাইভার গতি ঢিমে করল। সহজেই সে আন্দাজ করতে পারল, গাড়ির তলায় কেউ চাপা পড়েছে। রাত্রির অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ছুটে পালাল সে। দু-তিনজন পথচারী দুর্ঘটনা হতে দেখেই গাড়ির নম্বর দেখার জন্যে চ্যাঁচাতে লাগল। কিন্তু গাড়ি তখন হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে।

    ইতোমধ্যে আরো জনকয়েক লোক ছুটল সেখানে। একজন ট্রাফিক-ইন্‌সপেক্টর মোটর-সাইকেল চালিয়ে সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন, তিনিও থামলেন। যুবকের দুটি পা-ই গাড়ির চাকায় পিষে গেছে। অনেক রক্ত বেরিয়েছে, এখনো বেরুচ্ছে।

    সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত একটা গাড়ি ধরে নিয়ে তাতে যেমন-তেমন করে আহতকে চাপিয়ে দিয়ে বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরেও ধিক্ ধিক্ করে প্রাণস্পন্দন দেখা যাচ্ছিল যুবকটির বুকে।

    এমারজেন্সিতে তখন ডিউটিতে ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন মিস্টার খান এবং দুটি তরুণী নার্স মিস শাহ্‌নাজ আর মিস গিল।

    স্ট্রেচারে করে তাকে অপারেশন-রুমের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় নার্স দুটির দৃষ্টি পড়ল তার ওপর। বাদামি রঙের ওভারকোটটি এখনো গায়েই রয়েছে। সাদা সিল্কের মাফলারটিও গলায় জড়ানো। ওভারকোট ও মাফলারের জায়গায় জায়গায় রক্তের দাগ। দয়া করে ফেল্ট হ্যাটখানা তার বুকের উপর আলতো করে রেখে দিয়েছে কেউ।

    শাহ্‌নাজ মিস গিলকে বলল, ‘কোনো ভদ্রঘরের ছেলে বলে মনে হচ্ছে বেচারাকে।’ ফিফিস্ করে গিল বলল, ‘শনিবারে ছুটির সন্ধ্যায় বেশ সেজেগুজেই বেচারা বেরিয়েছিল।

    ‘ড্রাইভার ধরা পড়েছে কিনা, জানো?’

    ‘না, পালিয়ে গেছে।’

    ‘ভারি দুঃখের ব্যাপার।’

    অপারেশন-রুমে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন আর নার্স দুটি নাকের উপর সাদা পটি লাগিয়ে আহতের পরিচর্যায় ব্যস্ত। পাথরের টেবিলের উপর শুইয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। মাথা থেকে তীব্রগন্ধী তেলের ঘ্রাণ একটু একটু ভেসে আসছে। দুর্ঘটনায় তার দুটি পা পিষে গিয়ে থাকলেও মাথার টেরিটা তখনো অটুট রয়েছে। এখন তার সমস্ত কাপড়-চোপড় খোলা হচ্ছে। সবার আগে গলা থেকে সিল্কের সাদা মাফলারটি খোলা হল। সঙ্গে সঙ্গে নার্স দুটি চমকে উঠে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। তাদের এই আঁতকে ওঠা বিস্ময়কর নয়। মাফলারের নিচে যুবকের গলায় নেক্‌টাই বা কলার তো নেই-ই, এমনকি শার্ট পর্যন্ত নেই।

    ওভারকোট খোলার পর দেখা গেল, ওভারকোটের নিচে রয়েছে পুরনো ছেঁড়া একটা সোয়েটার। সোয়েটারের অজস্র ছিদ্রের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সোয়েটারটির চেয়েও বেশি পচা আর জীর্ণ একটি গেঞ্জি।

    মাফলারটিকে গলার চারপাশে এমনভাবে জড়িয়ে রাখা হয়েছে, যাতে করে তার বুকও ঢেকে গিয়েছে মাফলারে। শরীরে সর্বত্র পুরু হয়ে ময়লা জমে রয়েছে, তীব্র দুর্গন্ধ ভেসে আসছে শরীর থেকে। দু-মাস ধরে সম্ভবত গোসল করেনি সে। অবিশ্যি ঘাড়টুকু এর ব্যতিক্রম– ইতস্তত পাউডার ছড়ানো রয়েছে ঘাড়ে।

    সোয়েটার আর গেঞ্জির পরে প্যান্টের পালা আসতেই শাহ্‌নাজ আর গিল আরেকবার পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

    বেল্টের বদলে প্যান্টটা ছেঁড়া একটা নেক্‌টাই দিয়ে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে কোমরে। বোতাম কিংবা বলেসের কোনো বালাই নেই! দুই হাঁটুর উপর অনেকখানি করে জায়গা জুড়ে কাপড়ই অনুপস্থিত। তাছাড়া, আরো কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। প্রায় সম্পূর্ণ প্যান্টটিই ওভারকোটের নিচে ঢাকা ছিল বলে এগুলো কারো চোখে পড়েনি।

    বুট আর মোজা খোলার পালা আসতেই আরো একবার মিস শাহ্‌নাজ আর মিস গিল একজন আরেকজনের দিকে তাকাল।

    বুট দুটি অত্যন্ত পুরনো হওয়া সত্ত্বেও পালিশ লাগিয়ে বেশ চকচকে করে রাখা হয়েছে। কিন্তু এক পায়ের মোজার সাথে অন্য পায়ের মোজার কোনো মিল নেই। তাছাড়া, মোজা দুটি এত বেশি ছেঁড়া যে, যুবকের ময়লা গোড়ালি তার থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে পড়েছে।

    .

    নিঃসন্দেহে ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে তার। নির্জীব দেহখানা পাথরের টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে। টেবিলে শোয়ানোর পর মুখখানা ছাদের দিকে ছিল, কাপড়-চোপড় খুলতে গিয়ে সে-মুখ এখন ঘুরে গেছে দেয়ালের দিকে। দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছে, যেন দেহের নোংরামির সাথে সাথে আত্মার নোংরামির জন্যেও সে খুব লজ্জিত। তাই সবার কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে রাখতে চায় সে।

    যুবকটির ওভারকোটের বিভিন্ন পকেট থেকে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, তার তালিকা নিম্নরূপ :

    একটি ছোট্ট কালো চিরুনি, একটি রুমাল, সাড়ে ছয় আনা পয়সা, আধপোড়া একটি গোল্ডফ্লেক সিগারেট, কয়েকজনের নাম-ঠিকানা লেখা একটি ছোট্ট নোট-বই, নতুন গ্রামোফোন রেকর্ডের একটি মাসিক তালিকা, আর কতকগুলো বিজ্ঞাপনের কাগজ।

    দুঃখের বিষয়, বেতের ছড়িটি এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সম্ভবত দুর্ঘটনার সময় সেটা কোথাও হারিয়ে গেছে।

    অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার বোকা শৈশব – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
    Next Article এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে – আবদুল্লাহ আল-মুতী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }