Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প1423 Mins Read0

    কুয়োতলার কাব্য – অশোককুমার কুণ্ডু

    কুয়োতলার কাব্য – অশোককুমার কুণ্ডু

    বর্ষা এসেছে তিলুর উঠোনে। চোইত বোশেখের পোড়ামাটিতে আজই প্রথম বর্ষার এক ঝট। গন্ধ উঠেছিলো মাটির! আকাশটা তেমন জমেনি। প্রথম বর্ষা তো, কিছুটা কুমারী মেয়ের মন, দাঁড়ালো না। এসেছিলো, চলে গেল, উঁকি দিলো, সবটা দেখা গেল না।

    বুও দুকুঠরী ঘরের পশ্চিম মটকার কোণের আকাশ যেন ধান সিজোনো হাঁড়ির কালো মুখ, মিশকালো। যেন মরা বিকেলে আবার নামবে। এই এলো, আবার গোটাও পাততাড়ি, গোয়ালের গরু সামলাও, খামার থেকে তুলে আনো বন্দিনী তিলের শুটি, মাকাই ও সরষের বীজ, রোদ খেতে দেওয়া ঋতুমতী গমের বীজদের। হাওয়া বইলো দমকা মেরে। গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় গা ঘষাঘষি, ঠেকাঠেকি, অনেকদিন প্র যেন প্রাণখোলা প্রতিবেশী।

    এই কদিন দেখতে দেখতে শেষ আষাঢ়ের আরও পাঁচটা দিন গেল। তিলুর ক্যালেণ্ডার বলতে একটি তালপাতা। সে তালপাতায় আছে গোয়ালার গুণ-ছুঁচের হিসাবে দাগ। পাচদিন হলো মনে মনে হিসেব করলো তিলু, কেননা এই পাঁচদিন হয়েছে, কালো গাই-গরুটা ডাকছে। মাঠ দেখানোর সময়। এ সময় এই প্রথম ডাক পার হলে বড় মুশকিল, অথচ এই গরুটা তিলুর বাপের বাড়ির সামগ্রী। বিয়ের পরই দেওয়া, তিলুর বাচ্চা দুধ খাবে।

    এই পাঁচদিন তিলুর ভিতরে কোথাও মেঘ জমেছে? কোথাও কি বর্ষার পায়চারি কিংবা কোথাও বেড়ার পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাম মেহদী ফুলের গন্ধ? তিলু সামান্য নাড়া খেয়েছে, ঐ যে কথায় বলে, আগুনের কাছে ঘি থাকলে গলবেই গলবে।

    দুপুরে প্রথম জলের আগেই হুটোপাটি করে সংসারের জিনিসপত্র ভোলাতুলির সময় পেজালি বসেছিলো উঠোনে, ভাতঘুম থেকে ওঠার পর তিলু দেখলো সেইসব পেঁজালিগুলি মুছে গেছে প্রায়। গাই গরুটাকে দেখতে ভূষণ আসবে, আজকে চারদিনের ওষুধ শেষ হয়েছে। গরুটাও দস্যি, বলিহারি যাও! খোঁটার দড়ি ছিঁড়ে লড়াই করে ডাইরে শিং ভেঙে, ও একবারে রক্তের কন্যা। তারপর এই ডাক। বিপদের উপর আরও এক গেরো। এই সব ঘরগেরোস্তো, শ্বশুরবাড়ি, কাঠ কয়লার গনগনে আগুনের মত জা মায়া, আর তার বড় ছেলে, তিলুর বড় ন্যাওটা। এই সব পাঁচমিশেলি ভাবনায় তিলুর মন আজ আনচান। ভূষণ আসবে বিকেলে। ভূষণ এসেছিলো ফিরে লক্ষ্মীবার। সেই মানুষটার কোনো খবর নাই বহুদিন।

    খিড়কির পশ্চিমপাড়ে তালগাছ একপায়ে সব কথায় সাক্ষী। পাশের যে পাতাটা ঝুলে পড়েছে সেটায় বাবুই পাখিদের দিনের শেষবেলাকার আলোয় কিছু মজলিশি নালিশ। সেদিকে তাকাল তিলু। ভূষণ কবরেজ আসছে না কেন? শাশুড়ী গেছে পাড়া বেড়াতে। এখুনি এই নাগাদ সন্ধ্যের ফিরবে। ঐ মানুষটার কথার ভাষ্যি নেই। গাছপালার শিকড়কড় খুঁজতে খুঁজতে মাথার মধ্যে কথা শিকড় হয়ে গেছে না হলে আজ এত দেরি? জানে ধ্ব, অথচ কী করছে কে জানে, হয়তো ভুলে মেরে দিয়েছে। নয়তো অন্য গায়ে কোনো খেত আকন্দের ফুলের সন্ধান পেয়েছে। লাছদুয়ারে এসে মুখ বাড়াল তিলু।

    ভাঁড়ার ঘরের পাশে ঝিটচালের পাঁচিল অনেকটা পড়ে গেছে। ওখানে এই বর্ষার গন্ধে গজাবে কিছু লতাগুল্ম, বর্ষার স্পর্শে শিহরিত হবে। আর ওদিকে পুকুরের পাড়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা বৈচি গাছে সবুজ ফল ধরেছে। এ কদিনে তিলুর মধ্যে বেড়ে উঠেছে একটি গাছ নিতান্তই অবহেলায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো শাশুড়ীর ঘোড় দৌড়। বেড়ার পাশে ঝিঙে ফুলের হলুদ রঙ। শাশুড়ী বেড়ার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললো, ঝিঙে ফুলে বেলা মরলো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না দেখছো, জল আনতে আমি এই বুড়ো বয়সে যাই, ঠ্যাঙ হাত ছড়িয়ে ভোগ করো তোমরা, আমি মরে গেলে। তিলু নীরব। সরব হয় অন্তরের অন্তরীক্ষে। মাটির দেওয়ালে লাগানো ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখে তিলু।

    জা বাপের ঘর গেছে সংসারের ভার ছেড়ে দিয়ে, ভাঁড়ারের চাবি নিয়ে। তিলু এ সংসারে বড় অবৈধ। ভাঁড়ারের চাবি নিয়ে যাওয়াটা এই প্রথম। মানুষকে অবিশ্বাস করলে মানুষ বড় কাঁদে। তিলুর বোধহয় কান্নাও শুকিয়ে গেছে। বস্তুত আজকাল সে আর কাঁদে না। মুখে একটা মৃত হাসি জিইয়ে রেখে আজ দিন পাঁচেক সে কিছুটা আলাদা। গাঁয়ের বৌদের যেখানটায় খুটি সেখানটায় তিলু আশ্রয়হীন। অথচ দোষ তার কোথায়? এতদিন এই তিন বছরে বিয়ের পর, সে হিসেব করে দেখল প্রথম কমাসের জন্যে আলোকিত অধ্যায়। তারপর সামান্য কথা কাটাকাটি এবং হারাধনের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া। চলে যাবার পর তিল ভেবেছিলো ওটা সাবেকী ঢঙ, সব পুরুষ মানুষেরই যেমন। তার শাশুড়ীর তিলুকে বাপের বাড়ি পাঠানো। তারপর ঐ রকম সময়টুকুর জন্যে হঠাৎ আবির্ভাব। কোথাও ছিলো না এমন লেখা। তিল যখন বাপের বাড়িতে পাঁচদিন কাটালো, ভেবেছিলো হারাধন নোক পাঠাবে কিংবা নিজে আসবে। তখন সে হারাধনের হাত ধরে আবার ফিরে আসবে এখানে। হয়নি। সেই মিথ্যে অভিমান প্রসব করেছে এক বঞ্চনা। লোকে বলে হারাধন নাকি ফিরবে এ ভিটেয়, তিলু মরার। অন্তত শাশুড়ীর তাই রটানো খবর। এক একবার শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে কেঁদেছে। তারপরে শাশুড়ীর মুখঝামটায় সমস্ত দুঃখের খবরগুলো বাসি হয়ে গেছে।

    না না বেলা যাচ্ছে। আষাঢ়ের অহর প্রহর দীর্ঘ বেলারও মৃত্যু হয়। গাছের মল সহনশীলা তিলু চঞ্চল! সমস্ত ঘটনার কারণ হিসেবে প্রথম প্রথম সে নিজেকে দোষী করত, তারপর কপালকে মন্দ বলত। আজকাল তিলু অন্য কিছু ভাবছে।

    কলসী আর দড়ি নিলো তিলু, জলকে যাবে। তার আগে মোড়ল পুকুরে গা ধোবে, সেখান থেকেই চলে যাবে কুয়োতলায়। নিখেপ জল আনা চাই। এখন ঘরের আর তেমন কোনো কাজ নাই। সন্ধ্যে দেখাশোনাটা শাশুড়ী করে নেবে। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখল জায়ের ছেলে খেলে ফিরছে। এই বাচ্চাটাই তিলুর বুকে শিকড় গেড়েছে মামার বাড়ি যায়নি মার সঙ্গে। জ্যাঠাইমার ন্যাওটা। হারে রঙীন কাঁচের গুলি দেখিয়ে বলল, চারটে পেয়েছি আজকে। তাড়াতাড়ি ঘরে আয় জ্যাঠাই।

    তিলু হাসল। এই বালক তাকে বন্দী করেছে। তিলু বলে, ঠাকমা রেগে গেছে, চুপচাপ খেয়ে নিয়ে পড়তে বসে যাবি, আমার আজ লিখেপ। যাবো কি আসবো।

    ঘাটে মানুষ আসার সময় পার হয়ে গেছে। তিলুর দেরি হয়েছে আজ অকারণে। কোন কারণ ছিল না দেরির। ঘাটের ঝামার উপর কলসী নামিয়ে কাপড় আজাড়ে গামছা পরার আগে কলসী মাজল। জলে নামল ধীর পায়ে। জলে আয়নায় তিলুর মুখ টলছে। সেই টলা মুখ দেখে সামান্য মজা পেল। এই মরা বেলায় জিয়ল মাছ ফুট কাটছে। জলে দাঁড়ানো বাঁশের উপর এক শাদা বক শান্ত পূজারীর মতো নিথর। চুনো মাছ ভাসলেই ধারালো ঠোঁটে আক্রমণ।

    দীর্ঘকায় পাকুড় গাছ ছায়া ফেলেছে। আজ কেমন থমথমে লাগছে। তবে কি সবাই গন্ধ পেয়েছে তিলুর মহোৎসবের? তিলু স্বপক্ষে কিছু যুক্তি খাড়া করল। এতদিনে নিজেকে দোষ দেওয়া তারপর কপাল ধিয়ানো। আজ তিলু এক বলিষ্ঠ যুক্তি খাড়া করেছে। মানুষ শুধু মরতে বলে, সব ত্যাগ করতে বলে, ভালো হতে বলে। বদলে কেউ দেবার জন্যে হাত বাড়ায় না। এই দু’বছর সে হারাধনের অপেক্ষায়। সাত গাঁয়ে রটে গেল তিলু সতীলক্ষ্মী। কেউতো কই একদিনও সময় করে গেল না হারাধনের খোঁজ আনতে। তিলুর এই সুনাম আজ পচা কাসুন্দীর মতো লাগছে। ও যেন ছিড়তে চাইছে, ভাঙতে চাইছে ভিতরে ভিতরে কিছু। জলে ঢেউ দিল। গারে ছায়া ভাঙল, তিলুর মুখ হারাল, তিলু ডুব দিল। জল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভূত দেখল। জলে নামার সময় পুর্ব কোণায় কিছু গাছ নড়ছিল, ভেবেছিল ছাগল টাগল হবে। দেখল যা, তাতে অবাক হবার থেকেও বেশি কিছু। ভূষণ কবরেজ এই তিন সন্ধ্যেবেলায় কোন গাছের শিকড় তুলছে। হাতে ছোট কুড়ুল আর কোমরে বাঁধা তালপাতার থলি। মুখ তুলে ঘাটের দিকে তাকিয়ে ভূষণের মাথা ঝিমঝিম করছিল। ভূষণ ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তিলুদের গরুর কথা। ভুলে গেছে আজ যাবার কথা। এই গাছ-পাগলা ভূষণ কবরেজ কিছুটা দোষীর মতন কুড়ুল আর গোটা গাছটা সমেত এগিয়ে আসছে ঘাটের দিকে। তিলু সাত তাড়াতাড়ি করে ভিজে গামছার ওপর কাপড় জড়াল।

    তিন সন্ধ্যেবেলায় মোড়লপাড়া থেকে শাঁখ বাজল। পাকুড় গাস্ত্রে কোটর থেকে লক্ষ্মীপেঁচা বার হয়ে প্রথম সাঁঝে ডাক দিয়ে উড়ে গেল।

    .

    —ভাত কি দেয় ভাতারে, ভাত দেয় গতরে।

    ঠক করে পিতলের কলসী কুয়োতলার চটা-ওঠা সিমেন্টের মেঝেতে নামিয়ে পারুল বললে। কে জানে কী কারণে ও আজ মুড়ি-ভাজা খোলার মতন তেতে আছে। কুয়োতলায় যারা ছিল তারা বেশি গা করল না পারুলের কথায়, জানে ওকে নষ্ট মেয়ে বলেই।

    পারুল ও গাঁয়ের ঠোঁটকাটা। বিয়ের দু’বছর ঘোরার পর চার মাসের ছেলে কোলে গাঁয়ে ফিরে এসেছিল। স্বামীর মারধর, আইবুড়ো দেওরের হাত ধরে টানা, পারুলের একদম পোষায়নি। ভাইরা খুশী হয়নি। বড়দার বৌ তো উঠতে বসতে খোঁটা দিত। পারুল দাদাদের কাছে সামান্য ভিটে চেয়ে নেয়। তারপর ওর সঙ্গে জুটে যায় সহদেব। এধারের মাটি ওধার করে পারুল কপাল ফিরিয়েছে। ওর পিতলের কলসীতে বিকেলের আলো ঠিকরে পড়ছে। এখন পারুলের অবস্থা ফিরছে তরতর করে। ওসব কথা পারুলের সাজে, পারুলের মানায়। এখন ওর দাদারাই অভাবে পারুলের কাছে হাত পাতে।

    বিকেলবেলায় গাঁয়ের কোনো কুয়োতলায় দাঁড়ালে এইরকম দৃশ্য। এ সময়টাই বৌঝিদের সংসার জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি, খবরের আদান-প্রদান। রটনা-ঘটনা।

    এ গাঁয়ে কুয়ো বলতে একটাই। অন্য দুটোর জল তেমন ভালো নয়। একটার পাড় চুইয়ে পুকুরের জল ঢোকে। অন্যটায় লক্ষ্মী ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, তাই সে জল আর কেউ নেয় না। এ কুয়োর বয়েস কেউ জানে না। যারা জানতো তারা মরে গেছে। যারা জানে তারা ঠিক-বেঠিক মিশিয়ে জানে।

    সেই কবে লালমুখো সাহেবের বন্দুক নিয়ে কাছার পাড়ে পাখি-মারা, তারপর কী একটা কাগজে লিখে টিপসই। তারপর কুয়ো। কুয়োর কপিকল বার কয়েক বদলেছে। মাথার উপর পাতানো কাঠ দেখলে মালুম হবে কাঠটা কত পুরনো দিনের সাক্ষী। গায়ে তার, অসংখ্য দড়ির দাগ। সবাই বলে, এ কুয়ো পীরের থানের বলেই এর জল এত ভালো। কুয়োর থামের পাশে লেখা ‘এলাহি, ভরসা, মিস্ত্রী সেখ কাবাতুল্লা, সাকিন রসুলপুর।’ ‘সন’ কথাটার পর থেকে চটা উঠে গেছে। কুয়োয় গোল মেঝের উপর সিমেন্টের চিহ্ন নেই। বৌ-ঝিদের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে সেও অনেকটা দুঃখী মানুষের মতো সহনশীল ও নিথর।

    সারি সারি কলসী বসেছে কুয়োতলায়, হরেক রকমের কলসী। কোনোটা ঝকঝকে, কোননোটার গায়ে পড়েছে সময়ের ময়লা, কোনোটার কানা বাঁকা। কোথাও কোনোটার গা বেড়ানো, অতীত দিনের অসাবধানতায় পড়ে টাল খেয়ে যাওয়া, নয়তো কোনো অত্যাচারের কাহিনী। এরই মধ্যে বেমানান মাটির কলসী। কলসী দেখ আর কলসীর মালিককে দেখ! ঠিক আটকাল করতে পারবে কলসীর সঙ্গে মানুষের কত যোগ। কে কেমন, তার কলসী কেমন? যে কেমন কলসী তার তেমনি। কুয়োতলায় কলসীই মানুষদের মুখের কথা বলে।

    মনসারামের বৌ কলসীবালতি-দড়ি নিয়ে হাজির হয়। সুখী-সুখী মুখ। এখনও একবছর পুরো হয়নি বিয়ের। মনসা এই একটু আগে বেরিয়ে গেল কুয়োতর রাস্তার পাশ দিয়ে। যাচ্ছে কালীপুর মোকামে। সাইকেলের ফ্রেমে বাঁধা কাপড়ের পাড়। বিয়ের যৌতুক। মনসারামের সাইকেলের ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে পথের বাঁকে।

    হারুর পিসি ফুট কাটল বালতিতে গিট মারতে মারতে মনসার বৌ-এর দিকে তাকিয়ে। ‘হ্যাঁ লো লাতবৌ আজকাল কি সাইকেল চেপে জল আনতে এসিস? লাতি গেল এই দেখানু’ মনসার বৌ হাসি লুকোয়।

    –দিদিমা, আমার একটু তাড়া আছে। আমায় একটু আগে জল তুলতে দাও।

    —তাতো বটেই। লাতি কি এখুনি ফিরে পড়বে? সাঁঝ পহরেই শুয়ে পড়বি নাকি?

    ফুলীমামী রশিতে টান দিতে দিতে যোগ করল কথার পিঠে কথা, ছেলে, ছেলো, আমাদেরও রঙের গা ছেলো বয়েসকালে।

    তিলু মার খেয়েছে বেদম, গেল-মঙ্গলবারে শাশুড়ীর হাতে। এ আর নতুন খবর কী? কিন্তু মারের কারণ শুনে হাঁ হয়ে গেল দু এক জনা। তিলু নাকি ভূষণের সঙ্গে আছে। কুয়োতলার অনেকেই তিলুর হয়ে গাইল। কেউ দজ্জাল শাশুড়ীর কথা। উড়িয়ে দিল, কেননা তিলুর শাশুড়ী মিথ্যে খবর রটানোতে একবারে জাঁহাবাজ।

    মনসার বৌ কথাটা শুনে গেল। গাঁয়ের মধ্যে আপাতত ওরা সুখী-জোড়। রতির মার কথায়, যেমন হাঁড়ি তেমনি সরা। ভগমানের মিলিয়ে রাখা।

    কথাটা কানে গলে মনসার বৌ-এর। পীরের থানের দিকে এক হাত তুলে গড় করল। ঘরের পথটুকুতে তিলুর কথা ভাবতে ভাবতে ও ঘরে ফিরল। ও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তিলু এ গাঁয়ের মেয়েদের কাছে একটা বিশ্বাসের সিন্দুক।

    বেলা চলে যাচ্ছে দ্রুত।

    কপিকলের একদিকে রতির মার বালতি নামছে। অন্যদিকে কাঠ বেয়ে সন্ধ্যার বালতি। দুটো বালতি দুদিক থেকে। কির কির করে কপিকলে শব্দ উঠছে।

    ঝনাক, একটা শব্দ হলো।

    ছর ছর করে জল পড়ল। কুয়োর জল কুয়োতেই। কুয়োর পাট চুইয়ে জল পড়ছে। ব্যাস অমনি শুরু হয়ে গেল।

    —তোর মাগী উদোম বাই। দেখতে পাসনু আমার বালতি উঠছে? অত যদি তাড়া তবে সন্দের পোঁদে বাতি দিয়ে ক্যানে? বেলাবেলি আসতে পারুসনি?

    কথার পিঠে কথা পড়ছে। শুরু হচ্ছে বচসা।

    সাবিত্রী থামায় ওদের দুজনকে।

    ছবি এল। ফ্রকের পিছনে সেফটিপিন আঁটা। সামনের দিকে বুকের উপর তেলচিটে ময়লা দাগ, সন্ধের করুণ আলো। পিতলের কলসী বড় বিবর্ণ। মাজা হয়নি অনেকদিন। কলসী বাঁধা দিয়ে অভাবের দিন পার করেছে। এই কদিন হলো কলসী মহাজনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

    কলসীর দিকে তাকিয়ে সারি বলল সই, কলসী মাজুনি ক্যানে?

    পরশু ছাড়িয়ে এনেছে পালেদের ঘর থেকে। একদম অপসোর নাই। ধান সিজোনো হচ্ছে।

    কুয়োতলায় লম্বা লাইন। মেয়েরা ভাগ ভাগ হয়ে গল্প করছে।

    দ্রুত পায়ে সেজোপিসি আসছে। যেন প্রেসমার্কা গাড়ি।

    সবাই তাকায়। সবাই জানে সেজোপিসি এসে এমন একটা খবর দেবে যে সবাই সে খবরে বেবাক বোকা বনে যাবে। এই খবর রবারের গড়ির মতো টানতে টানতে বাড়াবে সেজোপিসি। আর সেই ফাঁকে জল তুলে নিয়ে যাবে। আসবে সবার শেষে, আর যাবে সবার আগে। যাবার সময় গল্প শেষে বলবে, এই যা। উনুনে দুধ আছে।

    আজকে কোনো গুরুতর সংবাদ হবে। সেজোপিসির শাস দ্রুত।

    একটা জটলা হয় সেজোপিসিকে ঘিরে। সারি বলে, কী, দিদিমা ছুটে ছুটে এসচো, দাদু লাছে দাঁড়িয়ে আছে নাকি?

    —তোর মাগী রঙের গা। বর দেখা হচ্ছে তো!

    সেজোপিসিকে কালোর মা একদম দেখতে পারে না। বলে, সেজোপিসি গোটা গাঁয়ের লেগে খপোর বিয়োয়।

    সুও যে বিয়োতে জানে সে মজা বোঝে। না হলে ঘর গেরস্থালীর কাজ ছেড়ে জল তোলা ভুলে সবাই ঘিরে ধরে কেন সেজোপিসিকে!

    খবরটা আর বাড়াতে হলো না আজ। খবরের পূর্বাভাস এসে গেছে কুয়োতলায়। আর এই সাঁঝের আগমনে খবরটা যেন ভঁসালো পেয়ারা। আইবুড়ো মেয়েরা পিসির কাছে এগিয়ে এল। চৌকিদার গিন্নীর মুখঝামটা, তোরা আইবুড়ো মেয়ে, তোদের এত কী? জল নিয়ে সেজোপিসি খবরের শেষ চমক দিয়ে গেল। গোটা কুয়োতলায় চরকীর আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল। সেজোপিসি আজ দেখেছে তিলু মোড়লপুকুরে ভূষণের সঙ্গে ‘বাক্যি’ করছে।

    তবুও সামান্য সন্দেহ রয়ে গেল দু একজনের মনে। অন্তত মাটির কানাভাঙা কলসীর মালিক, থামের গায়ে ঐ যে চুপচুপ ধন-যৌবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পার্বতী।

    সবার অলক্ষে পার্বতী চোখের ‘নোয়া’ মুছল, না না তিলু কখনও এমন হবে না।

    জল তুলতে তুলতে মলিনা তাকাল কালোর মার দিকে। কালোর মা গালে হাত দিয়ে, ‘ও ভাগ্যি মা, এত শত ব্যাপার।’

    মনিষ্যির মন তো লয়, লদী। এই দেখছো কাঠফাটা শুকনো বালি। কাল দেখবে ভরা বন্যেয় উথাল পাতাল। সেই ঘোলা জল, সেই স্রোত, সব কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। বোশেখে শান্ত নদী শিশুর মতো কাছে ডাকে। পরিষ্কার আয়নার মতো জল ‘তিয়াসে’র জল।

    নদীর সনে মানুষের কত মিল। এইসব দার্শনিক ভাবনা নিয়ে আর কলসীভর্তি জল নিয়ে ফিরে গেল পুব পাড়ার নমিতা। ও বাঁজা। লোকে বলে, ওর স্বামীর অসুখ আছে। নমিতা দেখছে জীবন তো চলছে এই ভাবেই। ও তিলুকে খুব ভালোবাসে। গাজনে ওর সঙ্গে ঝাঁপজল পাতিয়েছে। বুড়োশিবের চড়কের সিন্দুর তুলে বলেছে, ঝাঁপজল তোমার অপিক্ষে মিথ্যে হবে নে, দেখো। তোমার ভিতরে তো ময়লা নাই, তুমি তোমার মানুষ পাবে। দেখবে না এ বছরেই ফিরে আসবে। প্রথম রাতে কী কথা হবে আমায় কিন্তু শোনাতে হবে। তিলু সেদিন এই বন্ধ্যা রমণীর এক রমণীয় আশীর্বাদ মাথায় রেখে চোখ ঝলছল করে বলেছিল, আশায় আশায় আর কতকাল ঝাঁপজল?

    নমিতার ইচ্ছে আজই সাঁঝ প্রহরেই জিজ্ঞেস করে নেবে তিলুকে ঝাঁপজল এ কী শুনছি–ঝাঁপজলের বিশ্বাস তিলু ওকে লুকোবে না।

    কিন্তু নমিতার ভয় হয় ঐ পরান ডোবার বাঁকটায়, ওখানে অন্ধকার বড় ঘুরঘুটি। সেদিন পালেদের বড় ছেলে ওখানে দাঁড়িয়ে হাত ধরেছিল নমিতার। মানুষের বেঁচে থাকার কী জ্বালা! বাঁশ গাছের থেকে কেন লাউডগা সাপ নামে না? কেন ওকে সেই সাপ কাটে না?

    ***

    শেষ কথাটাই ভূষণ কবরেজের কানে বাজছে। তিলু বলে গেল, মানুষ হয়তো বোঝে, চাল হয়তো সেজে।

    ভূষণ উত্তর দিয়েছিল, আমারও হাল নাই, তোমারও বলদ নাই। এসো তবে। কিন্তু গলার ভিতর থেকে উত্তর আসেনি। ভূষণ শাদা আঁকোডের গাছটা ফেলে দিল জলে। এই শিকড়বাকড় দিয়ে আজন্ম কাটছে। গুরুর কথা মনে পড়ছে ভূষণের! গোঘাটের পঞ্চবটী থানের গুরু। কতবার বলেছে ভূষণকে, বাপ এবার বে কর। কাজে অনেক বল পাবি। অত দুঃখ রাখিবি কোথায়? না হলে পাগল হবি।

    ভূষণ বালা কুড়ুলের মুখ থেকে মাটি মোছে। গাই গরুটার ডাক শোনা যাচ্ছে এখনও। ভূষণ জানে ও ডাক কীসের। গরুটার একটা কঠিন অসুখ। মাঠ দেখানোর পর ওর পেটে বাচ্চা আসবে। দুধের মোড় ফুলে উঠবে। দুধ জমবে। কিন্তু ও বিয়োতে পারবে না। সেবার অনেক কষ্টে মরা বাচ্চা ভূষণের হাতেই নেমেছিল। এবার মারা যাবে গাইটা নিজেই। তাই ভূষণ এড়িয়ে চলছে।

    কিন্তু—সব কথার পিঠে কিন্তু।

    বনবাদাড়ের আনাচে কানাচে ব্যাঙ ডাকছে। মিটিমিটি করে জোনাকি জ্বলছে। অহেতুক কিছু শব্দ ভূষণকে নাড়ায়—পূর্বসূরীদের ডাকের মতন।

    ভূষণ ঘরে আসে। দড়মা থেকে শালপাতা বের করে চটা পাকায়। আরও একটু রাত বাড়বে। তারপর সে আজ জীবনের শেষ গাছ তুলবে। এ গা ছেড়ে দেবে। চলে যাবে গুরুর কাছে দুরে দুরে গোঘাট গাঁয়ে। গিয়ে বলবে, এই দ্যাখো ওস্তাদ শ্বেত করঞ্জার ফুল। এই লাও বনবৈচির শিকড়। এই দেখ পূর্ণিমায় লক্ষ্মীবারে ভোলা প্রতিষ্ঠা করা আশুদ গাছের ছাল।

    ঘরের সমস্ত সঞ্চয় যা ছিল একটা কুপীর আলো, মাটির হাঁড়ি, ঠ্যাং-ভাঙা কুকুর, সব ঠিক তেমনি আছে। ভূষণ মনে মনে ঠিক করল কিছুই নেবে না। এক কাপড়ে চলে যাবে। শুধু নেবে ওর বয়সকালের আড় বাঁশি। অনেকদিন ছোঁয়নি এটা।

    বুকে বেশ বাতাস দিচ্ছে। এমনি বাতাস ভূষণের দিয়েছিল সেবার, যেবার ও তিলুকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। শাশুড়ীর বঁটির আঘাতে তিলুর কোমর কেটে ঘা। তিলু মরতে চেয়েছিল। ভিতরে ভিতরে ঘা বেড়ে যাই-যাই। মাঝরাতে তিলুর দেওর নিমাই এসে ডেকেছিল ভূষণকে।

    তিলু ওষুধ খেতে চায়নি। ভূষণকে উত্তর দিয়েছিল, শিকড়কড়ে আর বাঁচতে আমি চাই না। শুধু চাই এই ঘা সোরোশ করে যেন ঢুকতে পারে কলজেতে। ভূষণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, মনিষি মরলেই তো মাটি হয়ে গেল। তালে কেন আর এই জীবন?

    সে তো গেল বছর। ভূষণ অনুভব করল এই যে সব গাস্ত্রে শিকড়বাকড়, এই যে সব প্রতিদিন মাটি খুঁড়ে তুলে আনা, এতে তো সব অসুখ সারে না। ভূষণের নিজের ভিতরেও তো ব্যথা আছে। বাড়লেই গুরুর কাছে চলে যায়। হাউ হাউ করে কাঁদে আর তখনই ভূষণকে গুরু বলে, এবার একটা বে কর ভূষণ। মাটির কলসী থেকে ভূষণ কিছুটা জল খেল। খুব ভাসা ভাসা লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিনে মানুষের। যে সমস্ত উপকার করেছে তা কত কম, কত সামান্য।

    কিছু আর খেতে ইচ্ছে করল না। খুঁটিতে হেলান দিয়ে আকাশ দেখল। সাঁঝতারা বেশ কিছুক্ষণ আগে উঠেছে। এখন সারা আকাশে যেন একথালা সুপুরি—অগুনতি অসংখ্য তারা। সাতভাই উঠেছে। চাদের একটা বেশ বের হচ্ছে। আষাঢ়ের কালো মেঘ সাঝে সাঝে ছুটে এসে চাপা দিচ্ছে আলো। আবার অন্ধকার, আবার আলো। এই সমস্ত খেলাটাই চলছে ভূষণের ভিতর। ভূষণ মনে মনে তৈরি হয়ে নেয়। ওকে চলে যেতে হবে এই ঘর, এই গ্রাম, এই মনীষ্যিদের ছেড়ে।

    তবে এটা বুঝেছে সে, যে মেয়েদের স্বামী নাই সে মেয়েরা দশ হাত কাপড়েও ন্যাঙটো, কত অসহায়!

    .

    তিলুর আজ যা কিছু চরম ঘটার জন্যে ইচ্ছে করছে রুখে দাঁড়াতে। কুয়োতলায় পার্বতী এখনও দাঁড়িয়ে। তিলুকে দেখে দখনো বাতাসের মতো তার বুক জুড়ে যায়। তিলু ওকে রশি বালতি দেয়।

    পার্বতী শুধায়, তুমি আগে নিয়ে যাবে? তোমায় তো আরও দুখেপ এসতে হবে। তিলু অন্যদিনের থেকে একটা আলাদা। না, তুমিই আগে নাও পিসি, আমি পরে নোব। আজ আমার এই এক খেপ জল।

    তিলু হাঁপাচ্ছে, কলসীর মুখে ছোট্ট একটা চাদ। কলসীর মুখের কানায় জলের শব্দ উঠছে। বালতির জল আজ একটা বেশি চলকাচ্ছে। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল। কোন নাঙ কুয়োতলায় ছিল যে এত দেরি, কুয়ো কেটে কি জল আনচু তেয়োধাতালীর ঝি? কলসী বালতি নামিয়ে রেখে তিলু জানত, এরপর কী। চুলের গুছি ধরে দুটো চড়। খুঁটিতে হাতটা লেগে শাখাটা ভাঙ্গল তিলুর। রবারের তিনটে চুড়ি ছিটকে বেরিয়ে গেল। উঠোনে গাছের ছায়ায় বোঝা গেল না। ঘর থেকে দেওর বেরিয়ে এসে মাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। দেওরের ছেলে পরান টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিল। এ সমস্ত দৃশ্যে পরান অভ্যস্ত, এমন কি এই উঠোনে পোঁতা তুলসীগাছও।

    তিলুর চোখের ভাষ্য আজ সামান্য আলাদা। কলসী নিয়ে দ্বিতীয়বার বের হল। খেয়াল করল না পরান ওর পিছে পিছে এসেছে কুয়োতলা অব্দি।

    শেষ খেপ জল নিয়ে যখন ঘরে ফিরল, তখন শুনতে পেল প্রথম প্রহর শেষের চৌকিদারের ডাক, হো—হো–হো-ও।

    প্রতিদিনের মতো ঘরে ধুনো দিল তিলু। মশারী টাঙিয়ে পরানকে ঘুম পাড়াল। শেষ খেপ জল আনার সময় পরান বলেছিল, জ্যাঠাই, বড় হয়ে আমি তোকে লিয়ে যাব মামাদের গাঁয়ে। পরান, ছেলেটা বড় বেঁধে রেখেছে তিলুকে। বোধ হয় বেঁচে থাকা এর জন্যেই। আরও একটা ক্ষীণ স্রোত অন্তরীক্ষে, যদি সে মানুষটা ফেরে। কেউ বলে, সে সন্ন্যাস নিয়েছে। পালেদের জামাই তারকেশ্বরে পুজো দিতে গিয়ে দেখেছিল তাকে। কেউ রটায় সে চাপাডাঙায় মেয়েছেলে রেখেছে।

    রাত বাড়ছে। সবার খাওয়া শেষে তিলু ঘাটে গেল। হাঁড়িতোলা রাত ভারী হবে এবার। তিলুর খাবার ইচ্ছে নেই। না খেলে শাশুড়ীর গালমন্দ, চোটপাট মারধর। লুকিয়ে জামবাটির তলার সমস্ত ভাত ফেলে দিল জলে। হাঁসে খাবে, মাছে খাবে। সবাই তো বেঁচে থাকবে। ঘরে ফিরে থালা রাখল। রান্না ঘর মুছল তিলু। চুপিসাড়ে দরজার পাশে গিয়ে শুনতে চাইল দেওরের ঘুমের গভীরতা কতখানি।

    শাশুড়ীর পানের ডিবের শব্দ আসছে। চৌকিদারের হাঁক, ‘হো-হো-হো-হো-ও’ রাতের গভীরতায় ডুবে যাচ্ছে সবকিছু। উঠোনে জাম গাছের ছায়া কখনও পড়ছে, কখনও হারাচ্ছে, আগাম বর্ষার আলো-ছায়ার খেলা। শোবার ঘরে ধুনোর আগুন সামান্য উসকে দিয়ে মশারীর মধ্যে গেল। পরান ঘুমিয়ে কাদা।

    কাল সকালে পরান কাদবে, কত কাদবে। শাশুড়ী এতদিন যা চাইত, যা খুলে মেলে বলত তাই ঘটেছে দেখে খুশী হবে। দেওর আর জায়ে কাল সকালে বা পরশু হাত-পা ছড়িয়ে সম্পত্তির হিসেব করবে। তারপর আবার সবাই ভুলে যাবে।

    ধুনো-চুরে আরও কিছুটা ধুনো দিল তিলু। চুপি সাড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। যেন গোয়াল দেখাতে যাচ্ছে। গরুটার শিঙের ব্যথাটা কমবে একদিন। ওকে মাঠ দেখানো হবে। ওর বাচ্চা হবে। সব ঠিক থাকবে, থাকবে না শুধু যার ধন সে।

    লাছ দুয়ারে হুড়কো খুলল তিলু। বাইরে এল। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করল। ঘুর পথে হাঁটতে শুরু করল। এত রাতে কেউ বের হবে না। যারা এত রাতে বের হয় তারা কেউ জানবে না। হাঁটবেও না এই ঘুর পথে।

    এই পথ সোজা কুয়োতলা। সেখান থেকে মাঠ ভেঙে, তারপর…। তিলু জানে না। সব পথ ভূষণের শিকড়ের থলিতে। ভয় লাগছে। আকাশে উড়ো মেঘেরা অন্ধকার সাজিয়েছে। এই অন্ধকার এখন বড় জরুরি, বড় দরকার।

    তিলু হাঁটছে। কুয়োতলায় যখন এল শুনতে পেল পুকুর পাড় থেকে ভূষণ গলার শব্দ করল। আচ্ছা যদি কেউ ভূষণকে দেখে? পুরুষ মানুষের সাতখুন মাফ। আর মেয়েমানুষের বদনামটাই সম্বল। তাই নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। মেয়েমানুষ বড় কাঙাল। এইবার তিলুর মধ্যে সংশয়ের ঢেউ। তবুও গেল পুকুর পাড় ধরে। আকাশ থেকে মেঘ সরে যাচ্ছ। ভূষণের বুকের মধ্যে যা ভয় জমছে তিলুর তার একশো গুণ।

    ভূষণ বলল ফিস ফিস করে, খুব কাছেই তিলু। চলো এই মাঠ-পথ অনেক সহজ।

    তিলু মুখ তুলল। ভূষণ গাছের শিকড়ের গন্ধ চেনে। মেয়েদের শরীরের এই গন্ধ সে কোনোদিন পায়নি। এখানে কোন শিকড় আছে? শ্বেতকরবী না তেসিরে মনসার আঠা! নাকি, রাঙা জবার ডাল। ভূষণ পাগলপারা। তিলুর মাথা ঘুরছে। ঘরের ধুনোর গন্ধ, পরানের হাত পা ছড়ানো শরীর। উঠোনের উপর জামের গাছের ছায়া। আর গাঁয়ের সব মেয়েদের হাতে যে বিশ্বাস তুলে দিয়েছিল তিলু!

    তিলু হাত ছাড়িয়ে নেয়। তুমি যাও।

    চৌকিদারের হাঁক কাছে আসছে। দ্রুত পায়ে তিলু কুয়োতলার কাছে ফিরে আসে। ভূষণকে দেখার চেষ্টা করল। একি ভূষণ মাঠ পার হয়ে সোজা পথ ধরেছে। ধরুক। সামনে চৌকিদারকে দেখে তিলু ভূত দেখলে। কে গো? উত্তর নেই। কাছে এল চৌকিদার। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল কী গো মা, এত রাতে? তিলু পীরের থান দেখিয়ে বলল, মাটি আনতে।

    সোজা পথেই তিলু ফিরল। শুধু ভাবল, এক আঁধার কাটানোর জন্যে আর এক আঁধারে কেন ডোবা, ডুব দেওয়া। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, এই জ্যোৎস্নায় আলোকিত পথে ওর ঝাঁপজল বলছে, সয়ে থাকলে রয়ে পাবি ঝাঁপজল। আর ওর বুকের মধ্যে পরানের হাত। মাথার মধ্যে ধুনোর গন্ধ। ও ঘরে ফিরে এল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন
    Next Article গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.