Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প1423 Mins Read0

    প্রতিষেধক – আবু ইসহাক

    প্রতিষেধক – আবু ইসহাক

    কিতাব্বে কথা বলতে বলতে নানি লক্ষ্য করেন–নাতনি অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘কিরে আতিয়া’ তুই কিছু শুনছিস না?

    হ্যাঁ শুনছি, তুমি বলে যাও। চমক ভেঙে আতিয়া বেগম বলেন।

    হ্যাঁ, মন দিয়ে শোন। শুনলি তো? ঐ মেয়েলোকগুলোও তোর মতো প্রশ্ন করেছিল।

    নানি তার কাহিনীর জের টেনে চলেন :

    পরের দিন মেয়েলোকগুলো তার কাছে এল। তিনি বললেন, তোমাদের সওয়ালের জওয়াব আমার মেয়ের কাছে পাবে। তারা তখন তার মেয়ের কাছে গেল। তিনি তাদের বললেন, তোমাদের সওয়াল কী? কী জানতে চাও তোমরা?

    মেয়েলোকগুলো বলল, আমরা জানতে চাই, একজন পুরুষ যদি চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে, তবে একজন স্ত্রীলোক কেন চারজন স্বামী গ্রহণ করতে পারবে না?

    তিনি বললেন, তোমাদের সওয়ালের জওয়াব দেব, কিন্তু তার আগে এক কাজ করো। চার রঙের চারটা বকরির দুধ চারটা আলাদা পাত্রে করে আমার কাছে নিয়ে এসো।

    তারা চলে গেল এবং দুধ নিয়ে ফিরে এল। তিনি তখন চারটা পাত্রের দুধ একটা পাত্রে মিশিয়ে বললেন, কালো বকরির দুধ কে এনেছে? বেছে নিয়ে যাও। সাদা বকরির দুধ কার, বেছে নিয়ে যাও। বাই বললে, দুধ তত মিশে গেছে, এখন কেমন করে বেছে নেবে?

    তিনি তাদের বললেন, এখন বুঝতে পেরেছ তো, না, বুঝিয়ে বলতে হবে? মেয়েলোকগুলো তাদের সওয়ালের জওয়াব পেয়ে চলে গেল।

    নানি তার কাহিনী শেষ করে একটু দম নেন। আতিয়া বেগমের বিষণ্ণ মুখে আরও মেঘ জমেছে। তার দিকে চেয়ে নানি বলেন, এবার তোর প্রশ্নের জওয়াব পেয়েছি তো? আর চিন্তা করে কী করবি,বোন? আমরা মেয়েলোক মেয়েলোকই। পুরুষরা যেভাবে চালায়, সেভাবে চলতে হবে।

    না, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। আমি তা সহ্য করতে পারব না।

    সহ্য না করে উপায় কী বোন? আমরা কত সহ্য করেছি। আমার বিয়ের সময় আমার খেদমতের জন্যে আব্বজন একজন বান্দী সঙ্গে দিয়েছিলেন। বান্দীটাকে আবার তোর নানার সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন চিন্তা করে দ্যাখ, আমরা বাপের বাড়ি থেকেই সতীন সঙ্গে করে স্বামীর ঘর করতে গেছি। তারপরেও তোর নানা আরও দুইখান সাদী করেছিলেন।

    তোমাদের যুগ আর নেই। তোমাদের সময়ের মেয়েরা ছিল হাঁসী আর মুরগির মতো। কিন্তু আমরা তা নই। আমরা মানুষ। মানুষের মতো বাঁচতে চাই। মানুষ হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার চাই।

    অধিকার চাইলেই তো আর পাওয়া যাবে না। শরাশরীয়ত তো মানতে হবে।

    আতিয়া বেগম দাঁড়ান। বলেন, নাহু, তোমার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। রাত অনেক হয়েছে। এবার শুয়ে পড়ো, আমি যাই।

    আতিয়া বেগম শোবার ঘরে যান। দুই পাশে দুই খাটে ঘুমুচ্ছে শাহীন ও মমতা। আট বছরের ছেলে আর দু’বছরের মেয়ে।

    শাহীনের একটা হাত লেপের বাইরে বেরিয়ে আছে। তিনি খাটের পাশে বসে তার হাতটা লেপের মধ্যে গুঁজে দেন। তারপর চেয়ে থাকেন ছেলের মুখের দিকে। একই ছাঁচে গড়া পিতা-পুত্রের মুখ। দশ বছর আগে আফতাবের মুখ অনেকটা এ রকমই ছিল। অন্তত তাঁর চোখ সে মুখ তখন এমনি নিষ্পাপ, এমনি স্নিগ্ধ মনে হয়ত অতীত দিনের স্মৃতি তার মনের পর্দায় ছায়া ফেলতে শুরু করে।

    লন্ডনে অধ্যয়নরত বাংলাভাষী ছাত্র-ছাত্রীদের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আফতাব আহমদের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় ধাপ বেয়ে বেয়ে কেমন করে ভালোবাসার মিনার-চূড়ায় আরোহণ করেছিল, তা ভাবতে আজও তাঁর মনে দোলা লাগে। আফতাব স্থাপত বিদ্যায় উচ্চডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ভালো মাইনের চাকরি নেয় গিলবার্ট কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে।

    আতিয়া বেগম এম. এড. ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন তার পরের বছর। শিক্ষা বিভাগে তারও ভালো চাকরি জুটে যায়।

    দুই মন যখন একঠাই হয়ে আছে, তখন দুই হাত এক করতে আর অসুবিধা কী? বেশ ধুমধামের সঙ্গেই আফতাব ও আতিয়ার শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়ে যায়।

    বিয়ের পরের সেই উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই আতিয়া বেগমের চোখের কোলে পানি চকচক করে। তিনি ভেবে পান না, সেদিনের সেই আফতাব কেমন করে আজকের এই আফতাবের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে। হ্যাঁ, তাই। আজ তিনি বড় কন্ট্রাকটর। কোয়ালিটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক। টাকা-পয়সার হিসেব নেই। আর সেদিন তো ছিলেন আট শটাকা মাইনের কোম্পানির আর্কিটেক্ট।

    আতিয়া বেগম আঁচলে চোখ মোছেন। তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে পড়ার ঘরে বসেন। পাশের থাক থেকে টেনে নেন একখানা বই। বইটা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে এনেছেন আজ।

    “রক্ত ও তার শ্রেণীবিভাগ” পরিচ্ছেদটার ওপর তিনি তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। পড়তে পড়তে তার মুখের মেঘ কেটে যায়। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বারবার পড়ে একা বিশেষ অধ্যায়ের কতগুলো কথা তিনি মুখস্থ করে ফেলেন।

    আতিয়া বেগম টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে শুরু করেন, কিন্তু দুটো সংখ্যা ডায়াল করেই কী ভেবে রিসিভারটা রেখে দেন। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখেন রাত পৌনে এগারোটা। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যান। ছোট অস্টিনটা তাকে নিয়ে দ্রুত ছুটে চলে।

    গন্তব্যস্থল আর বেশি দূর নয়। রাস্তার কিনারায় গাড়িটা রেখে আতিয়া বেগম হেঁটে চলেন, গেটের কাছে গিয়ে তাকান একবার বাড়িটার দিকে। ওপরতলার বদ্বার ঘরে আলো জ্বলছে। আর কোন ঘরে আলো নেই। চাকরবাকরেরা ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়।

    গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই বিরাটকায় অ্যালসেশিয়ানটা পেছনের দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে সামনের পা দুটো তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আতিয়া বেগম দু’হাত দিয়ে কুকুরটার দুই পা মর্দন করে চুপ করাবার জন্য আঙুলের ইশারা করেন। কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে আবার গেটের কাছ গিয়ে শুয়ে পড়ে।

    ঘরে-পরার স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল পায়েই তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন; তাই সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময়ও শব্দ হল না একটু।

    অস্পষ্ট কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যায়। এত রাত্রে কার সঙ্গে কথা বলছেন?

    নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যা আতিয়া বেগম। প্রথম জানালাটার কাছে যেতেই তিনি দেখতে পান-মিষ্টার আফতাব টেলিফোনে কথা বলছেন।

    শুনুন, রহমান সাহেব! যে রকম বোঝা যাচ্ছে, ফ্যামিলি ল’ অর্ডিন্যান্সটা শিগগিরই পাশ হয়ে যাবে। তাই আমি বলছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটা শেষ করে ফেলা দরকার।

    আতিয়া বেগম দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন।

    আঁ, আগামী মাসে? না না, সে অনেক দেরি। এ মাসের মধ্য হতে অসুবিধাটা কী?…. তবে আর দেরি করে লাভ কী? আপনি ব্যবস্থা করে ফেলুন। কোন জাঁকজমকের দরকার নেই। ….হ্যাঁ, আর একটা কথা, ঢাকার বাইরে হলেই ভালো হয়।… কোথায়? কুষ্টিয়ায়? তা আমার দিক থেকে কোন অসুবিধে নেই…..। আচ্ছা, ওদের জিজ্ঞেস করে এসে আমায় বলুন। আমি ধরে আছি।

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তা হলে পঁচিশ তারিখ….কী বার পড়ে? …বুঝবার? হ্যাঁ, তা হলে এটাই ঠিক রইল। সব ব্যবস্থা করে ফেলুন। পনেরো দিন তো মাত্র বাকি।……অ্যাঁ কোনটা? ‘বি’ টাইপ কোয়াটার্স? ওটার টেন্ডার খুলবে পরশু। আসা করি কন্ট্রাক্টটা পেয়ে যাব। ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে তো আমার পুরনো হয়। …অ্যাঁ? ও হ্যাঁ–হ্যাঁ —তা আমি ভুলব না। আপনারা না ভুললেই হয়।…..হ্যাঁ তা টেন পারসেন্ট? তা আপনি যদি ম্যানেজ করতে পারেন, আমার আপত্তি নেই। …আচ্ছা, টিক আছে হালো রহমান সাহেব, সুরাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?…একটু ডেকে দিন। অফিসের একটা দরকারি ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।…আচ্ছা আমি ধরে আছি।

    হ্যালো, কে সুরাইয়া? সিভিল সাপ্লাইয়ের বিলটা চলে গেছে? …..আচ্ছা, ঠিক কাছে। আচ্ছা শোন, তোমার দুলাভাই কিছু বলেছে?…..কী আবার, পঁচিশ তারিখের কথা বলেননি?…..থাক, আর নেকামো করো না।….একা একা কী করছ? চলে এসো না?…হ্যাঁ, ডিক্টেশানই দেব।

    …শোন একা একা ভালো লাগছে না। কথা বলার লোক নেই।….ইন্সপেকট্রেস? সে তো নেই। তিন-চারদিন হল সে তার সরকারি বাসায় চলে গেছে। ….হা? তা ঝগড়া একটু হয়েছে বৈ কি। তুমি চলে এসো। …আঁ, পঁচিশ তারিখের পর? নাহ্, তোমাদের নিয়ে আর পারা গেল না। শোন সুরাইয়া, দিন তো আর বেশি নেই, মাত্র পনেরো দিন। গয়নাগাটির অর্ডার কালই দেয়া দরকার। আমার এখানে গয়নার ক্যাটালগ আছে দুটো। তুমি এসে যদি পছন্দ করে দিয়ে যেতে।….না, অফিসে এ সব চলে না। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।…অ্যাঁ? …না, না ওরা টের পাবে না। তোমার ঘর তো সিঁড়ির কাছেই। চোখ রেখো, সিগারেট জ্বললেই চুপি চুপি বেরিয়ে এসো। …..আচ্ছা।

    আফতাব রিসিভারটা রেখে দিয়ে দাঁড়ান। টেবিল থেকে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে তিনি দরজার দিকে এক পা বাড়িয়েই হঠাৎ চমকে ওঠেন।

    কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

    আতিয়া বেগমের কণ্ঠে উষ্ণতার আভাস পেয়ে হকচকিয়ে যান আফতাব। আমতা আমতা করে বলেন, না একটু বাইরে যাচ্ছি।

    বাইরে কোথায় যাচ্ছ?

    একটু শাহবাগ হোটেলে যাব। করাচি থেকে—

    থাক, মিছে কথা বলার চেষ্টা করো না।

    মিছে কথা!

    হ্যাঁ মিছে কথা। তুমি কোথায় যাচ্ছা, জানি। সব শুনেছি।

    এবার আরও থতমত খেয়ে যান আফতাব। পাশের টেবিলটার একটা কোনা ধরে তিনি মরিয়া হয়ে বলেন, ও আড়ি পেতে শোনা হয়েছে?

    হ্যাঁ, আড়ি পেতেই শুনেছি।

    তা বেশ করেছ। আমার যেখানে খুশি আমি সেখানে যাব। আফতাবের রাগ এবার গা মোড়ামুড়ি দেয়।

    যেখানে খুশি সেখানে যাবে? নিশ্চয় যাব। আরও শুনে রাখ, এ মাসের পঁচিশ তারিখে আমাদের বিয়ে।

    হ্যাঁ, ধ্বই তো শুনলাম।

    ব্যস, আর কী? এবার যেতে পারো।

    হ্যাঁ যাব। তার আগে আমার কথার জবাব দাও।

    কী তোমার কথা?

    আমি জানতে চাই, এ বয়সে কেন এ পাগলামি করতে যাচ্ছ?

    পাগলামি! পাগলামির কী দেখলে তুমি?

    পাগলামি নয়? লোকে বলবে কি, বল তো?

    কী বলবে আর। শুধু দুটো কেন, আমি চারটে বিয়ে করতে পারি সে সামর্থ্য আমার আছে।

    হ্যাঁ, আর্থিক সামর্থ্য তো আছে। তারপর বলো দৈহিক সামর্থ্য আছে!

    নিশ্চয়ই আছে।

    হ্যাঁ, তা তো আছেই।

    উত্তেজনার মুখে কথাটা বলেই অস্বস্তি বোধ করেন আতিয়া বেগম। আর আফতাব তার চোখের দিকে চেয়ে মিইয়ে যান।

    আতিয়া বেগম বলেন, বসো, কথা শোনো।

    অন্যমনস্কভাবে আফতাব একটা সোফায় বসে পড়েন। তার সুমুখে আর একটায় বনে আতিয়া বেগম। বলেন, দ্যাখো, কেলেঙ্কারি করো না।

    কেলেঙ্কারি! আমি রা শরীয়ত মতো বিয়ে করব তাতে কেলেঙ্কারির কী আছে?

    হ্যাঁ, শরীয়ত পুরুষদের চারটে বিয়ে করবার বিধান দিয়েছে। কিন্তু যেসব কঠিন শর্তের উল্লেখ করেছে, তা পালন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

    নিশ্চয়ই সম্ভব।

    মোটেই নয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে সব স্ত্রীকে সমান চোখে দেখা কখনও সম্ভব নয়। কোরান শরীফে অসম্ভব শর্ত জুড়ে দিয়ে পরোক্ষভাবে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে

    দ্যাখো, নিজের খুশিমত কোরান শরীফের ব্যাখ্যা করতে যেও না।

    নিজের খুশিমতো কিছুই বলছি না। ভালো করে পড়ে দেখো। তা ছাড়া, কোন্ সময়ে, কোন অবস্থায় এ বিধান দিয়েছে, জানো?

    না, জেনে দরকার নেই।

    দরকার নিশ্চয়ই আছে। শোনো, ওহোদের যুদ্ধে অনেক মুসলমান শহিদ হয়েছিলেন। যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাদের সংখ্যা ছিল মুসলমান মেয়েদের তুলনায় অনেক কম। ঐ সময় সুরা নিসা নাজেল হয়। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আর ঐ বাড়তি মেয়েলোকদের গতি করবার জন্যেই আল্লাহতায়ালা একজন পুরুষকে চারজন পর্যন্ত স্ত্রীগ্রহণের অধিকার দেন। তাও আবার শর্তসাপেক্ষে। কিন্তু এখন তো আর সে অবস্থা নেই। আমাদের দেশে পুরুষ আর মেয়েদের সংখ্যা প্রায় সমান। আর জন্মনিয়ন্ত্রণের যুগে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কোন প্রশ্নই ওঠে না।

    ও ইসলামের ঐ বিধানের আর দরকার নেই বলতে চাও?

    তা কেন? ইসলামের বিধান চিরদিন বেঁচে থাকবে। বিশেষ অবস্থায় আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্যে তাকে কাজে লাগাব।

    যেমন?

    যেমন ধর, আমি যদি কোনদিন পঙ্গু হয়ে যাই তখন তুমি আর একটা বিয়ে করতে পার। এখন শুধু ঐ কানুনের দোহাই দিয়ে আর একটা বিয়ে করে অশান্তিই ডেকে আনবে। কানুন তৈরি হয় সমস্যা সমাধানের জন্য, সমস্যা বাড়াবার জন্যে নয়, মতলব হাসেলের জন্য নয়।

    থাক, তোমার কথার কচকচি শুনতে চাইনে। আমার যা ইচ্ছে আমি তাই কব।

    তোমার যা ইচ্ছে তাই করবে? তা বেশ। তা হলে আমিও যা ইচ্ছে তাই করব। আতিয়া বেগমের শরীর রাগে কাঁপতে থাকে।

    আমিও আর একটা বিয়ে করব।

    আর একটা বিয়ে করবে। তা করো, শরীয়তে যদি সে রকম বিধান থাকে।

    শোনো, একজন স্ত্রীলোকের চার স্বামী হলে সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে গোলমাল বাঁধবে, কার সন্তান কোনটি চেনা যাবে না—এই যুক্তিতে চোদ্দো শ বস্তু আগে পুরুষদেরই শুধু চারটে বিয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে মেয়েদের দেওয়া হয়নি। এ যুক্তি দোহাই দিয়ে এ যুগে যদি পুরুষেরা চারটে বিয়ে করতে পারে, তবে ঠিক একই যুক্তিতে একজন স্ত্রীলোক এক সঙ্গে দু’জন পর্যন্ত স্বামী গ্রহণ করতে পারে।

    সে কী রকম?

    এটা বিজ্ঞানের যুগ। এ যুগে একাধিক স্বামীর সন্তানদের চিনে বের করা মোটেই কষ্টকর নয়। সন্তানদের রক্ত পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, কে কার সন্তান।

    রক্তের শ্রেণীবিভাগের কথা জানি কিন্তু তা দিয়ে সন্তান চেনা যাবে না।

    নিশ্চয়ই চেনা যাবে।

    যাবে! নিশ্চিতরূপে জানা যাবে কে কার সন্তান?

    হ্যাঁ, নিশ্চিতরূপে নির্ভুলভাবে জানা যাবে কে কার সন্তান।

    আমি বিশ্বাস করি না।

    বিশ্বাস কর না?

    আতিয়া বেগম তার হাতের বইটা খুলে নির্দিষ্ট একটা পৃষ্ঠা বের করে বলেন, এখানে কি লিখেছে শোন—

    Innumerable experiments and extensive work have definitely shown that unions of……

    Parents O X O give only O, but cannot give A, B, AB
    Parents o X A give only O, A, but cannot give B, AB
    Parents 0 X B give only O, B, but cannot give A, AB
    Parents 0 X B give only A, AB, but cannot give O, B

    পড়া শেষ করে আতিয়া বেগম বলেন, এবার বিশ্বাস হয়েছে তো?

    হ্যাঁ, কিন্তু বিয়েশাদীর ব্যাপারে এর প্রয়োগ অসম্ভব।

    কেন অসম্ভব? তোমারও আমার রক্ত এক শ্রেণীর। ঐ বারে তোমার অপারেশন-এর সময় রক্তের দরকার হয়েছিল। আমি রক্ত দিয়েছিলাম। তখনই জানতে পেরেছি, তোমার ও আমার রক্ত ০ শ্রেণীর। আমাদের ছেলে-মেয়েদের রক্তও তাই। এখন আমি যদি আবার A রক্ত শ্রেণীর একজনকে বিয়ে করি, তবে আমাদের সন্তান হবে অথবা AB। সন্তান জন্মের পর রক্ত পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে—সে সন্তান তোমার না তার।

    দ্যাখো, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এ সব শুনতেও ঘেন্না লাগে।

    ঘেন্না লাগে! শুধু শুনতেই ঘেন্না লাগে? তুমি যে আর একটা মেয়েকে নিয়ে আমার চোখের সামনে ঘর করবে, তাতে আমার ঘেন্না লাগবে না?

    দ্যাখো, পুরুষ আর মেয়েদের ব্যাপার আলাদা।

    মোটেই নয়। পুরুষ ও নারী একই রক্তে-মাংসে গঠিত। তুমি যদি আর একটা বিয়ে করো, তবে আমিও করব।

    তা কর, কিন্তু কোন ধর্ম, কোন সমাজই তা বরদাস্ত করবে না।

    না করুক, তবুও, লুও আমি দেখিয়ে দিতে চাই–

    হ্যাঁ, দেখাও। এ একটা অপূর্ব দৃষ্টান্ত হবে। দুনিয়ার লোক তোমার প্রশংসায় হাততালি দেবে। পাইওনিয়ার বলে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে তোমার নাম। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন আফতাব।

    দ্যাখো, তোমার টিটকারি তোয়াক্কা করি না। ভালো চাও তো এ বিয়ে ভেঙে দাও।

    কেন ভেঙে দেব? তোমার ভয়ে? হঁহ্‌–।

    তোমার শাহীন আর মমতার কী হবে, ভেবে দেখেছ।

    ভাববার কী আছে?

    ভাববার কিছু নেই? ওদের ভবিষ্যৎ ভেবেও তোমার সঝে চলা উচিত।

    সমঝে চলা উচিত। আমি কি কেরানি না স্কুল-মাস্টার? ওদের জন্য এত টাকা রেখে যাব—

    দুনিয়াতে টাকাই সব নয়।

    নিশ্চয়ই, দুনিয়াতে টাকাই সব। ওদের জন্যে যা রেখে যাব, দু’হাতে খরচ করেও তা ফুরাতে পারবে না। তোমার ছেলেটা তো ইচ্ছে করলে চার চারটে বউ

    পুষতে পারবে।

    দ্যাখো, তোমার মাথায় ভূত চেপেছ। নিজে তো উচ্ছন্নে যাবেই, ওদেরকেও না নিয়ে ছাড়বে না।

    চুপ করো।

    কেন চুপ করব? তুমি তোমার মত বদলাবে কি না, বলো?

    না।

    বিয়ে তা হলে করবেই?

    হ্যাঁ, করব। নিশ্চয়ই করব এবং পঁচিশ তারিখই তারিখ।

    বেশ, তা হলে আমিও বিয়ে করব।

    তা করো, কিন্তু বর জুটবে না।

    নিশ্চয়ই জুটবে। তুমি দেখে নিও।

    হ্যাঁ দেখব।

    হ্যাঁ দেখবে, এই পঁচিশ তারিখের মধ্যেই দেখবে।

    আচ্ছা আচ্ছা, করে দেখিও।

    আতিয়া বেগম উঠে দাঁড়ান। রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। ঘর থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।

    মিস্টার আফতাব ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকেন খোলা দরজার দিকে। কিছুক্ষণ পরে দাঁড়ান। তার গম্ভীর মুখে ফুটে ওঠে অবজ্ঞার হাসি। নিজে নিজেই বলেন, যত সব আজগুবি থিওরি। এ নিয়ে তর্ক করা সোজা। কাজে খাটানো অত সোজা নয়। গাড়ির হর্ণ শুনে তিনি জানালা দিয়ে বাইরে দিকে তাকান। পরিচিত একটা ছোট্ট গাড়ি বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে গেল।

    হঠাৎ তার গাড়ি নিয়ে বেরুবার কথা খেয়াল হয়। তিনি হাতঘড়ির দিকে তাকান। বারোটা বেজে দশ মিনিট। তিনি মনে মনে বলেন, শীতের রাত, এতক্ষণ কী আর সে জেগে আছে? হু একবার দেখতে দোষ কী!

    দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার শেলেটা একটা গলির মুখে বড় রাস্তার ওপর থামে। গাড়ি থেকে নেমে অন্ধকার গলি দিয়ে কিছু দূর এগিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে যান। সিগারেট ধরিয়ে একটা ছোট্ট বাড়ির বাইরের সিঁড়ির দিকে চেয়ে থাকেন।

    হ্যাঁ, ঐ তো সিঁড়ি দিয়ে নামছে।

    মিস্টার আফতাবের মনটা নেচে ওঠে।

    ক্রিং—ক্রিং—ক্রিং—

    মিস্টার রহমানের বাড়িতে টেলিফোন বাজছে। চার-পাঁচবার বাজবার পর আর ক্রিং শোনা যায় না। বোধ হয় রিসিভার তুলেছে কেউ।

    সিঁড়ির নিচে এসে হঠাৎ থেমে গেছে সুরাইয়া। কান খাড়া করে কী যেন শুনছে।

    এ কী। আবার দৌড়ে ওপরে যাচ্ছে কেন সে?

    মিস্টার আফতাব অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই হঠাৎ দোতলার বাতি জ্বলে ওঠে। মিসেস রহমান স্তব্যক্তভাবে সুরাইয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছেন।

    এবার তার মনে বিদ্যুৎ খেলে যায়। সুরাইয়ার হঠাৎ এভাবে ফিরে যাওয়ার আর তার ঘরে মিসেস রহমানের যাওয়ার পেছনে টেলিফোনের ডাকটাই নিশ্চয়ই দায়ী। তিনি রাগে ঠোঁট কামড়ান। মনে মনে বলেন, এ সব করেই কি আর আমাকে রুখতে পরবে?

    .

    প্রাতরাশের পর সিগারেট ধরিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসেন মিস্টার আফতাব। রোজকার মতো খবরের হেডিংগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে বের করেন বিজ্ঞাপনের পাতা। টেন্ডারের বিজ্ঞপ্তি খুঁজতে খুঁজতে একটা বিজ্ঞাপনের ওপর চোখ পড়ে তার। এ ধরনের বিজ্ঞাপন পড়তে এখনো পুলক জাগে তার মনে। কিন্তু ওটা পরেই তিনি চমকে উঠেন। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। তিনি আবার পড়েন বিজ্ঞাপনটা

    উচ্চ শিক্ষিত, উদারচেতা এবং সংস্কারমুক্ত পাত্র চাই। পাত্রে রক্ত A, B শ্রেণীর হওয়া আবশ্যক। পাত্রী সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, উচ্চ শিক্ষিতা এবং উপাজর্নক্ষম। বিস্তারিত বিবরণসহ পত্রালাপ করুন. জি.পি.ও. বক্স নম্বর ৪২৩১।

    মিস্টার আফতাব কাগজ হাতে নিয়ে গুম হয়ে বসে থাকেন। ছাইদানির ওপর তাঁর জ্বলন্ত সিগারটেটা পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

    বেয়ারার পায়ের শব্দে তাঁর চমক ভাঙে। ছাইদানির ওপর রাখা সিগারেটটার দিকে একবার তাকিয়ে তিনি আর একটা সিগারেট ধরান। এঁটো পেয়ালা-পিরিচ ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে বেয়ারা চলে যায়। তিনি পাশ থেকে টেলিফোন তুলে নেন। ডায়াল করে ডাকেন, হ্যালো কে? বক্স নম্বর ৪২৩১?…হ্যাঁ দেখলাম।…না, আশ্চর্য হইনি, বরং খুশি হলাম। আশা করি বিজ্ঞাপনদাতার ইচ্ছে পূর্ণ হবে।…..আমার ইচ্ছে? আমারটা তো পূর্ণ হবেই।… পাত্রীর বিশেষণগুলো পড়ে কিন্তু আমারই আবার পাত্র সাজবার লোভ হচ্ছে।… হ্যাঁ,–হ্যাঁ, তা ঠিকই। কিন্তু আসল বিশেষণগুলো বাদ পড়ল কেন?……কোনগুলো? যারটা তারই তো জানা উচিত আমার বলতে হবে কেন? ..আঁা, আমার মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগবে? আচ্ছা বলছি, কালকের বিজ্ঞাপনে তা জুড়ে দেওয়া হবে তো?…ও পছন্দ হলে। আচ্ছা বলছি-পাত্রী ব্রিাহিতা এবং দুই সন্তানের জননী। কেমন পছন্দ হল তো?…না? অ্যাঁ? লেখা হবে না? কেন?…ও, পরে প্রার্থীদের জানানো হবে? তা বেশ। কিন্তু তখন জেনেশুনে বাসি ফুলের ওপর কি আর মৌমাছি বসবে? উঁহু! যদি বসে তো বসবে বোলতা, না হয় গুবরে মাছিহ্যালো হ্যালো।

    তিনি আবার ডায়াল করে ডাকেন, ‘হ্যালো’ একি! ছেড়ে দেওয়া হল কেন?….নোংরা! নোরা কথা বললাম কখন?…ওগো সত্য কথাই তো বলেছি। বাসি ফুলের ওপর গুবরে মাছি বসবে না তো কি মৌমাছি বসবে? হ্যালো—আহ্, আবার ছেড়ে দিয়েছে।

    রিসিভারটা নামিয়ে রাখেন মিস্টার আফতাব। সোফায় হেলান দিয়ে বসেন আরাম করে। তাঁর মুখ থেকে এমন মোক্ষম, এমন লাগসই একটা উপমা বের হওয়ার জন্য তিনি খুশি হন খুব। তাঁর মরে ভার অনেকটা হালকা হয়।

    .

    তারপর সপ্তাহখানেক চলে যায়।

    দিনগুলো যে তার নির্ভাবনায় কেটেছে, তা নয়। বিজ্ঞাপনের ফল জাবার জন্য মাঝে মাঝে তার মনে কৌতূহল জেগেছে। কিন্তু জোর করে তিনি তা দমন করেছেন, শেষ এক দিন কৌতূহলের সঙ্গে যোগ হয় টিটকারি দেওয়ার লোভ। তিনি টেলিফোনে আতিয়া বেগমকে ডাকেন। কিন্তু র শুনে চমকে ওঠেন, তার টিটকারি দেওয়ার লোভ উবে যায়। ভাবনার ঢলে ডুবে যায় তার মন :

    দুনিয়ায় এমন ক্যবলাও আছে তা হলে? ব জেনে-শুনে রাজি হয়ে গেল। বোধহয় তাকে কিছুই ভেঙ্গে বলা হয়নি। ঠগবাজি করে বড়শিতে গাঁথা হচ্ছে। কিন্তু বয়সটাও কি বিবেচনা করে দেখেনি আহাম্মকটা? পঁচিশ বছরের নওজোয়ান! কী জানি, বোধ হয় ব্রাউনিং রোমান্সের শখ। লোকটা নাকি আবার চিত্রশিল্পী, প্যারি ঘুরে এসেছে। গঁগা-লোত্ৰেকদের সমগোত্রীয় এ ধ্ব হতচ্ছাড়াদের তো আবার চরিত্রের বালাই নেই।

    তার মাথার মধ্যে ব্যাপারটা এলোমেলো ভাবে ঘুরপাক খায়। তিনি নানা দিক থেকে এটাকে যাচাই করবার চেষ্ট করেন। শেষে নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কেন একটা আজগুবি আর অসম্ভব ব্যাপারটা নিয়ে তিনি শুধু শুধু মাথা ঘামাচ্ছেন? এমন হাস্যকর ব্যাপারকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কোন অর্থ হয় না। তিনি বুঝতে পারেন–এ শুধুই একটা চালবাজি। ধাপ্পা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাকে নিবৃত্ত করার মত ছাড়া আর কিছুই নয়। অনর্থকভাবে বিচলিত হওয়ার জন্য নিজের কাছেই লজ্জিত হন তিনি।

    চিন্তাটাকে মন থেকে জোর করে ঝেড়ে ফেলেন মিস্টার আফতাব। সুরাইয়াসহ মিস্টার রহমান সপরিবারে কুষ্টিয়া চলে গেছেন দুদিন আগে। শুভ দিন এগিয়ে আসছে। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। আনন্দের কারাগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করেছে তার মনের আকাশে। সেখানে কোনও মেঘই তিনি এ সময়ে জমতে দেবেন না।

    তবুও মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন এসে জমা হয়। তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু তা অল্পক্ষণের জন্যই তাঁর অবিশ্বাসের ঝড়ো হাওয়া সেগুলোকে তাড়িয়ে দেয়।

    .

    বিকেল তিনটায় স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা হবেন মিস্টার আফতাব। গোয়ালন্দ হয়ে যাবেন কুষ্টিয়া। দুপুরের আগেই তার বিছানাপত্র বাঁধাছাদা হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে কয়েকটা জিনিস। নতুন আর দামি এ জিনিসগুলোর চাকরবাকরের হাতের ছোঁয়া লাগবে, তা পছন্দ নয় তার তাই মধ্যাহ্ন ভোজনের র তিনি নিজেই জিনিসগুলো গোছগাছ করতে লেগে গেছেন। ফর্দের সঙ্গে মিলিয়ে একটার পর একটা গয়নার বাক্স আর শাড়ি রাউজের প্যাকেট তুলছে একটা সুদৃশ্য চামড়ার বাক্সে।

    দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে।

    তিনি পেছন ফিরে তাকান।

    আতিয়া বেগমের চাপাশি। সালাম দিয়ে সে ঘরে ঢোকে। একটা লেফাপা তাঁর হাতে দিয়ে সে চলে যায়। লেপাকাট খুলে তিনি চিঠিটা পড়েন–

    গ্রীন অ্যারো, ঢাকা স্টেশন,
    ২৩ শে জানুয়ারি, ১৯৬১

    প্রিয় আফতাব,

    দাম্পত্য জীবনে তুমি বা আমি কেউ আর এখন একনিষ্ঠ বলে দাবি করতে পারি। আমাদের দুজনেরই ভালোবাসা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে গেছে। সম্বোধনে আগের মত ‘প্রিয়তম’ লিখে কপটতা করা ইচ্ছে তাই নেই।

    আজ সোয়া একটার ট্রেনে চাটগাঁ যাচ্ছি। ট্রেনে বসেই লিখছি এ চিঠি। কেন যাচ্ছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তোমার দেখাদেখি আমিও পঁচিশ তারিখই ধার্য করেছি। ইতি–

    আতিয়া

    মিস্টার আফতাব ঘড়ি দেখেন। পৌনে দুটো। ট্রেন বহু আগেই ছেড়ে গেছে।

    তার সারা মুখে কালো ছায়া। শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠানামা করে কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। তিনি আচ্ছন্নের মত বসে থাকেন।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনে নেন তিনি। তাঁর ঠোঁটের কোণে আগের মত ফুটে ওঠে অবিশ্বাসের হাসি। তিনি মনে মনে বলেন, এ আর এক নম্বর ধাপ্পাবাজি। মনে করেছে, ধাপ্পা দিয়ে সব বানচাল করে দেবে। ওঁহু, ও সবে এ বান্দা টলে না। পা যখন বাড়িয়েছি তখন কার সাধ্য পথ আটকায়!

    একটু চিন্তা করে অস্ফুট স্বরে বলেন আবার, আমার সঙ্গে আড়ি দিয়ে দিন ধার্য করা হয়েছে। আমি যাচ্ছি কুষ্টিয়া আর উনি যাচ্ছেন চাটগাঁ। চমৎকার চাল। এখনি বাসায় টেলিফোন করলে সব ফাস হয়ে যাবে।

    মিস্টার আফতাব উঠে গিয়ে টেলিফোন করেন, হ্যালো, কে? …গভর্নের্স? বেগমকে ডেকে দিন।…অ্যাঁ, নেই? কোথায় গেছেন?…চাটগাঁ!

    রিসিভার রেখে দিয়ে তিনি আবার ভাবেন—চাটগাঁ যেতে হলে নিশ্চয়ই ছুটি নিতে হয়েছে অফিসে খোঁজ নিলে বেরিয়ে পড়বে কেমন চাটগাঁ যাওয়া হয়েছে।

    তিনি তখনি টেলিফোন করেন আতিয়া বেগমের অফিসে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ইন্সপেকট্রেস দু’সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন।

    এবার তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকেন ঘরের এদিক ওদিক।

    ড্রাইভার এসে স্মরণ করিয়ে দেয়, হুজুর, সোয়া দুইটা বাজে। মালপত্র গাড়িতে তুলব?

    মিস্টর আফতাব শূন্য দৃষ্টিতে ড্রাইভারের দিকে তাকান। অন্যমনস্কভাবে বলেন, অ্যাঁ, কী বলল

    সময় হয়ে গেছে, হুজুর।

    সময় হয়ে গেছে! আচ্ছা যাচ্ছি।

    মালপত্র গাড়িতে তুলব?

    একটু পরে।

    ড্রাইভার চলে যায়।

    মিস্টার আফতাব রিসিভার তোলেন। নম্বর ডায়াল করে ডাকেন, হ্যালো, পি. আই. এ. রিজার্ভেশন….গুড আফটার নুন। দেখুন, আজ সন্ধ্যের ফ্লাইটে চিটাগাং-এর একটা সিট দরকার। ….আচ্ছা, খোঁজ করে বলুন….আঁ, আছে? ধন্যবাদ। নাম লিখে নিন, এ. আহমদ। আমি এখনি টিকেট কিনতে লোক পাঠাচ্ছি।

    মিস্টার আফতাব চাটগাঁ যেতে পারেন—এরকম সন্দেহ আতিয়া বেগমের মনেও জেগেছিল। তিনি অনুমান করেছিলেন কুষ্টিয়া যাওয়া বাতিল করে আফতাব হয়তো তার পিছু ধাওয়া করবেন, চাটগাঁ গিয়ে হৈ-হট্টগোল করতে চাইবেন। তাই রওনা হবার সময় শাহীন-মমতার গভর্নের্স-এর কাছে তিনি চাটগাঁর একটা টেলিফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ মত চাটগাঁর প্লেন ছাড়বার সময় পার করে গভর্নেন্স টেলিফোন করেন আফতাবের বাড়িতে। খবরটা যোগাড় করে তক্ষুনি চাটগাঁর নম্বরে ট্রাঙ্ককল করে জানিয়ে দেন–মিস্টার আফতাব সন্ধ্যার প্লেনে চাটগা রওনা হয়ে। গেছেন।

    ‘হোটেল রয়েল’-এর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ। আরামকেদারায় গা ঢেলে দিয়ে নির্জীবের মতো পড়ে আছে মিস্টার আফতাব। প্লেনে বসে প্রতিকারের যে সমস্ত উপায়গুলো তিনি সারাক্ষণ ভাবতে ভাবতে এসেছিলেন, সেগুলোরই রোমন্থন চলে তাঁর মনের মধ্যে। কিন্তু উপায়গুলোর একটাও তার মনঃপুত হয় নি। ওর যে কোনটার আশ্রয় নিতে গেলেই হৈ-চৈ হবে, মানইজ্জত বিপন্ন হবে। মাঝে মাঝে তিনি আঁকড়ে ধরেন তার সেই অবিশ্বাসের খুটি। মনে মনে বলেন, ও সবের কোনই দরকার হবে না। গোপনে পিছু নিলেই সব চালবাজি বেরিয়ে পড়বে।

    তিনি ঘড়ির দিকে তাকান। রাত ন’টা। ট্রেন আসার আর আধ ঘণ্টা মাত্র দেরি। তিনি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে যান রেল-স্টেশনে।

    অস্থিরভাবে তিনি প্ল্যাটফর্মের এমাথা ও-মাথা করেন বারকয়েক। হঠাৎ ঘন্টির আওয়াজ শোনা যায়।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। ফার্স্ট ক্লাস কামরাগুলো প্রায় তার বরাবরই এসে থেমেছে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে পেছন দিকে সরে যান। ভিড়ে মাঝে দাড়িয়ে দুর থেকে চেয়ে থাকেন কামরাগুলোর দিকে।

    দরজায় আতিয়া বেগমের মুখ দেখা যায়। কে একজন ফেল্ট-হ্যাটধারী এগিয়ে যাচ্ছে কামরার দিকে। আতিয়া বেগম হেসে তারদিকে হাত বাড়িয়ে দেন।

    মিস্টার আফতারে বুকের ভেতর ধক করে ওঠে।

    বাজ-বিছানা মাথায় নিয়ে কুলি আগে আগে চলছে। তার পেছনে আতিয়া বেগম আর সেই লোকটি। তাঁরা পাশাপাশি কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন। আতিয়া বেগমের চেয়ে দুতিন ইঞ্চি লম্বাই হবে লোকটি। ও পুরুষ হিসেবে তাকে একটু বেঁটেই মনে হয়।

    মিস্টার আফতাব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তাঁদের অনুসরণ করতে থাকেন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি-স্টণ্ডের দিকে হারে ইশারা করে লোকটি। একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। বাক্স-বিছানা ক্যারিয়ারে ভোলা হলে তোকটা গাড়ির দরজা খুলে ধরে।

    এতক্ষণে লোকটার মুখ দেখবার সুযোগ পান মিস্টার আফতাব। উজ্জ্বল ফরসা রঙ, টিকালো নাক, মাধুর্যমণ্ডিত মুখ। বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশি হবে না।

    লোকটির সুন্দর চেহারার দিকে তাকিয়ে তার নিজের চেহারা বিকৃত হয়ে যায়, বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে।

    আতিয়া বেগম গাড়িতে উঠে বসেন। লোকটি তার পাশে বসে দরজা বন্ধ করে দেয় ট্যাক্সি রওনা হয়।

    মিস্টার আফতাব তাড়াতাড়ি আর একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়েন। আগের ট্যাক্সিটার পিছু পিছু যাওয়ার নির্দেশ দেন ড্রাইভারকে।

    অনেকটা পথ চলে, অনেক মোড় ঘুরে ট্যাক্সিটা কমমোপলিটান হোটেলের দরজায় গিয়ে থামে। কারো বাড়িতে যাচ্ছে না সে!

    যে আশার আলো নিভু নিভু করেও তার মনে এতক্ষণ জ্বলছিল, তা এবার দুপ করে নিভে যায়। তিনি অনুমান করেছিলেন-আতিয়া বেগম মনের দুঃখে আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে যুবকটি সেই বাড়িরই কেউ।

    মিস্টার আফতাব তাঁর ট্যাক্সিটা থামিয়ে রাস্তার পাশে নেমে পড়েন।

    ট্যাক্সি থেকে নেমে যুবকটির সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান আতিয়া বেগম। তাদের অনুসরণ করে তে-তলা পর্যন্ত যান আফতাব। কিন্তু তাদের আর দেখতে পাওয়া যায়না। তারা কোন কামরায় ঢুকে পড়েছে নিশ্চয়। সামনে এগিয়ে যাবেন, না নেমে যাবেন স্থির করবার আগেই দেখেন বাক্স-বিছানা নিয়ে দু’জন বেয়ারা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। তিনি কয়েক পা এগিয় গিয়ে বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে বাইরের দিকে চেয়ে থাকেন। বেয়ারা দু’জন তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিছুদূর গিয়ে তারা একটা কামরায় ঢুকতে তিনি সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যান। কামরাটার নম্বর যোগাড় করেই নেমে যান নিচে।

    আতিয়া বেগম যে রুমে উঠেছে, তার উল্টো দিকে একটা রুম পেয়ে যান। মিস্টার আফতাব। কামরায় ঢুকেই চেয়ার টেনে জানালার পাশে বসেন। পর্দা ফাঁক করে চেয়ে থাকেন সুমুখের দরজার দিকে।

    .

    দু’জনের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু যুবকটির বেরুবার নামগন্ধ নেই। সে কি ওখানই রাত কাটাবে নাকি!

    মিস্টার আফতাবের মনের চিন্তাগুলো বিছার মত কিলবিল শুরু করে দেয়। ক্রোধে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তিনি অস্থিরভাবে চুল টানতে থাকেন।

    একবার তাঁর মনে হয়—আর সময় দেওয়া ঠিক নয়। সর্বনাশ ঘটবার আগেই চড়াও হওয়া দরকার।

    পকেট থেকে পিস্তল হাতে নিয়ে তিনি দরজা পর্যন্ত এগোন। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে আগেন। হৈ-হট্টগোল করবার তাঁর মোটেই ইচ্ছে নেই।

    রাত বেড়ে চলেছে। মিস্টার আফতার পর্দা ফাঁক করে একভাবে চেয়ে আছে। কিন্তু লোকটা বেরুচ্ছে না কেন? ওখানেই শুয়ে পড়ল নাকি?

    এবার তাঁর বাঁধ ভেঙে যায়। পিস্তলটা মুঠোয় ধরে তিনি কামরা থেকে বার হন কিন্তু ঐ রুমের দরজার কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ান। কথাবার্তার ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া যায়। তিনি আবার নিজের কামরায় ফিরে আসেন। চেয়ারটায় বসে দাঁতে দাঁতে ঘষতে থাকেন।

    কিছুক্ষণ পরে লোকটি বেরিয়ে আসে। মিস্টার আফতার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

    কিন্তু লোকটা যে ঐ রুমটার ঠিক পাশেরটায় ঢুকল।

    আর এক মুহূর্ত দেরি করা ঠিক নয়। লোকটা হয় তো এখনি গিয়ে ঢুকবে অবর।

    মিস্টার আফতাব দ্রুত-পায়ে ঘর থেকে বের হন। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েন আতিয়া বেগমের রুমে।

    আতিয়া বেগম শোবার আয়োজন করছিলেন। হঠাৎ তাঁকে দেখে চমকে ওঠেন। ভয়ে পিছিয়ে যান দু’কদম।

    মিস্টার আফতাবের চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। তিনি রাগে কাঁপছে।

    কিছুক্ষণ কারও মুখ থেকে কোন কথা বেরোয় না। মিস্টার আফতাবই প্রথমে কথা বলেন, এ কী হচ্ছে? বজ্র-গম্ভীর তাঁর স্বর।

    কোথায় কী হচ্ছে?

    কোথায় কি হচ্ছে। আমি কিছুই দেখিনি মনে করেছ?

    দেখেছ, বেশ করেছ! কিন্তু চিল্পাচ্ছ কেন? লোক জড় করবার ইচ্ছে আছে?

    আতিয়া বেগম এগিয় গিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেন। ফিরে এসে বলেন, কী বলতে চাও, ধীরে সুস্থে বলো। দয়া করে চিল্লাচিল্লি করো না।

    তোমার ঘরে কে ছিল এতক্ষণ?

    কে ছিল, বুঝতে পারছ না? চলো আলাপ করিয়ে দিই।

    দ্যাখো, তুমি যেমন, পড়েছ তেমনি এক বদমায়েশের পাল্লায়।

    চুপ করো। যা-তা বলল না।

    কেন বলব না? তোমার যা করাতে যাচ্ছে কোন ধর্ম, কোন সমাজ তা দাস্ত করবে না।

    কেন করবে না? পুরুষদের স্বেচ্ছাচার যদি বরদাস্ত করতে পারে, তবে। মেয়েদেরটা করতে পারবে না কেন?

    দ্যাখো, আর কোনও তর্ক করতে চাইনে।

    তর্ক করতে তোমাকে কে ডেকেছে? কেন এসেছ এখানে?

    এসেছি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে।

    ফিরিয়ে নিতে! কেন?

    কেন আবার কি? স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব রয়েছে।

    তোমার আবার দায়িত্বজ্ঞান আছে নাকি?

    চুপ। আর কোন কথা শুনব না। চলো, ফিরে চলো।

    না, আমি যাব না।

    বাজে কথা রাখো। এখন ফিরে চলো।

    ফিরে যাওয়া এখন সম্ভব নয়।

    কেন নয়?

    কেন নয়, তা বুঝতেই পারছ। সব ব্যবস্থা পাকাঁপাকি হয়ে গেছে, এখন—

    দ্যাখো, যদি ফিরে না যাও, তোমাকে আমি ‘বাইগ্যামির’ চার্জে ফেলব।

    হ্যাঁ যাও। কোর্টে গিয়ে মামলা করো।

    অগত্যা তাই করতে হবে। কিন্তু তার পরিণাম ভেবে দেখেছ?

    পরিণাম না ভেবেই কি এ পথে পা দিয়েছি ভেবেছ? কী হবে? কয়েক বছর জেল, এই তো? হোক। স্বামীর স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে স্ত্রীর এ সংগ্রাম একেবারেই বিফলে যাবে না। নারী জাতির সামনে এ এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। পুরুষদের বহুব্বিাহের বিরুদ্ধে আমার যুক্তি একদিন না একদিন আইনের মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।

    ও সব বড় বড় বুলি রাখো। এবার ফিরে চলো।

    আমি যাব না।

    যাবে না?

    না।

    তোমাকে যেতেই হবে।

    না গেলে?

    না গেলে পুলিশ ডাকব।

    তা ডাক। কিন্তু জেনে রাখ, এ ব্যাপারে পুলিশের করবার কিছুই নেই।

    তা হলে আমি এক সাংঘাতিক কথা উচ্চারণ করতে বাধ্য হব।

    কী সাংঘাতিক কথা?

    তোমাকে আমি তালাক দেব।

    দাও। তা হলে তো বেঁচে যাই। হাত পা ধুয়ে পাক সাফ হই।

    দ্যাখো, আর বাড়াবাড়ি করো না। এবার ফিরে চল।

    আহা, হাত ছাড়ো। ব্রিও করছ কেন?

    আতিয়া বেগমের রাগ রক্তিম চোখ-মুখের দিকে চেয়ে তিনি ভড়কে যান। হাত ছেড়ে দিয়ে হতাশভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়েন।

    আতিয়া বেগম বাথরুমে যান। ফিরে এসে খোঁপার ক্লিপ কাঁটা খুলে রাখেন টেবিলের ওপর। ভাঁজ করা লেপটা বিছানার ওপ্র পেতে দেন। তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে বলেন, রাত বারোটা। এবার উঠতে পারো। আমি ঘুমাব।

    মিস্টার আফতাব গুম হয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ যেন স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠেন। ব্রা গলায় বলেন, আতিয়া আমি আমার মত বদলেছি। তুমি ফিরে চলো।

    কীসের মত বদলেছ?

    আমি আর বিয়ে করব না।

    বিয়ে করবে না। কিন্তু এখন একথা শুনিয়ে লাভ কী? আমি তো আর আমার মত বদলাতে পারব না।

    নিশ্চয়ই পারবে।

    না, পারব না। আমি নিরুপায়।

    মিস্টার আফতাব উঠে যান। আতিয়া বেগমের কাছে গিয়ে বলেন, আতিয়া আমায় মাপ করো। আমি আর কোন দিন বিয়ের কথা মুখে আর না।

    হ্যাঁ, দশ বছর আগে এরকম কথাই শুনতাম। পুরুষদের আমি বিশ্বাস করি না।

    এবার বিশ্বাস করো। তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, আর কোন দিন ওকথা মুখে আনব না।

    আতিয়া বেগম খাটের কিনারায় বসে পড়েন। তাঁর মুখ থমথম করছে। তাঁর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আফতাব বলেন, কী ভাবছ এত? দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলল।

    কিন্তু ভদ্রলোকটির সঙ্গে আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ওঁকে ধোঁকা দিতে পারব না।

    এতে ধোঁকা দেয়ার কী আছে?

    নিশ্চয়ই আছে, ওঁকে আমিই টেনে এনেছি এ পথে। বেচারাকে এভাবে দাগা দিয়ে ভেগে যাব, তা আমার পক্ষে অসম্ভব।

    তবে কী করতে চাও।

    ওর কাছে আমাদের মাপ চাওয়া উচিত।

    মাপ চাইতে হবে কেন আবার?

    মাপ চাইতে হবে না? বেচারাকে—

    আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার যা অভিরুচি। কিন্তু আমাকে মাপ চাইতে হবে কেন?

    নিশ্চয়ই চাইতে হবে। কিছুর জন্য তুমিই তো দায়ি।

    আচ্ছা ঠিক আছে।

    আতিয়া বেগম হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবতে থাকেন। মিস্টার আফতাব আবার বলেন, তবে আর দেরি কেন? চলো মাপ চেয়ে আসা যাক।

    চলো। হ্যাঁ, আর একটা কথা। তুমি যে মত বদলেছ, কুষ্টিয়ায় টেলিগ্রাম করে দাও।

    এত রাত্রে কোথায় টেলিগ্রাম করতে যাব? কাল করলেই চলবে।

    না চল, হোটেরে টেলিফোন থেকে ফনোগ্রাম করে দিয়ে আসি।

    রুম থেকে বেরিয়ে দু’জনেই নীচে চলে যান। ফনোগ্রাম পাঠিয়ে কিছুক্ষণ পরেই আবার ফিরে আসেন।

    নিজের রুমে না গিয়ে পাশের দরজায় খটখট আওয়াজ দেন আতিয়া বেগম। তাঁর পেছনে মিস্টার আফতাব।

    কয়েকবার খটখট দেওয়ার প্র বাতি জ্বলে ওঠে। ছিটকিনি খোলার শব্দ হয় খুট করে।

    আতিয়া বেগম দরজাটা একটু ফাঁক করে মুখ বাড়াতেই মিস্টার আফতাব শুনতে পান রুমের ভেতর কেন যেন স্যানডেল পায়ে দৌড়াচ্ছে।

    তাঁরা দুজনেই ভেতরে ঢোকেন। মিস্টার আফতাব কাউকে না দেখে আশ্চর্য হন। লোকটা ভয়ে পালিয়ে গেল নাকি!

    হঠাৎ খাটের ওপর নজর পড়তেই দেখেন–কে একজন কম্বল মুড়ি দিয়ে রয়েছে। আর খাটের পাশ থেকে ঝুলছে কালো সাপের মতো একটা জিনিস।

    কী ওটা!

    মিস্টার আফতারে দুটো চোখে বিস্ময়ের বিদ্যুৎ চমকায়। তিনি বেণীটার দিকে চেয়ে বোকার মতো হাসতে থাকেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন
    Next Article গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.