Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প1423 Mins Read0

    জননী – হাসান আজিজুল হক

    জননী – হাসান আজিজুল হক

    কয়েক বছর আগে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়িতে মে মেয়েটি কাজ খুঁজতে আসে, তার রূপ দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। চৌদ্দ পনেরো বছদ্র বয়স হবে তার, গায়ের রং ধপধপে ফর্সা, টানা টানা টলটলে বিশাল দুটি চোখ, ঈষৎ লম্বাটে মুখে টিকলো ছোটো নাক, তাতে সাদা পাথর বসানো এতটুকু একটা নাকফুল।

    আমার স্ত্রী তাকে জিগগেস করলে, নাম কি তোর?

    আয়েশা।

    কাজ করবি?

    করবো না ক্যানে?

    কি কাজ করবি, শুকনো না ভিজে?

    পেলে ভিজে করবো।

    থাকবি তো আমাদের বাসায়, রাতে?

    সাঁঝবেলায় মায়ের ঠেয়ে যাবো।

    তা পারবি না, ভিজে কাজ করলে এই বাসায় থাকতে হবে।

    তবে আমি যেচি কাজ করব না–বলে মেয়েটি বেরিয়ে যাবার জন্যে পা তোলে।

    বেশ কদিন কাজের লোক নেই বাসায়। আমাদের গরজ বেশি।

    স্ত্রী তার পথ আটকে ধরলেন, তুই বাড়ি যাবি কখন?

    বননু তো সাঁঝবেলায়–মায়ের ঠেয়ে যাবো।

    ঠিক আছে। কাজে লেগে পড় যা।

    মেয়েটি কাজে বহাল হলো। মনে মনে একবার ভাবি আগুনের রূপ নিয়ে কে এই মেয়েটি।

    বিকেলের দিকে আমার ছোটো ঘরে বসে কাজ করছি। পাশের বাসার বৌ আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে করতে জিগগেস করলেন, মেয়েটিকে কাজে লাগালেন?

    ওঁদের আমি দেখতে পাচ্ছি না। কথা শুনতে পাচ্ছি। বৌটি চাপা হেসে বললেন, বুঝবেন পরে।

    আমার স্ত্রী কৌতুকব্যস্তে জিগগেস করেন, কেন, কেন, বলুন তো! কোন ব্যাপার আছে নাকি? থাকলে বলুন, ছাড়িয়ে দিই কাজ থেকে।

    না, না, তেমন কিছু নয়। আবার যেন তাঁর চাপা হাসির শব্দ পেলাম।

    রাতে শোবার ঘরে স্ত্রী বললে, আচ্ছা, এটা কি অসম্ভব নয়?

    কেন কি হয়েছে বলো তো?

    এই কথা কি বিশ্বাস হয়? বলে স্ত্রী হাসতে শুরু করেন।

    কথাটা কি সেটা তো আগে বলবে।

    উনি হাসতেই থাকেন। আমি বিরক্ত হয়ে বলি, কথাটা কি বলে তারপর যততখুশি হাসো।

    হাসতে হাসতেই স্ত্রী বললে, ওর নাকি এই বয়সেই—এইটুকু বলে আবার হাসি।

    অতিষ্ঠ হয়ে বলি, দুত্তেরি।

    হাসি তখনো চলছে, ওর মধ্যেই বললে, ওর নাকি এই বয়সেই একটা ছেলে হয়ে গেছে।

    দূর তাই হয় নাকি? খবরটা তোমাকে দিল কে?

    খবর যে-ই দিক, কথাটা সত্যি।

    একটু অস্বাভাবিক বটে, তবে অসম্ভব নয়। মেয়েটির তাহলে বিয়ে হয়েছিলো নিতান্ত অল্প বয়সে আমি বলি আর সকালের পরিষ্কার আলোয় দেখা মেয়েটির মধু রং-এর নরম ত্বক; অসাধারণ দুটি চোখ, প্রতিমার মতো সুডৌল মুখ আমার মনে পড়ে যায়। এসব একবার তহ্নছ হয়ে যাবার পর মেয়েটি আবার গুছিয়ে নিয়েছে। মহাভারতের সত্যবতীর কথা মনে পড়লো, সঙ্গমের পরও তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি।

    স্ত্রী আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে আমি বলি, বিয়ে হয়েছিলো তাহলে। সেই একই গল্প স্বামী ভাত দেয় না, তাড়িয়ে দিয়েছে, না হয় নিজে গায়েব হয়ে গেছে।

    আমার মুখের উপর চোখে চোখ সরান না তিনি, বিয়ে হয়নি। বি

    য়ে হয়নি? কি বলছো কি তুমি? তাহলে—

    বাচ্চা হতে হলে বিয়ে হতেই হবে কে বললো তোমাকে?

    তা বটে! ইস-প্রচণ্ড ক্ষোভে ভিতরটা আমার জ্বলে যেতে থাকে। কি অসঙ্গত, কি বীভৎস।

    গণ্ডারের তাজা গোলাপ খাওয়ার মতো। এই রকমই নাকি করে মেয়েটি—অনেকক্ষণ পরে স্ত্রী বললেন।

    তাড়িয়ে দেবে কি মেয়েটিকে? আমি জিগগেস করলাম। উপায় কি? জেনেশুনে এরকম একটা মেয়েকে–

    লোকভয়ে?

    না, ঠিক তা নয়।

    ঠিক তাই। কে কি বলবে তাই তো?

    তাহলে কি করা যায়?

    রেখে দাও মেয়েটিকে। আমাদের নিজেদের মেয়েরও তো ঐরকম বয়স। তাড়িয়ে দিলে ওর কপালে কি ঘটবে আন্দাজ করতে পারছো?

    তা তো পারছি।

    ওকে কাজে রাখা যদি উচিত মনে করো তাহলে সাহস করো। ও তোমার দয়া ভিক্ষা করছে না কঠিন মেহনত করে তোমার কাছ থেকে রুজিটা পাচ্ছে।

    আচ্ছা থাকুক–দ্বিধার সঙ্গে স্ত্রী রাজি হলেন।

    মেয়েটির কাজ নিখুঁত। আপনমনে চুপচাপ খেটে যায়। কথা কম বলে কিন্তু যখন বলে খুবই খারাপ শোনায়। গোলাপ কাটার মতো ঘষা কর্কশ কণ্ঠস্বর তার। তবে কথা কম বলে।

    মাস দুই গেছে। মেয়েটি যে আসে যায় আমি খেয়ালও করি না। হঠাৎ সেদিন রাতে শোবার আগে স্ত্রী বলেন, ব্যাপারটা লক্ষ করেছ?

    কি বলো তো?

    না, তোমাদের চোখে অবশ্য পড়ার কথা নয়। মেয়েটির আবার বাচ্চা হবে।

    কি? তার মানে। ভীষণ চমকে আমি চিৎকার করে বলি।

    হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। মেয়েদের চোখ এই ব্যাপারে ভুল দ্যাখে না। আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। এখন দ্যাখো।

    কি করবে তাহলে? আমার ভিতরটা শুকিয়ে ওঠে, ওটা তো একদম ঠিক কথা নয়—বিয়েটিয়ে হয়নি বলছো।

    আবার বিয়ে। বাচ্চা হতে বিয়ে লাগে না।

    থাকুক আমার বাড়িতে। আমি রুখে দাঁড়াচ্ছি। যদি পেটে বাচ্চা ধরেই থাকে, এখানেই ওর প্রসব হবে।

    বুদ্ধি বটে তোমার। সারা দেশে ঢি ঢি পড়ে যাক আর কি?

    পালাবো? ভিতরটা আমার জ্বলে যাচ্ছে পালাবো এই বাস্তব থেকে? যা করা দরকার মনে হচ্ছে, লোকভয়ে তা করতে পারা যাবে না? শোনো, যা হয় হোক, মেয়েটিকে তোমার আশ্রয় দাও। জীবনে অন্তত একবার মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াতে দাও। এই অসহ্য ছুঁচো আর চামচিকের জীবন থেকে অন্তত একবার বেরিয়ে আসি।

    মাথা খারাপ হয়েছে? তোমার নিজের বোধহয় ছেলেমেয়ে সংসার বলতে কিছু নেই।

    এ মেয়েটি আমাদের মেয়েটিরই মতোবুকের ভিতর থেকে উঠে আসা বাষ্প আমি কিছুতেই ঠেলে ভিতরে পাঠাতে পারি না। কথা বন্ধ হয়ে যায় আমার কথার মাঝখানে।

    কি বললে? আমাদেরই মেয়ের মতো? খেপে গেলে নাকি? একটা রাস্তার বদস্বভাব মেয়ে, জন্মের পর থেকে পুরুষসঙ্গ করছে

    সেই হারামজাদা শুয়োরের দল, পুরুষ শুয়োরদের বুঝি কোন দোষ নেই রাগে চিৎকার করে আমি গলা চিরে ফেলি।

    সে তত তোমরাই—স্ত্রী চেঁচিয়ে ওঠেন।

    সে তো আমরাই—চকিতে একটা কঠিন সত্য লোহার শাবলের মতো কপালের ঠিক মাঝখানে আঘাত করে। অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে আমি বলি, সে তো ঠিকই কিন্তু মেয়েটির দোষ কি?

    আমার অত জজিয়ত্রি দরকার নেই–কালই আমি ওকে তাড়াব।

    কি আশ্চর্য, একটা ঘোরের মধ্যে আমি বলে ফেলি, একটু সবুর করো, মানুষ আসা দেখতে দাও আমাকে।

    কি ভেবে কেমন করে যে এই সস্তা সিনেমার ডায়লগটি বলে ফেলি জানি না। কিন্তু আমার স্ত্রী চুপ করে যায়। মেয়েটা থামে না, সিনেমা চলতে থাকে, মানুষ নিষ্পাপ নিষ্কলংক শিশু আসছে, সুস্থ সতেজ জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসবে মানুষ। সমস্ত পৃথিবীর অপেক্ষা তার জন্যে।

    যেমন বলেছিলেন, আমার স্ত্রী পরের দিনই মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিলেন না। তবে মেয়েটির প্রতি তার ব্যবহার খুবই কঠিন হয়ে উঠলো। ছোটোখাটো ত্রুটির জন্য নির্মম কথা শুনতে হতো তাকে। কিন্তু সে একটি কথারও জবাব দেয় না।

    আমি ওকে খুব কাছ থেকে লক্ষ করতে থাকি। বলতে কি আমার স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত হতে লাগলো। চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই নির্জন জ্যোৎস্নারাতের স্তব্ধতার মধ্যে কান্নায় ভিতর থেকে ভরে উঠছে ধলেশ্বরী মধুমতী—নিষ্কলুষ রুপোর পাতের মতো ডিমে ভরা ইলিশের ঝক সমুদ্র থেকে ছুটে আসছে স্রোতের উজান বেয়ে—ডিম ছাড়তে পারার আগেই জালে আটকে তারা আছড়ে পড়ছে জেলেদের ডিঙি নৌকায়। ঝিকিয়ে উঠছে আবছা তরল অন্ধকারের মধ্যে। তাদের পুচ্ছ তাড়নার শব্দ উঠছে ছপ ছপ তারপর কানকো ফেটে গলগল করে কালচে-লাল রক্ত বেরিয়ে এসে ধুয়ে দিচ্ছে রুপোলি শরীর। চৌকো স্নাইডের মতো চারপাশ বাঁকা একটি করে ছিপ শব্দ করে সরে যায়। আমি চোখ খুলি। সামনের মাঠে দেখি শীতের শুকিয়ে ওঠা শাদা ঘাসের জমির একপাশ থেকে সবুজ ঘাস উঠে আসছে ঢেকে ফেলছে বিবর্ণ মাঠটা আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেহগনি গাছ, মোম দিয়ে মাজা ফিকে সবুজ পাতায় আগাগোড়া সাজানো।

    কতোদিন কেটেছে এমন। মাস দুই হতে পারে। শেষে একদিন ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার স্ত্রী শান্ত নিচু কঠিন গলায় বললেন, ওকে আর রাখা যায় না?

    আমি বলি, ঠিক বলেছ—আর একদিনও ওকে রাখা চলে না।

    পরের দিন আয়েশা এলে আমার স্ত্রী বলেন, তোকে আর রাখতে পারছি না। নিজের জিনিসপত্র যা আছে নিয়ে চলে যা আমার বাড়ি থেকে। দূর হয়ে যা।

    আয়েশা কোনো কথা না বলে নিজের ময়লা একটা শাড়ি, রং-জ্বলা একটা গামছা আর এমনি টুকিটাকি দু-চারটি জিনিস হাতে তুলে নিয়ে আমার স্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ায়, তার সেই আশ্চর্য সুন্দর দুটি চোখ মেলে সে বলে, যেচি, আমার এ মাসের যা পাওনা হয়েছে দিবেন না? স্ত্রী বলেন, এই তোর মাইনে; নে ধর আর এইটা তোকে দিলাম। আর কোনোদিন এদিকে আসবি না। তোকে যেন আর কোনদিন দেখতে না পাই। যা, মরগে উই—তীব্র রাগে কথা কটি বলে তিনি মেয়েটির হাতে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে ঠেলে দেন।

    আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটো সিঁড়ির দিকে যেতেই আমার স্ত্রীর অত্যন্ত দ্রুত, অত্যন্ত অস্থির হাতে খটাখট শব্দে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়েই ফিরে দাঁড়িয়ে চোখে আঁচল চাপা দেন। তাঁর মুখের উপর কেটে বসা কঠিন রেখাগুলি কিন্তু একটুও ভাঙে না—অথচ সামান্য নড়চড় হলেই নানা টুকরোয় যেন ছড়িয়ে পড়বে। ওঁর মুখ। তিনি ঘরের দিকে চলে গেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, তারপর উজ্জ্বল রোদের মধ্যে আয়েশা বেরিয়ে এলো। ছেঁড়া ময়লা শাড়ির ভিতর দিয়ে আগুনের শিখারমতো তার রূপ ঝলকাচ্ছে। অনেক বড়ো দেখাচ্ছে তাকে। শরীর ঢাকতে তার উজ্জ্বল ত্বক যেন একটু কম পড়েছিলো, সেজন্যে খুব টানটান। এখনো ঠিক বুঝা যায় না উষ্ণ রক্তের মধ্যে কি গভীর নিগ্নতায় নিশ্চিন্ত অন্ধকারে এই কুমারী জননীর সন্তান কতোটা বড়ো হয়েছে। আমি জানি বলেই আয়েশার ঈষৎ ভারি তলপেটটার আন্দাজ পাই।

    আমাদের এদিকে আসে না বটে, তবে ওকে মাঝমাঝে রাস্তার কিনারা ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে দেখি, দেখতে পাই গাছে ছায়ায় বসে নিরুদ্বেগে ময়লা আঁচল দিয়ে গাম মুছছে। পৃথিবীকে সে দেবে অমূল্য উপহার, গর্বে তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে তার বুক, অবজ্ঞার চোখে সে চেয়ে আছে মানুষের ইর সংসারের দিকে। জানি এসব কিছু নয়, আমিও তৈরি করেছি দুস্পাঠ্য দুজ্ঞেয় অক্ষরমালা, যা কেবল আমিই পড়তে পারি। এইসব অক্ষর কি দাগে-ঢাকা, ক্ষয়-পাওয়া সুদূর অতীতের কোনো শিলালিপিতে ছিলো, নাকি আমিই তৈরি করে নিয়েছি?

    দুটোই পাশাপাশি চলতে থাকে। কঠিন কঠোর কল্পনাহীন সত্তাহীন অর্থহীন ক্লান্তিকর বাস্তব আর ঠিক তার পাশে সৃষ্টি হতে থাকে অগ্নিগর্ভ সংকেত, দেখা দেয় সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্ম দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক জননী।

    এরপর আবার একদিন আয়েশাকে দেখতে পেলাম বিরাট ধামার মতো পেট নিয়ে পা টেনে টেনে হেঁটে চলেছে। কোনো বাড়িতে তো সে আর এখন ঢুকতে পারছে না। ও কি এখনো ওর মায়ের ঠেয়ে যায়? সেখানে কি ওর ঠাই মিলবে প্রসব হওয়ার জন্যে? নাকি সিঁড়ির নিচে অন্ধকারে এক কুকুরীর সঙ্গে একই যন্ত্রণায় সে কারাবে?

    হঠাৎ একদিন দেখি বেশ ঝরঝরে শরীর তার। একটু শীর্ণ হয়েছে। দুই স্ফীত স্তনভার বইতে পারছে না। মরিয়া হয়ে তাকে আমি হাতছানি দিয়ে ডাকি। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে চিনতে পেরেছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না তার মধ্যে। চিনতে পারলেই বা কি? নিস্পৃহ নিরাসক্ত চোখে আমার দিতে চাইলো সে। সেই বিশাল দুটি চোখ একটু গর্তে বসে গেছে। বিচ্ছিরি ব্যাপার, ঠিক তখুনি আমার কান্না এলো–এমন অসম্ভব ভাবপ্রবণতায় নিজের ওপরেই আমি জ্বলে উঠি। গলায় বাষ্প ফেনিয়ে উঠতে উঠতে আবার নিচে নেমে যায়। কেউ যেন শুনতে না পায়, দেখতেও যেন না পায়, আমি এদিক ওদিক চেয়ে দেখে নিচু গলায় ফিসফিশ করে জিজ্ঞেস করি বাচ্চা হয়েছিলো তোর, তার কি হলো রে?

    তার সেই নিচু কর্কশ গলায় সে বলে, নাইখো।

    কেন, কোথায় দিয়েছিস তাকে? কঠিন গলায় আমি বলি। আমার হঠাৎ রাগ হয়ে যায়।

    কিছুমাত্র পরিবর্তন নেই তার মধ্যে। ঠিক আগের কথাটিই আবার বলে, নাইখো।

    কোথায় কাকে দেয় সে সন্তান? দেবতাদের শাপমুক্ত করছে নাকি? আয়েশা ধীর পায়ে গাছতলার দিকে ফিরে যায়।

    তিনবারের বার সে গর্ভধারণ করেছে জানতে পেরে আমি বাসায় ফিরে এসে আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েটিকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকি। আমার স্ত্রী কাছে এসে বলেন, ও আবার কি ঢং!

    আমি চোখ মুছতে মুছতে বলি, ওকে তো কোনোদিন আদর করি না।

    কচি বেলায় হাত মুঠো করে আমার বুকে ঘুমোত, গান শুনতে শুনতে কাঁধে মাথা রাখতে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেছে।

    আমার স্ত্রীর চোখেও হঠাৎ জল চলে এলো। মেয়েকে ধমকে উঠে বললেন, যা এখান থেকে। মেয়েটা হকচকিয়ে চলে যায়।

    এবার দেখি আয়েশার শরীররটা ভেঙে যাচ্ছে। এ সেই রকমের ভাঙা যাতে মনে হয় ভাঙার ব্যপারটা শেষ হলে শরীরের টুকরোগুলো এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়বে। চারদিক থেকে কুড়িয়ে এনে জোড়াতালি দিতে গেলে হয়তো দেখা যাবে পা বা কার হাড় নিয়ে চুষছে একটা কুকুর। কোথাও যায় না সে। গর্ভের অসম্ভব ভার নিয়ে বৃত্তাকার রাস্তা ধরে ধারপায়ে শুধু হেঁটেই চলে। চোখে তার নিস্পৃহ অবজ্ঞা মেশানো দৃষ্টি।

    আমার স্ত্রীকে কখনো তার কথা বলি না। আমি হঠাৎ জেগে উঠে দেখেছি আমার মুখের দিকে তিনি অপলক চেয়ে আছেন। আমার চোখ খুলে গেলেই তিনি দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে নেন?

    প্রসবের সময় আসন্ন হয়ে এলে একদিন আয়েশাকে দেখি তার সেই পছন্দের জামগাছের তলায় চিৎ হয়ে নিস্পন্দ শুয়ে আছে বাতাসে ফঁপিয়ে ভোলা মশারির মতো ফুলে ফোলা আছে তার পেট। মাটি রং-এর পাতলা ঘেঁড়া শাড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছে কিন্তু সব ঢাকেনি। এই পেটের বোঝা খালাস হয়ে গেলেই এতটুকু সময় নষ্ট না করে সে তার জরায়ুতে নিযুক্ত করে নেবে আর একটি ডিম্বকোষ। আজ তার এই বিশাল গর্ভগৃহ দেখে মনে হয়, একটিমাত্র সন্তানের জন্য জায়গাটি বড়ো বড়ো—হয়তো ওখানে শত কলসীতে ভরা আছে একশো সন্তান। পিতৃহীন জারজেরা মায়ের হয়ে অধিকার নেবে মাটির।

    আর একবার মাত্র আয়েশাকে দেখেছি। তারপরে আর কখনো নয়। একটা ইটের ভাঙা পাঁচিলের উপর সে বসে আছে। পাতলা তামাটে চামড়া দিয়ে আগাগোড়া। মোড়া। কিন্তু চামড়াটা এবার মাপে বড়ো হয়েছে। কনুইয়ের কাছে ময়লা ন্যাকড়ার একফালি ঝুলে আছে—গলার কাছে কয়েকটা ভাজ, বুকের উপর ন্যস্ত আছে একটু। কালো কোঁচকানো দুটো ধারালো ফালি আর বাকি বাড়তিটা ঝুলে আছে তার নিতম্বের নিচে। বাংলাদেশের ম্যাশের মত খাঁজকাটা, ভাজ করা, তীব্র ধারালো। এবার কিছুতেই ওর চোখ দেখতে পাই না। কপালের নিচে দুটি বড়ো বড়ো কালো গর্ত, সেখানটায় এমন অন্ধকার যে কিছু দেখতে পাওয়া গেল না। সরু শীর্ণ হাত তুলে সে আকাশে দাগ কেটে দেয়, তারপর হাত নামিয়ে হিংস্র নখরসহ তার ধাতব আঙুলগুলো দিয়ে কঠিন আক্রোশে মাথা চুলকোতে তাকে।

    আমি দেখি আকাশ বুজোতে বুজোতে অন্ধকার নেমে আসছে। তার মধ্যে সে হারিয়ে যাবার আগেও আমি দ্রুত পায়ে এই পরিশুদ্ধ জননীর কাছে গিয়ে জিগগেস করি, মা, এবার তোর কি হলো?তার জনহীন জন্মার সে সম্পূর্ণ খোলা রেখেছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন
    Next Article গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.